“মা রান্নাবান্না কিছু জানা আছে নাকি শুধুই লেখাপড়া করেছ?”
- একটা নলেন গুড়ের সন্দেশ মুখে পুরে রাধাকান্ত নন্দী জিজ্ঞাসা
করলেন ।
উত্তরে মাথা নীচু করিয়া অনুরাধা বলল, “আজ্ঞে কিছু কিছু
রান্না করতে জানি” ।
তিন পুত্রের পর যখন এক কন্যা জন্মগ্রহণ করল তখন সুরেশ ও
তার স্ত্রী মিনতি সাধ করে নাম রেখেছিলেন
অনুরাধা । সুরেশের বাড়ি দক্ষিণ চব্বিশ পরগণা জেলার জয়নগর গ্রামে । জয়নগরের
মোয়া পশ্চিমবঙ্গ কেন, পুরো ভারতবর্ষে বিখ্যাত ।
এখানে তৈরি হয় খেজুর রস থেকে গুড় এবং সেই গুড়ের মোয়া । শুধু মোয়া কেন,
নানাপ্রকার মিষ্টিও এই গুড় থেকে তৈরি হয়,
একেই বলে নরেন গুড় ।
সুরেশের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়,
দুই একজনের জমি ভাগ চাষ করে কে আর কবে
বড়লোক হতে পেরেছে । বড় ছেলে অরুণের মনোহারীর
দোকান আছে জয়নগর বাজারে, মেজো ছেলে কলকাতায়
চাকরি করে সপ্তাহান্তে বাড়ি আসে, ছোট ছেলে
এলআইসি এজেন্ট কমিশন ভালো উপায় । এই তিন ছেলের
পরে মেয়ে অনুরাধা । সংসারের চাপে পড়ে তিন
ভাই উচ্চমাধ্যমিকের পর আর মহাবিদ্যালয়ের চৌকাঠ পার হতে পারেনি । অনুরাধা
কিন্তু শুধু মহাবিদ্যালয় নয়, ও বিশ্ববিদ্যালয়ের চৌকাঠও পার করেছে । সেই ইতিহাসে এম এ পাশ করেছে । স্কুল সার্ভিসের পরীক্ষা দিয়েছিল তাতেও পাশ করেছে
। কাজেই স্কুল মাস্টার হবে । অবশ্য তার জন্য তার তিন দাদা ও বাবা মায়ের অবদান
অনস্বীকার্য ।
ছোটবেলা থেকেই অনুরাধা পড়াশোনায় খুব ভালো, পড়াশোনার সাথে সাথে আরেকটা
জিনিস ভালো করতে পারে, সেটা হলো ছবি আঁকা ।
সে কোন শিক্ষকের থেকে ছবি আঁকা শিক্ষা লাভ করেনি, অথচ এই রকম ছবি আঁকতো যেন জীবন্ত মনে হতো ।
তার আঁকা কিছু ছবি মহাবিদ্যালয় ম্যাগাজিনে
ছাপা হয়েছে । তখন সে ক্লাস নাইনে পড়ে। অংকের
শিক্ষক সুকুমার বাবু রিটায়ার করেন । ক্লাস নাইনের সমস্ত ছাত্র-ছাত্রীদের পক্ষ থেকে
স্যারকে একটা পোর্ট্রেট আঁকা ছবি বাঁধিয়ে উপহার দেওয়া হয় । সেটা অনুরাধার আঁকা । স্কুলের সকলে সেই ছবিটার খুব
প্রশংসা করেছিল ।
সেই অনুরাধার এখন বিয়ের কথাবার্তা চলছে, ক্যানিংয়ের
রাধাকান্ত নন্দী মহাশয়ের ছেলের সঙ্গে ।
দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার ক্যানিং স্টেশনে নেমে যদি কাউকে
নন্দী বাড়ী কোথায় জিজ্ঞাসা করা হয়, তবে সবাই বিনা দ্বিধায় পথ দেখিয়ে দেবে ।
ক্যানিং স্টেশনে নেমে যে সোজা রাস্তা
মাঠের দিকে চলে গেছে সেইটা ধরে মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই বিরাট বড় বাড়ি, নন্দীবাড়ী
।
রাধাকান্ত নন্দীর বাবার নাম ছিল রতিকান্ত নন্দী । তিনি
ব্যবসা-বাণিজ্য করে প্রচুর অর্থ উপার্জন
করেছিলেন । তিনিই এই বিশাল বাড়ি তৈরি করেন মাতলা নদীর ধারে । রতিকান্ত নন্দীর দুই পুত্র রাধাকান্ত এবং
নীলকান্ত । নামের পরে “কান্ত” লাগানো নাকি এদের পূর্বপুরুষের আমল থেকে হয়ে আসছে ।
নীলকান্ত ডাক্তার কলকাতার বালিগঞ্জ থাকে,
মাঝেমধ্যে গ্রামের বাড়িতে আসে ।
গ্রামের বাড়ি ও ব্যবসা-বাণিজ্য সব রাধাকান্ত দেখাশোনা
করে । রতিকান্ত মারা গেছেন দুই বছর হলো, বাড়িতে এখন থাকেন রাধাকান্ত, তাঁর স্ত্রী
বিন্দুবাসিনী, পুত্র রজনীকান্ত, কন্যা নিরুপমা এবং চাকর-বাকর তো আছেই ।
এই রজনীকান্তের সঙ্গে অনুরাধার বিয়ের কথাবার্তা চলছে
। আজ রাধাকান্ত তার দুই - একজন ব্যবসায়িক
বন্ধু ও ঘটককে সঙ্গে নিয়ে জয়নগরে সুরেশের মেয়ে অনুরাধাকে দেখতে এসেছেন ।
সুরেশ বসার ঘরেই সবাইকে বসিয়েছে, সোফার ওপর । সামনের
টেবিলের ওপর আছে জয়নগরের বিখ্যাত মা কালী মিষ্টান্ন ভান্ডারের তৈরি নলেন গুড়ের
সন্দেশ, মোয়া, ইত্যাদি । ঘরের এক পাশে মাথা নিচু করে বসে আছে অনুরাধাব।
ইতিমধ্যে অনুরাধার মামা কয়েকটি ছবি এনে রাধাকান্তের বাবুর হাতে সামনে রাখল ।
সবক'টি অনুরাধার আঁকা, রাধাকান্ত সেগুলো মনোযোগ সহকারে দেখতে লাগলেন ।
তার এক বন্ধু তারিফ করে বললেন, "ছবিগুলো খুব
সুন্দর, নন্দনে একটা চিত্র প্রদর্শনীর এক্সিবিশন শুরু করা যেতে পারে, আমার এক পরিচিত কলকাতায় আছে, আপনারা বললে আমি কথা বলতে পারি । ওখানে অনেক দামে ছবি বিক্রিও হয়”
।
শেষে কথাটি রাধাকান্তকে যেন একটু বিঁধল, তাই তিনি তাড়াতাড়ি
বাধা দিয়ে বললেন, "না না পুত্রবধূর হাতে আঁকা ছবি বিক্রি করে রোজগার করতে
হবে এমন অবস্থা রাধাকান্ত নন্দীর হয়নি । তবে মায়ের আঁকা ছবিগুলোয় সত্যিই
নিপুণতার ছাপ আছে “।
ঘটকমশাই কিন্তু ছবির চাইতে টেবিলের সামনে রাখা
মিষ্টির দিকে বারবার দেখছিলেন । এরপর আরো
দু-একটি পারিবারিক কথা জিজ্ঞেস করে রাধাকান্ত বললেন, ”ঠিক আছে মা, ভেতরে যাও”
।
অতঃপর সুরেশের দিকে তাকিয়ে বললেন, “মেয়ে আমাদের পছন্দ
হয়েছে, একবার ছেলে এসে দেখে যাবে, কারণ আমরা আর ক'দিন, যার সঙ্গে সারাজীবন থাকতে
হবে তার সঙ্গে সরাসরি কথা বলা দরকার” ।
সুরেশ রাধাকান্তকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছিল । এর কয়েকদিন পরে রজনীকান্ত
একবার এসে মেয়ে দেখে গিয়েছিলো । সুরেশ একটু ভাবনাচিন্তা করেছিল কারণ এত বড় ঘরে মেয়ের
বিয়ে দিতে গেলে টাকাপয়সা সবথেকে বড় সমস্যা । গয়নাগাটি কিছু করানো আছে বটে, কিন্তু
ক্যাশ টাকাপয়সা লাগবে । সুরেশ এইসব কথা চিন্তা
করে একদিন অনুরাধার মামা ও তিন ছেলেকে নিয়ে বসে একটা মিটিং করলো ।
বরযাত্রী যদি একশ' জনের মধ্যে হয় এবং ছেলের বাড়ি থেকে
যদি কোন কিছু বিশেষ চাহিদা না থাকে, তাহলে বিয়ে হতে পারে । মিনতির একটাই ইচ্ছা,
তার মেয়েকে যেন তার মত কষ্ট স্বীকার না করতে হয় । তার জন্য নিজের যা কিছু
গয়নাগাটি আছে তা দিতে প্রস্তুত । একটাই মেয়ে, যেন সুপাত্রে ও সুপরিবারে বিবাহ
হয় । বলা বাহুল্য এটা শুধু তার ইচ্ছা
নয়, কন্যাদায়গ্রস্ত সমস্ত পিতা-মাতার ইচ্ছা ।
যাইহোক পাত্র এসে দেখে যাবার পর তার সম্মতির কথা জানায়
। এখানে উল্লেখযোগ্য রজনীকান্ত বেশি লেখাপড়া করতে পারেনি । ক্যানিং কলেজ থেকে
কমার্সের গ্রাজুয়েট মাত্র । মার্কস ভালোই
ছিল, চাইলে মাস্টার ডিগ্রী করতে পারতো , কিন্তু বাবার ব্যবসা এত বড় হয়ে গেছে যে
এখন আর রাধাকান্ত একা সামাল দিতে পারছে না ।
তাই পিতাকে সাহায্য করার জন্য পড়াশোনা সমাপ্ত করতে হয় । সেই আক্ষেপটা বোধহয় মনের কোণে রয়ে গিয়েছিল
। তাই এম. এ. পাশ মেয়ে যে জয়নগরের মত
এলাকায় আছে তা সে ভাবতেও পারেনি । তাই দেরি না করে বিয়েতে সম্মতি জানিয়েছিল ।
এখন পৌষ মাস, হিন্দু মতে বিবাহ নেই । সামনের মাঘ ফাল্গুনের মধ্যে যে দু'একটা বিয়ের তারিখ আছে তাও সম্ভব
নয় । কারণ সেটা বড় তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে
। নন্দীবাড়ির বিয়ে বলে কথা, তৈরীর জন্য অন্তত চার-পাঁচ মাস লাগবে । অতএব জ্যৈষ্ঠ মাসের একটা দিন দেখে বিবাহ স্থির
করা হলো ।
এর মধ্যে মাঘ মাসের একটা দিন দেখে রাধাকান্ত কন্যাকে
আশীর্বাদ করে গেলেন । এখন আসা যাওয়ার
কোনো বাধা নেই দুই পরিবারের মধ্যে ।
পয়লা বৈশাখ হালখাতায় সুরেশ সস্ত্রীক রাধাকান্তের
বাড়িতে গিয়েছিল, হালখাতা নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে । একটা পেট্রোল পাম্পের
লাইসেন্সের জন্য আবেদন করেছিলেন রাধাকান্ত, অনেকদিন ধরে সেটা ঝুলেছিল, অতঃপর চৈত্র
মাসে ইন্ডিয়ান অয়েলের অফিস থেকে লোক এসে জায়গা দেখে পেট্রোল পাম্প তৈরি করার
অনুমতি দিয়েছে ।
পাঠকদের উদ্দেশ্যে পেট্রোল পাম্প সম্বন্ধে একটু ধারণা
দিতে পারি । পেট্রোলের দামের সাধারণত বহু
পরিবর্তন হয় । কখনো বাড়তে থাকে, আবার কখনো কমতে থাকে । আমরা কাগজে প্রায়ই দেখি
সরকার পেট্রোলের দাম এক টাকা বা দুই টাকা
বাড়িয়েছে, এটা অমুক তারিখের মধ্যরাত্রি থেকে কার্যকর হবে । কেউ যদি তার আগে কম
দামে পেট্রোল কিনে থাকে তাহলে সে পরেরদিন থেকে কমদামের পেট্রোল বেশি দামে বিক্রি
করতে পারবে । তাদের লাভের পরিমাণ অনেক বেড়ে
যায় । একটা উদাহরণ দিতে পারি । কোন এক পেট্রোল পাম্পের মালিক ১৪ই আগস্ট, ৫০ হাজার লিটার পেট্রোল কিনে ছিল ৪৮ টাকা ৫০
পয়সা প্রতি লিটার দরে । সরকার ঘোষণা করল ১৪ই আগস্ট রাত্রি ১২.০০ থেকে পেট্রোলের
দাম ৫০ টাকা ১০ পয়সা হলো প্রতি লিটার ।
মোটামুটি ভাবে এক টাকা ৬০ পয়সা প্রতি লিটারে লাভ হলো । তাহলে আশি হাজার টাকা লাভ
হল এক রাতে ।
ক্যানিং শহরের বাইরে নামখান- বাসন্তী হাই-রোডের ধারে একটা পেট্রল পাম্প খুলবে এবং সেটা
পুত্রবধূর নামে হবে ‘অনুরাধা পেট্রোল সার্ভিস’ । যদি সবকিছু ঠিকঠাক থাকে তাহলে
বিয়ের আগে পেট্রোল পাম্প উদ্বোধন হতে পারে । নন্দীবাড়ির কুলপুরোহিত পঞ্জিকা দেখে
ঠিক করলেন ১০ই জ্যৈষ্ঠ বিবাহের দিন এবং
১২ই জ্যৈষ্ঠ বৌভাত অনুষ্ঠান । জয়নগর থেকে এই বিয়ের সম্মতি এসে গেছে, কাজেই নন্দী
বাড়িতে এখন সাজ সাজ রব । এখানে উল্লেখ্য রাধাকান্তের বড় ভাই নীলকান্তের দু'টি
মেয়ে । অতএব নন্দী পরিবারের একমাত্র
কুলদীপক এই রজনীকান্ত । কাজেই তার বিয়েতে নন্দী বাড়িতে যে উৎসব হবে সেটা
অনস্বীকার্য ।
ঢাকাই মসলিন, বেনারসের বেনারসী, দক্ষিণের কাঞ্জিভরম, যত
সব দামি দামি শাড়ি কাপড় কেনা হলো, সেনকো গোল্ডের গয়না, জড়োয়ার সেট, নবীন ময়রার
মিষ্টি, বাড়িতে তৈরি হবে সাত দিন আগে ।
নিজের চারটে পুকুরের মাছ এবং সমুদ্রের ইলিশ, পমফ্রেট, চিংড়ি থাকছে। চিকেনের জন্য
একটা পোল্ট্রি ফার্মের সব মুরগি কিনে নিয়েছেন । তারা বৌভাতের দিন সকালে ডেলিভারি
দেবে । এছাড়া পাঁঠার মাংস থাকছে ।
ওদিকে মেয়ের বাড়িতে এত বড় না হলেও জোগাড় কম হবে না
। বরযাত্রী ৭০ থেকে ৮০ জন হবে বলেছে, এছাড়া
বাড়ির আত্মীয়-স্বজন ও পাড়াপড়শি মিলিয়ে প্রায় ৫০ -৬০ জন হবে ।
অর্থাৎ মোট ১০০ থেকে ১৫০ জনের জোগাড় করতে হবে । সুরেশ ও তার স্ত্রী জোগাড়ের কোনরকম খামতি
রাখতে চাইছে না । পাত্রপক্ষের কোনরকম দাবিদাওয়া নেই, তবুও গয়না কাপড়চোপড় দানসামগ্রী
ইত্যাদি মিলিয়ে প্রায় তিন-চার লাখ টাকা
খরচা হবে । ছেলেরা কিছু কিছু করে দেবে এবং মিনতির বাপেরবাড়ী থেকেও বেশ কিছু জিনিস
আসবে ।
দেখতে দেখতে সেই শুভ অনুষ্ঠানের দিন এসে গেল । এখন গরমকাল, দুপুরে যেন আগুনের ঝলকানি বের হয় ।
কালবৈশাখীর কোন নাম গন্ধ নেই । সকাল দশটার পর বাইরে বেরোনো সম্ভব নয় । অনুরাধার
ভাইয়েরা সবাই নানা কাজে ব্যস্ত, সুরেশ কন্যাসম্প্রদান করবে তাই সকাল থেকে উপবাস
আছে । তার স্ত্রী বলেছিল দুধ, ফল, মিষ্টি খেতে, কিন্তু সুরেশ মানা করেছিল । একটা
মেয়ে, বিয়ে একবারই হবে । তাই উপবাসও ঠিকভাবে পালন করবে । অতএব সে কিছুই খাবে না
।
আজ বিয়ের লগ্ন আছে দু'টি । গোধূলিলগ্নে সন্ধ্যে ছ'টা
এবং রাত্রি ১.৩০এর পর । রাত্রিরের লগ্ন
ধরলে বিয়ে শেষ হতে হতে সকাল হয়ে যাবে,
কারণ সুরেশের পুরোহিত হল জয়নগর গ্রামের স্কুলের সংস্কৃতের টিচার । কাজেই
তাঁর কাছে শর্টকার্ট করতে পারবে না । তাই
গোধূলি লগ্নে বিয়ে স্থির হয়েছিল । পুরোহিত মশাই সম্প্রদানের জন্য জিনিসপত্রের যে ফর্দ দিয়েছিলেন সেগুলি
সুরেশ ছোট ছেলেকে দিয়েছিল আনতে । সে দোকানে গিয়ে প্রায় সব জিনিস এনেছিল, দু-একটা জিনিস পায়নি । দুর্ভাগ্যক্রমে সেটা সে বাড়িতে বলতে ভুলে
গিয়েছিল । ইতিমধ্যে বিকাল চারটে বাজে,
পুরোহিত এসে ব্যাগ থেকে জিনিসপত্র মিলিয়ে মিলিয়ে দেখে নিলেন ।
তিনি বললেন, "যোগী ডুমুরের ডাল নেই, এটা ছাড়া
বিয়ে হবে কি করে, অগ্নিতে আহুতি দেওয়ার জন্য এটা তো অবশ্যই চাই” ।
বরযাত্রী আর কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বে, ছেলেরা কেউ
নেই । যোগী ডুমুরের গাছ অবশ্য একটু দূরেই আছে, তাদের পাড়ায় যে বড় দীঘি আছে তার
পাড়েই একটা যোগী ডুমুর গাছ সুরেশ জানে । কাজেই সেখান থেকে সে নিয়ে আসতে পারবে
। একটা কাটারি হাতে, পাশের বাড়ির পল্টুকে নিয়ে সে চলল যোগী ডুমুরের সন্ধানে । পলটুর বয়স ১০ বছর হবে, সে অনুরাধার কাছে
প্রাইভেট টিউশন পড়ে । অনুরাধার বাবাকে জেঠু বলে ডাকে ।
গাছের নিচের গিয়ে সুরেশ দেখল নিচ থেকে ভাঙার মতো ডাল
নেই । নিচ থেকে দাঁড়িয়ে ডাল পারা যাবেনা, গাছে উঠতেই হবে ।
সে পল্টুকে বলল, “ তুই নিচে দাঁড়া, আমি ওপরে উঠে ডাল
ভেঙে দিচ্ছি । তুই নিচ থেকে কুড়িয়ে নিবি”
।
গাছের মোটা গুঁড়ি বেয়ে একটা ডালে উঠল ।
তারপর এক হাতে কাটারী, অন্য হাতে
একটা ডাল ধরার জন্য এক পা তুলে অন্য ডালে যেই দিতে যাবে অমনি হাত ফসকে সোজা নিচে পড়ল। নিচে শক্ত এঁটেল মাটি, বৃষ্টি
নেই, তাই ফুটিফাটা হয়ে গেছে। মাথার পিছনের দিকটা একটা ইট এর উপর পড়েছিল, আর
সঙ্গে সঙ্গে সুরেশ অজ্ঞান হয়ে যায় । একে সারা দিন উপোষ, তার ওপর সুরেশের লো
প্রেসার ।
হঠাৎ এইরকম একটা পরিস্থিতিতে পল্টু ভয় পেয়ে যায় ।
দু'বার ডাকে, “ জেঠু জেঠু” । কিন্তু কোন
সাড়া পায় না, তারপর ভয়ে সে বাড়ির দিকে ছোটে । বাড়িতে গিয়ে তার বাবাকে পুরো ঘটনাটি বলে,
অনুরাধার মামা তখন তাদের বাড়িতে কিছু কাজের জন্য এসেছিল । তাড়াতাড়ি তাকে সঙ্গে
নিয়ে গিয়ে পল্টুর বাবা গাছের তলায় এসে দেখল সুরেশ গাছের নিচে পড়ে আছে । এক
হাতে কাটারী, আর এক হাতে ভাঙা ডাল, পা দুটো ভাজ করা, মাথাটি একটা ইটের উপরে তাতে
রক্তের দাগ, চোখ স্থির হয়ে আছে, নাক
দিয়ে রক্ত পড়ছে । তাড়াতাড়ি ধরাধরি করে ওদের বাড়িতে নিয়ে গেল, পরে ডাক্তার
এসে জানিয়েছিল মাথার পিছনে আঘাত লাগার জন্য রক্তক্ষরণ হয় আর তাতেই তিনি মারা যান
। সারাদিন নির্জলা উপবাস থাকার জন্য তার রক্তচাপ কমে যায় এবং তাই যখন একটা ডাল
থেকে অন্য ডালে যেতে হয় তখনই তার মাথা ঘুরে যায় এবং হাত ফস্কে নিচে পড়ে যায় ।
ওদিকে বরযাত্রী এসেছে, বিয়ের আয়োজন শুরু হয়ে গেছে ।
এমতাবস্থায় এই কথা পন্ডিতমশাইকে জানালে বিয়ে এক্ষুনি বন্ধ করে দেবে । অনুরাধার মামা পল্টুকে দিয়ে মিনতিকে এদের
বাড়িতে ডেকে পাঠিয়েছে । মিনতি এসে দেখে তো কান্নায় ভেঙে পড়ল । অনেক কষ্টে তার
কান্না থামিয়ে অনুরাধার মামা স্থির করলো যে কোনোভাবেই বিয়েটা আগে দিয়ে দেওয়া
দরকার, তারপর মৃত্যুসংবাদ প্রকাশ করবে
। কারন লগ্নভ্রষ্টা মেয়ের সংসারে আর
বিয়ে হয় না ।
এই খবরটা জানে একমাত্র পল্টু ও তার বাবা-মা, অনুরাধার মা
ও মামা । বিয়ের আয়োজন করতে করতে হঠাৎ পুরোহিত মশাই আবিষ্কার করল একটি যোগী
ডুমুরের ডাল তার ব্যাগের মধ্যে রয়ে গেছে, এতেই কাজ হয়ে যাবে । কিন্তু একটা সমস্যা, কন্যাসম্প্রদান করবে কে
। অবশেষে অনুরাধার মামা কন্যাসম্প্রদান
করতে সম্মত হলো ।
তাই দেখে অনুরাধা জিজ্ঞেস করল, “ বাবা কোথায় ?”
তার মামা বলল, ”একটা জরুরী কাজে তাকে লক্ষীকান্তপুর যেতে
হয়েছে, তবে মনে হয় সে সকালেই চলে আসবে । “
কি কাজ, কার সঙ্গে গেছে, এইসব নানা প্রশ্ন অনুরাধা করতে
লাগল । অবশেষে কিছুটা বুঝিয়ে, কিছুটা ধমক দিয়ে, তাকে বিয়েতে রাজি করানো হলো ।
একমাত্র মিনতি শুধু আঁচলে মুখ ঢেকে কেঁদে যাচ্ছে । সবাই ভাবলো একমাত্র মেয়ের
বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, তাই কাঁদছে ।
কিন্তু সত্যি ঘটনাটি প্রকাশ হলো পরের দিন সকালে
আশীর্বাদের সময় । সকলের আশীর্বাদ হয়ে
যাবার পর ধান দূর্বা নিয়ে মিনতি যখন অনুরাধার মাথায় দিতে যাবে তখন আর সে নিজেকে
স্থির রাখতে পারলো না । অনুরাধাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল এবং বলেই ফেলল
তোর বাবা মারা গেছে ।
শুনেতো বাড়িসুদ্ধ লোক থ হয়ে গেল, বরযাত্রীরা সকলেই কাল চলে গিয়েছিল । শুধু বরের
দু-একজন বন্ধুবান্ধব ও রাধাকান্ত ছিলেন ।
রাধাকান্ত বললেন, ”কখন ? কিভাবে ?”
অনুরাধার মামা পুরো বিষয়টি ঘটনাটি বিবৃত করল ।
রাধাকান্ত বললেন, “কিন্তু আমরা যখন খাচ্ছিলাম তখন একবার
আমরা ওনাকে দেখলাম । আমাদের সঙ্গে এসে কথা বলছিলেন, আমাদের জিজ্ঞাসা করলেন
রান্নাবান্না কিরকম হয়েছে” ।
তার এই কথার সমর্থনে বরের এক বন্ধু বলল, “হ্যাঁ,
মেসোমশাই আমাদের কাছে এসেও জিজ্ঞেস করেছিলেন কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা । আমি তো চিনি, কারণ রজনীর সঙ্গে আমি পাত্রী
দেখতে এসেছিলাম আগে” ।
ওদিকে পুরোহিতমশাই বললেন, “আমি গত দু'মাস ধরে আমি কোন
বিয়ে বা পূজা-আচ্ছা করিনি অথচ আমার ব্যাগের মধ্যে যোগী ডুমুরের তাজা ডাল এলো কি
করে সেটাই আমি কাল থেকে ভেবে পাচ্ছি না”।
পাড়ার দু-একজন লোক অবশ্য মেয়ের দুর্ভাগ্য সম্বন্ধে
একটু কটাক্ষ করল এবং শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে যে অমঙ্গল হতে পারে সে সম্বন্ধেও বলল ।
কিন্তু রাধাকান্ত এসব কথার কোনো কর্ণপাত করলেন না ।
তিনি বললেন, "মানুষ নিজের ভাগ্য নিজেই তৈরি করতে
পারে । ভাগ্যের দোহাই দিয়ে নিষ্কর্মা হয়ে ঘরে বসে থাকার থেকে কর্ম করে যাওয়া
ভালো । আমি পুত্রবধূকে নিয়ে যাব” ।
বস্তুতপক্ষে রজনীকান্ত ও তার বন্ধুরা এইসব কথায় কোন আমল
দিল না । পরিশেষে সবার আশীর্বাদ হয়ে যাবার পর অনুরাধা স্বামীকে নিয়ে এলো
পল্টুদের বাড়ি । সেখানে বাবাকে
অন্তিমবারের মতো প্রণাম জানিয়ে সে শ্বশুরবাড়ি বিদায় নিল ।
এই ঘটনার পর আজ পাঁচ বছর কেটে গেছে । অনুরাধার একটি পুত্রসন্তান হয়েছে
এবং সে স্কুলের অ্যাসিস্ট্যান্ট হেডমাস্টার হয়েছে । সংসার জীবন ও কর্মজীবন সে সমান তালে সামলাচ্ছে।
ছবি - আন্তরজাল থেকে সংগৃহীত
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন