রাতের সঙ্গী - চন্দ্রাবতী চোংদার

 



" একি তুই কখন এসে শুয়েছিস? খাবার সময়ে তোকে যে বললাম আজ আমার শরীরটা ভালো নেই, আজ আমার কাছে শুবি তখন তো ভারী মুখ বেঁকিয়ে বললি আজ পারবি না, অবিনাশ ফোন করবে। তা এত রাতে চুপি চুপি এলি যে!! কি ব্যাপার!! কি রে কিছু বলছিস না যে? অবিনাশের সঙ্গে ঝগড়া করেছিস বুঝি?? কি রে এত কিছু জিজ্ঞেস করছি, উত্তর দিচ্ছিস না কেন? কি জানি বাপু তোর যে মাঝে মাঝে কি হয়!! এইরকম মাঝরাতে আমার ঘরে চলে আসিস আর কিছুই বলিস না। তা আমাকে যখন কিছু বলবি না তখন আমার কাছে আসা কেন! নিজের রুমেই তো থাকতে পারিস। যাই হোক, কত রাত হয়েছে জানিস, ঘুমিয়ে পর। কাল কথা হবে। ও হ্যাঁ আর একটা কথা, আচ্ছা রাতে কি আমি শোবার পর বৃষ্টি হয়েছে? কেমন যেন রুমটা অন্যরকম ঠান্ডা ঠান্ডা মত লাগছে। তুই কি একটাও কথা বলবি না? বলতে হবে না। অবিনাশের জন্য শোকপালন কর, আমি ঘুমালাম..."

আধো ঘুমে মিঠাই কথাগুলো বলে গেল। অপরজনের উত্তর না পেয়ে পাশ ফিরে আবার ঘুমিয়ে গেল।


পরেরদিন দুপুরবেলা , সবাই খাবার টেবিলে হাজির। বেশ হৈ হৈ রৈ রৈ ব্যাপার চলছে, এমনসময় রিয়াই বলে উঠলো - " রবিবারের দুপুরে পাতিলেবু চটকে চিকেন ভাত না হলে ঠিক যেন জমে না বলো রুনুদি ! "


সঙ্গে সঙ্গেই রুনু উত্তর দিলো - " হ্যাঁ রে ঠিকই বলেছিস। তাছাড়া মিনুদির হাতের রান্নার জবাব নেই। উফফ জাস্ট ফাটাফাটি। আমরা যে বাড়ির বাইরে থেকেও এত সুন্দর বাড়ির মত খেতে পাই , তা কি কম ভাগ্যের রে !! "


" হ্যাঁ গো রুনুদি , একদম ঠিক বলেছো। ওইযে তৃষারা যে বাড়িটায় থাকে, ওদের রান্নার লোকটা একদম ভালো না। নিজের মতো রান্না করে দেয়। আর আমাদের মিনুদি একদম নিজের দিদির মতো আমাদেরকে সব বাড়ির মত রান্না করে খাওয়ায়। টাকা তো ওরাও দেয়। কিন্তু কই আর ভালো কিছু পায় বলো ! "


" টাকা দিলেই আর সবকিছু এক হয় রে! হয় না। সবই ভালোবাসা। সবাই তো আর একও হয় না বল। এইযে আমরা একসাথে এই বাড়িটায় থাকি, সবাই সবাইকে কত আপন ভাবি। তাছাড়া বাড়ির মালকিনরা মানে মাসিমা, মেসোমশাইও বেশ ভালো মানুষ। তা হ্যাঁ রে খাবার টেবিলে তো সবাই আছে দেখছি। একজন ছাড়া। তিনি কোথায় ? সকাল থেকেই তার দেখা নেই, রুম থেকে তো বেরই হচ্ছে না। এখন থেকেই কি পুজোর শপিং এর লিস্ট বানাচ্ছে নাকি! "


" হ্যাঁ তাইতো। মিঠাইদি এখনো আসেনি। কি হলো বলোতো? আমি বরং একবার দেখে আসি। মিঠাইদি কালকে অনেক রাত পর্যন্ত জেগে ছিল। পড়াশোনা করছিল বোধহয়। আমি কালকে বাথরুমে যাচ্ছিলাম হঠাৎ মনে হল মিঠাইদির গলার স্বর শুনতে পেলাম। ভাবলাম পড়ছে হয়তো ! "


রিয়াকে থামিয়ে দিয়ে রুনু বলে উঠলো - " জানিস রিয়া, আমিও মাঝে মাঝে মিঠাইয়ের রুম থেকে ওর আওয়াজ শুনতে পাই। যেন কারো সাথে কথা বলে। কি বলে শুনতে পাইনি। আমার রুম থেকে ওর রুম অনেকটাই দূরে। তবে নিস্তব্ধ মাঝরাতে বাইরে উঠলে পিন পড়ার আওয়াজও পাওয়া যায়, সেখানে কথার আওয়াজ তো পাওয়া যাবেই। কিন্তু তা কি করে হয় বল। আমরা তো এক একটা রুমে একজন করেই থাকি। তবে কি মিঠাই প্রেম ট্রেম করছে নাকি বলতো? খোঁজ নিতে হচ্ছে তো। এই এই সবাই চুপ কর। তোরা এত বকিস যে কি বলবো। আমার একটা কথা আছে , এটেনশন প্লিজ!! কিরে শুনবি না নাকি?? চুপ কর, চুপ কর। "


রুনুর কথা শুনে সবাই নানান কথা শুরু করে দিয়েছে। এরই মাঝে গলার স্বর একটু উঁচু করে মৌলী বলে উঠলো - " কি বল বল, শুনছি ..."


" এইযে লেডি গ্যাং আজ থেকে তোদের ওপর একটা দায়িত্ব দিচ্ছি, সবাই মিলে গোয়েন্দাগিরি করে আসল সত্য উপস্থাপন কর দিকি, মিঠাই কি লুকিয়ে প্রেম করছে ?? কিরে তোরা পারবি তো ?? আর নীলার ওপর বেশি দায়িত্ব থাকলো, নীলা ওর কাছের বন্ধু। "


সাঁই করে একবার মাথাটা ঘুরিয়ে দেখে নিয়েই রিয়া নিচু স্বরে ফের বলে উঠলো - " এই সব চুপ চুপ, মিঠাইদি আসছে। "


সবাই চুপ হয়ে গেছে , যেন কোনো কথাই হচ্ছিল না।

খাবার টেবিলের কাছে এসে, সবাইকে চুপচাপ বসে থাকতে দেখে ভারী অবাক হয়ে মিঠাই বলে উঠলো - " কি ব্যাপার? আজ এত চুপচাপ কেন রে তোরা? কাল ইউনিভার্সিটিতে কথাসাহিত্যের ক্লাস করে মৌনব্রত করেছিস নাকি ?? "


রিয়াই হঠাৎ তৈরি হওয়া নীরবতা ভেঙে বলে উঠলো - " না গো মিঠাইদি, এমনিই। আমরা একটু ভদ্রগোছের মেয়ে হয়ে উঠতে চেষ্টা করছি। নাহলে তুমিই তো বলো আমরা দিন দিন বাচাল হয়ে যাচ্ছি বেশি করে। তাই নিজেদের লাগাম টানছি। "

রিয়ার কথা শুনে রুনু, অহনা, প্রিয়া, নীলা ও মৌলী সবাই হা হা করে হেসে ফেললো। এমনকি মিঠাইও হেসে ফেললো।


সবার হাসি শুনে রিয়া আবার বলে উঠলো - " যাহ, তোমরা সবাই হাসছো? আমি ছোটো বলে তোমরা এমন করো। আমি আর কিছু বলবো না।"


রিয়ার রাগ ভাঙাতে রুনু বললো - " না না রিয়া, রাগ করলে হবে না। আমাদের কাজ শুরু করতে হবে এবার। "


হঠাৎ কাজের কথা শুনে ভীষণ আগ্রহী হয় মিঠাই - " রুনু, কিসের কাজ রে? কই আমি তো কিছু জানি না। আমাকেও বল? "


প্রিয়া সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে - " সব জানতে পারবি পরে, আমরা চোর ধরছি। "


" কিযে সব বলিস কিছুই বুঝি না। মিনুদি অনেক দেরি হলো গো আমার জন্য। তুমি দিয়ে দাও ..."


পরের সপ্তাহে শনিবার বিকেলবেলা, রুনু সবাইকে ডেকে বলছিল - " আজ কিন্তু মিঠাইয়ের ফোন আসবে, ও হয়তো আবার কারো সাথে কথা বলবে। আজ মোক্ষম দিন, তোরা সবাই রেডি থাকিস। বেশ তিন মাস ধরে আমাদের ঘোল খাওয়াচ্ছে মেয়েটা। আজ আমরাও ওকে হাতেনাতে ধরবো। "


নীলা বললো - " ও মনেহয় কোনো চাকরিওয়ালা ছেলের সাথে প্রেম করছে, বুঝলি তোরা! হিরোর রবিবার অফিস ছুটি, তাই শনিবার রাতে চুটিয়ে প্রেম করে। এদিকে আমাদের ম্যাডামেরও তো রবিবার ইউনিভার্সিটি অফ। দু'জনে বেশ ভালোই চালাচ্ছে ..."


নীলার কথায় সবাই মুচকি মুচকি হাসলেও অহনা ঠেস মারে - " হ্যাঁ নীলা তুই ঠিকই বলেছিস, কারণ এব্যাপারে তোর অগাধ অভিজ্ঞতা। আমাদের তো তা নেই। অবিনাশদা যে শনিবার তোকে সারারাত বকায়, তা আমরা সবাই জানি..."


কিছুটা লজ্জা লজ্জা মুখে নীলা বলে - "ওমনি আমায় নিয়ে টানাটানি শুরু করলি তো তোরা ?? চুপ কর এবার। মিঠাইয়ের আসার সময় হয়ে গেল।"


বলতে বলতেই মিঠাইয়ের আগমন । সবাইকে দেখে মিঠাই-ই বলে উঠলো - " কিরে তোরা সবাই এখানে? কিছু হয়েছে নাকি?? "


রুনু বলে - " না রে মিঠাই কিছুই হয়নি। যা তুই ফ্রেস হয়ে নে, বাইরে থেকে এলি। এমনিই সবাই মিলে একটু আড্ডা দিচ্ছিলাম। "


" তা এভাবে গেটের সামনে কেন? আড্ডা তো সবসময়ই কারো না কারো রুমে চলেই। কিন্তু তোদেরকে এই গেটের সামনে দেখে একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। ভাবলাম কিছু হলো নাকি!! আচ্ছা সবাই একটু পরে খাবার টেবিলে চলে আসিস। আমি গরম গরম সিঙ্গারা এনেছি। "


রিয়া প্রায় লাফিয়ে ওঠে - " হুররে, কি মজা..."

এক কাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই | Food illustration art, Food painting, Food  illustrations

সন্ধ্যায় খাবার টেবিলে সবাই এসে হাজির। মৌলি প্যাকেট থেকে খাবারগুলো বার করতে করতে বলে - " হ্যাঁরে আজ হঠাৎ সিঙ্গারা আনলি যে ? "


" আরে ওই পুচকিটার আজ বার্থডে ছিল, আমি জানতাম না। গান শিখিয়ে উঠতে যাচ্ছি ওর মা বললো 'মিঠি একটু বসে যাও। আজ শর্মির জন্মদিন। দুপুরে খাওয়াদাওয়া হয়েছে। তা তুমি তো দু'সপ্তাহ আসোনি। তাই তোমায় বলা হয়নি। তোমার ফোনে ফোন করেছিলাম, আউট অফ রিচ বলছিল। ফোনেও পেলাম না। তাই এখন একটু খেয়ে যেও।' কি লজ্জার কথা বল, শর্মিকে গিফ্ট দেওয়া হলো না। খেয়ে চলে এলাম। ওর মা তোদের জন্যেও বেশি করে সিঙ্গারা আর কেক দিয়েছে। আমি বারণ করলাম, কে শোনে কার কথা। ওকে পরের সপ্তাহে গিফট দেবো। কি দেওয়া যায় বলতো ?? "


পেটুক প্রিয়া সঙ্গে সঙ্গে বলে ওঠে - " আরে এখন ওসব থাক। পরে বলবো আমরা, এখন তো খেতে দে। নাহলে সব ঠান্ডা হয়ে যাবে। এর সাথে একটু চা হলে মন্দ হয়না, কি বলিস তোরা? "


প্রিয়ার অবস্থা দেখে হো হো করে হাসতে থাকে অহনা - "হ্যাঁ হ্যাঁ একদম। তোরা বস। আমি লিকার চা বানিয়ে আনছি।"

এই বলে অহনা রান্নাঘরের দিকে চলে গেল।


মৌলী বলে - " আজ সন্ধ্যেটা পুরো জমে গেল রে! তোরা কি সব টেবিলেই বসে থাকবি? আমি উঠছি। বাড়িতে ফোন করবো। "


বাকিরাও বলে ওঠে, " আমরাও তো উঠবো, আমাদেরও বাড়িতে ফোন করা বাকি আছে।"


ডিনার শেষে নিজের রুমে শুতে যাবার সময় মিঠাই লক্ষ্য করে অন্যরা সব কি যেন ফিসফিস করছে। ওদেরকে উদ্দেশ্য করে বলে, " হ্যাঁরে কি বলছিস সব? আমাকেও বল। "


রুনু বলে - " না রে কিছু না। চল শুতে যাই। "


মিঠাই স্পষ্ট যেন দেখলো সবাই মিলে কিছু একটা বলছিল, কিন্তু তাকে কেউই কিছু বললো না। মিঠাইয়ের মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল।

নিজের মনেই অভিমান করে বললো - " যাকগে, কি হবে জেনে সবকিছু। আমি হয়তো ওদের ভালো বন্ধু হয়ে উঠতে পারিনি, তাই ওরা বলেনি। আজ তো শনিবার, যদি নীলাটা মাঝরাতে আসে তাহলে ওকেই চেপে ধরবো। ও নিশ্চয়ই না বলে থাকতে পারবে না। "


সবাই সবার রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লো। মিঠাই আজ আর রুমের দরজায় ছিটকিনি লাগালো না, স্রেফ আলতো করে বন্ধ করে দিলো। হয়তো নীলা আসবে...।


গভীর রাত, চারিদিকে শুনশান নিস্তব্ধতা। ঘড়ির টিকটিক আওয়াজ ছাড়া যেন এই দুনিয়ায় আর কোনো আওয়াজ নেই। সবাই যেন চিরনিদ্রায় মগ্ন। হঠাৎ মিঠাইয়ের ঘুম ভাঙলো। রাত তখন দু'টোর কাছাকাছি। মিঠাই কেমন যেন শীতলতা অনুভব করলো। হঠাৎ বলতে শুরু করলো - " এইতো নীলা তুই এসেছিস। আমি জানতাম তুই আসবি। তাই আজ রুমে দোর দিইনি। কিন্তু কি অদ্ভুত রে! তুই যেদিনই আমার রুমে আসিস, সেদিনই কি বৃষ্টি হয়!! ভারী একটা শীতলতা অনুভব করি। তোকে কোনোদিন বলিনি। তবে আজ বলছি। রুমটাও যেন অস্বাভাবিক রকমের হয়ে যায়। তোর আর অবিনাশের বিরহের ফল নাকি?? " বলেই মিঠাই হো হো করে হেসে উঠলো।


এদিকে বাকিরাও সব উঠে গেছে। সবাই মিঠাই এর রুমের বাইরে এসে মিঠাইয়ের দরজায় আড়ি পেতেছে। কিন্তু একি! মিঠাই যেন নীলার নাম ধরে ডাকলো! আবার হাসছে!

নীলা বিস্মিত হয় - " আমি তো এখানে। তবে মিঠাই কাকে নীলা বলছে!! "


রুনু বলে - " এই নীলা চুপ কর। বাকি কথা শুনতে দে..."


মিঠাই ওদিকে বলে চলেছে - " এই নীলা কিছু তো বল। তাছাড়া আজ খাবার শেষে তোরা কি বলেছিলিস রে ফিসফিস করে? আমাকেও বল সোনা। আমি কিন্তু কষ্ট পেয়েছি। জানি তুই এলে ঠিকই বলবি। এই নীলা কিছু তো বল?? " মিঠাই পাশেই শুয়ে থাকা নীলাকে ছুঁতে যায়।

" একি নীলা তোকে আমি ছুঁলাম, কিন্তু কই তুই?? এসব কি মজা হচ্ছে আমার সাথে? তুই তো আমার পাশেই শুয়ে, তবে তোর স্পর্শ নেই কেন? "


এবার মিঠাই কিছুটা ভয়ে উত্তেজিত হয়ে ধড়ফড় করে ওঠে বিছানা থেকে নেমে রুমের আলো জ্বেলে দেয়।

" একি !! এ কি করে সম্ভব!! এক্ষুণি তো এখানে মেয়েটা ছিল। এর মধ্যে গেল কোথায়?? রুমে তো কেউ নেই। কি হলো!! আমি কিছুই বুঝতে পারছি না..."


'নীলা নীলা' এই বলে রুমের বাইরে বেরোতেই দেখতে পায় রুমের বাইরে সব বন্ধুরা দাঁড়িয়ে।


" ও এবার বুঝতে পেরেছি। এইসব তোদের কারসাজি। এসব করবি বলেই খাবার শেষে ফিসফিস করছিলিস। আমাকে নিয়ে মাঝরাতে মশকরা করা, দাঁড়া তোদের সব ক'টাকে আমি দেখে নেবো। আর এইযে নীলা তুই কখন বাইরে এলি বলতো ? এত কমসময়ে কিকরে এলি? যেন অদৃশ্য হয়ে গেলি!! "


নীলা অবাক হয়ে বলে - " এসব তুই কি বলছিস মিঠাই? মানলাম আমরা তোর রুমে আড়ি পেতেছি। কিন্তু আমি কখন তোর রুমে গেলাম??"


মিঠাই একটা মৃদু ধমক দেয় - " বেশি ঢং করিস না। তুই যাসনি আমার রুমে!!এটা আমায় মানতে হবে বলছিস ? এটা ডাহা মিথ্যে কথা নয় কি !! প্রতি শনিবার না হলেও তুই বেশিরভাগ শনিবারই আমার রুমে মাঝরাতে গিয়েছিস। সে তুই এখন নাই-ই স্বীকার করতে পারিস !! "


নীলা বলে - " আরে মিঠাই বিশ্বাস কর , আমি তোর রুমে কোনোদিন মাঝরাতে যাইনি। তুই তো জানিস অবিনাশ কেমন। শনিবার রাতটা ওর সাথে কথা বলেই কেটে যায়। আমার পাশের রুমে অহনা থাকে, ওকেই জিজ্ঞেস কর। ওরা সবই জানে। "


অহনাও বলে - " হ্যাঁ রে মিঠাই, নীলা ঠিকই বলছে। আমি আর কাবাব মে হাড্ডি হতে যাই না। কিন্তু ওরা চুটিয়ে প্রেম করে, তবে নীলা খুব আস্তে কথা বলে। কি যে বলে ওর অবিনাশই শুধু জানে। বাবারে বাবা , কি ফিসফিসানি!! "


" এই অহনা চুপ করবি। কিন্তু আমার কথা হলো মিঠাই আমার নাম কেন করছে? " বলে নীলা। " আমি যে ওর রুমে যাই না সেটা তো প্রমাণিত। আমরাই তো ভাবতাম তুই বুঝি প্রেমট্রেম করছিস, অনেকদিন ধরে এই রাতের বেলা তোর রুম থেকে আওয়াজ পেতাম। কমবেশি সকলেই শুনেছি। তাই আজ আড়ি পেতেছি যে তুই কার সাথে কথা বলিস জানবো বলে... "


মিঠাই অবাক হয়ে জানতে চায় - " নীলা তুই সত্যিই কি আমার রুমে আসিস না?? "


" আরে না রে। কেন বলতো ? আর তুইই বল, আমি যদি আসতাম তাহলে কি তোর সাথে কথা বলতাম না ? নাকি মৌনব্রত করে সারা রাত কাটিয়ে দিতাম ? "


" আমি আর কিছু সত্যিই ভাবতে পারছি না। তুই যদি না আসিস, তবে কে আসতো আমার রুমে ?? "


সকলের গা ছমছম করছে, অজানা ভয়ে গায়ের লোম খাড়া হয়ে উঠছে ক্রমশ । তখন রুনু বলে - " এই তিন্নি একটু জল এনে দে, মেয়েটা কেমন যেন করছে। চল চল বিছানায় গিয়ে বসবি। "

সবাই মিলে মিঠাইকে নিয়ে তার রুমে বিছানায় এনে বসায়।


মৌলী জিজ্ঞাসা করে - " আচ্ছা বলতো কি হয়েছে ? "


মিঠাই বলে - " তবে শোন। প্রতি শনিবার নাহলেও বেশিরভাগ শনিবার রাতে আমার ঘুম ভেঙে যেত, অদ্ভুত এক পরিস্থিতিতে। আমার পাশে এক নারী শুয়ে। কেমন যেন সব শীতল হয়ে উঠত। আমি তো এতদিন ধরে ভেবে এসেছি নীলা এসেছে আমার রুমে। হয়তো অবিনাশের সাথে ঝগড়া হয়েছে, তাই মনখারাপের জেরে আমার রুমে এসেছে। আমার নিজেরও বড় অদ্ভুত লাগতো জানিস। আমি অনেক কিছুই বলতাম আধোঘুমে, কিন্তু এটাই ভাবতাম নীলা কেন কিছু বলে না! আজ যা হলো তা তো অবিশ্বাস্য!! নীলা ভেবে যার গায়ে হাত দিলাম, সেখানে আর কিছুই স্পন্দন পেলাম না। আমার কেমন যেন মনে হলো। তাই হঠাৎ করে উঠেই রুমের আলো জ্বালিয়ে বাইরে গেলাম। তারপরের তো সবই তোরা জানিস... "


" আমরা মাঝরাতে তোর গলার স্বর শুনেছি রে।তাই তো এই প্ল্যান। " বলে রুনু। " কিন্তু এমনটা স্বপ্নেও ভাবিনি। এসব কি হচ্ছে বলতো ? শোন তোকে আজ আর এই রুমে শুতে হবে না। সকালের শুধু অপেক্ষা। সকাল হলেই বাড়িওয়ালাকে ডেকে জিগেস করবো, কিছু বলতে পারে কিনা দেখি। মিঠাই তুই চল আমার রুমে..."


সবাই চুপচাপ চলে গেল নিজেদের রুমে। কেউই আর কোনো কথা বললো না। থমথমে ভয়ার্ত পরিবেশ।


পরদিন সকালে বাড়ির মালিককে ডেকে সব কিছু ওরা খুলে বললো। সব শুনে বাড়ির মালিক ও তার স্ত্রী কেমন যেন ঘামতে শুরু করেছে, মুখ শুকনো। ধপাস করে দু'জনেই বসে পড়ে। কোনো কথাই বলে না।


তখন মিনু বলে - " আমি বলছি। তোমরা সব শুনবে তো!! বিশ্বাস করবে তো?? তোমরা সব লেখাপড়া জানা এত শিক্ষিত মেয়ে। আমি যেসব কথা বলবো তা তোমরা বিশ্বাস না করলেও সত্য গো। "


সবাই সবার দিকে তাকাচ্ছে , মুখ থমথমে।

মিনুদি বলতে শুরু করলো - " আজ থেকে ঠিক পাঁচবছর আগে এই বাড়িতে মিঠাই দিদির রুমে একটা মেয়ে "কেয়া" তোমাদের মতোই থাকতে আসে। তোমাদের মতোই পড়াশোনা করতো। তখন বেশি কাউকে ভাড়া দেওয়া হতো না। অনেকেই এই বাড়িতে থাকতে চাইতো, এটা তোমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে, আর সবদিক দিয়ে সুবিধে পাওয়া যায়। তাই প্রচুর মেয়ে আসতো। নিচের পশ্চিমদিকের রুমগুলোতে পাঁচজন থাকতো। আর দক্ষিণদিকের দু'টো রুমে দু'টো মেয়ে থাকতো। কেয়া থাকতো ওই দক্ষিণদিকের একদম ধারের রুমটায়, যেটাতে এখন মিঠাইদিদি থাকে। খুব হাসিখুশি, ভালো মেয়ে ছিল গো। ওর বাড়িতে কিসব ঝামেলা হত, তাই ও বাড়িও খুব একটা যেতে চাইতো না। পুজোর সময় ছুটিতে সবাই বাড়ি গেলেও ও গেল না। আমি জিজ্ঞেস করায় আমাকে একদিন ডেকে বলেছিল "জানো মিনুদি, আমার বাড়িতে শান্তি নেই, এখানে আমি বেশ আছি। আমার কোনোকিছুই নেই গো, ভালোবাসার মানুষও তেমন কেউ নেই। কাদের জন্য বাড়ি যাব বলো " । ওর কথা শুনে আমারই খুব কষ্ট হয়েছিল। তারপর থেকে দেখতাম ও এখানে দিব্যি থাকে, আর যারা থাকতো সবাইকে নিয়ে ওর রুমে আড্ডা দিতো। সবাইকে বড় ভালোবাসতো। এইভাবেই দিন চলছিল। ও এখানে অনেক বাড়ি পড়াতেও যেত। পরের বছর শ্রাবণ মাসের শেষ শনিবার মেয়েটা পাশেই বন্ধুর মেস থেকে আসার সময়ে রাস্তা পেরোতে গিয়ে গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যায়, সেদিন প্রচুর বৃষ্টি হয়েছিল। তার পরে এই বাড়িতে অনেক কিছু ঘটে। বাড়ির মালকিনরা অনেক কিছু করে, কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। এই ঘটনার পর কেউ আর এবাড়িতে থাকতে চাইতো না। একদিন এবাড়ির দোরগোড়ায় একজন সন্ন্যাসী আসেন, তিনি বলে গিয়েছিলেন এই বাড়ি যেন কখনো খালি না রাখা হয়, তাহলে বিপত্তি আরো বাড়বে। নিষ্পাপ চঞ্চল মেয়েরা থাকলে এর থেকে মুক্তি মিলবে, আর কিছু হবে না। পরের বছর থেকে আবার সবাই থাকতে শুরু করে, কিন্তু এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। তাই আর ভয়ে কেউ থাকতে চায় না। এবছর কয়েকমাস আগে তোমরাই আবার এলে এবাড়িতে। অনেকবছর পর এই বাড়ি আবার হাসিখুশিতে ভরে উঠতে থাকলো। আমরা ভাবলাম সব বুঝি ঠিক হয়ে গেছে, আর তো তেমন কিছু শুনিনি। মিঠাইদি খুব ভালো মেয়ে, খুব নরম স্বভাবের। তাই হয়তো ওর কিছু হয়নি। কিন্তু ওর অনুভবে সে থাকতো। "


বাড়িওয়ালা অসহায় স্বরে বলেন - " কি যে বলি তোমাদের। আমরা একা থাকতাম এত বড় বাড়িতে। তাই তোমাদের মতো মেয়েদের রাখতাম। ঘরটা ভরে থাকতো। কি থেকে যে কি হয়ে গেল! জানি তোমরাও এবার চলে যাবে!"


" না মেসোমশাই, আমরা কোথাও যাবো না। " মিঠাই বলে উঠলো। " আমি এসব বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু এতদিনে আমার সাথে যা কিছু হলো, তাতে অনুভব করেছি যে আমার একজন ছায়াসঙ্গী আছে। তা সে থাকুক। সে তো কারোর কিছু ক্ষতি করেনি। তার আত্মার শান্তি কামনা করি। সে খুশি হলেই মুক্তি পেয়ে যাবে। মিনুদির কথা শুনে মনে হল মেয়েটা বড় দুঃখী ছিল। আর এখানেই ও একটু শান্তি খুঁজতো। ওই রুমটা  খুব প্রিয় ছিল, তাই মৃত্যুর পরেও ছেড়ে যেতে পারেনি। আপনি ওই রুমটার অদলবদল করিয়ে দিন। আমি ততদিন আমার বন্ধুদের যার হোক রুমে থাকবো। "


বিস্মিত হয় মৌলী - " মিঠাই তুই এসব কি বলছিস?? এখনো থাকবি এখানে? "


স্মিত হেসে মিঠাই বলে - " শুধু আমি না রে, তোরাও থাকবি। যেমন ছিলাম তেমনটাই থাকবো। এক্কেবারে ইউনিভার্সিটির পাট চুকিয়ে বিদেয় নেবো। "

সবাই দীর্ঘশ্বাস ফেললো।


মিঠাইয়ের কথামত কাজ করানো হলো বাড়িটার। একটু ভেঙেচুরে অন্যরকম করা হলো। সব রুমগুলোকেই নতুন করে রং করা হলো। এখন একদম অন্যরকম হয়ে গেছে বাড়িটা। পুজোও করা হয়েছে।


এরপরে বেশ কয়েকদিন কেটে গেছে, শ্রাবণ মাসের সেই শনিবারের রাত। মিঠাই আজও যেন আগের মতো অনুভব করছে। তবে আজ বেশিই। গা ছমছমে রাত, কিছুতেই ঘুম আসছে না। অনেকক্ষণ এপাশ ওপাশ করে উঠে বসে বলে উঠলো, " কেয়া ? শুনতে পাচ্ছো আমার কথা ? যদি পাও তবে বলি কষ্ট পেও না। তুমি যাতে আর কষ্ট না পাও তার ব্যবস্থা করবো আমরা ।"


হঠাৎই একটা কান্নার আওয়াজ শুনতে পেল মিঠাই। অনুভব করলো কেউ যেন তার পাশে বসে। মিঠাই বলে উঠলো - " এবছর পুজোতে আমরা বাড়ি যাব। তুমি তোমার মতোই ক'টা দিন এই রুমে থাকতে পারবে। তারপরেই তোমার মুক্তি ঘটবে । আর অনুভব করবো না আমার রাতের সঙ্গীকে। "


সেদিন যাকে স্পর্শ করতে গিয়েও পারেনি, আজ সে হাতে হাত ছোঁয়ালো। শিরশির করে কেঁপে উঠলো মিঠাইয়ের শরীর।


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন