পিপাসা - রথীন্দ্রনাথ রায়



(১) 

রোহিত আঢ্য। ওর খুব একটা যে বড় স্বপ্ন ছিল, তা নয়। তবে বাবা মায়ের কষ্ট লাঘব করতে খুব সচেষ্ট ছিল সে। গ্রাম থেকে মানে একেবারে তৃণমূল স্তর থেকেই উঠে এসেছে। এলাকার কলেজ থেকে বি কম পাস করার পর বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম বি এ করেছে। বন্ধুরা বলেছিল, বি কম পাশ করে তেমন কিছু হবে না। তোকে আরও কিছু করতে হবে। সেই আরও কিছুর জন্য এম বি এ তে ভর্তি হওয়া। এর জন্য ওকে দু'বেলা টিউশনি পড়াতে হতো। তারপর এমবিএর ক্লাসে আসতে পারতো। তারও পর ছিল রাত জেগে পড়াশোনা। ফলও ভালোই হয়েছিল। এমবিএ তে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। খুব আনন্দ হল তার। কিন্তু তেমনভাবে প্রকাশ করল না। যেন কিছুই হয়নি। তবে বাড়ি ফিরে বাবা মাকে প্রনাম করে আশির্বাদ নিয়েছিল। এর আগে কয়েকটা কর্পোরেট সংস্থায় চাকরির জন্য আবেদনও করেছিল। কিন্তু সেখান থেকে তেমন কোনও রেসপন্স আসেনি। তাই আবার নতুন করে আবেদন করতে মনস্থির করল। কিন্তু ঠিক সেই সময়েই ওর মোবাইলে রিংটোন বেজে উঠলো। ডিসপ্লেতে দেখল ডিপার্টমেন্টাল হেড সুমন্তবাবু --

-- স্যার, ভালো আছেন ?

-- হাঁ, আছি। কালই মুম্বাইয়ের একটি সংস্থা ক্যাম্পাস ইন্টারভিউ নিতে আসছে। তুমি চলে এসো।

-- স্যার ?

-- ঠিক দু'টোর মধ্যে। এখন রাখছি, কাল কথা হবে।

রোহিত নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছেনা। স্যার নিজে ডাকছেন! তাছাড়া ইতিপূর্বে ক্যাম্পাস ইন্টারভিউয়ে সে যায়নি। কেমন হবে ব্যাপারটা কে জানে! যদিও স্যার তার পাশে থাকবেন। তবু একটা আশঙ্কার দোলাচল থেকেই যায়। ওইসব সংস্থায় ওয়ার্ক কালচার কেমন, সে জানেনা। তবে কর্পোরেট কালচার নিয়ে সে কিছু পড়াশোনা করেছে এবং শুনেছেও কিছু। ওদের সবকিছুই নাকি কেতাদুরস্ত। ঝাঁ চকচকে পোশাক পরিচ্ছদ, চলন বলন সবকিছুই।

আগামীকাল ইন্টারভিউ। রাতটুকু সময়। তার জানার ব্যাপারে সে একশো শতাংশ আত্মবিশ্বাসী। কিন্তু সাজপোশাক এবং বাচনভঙ্গি নিয়ে তার একটু খুঁতখুঁতুনি আছে। যদিও সে ব্যাপারে স্পোকেন ইংলিশের ক্লাসে নিজেকে তৈরি করে নিয়েছে। তবু শেষপর্যন্ত কি হবে কেজানে! কাল ঠিক দু'টোর মধ্যে। তাহলে রাতটুকু মাত্র সময়। মাকে বলল, কাল একবার বর্ধমান যেতে হবে।

-- ক'টায় যেতে হবে ?

-- বাড়ি থেকে ন'টা নাগাদ বেরোলেই চলবে।

-- তাহলে সকাল সকাল রান্না করে দেব ?

-- না মা, ইউনিভার্সিটির ক্যান্টিনেই খেয়ে নেব। জানো মা, এটা যদি হয়ে যায় তাহলে তোমাদের আর কষ্ট পেতে হবেনা।

-- আমাদের কষ্টের কথা ভাবিনা, তুই নিজের পায়ে দাঁড়ালেই আমরা খুশি।

মা রান্নার কাজে চলে গেলেন। যেন সদা ব্যস্ত। একটুও কথা বলার সময় নেই।

পরদিন যথা সময়ে ক্যাম্পাসে পৌঁছাল রোহিত। স্যার যেন ওর জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। আরও অনেকেই এসেছে। তবু স্যার যেন ওকেই খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। ও যেতেই আশ্বস্ত হয়ে বললেন, যাক তুমি এসে গেছো! আমি খুব খুশি। আর তুমি সিলেক্ট হলে আমাদের ডিপার্টমেন্টেরই সুনাম হবে। ব্যাপারটা মাথায় রেখো।

ব্যাপারটা মাথায় রেখেছিল রোহিত। ওর সি ভি দেখে এবং ওর সঙ্গে আলোচনা করে খুশি হল মুম্বাইয়ের সংস্থাটি। ওর হাতে নিয়োগপত্র তুলে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, কবে জয়েন করতে পারবেন?

-- যখন বলবেন ?

-- ঠিক আছে। আমরা আপনাকে নেক্সট্ উইকে কোম্পানি ডিটেইলস আ্যন্ড প্লেনের টিকিট পাঠিয়ে দেব।

-- থ্যাঙ্ক ইউ।

এবারও তার আনন্দ হল বটে, কিন্তু প্রকাশ করলনা। বন্ধুরা বলে, ও নাকি বড্ড বেশি ইন্ট্রোভার্ট। উচ্ছাসে ভেসে যাওয়া ওর স্বভাব নয়।

কয়েকদিন পরেই একটা পার্সেল এল ওর বাড়িতে। কোম্পানি ডিটেইলস এবং প্লেনের টিকিট। আগামীকালই যেতে হবে।

না, আর কোনও কিন্তু নয়। ও তো চেয়েছিল যা হোক একটা কিছু। কিন্তু এ তো যা হোক একটা কিছু নয়। দ্য এশিয়ান -- একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এদের সাম্রাজ্য। চাকরিও হবে, আবার ঘুরে ঘুরে দেশ দেখাও হবে। মুম্বাইয়ের জুহুতে শ্রীরাম হাইটসের ছাপ্পান্ন তলায় এদের অফিস। তার মানে আকাশের সাথে হবে তার বন্ধুত্ব। সুতরাং আর পিছিয়ে থাকা নয়।

দুপুর বারোটায় ওর ফ্লাইট। সুতরাং বাড়ি থেকে ওকে বেশ সকাল সকাল বেরোতে হল। একটা টেনশন ছিলই। কাজটা কেমন কাজ, কিছুই জানে না সে। সম্পূর্ণ অপরিচিত। নানারকম ভালোমন্দ ভাবনায় ঠিকমতো ঘুমাতে পারেনি সে। ইতিমধ্যে নিজের ব্যাগটা নিজেই গুছিয়ে নিয়েছে। এই ভোরে বাবা মা দু'জনেই উঠে পড়েছে। রোহিত বেরোবার সময় বলল, তোমরা কিচ্ছু ভেবো না, আমি নিয়মিত তোমাদের ফোন করব।

প্রনাম করে উঠে দাঁড়াল সে।

বাবা বললেন, তুমি ভালো থাকলেই আমরা ভালো থাকব।

ব্যাগটা বাবার হাত থেকে নিল রোহিত। এ পর্যন্ত তো আমার ভার তুমিই বহন করেছ। এবার আমাকে সুযোগ দাও।

-- তাই বুঝি! ছেলে আমার কতো বড়ো হয়ে গেছে!

মা ওর চিবুকে হাত দিয়ে বললেন, ভালো থাকিস বাবা।

বেরিয়ে পড়ল রোহিত। কিন্তু বর্ধমান স্টেশনে এসে সে আশ্চর্য হল। সায়ন্তিকা। সায়ন্তিকা রক্ষিত। ওকে তো সে মুম্বাই যাওয়া নিয়ে কিছু বলেনি! তাহলে ও জানল কেমন করে! এটা টেলিপ্যাথি না মনোপ্যাথি কেজানে!

সায়ন্তিকা ওর কাছে এসে বলল, তুই লুকিয়ে লুকিয়ে মুম্বাই যেতে চেয়েছিলি। ভেবেছিলি তোকে সি অফ করার কেউ নেই?

-- না রে, সেরকম কিছু ভাবিনি। ভেবেছিলাম মুম্বাই পৌঁছে তোকে ফোন করব। তারপর ওখানে সেটল হয়ে তোদের বাড়ি আসব।

-- ভালো খবরটা আমাকে জানাতে পারিসনি, আর সত্যি আমি জেনে ফেললাম! এটা ভেবেই আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছিস? আসলে তোর আমার সম্পর্কটা বাহ্যিক নয়, আন্তরিক। রাত্রে একটা স্বপ্ন দেখলাম, তুই মুম্বাই চলেছিস আর তোকে আমি সি অফ করতে স্টেশনে এসেছি ।

রোহিত ওর চোখদু'টোর দিকে চেয়ে থাকে। ওর চোখের গভীরে সে নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পায়। বলে, কিছু মনে করিস না। আমি তোর ছিলাম, আছি, থাকব।

-- ঠিক আছে বাবা, ঠিক আছে। শোন, তোর ট্রেন ক'টায়?

-- আটটা কুড়িতে।

-- বেশ, এই খাবারটা রেখে দে। সকালেই বানিয়েছি।

-- তুই?

-- হ্যাঁ। কেন, আমি পারি না নাকি ?

-- পারিস। তবে --

-- তবে?

-- বলব না।

-- তুই না একইরকম আছিস। খাবি কিন্তু।

-- নিশ্চয়ই। তুই নিজের হাতে বানিয়েছিস, আর আমি খাবো না সে কি হয় নাকি?

খাবারটা ব্যাগে রেখে দিয়ে ধীরে ধীরে প্লাটফর্মের দিকে পা বাড়ায় রোহিত। সায়ন্তিকা হাত নাড়তে নাড়তে বলে, সাবধানে থাকিস।

 

(২)

 

ছত্রপতি শিবাজী টার্মিনালে পৌঁছে রিসেপশনে এল রোহিত। উদ্দেশ্য সংস্থার তরফে যদি কেউ থাকে তাহলে তার পক্ষে অফিসে পৌঁছাতে অসুবিধে হবে না। কিছুক্ষণ এদিক ওদিক তাকাতেই দেখল দ্য এশিয়ানের ব্যাজ এবং টুপি পড়ে এক ভদ্রলোক ওর দিকেই এগিয়ে আসছে। ভদ্রলোক কাছে এসে বলল, এক্সকিউজ মি, আর ইউ রোহিত আঢ্য? ফ্রম ওয়েষ্ট বেঙ্গল?

-- ইয়া। ইউ?

-- রাও গনেশন, দ্য এশিয়ান। আপ হিন্দি সমঝতে হ্যায়?

-- থোড়া। লেকিন বোলনেমে কভী কভী দিক্কত আতা হ্যায়।

-- জরুরৎ মে দিক্কৎ নেহি রহেগা। ম্যায় তেলেগু। অন্ধ্রকা আদমী মগর অব আসানী সে হিন্দি বোল শক্তা হ্যায়।

লোকটাকে ভালো বলেই মনে হল রোহিতের। বেশ টকেটিভ মানে কথা বলতে ভালোবাসে। তার মতো মুখচোরা নয়। ওদের গাড়িটা মসৃণ গতিতে এগিয়ে চলেছে। ভেতরটা বেশ ঠাণ্ডা। তার মানে এসি আছে নিশ্চয়ই। দ্য এশিয়ান -- একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি বলে কথা। একটা ট্রাফিক সিগন্যালে কয়েক মিনিট দাঁড়িয়ে রইল গাড়িটা। তারপর আবার এগিয়ে চলল। দু'পাশে মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিং। কতগুলো ফ্লোর হবে কেজানে! দু'পাশে অজস্র গাড়ি। তার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলেছে গাড়িটা।

মাঝে গনেশন একবার বলল, আপ বাঙালি হ্যায় না ?

-- হাঁ।

-- হমারা বস্ মীন সিইও ভি বাঙালি।

-- আদমী ?

-- নেহি। আউরৎ। লেকিন বহোৎ মেজাজী। ম্যায় তো ফোর্থ ক্লাস হুঁ। ইসলিয়ে পাশ নেহি গ্যয়া। দূর সে দেখা।

বলতে বলতেই গাড়িটা জুহুর মেরিন ড্রাইভের ওপর দিয়ে ছুটতে লাগল। রাস্তাটা মসৃণ, মানে কোথাও খানাখন্দ বলতে কিছু নেই। গাড়ি আশি - একশোতে ছুটলেও কোনও ঝাঁকুনি লাগছে না। ডানদিকে নীল আরব সাগর আর তার বেলাভূমিতে অজস্র রঙিন মানুষের ভিড়। কেউ বলে মুম্বাই এক আজব নগরী। বেচারা বচ্চন ( অমিতাভ ) কলকাতায় পাত্তা করতে না পেরে মুম্বাইতে এসে বিরাট এক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছেন।‌

স্বপ্ন সে দেখে। কর্পোরেট জগতের। সুন্দর পিচাইয়া কি, তার থেকেও ওপরে উঠতে হবে তাকে। গাড়িটা একটা বড় বিল্ডিং এর সামনে এসে থামল। দু'জন সিকিউরিটি গার্ড লোহার গেট খুলে দিয়ে সরে দাঁড়াল।

গনেশন সিকিউরিটির খাতায় লেখালেখি করে তার কাছে ফিরে এসে ফিরে এসে বলল, চলিয়ে সাহাব।

-- সাহাব নেহি, রোহিত।

-- ম্যায় তো ফোর্থ ক্লাস হুঁ !

-- ওসব ছোড়িয়ে। মিত্র শোচিয়ে।

-- ঠিক হ্যায় --

গাড়ি থেকে নেমে বেশ বড় একটা লাউঞ্জ পার হয়ে ওরা লিফটের সামনে এসে থামল। লিফট এখন টপ ফ্লোরে আছে, মানে একশো দুইয়ে -- তার অর্থ এই শ্রীরাম হাইটসে একশো দুটি ফ্লোর আছে। আর ওদের অফিস ছাপ্পান্ন তলায়।

লিফট গ্রাউন্ডে এসে থামল। বেশ কয়েকজন কথা বলতে বলতে বেরিয়ে এল লিফট থেকে। ওরা কোন ভাষায় কথা বলছে কেজানে!

গনেশন লিফ্টম্যানকে বলল, ফিফটি সিক্স।

একটার পর একটা ফ্লোর পার হয়ে চলল লিফট। রোহিত কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে। স্বপ্নকে ছুঁতে পারার একটা রোমান্টিকতা এবং ভয় দু'টোই একসঙ্গে তার বুকের ভেতর ধুকপুকুনি শুরু করেছে।

এইচ আর ও হেমন্ত সাকসেনা রোহিতের কাগজপত্র দেখে নিয়ে বললেন, শোচিয়ে মত্। নিয়োগপত্র মিল গিয়া, জয়েনিংভি হো গিয়া। অব আপকা বিশ্রাম কি জরুরৎ হ্যায়।

কলিংবেল টিপতেই পিয়ন টাইপের একজন লোক এসে হাজির হল। হেমন্তবাবু তাকে বললেন, সাহাবকো হমারে রেসিডেন্সমে লে যাও। রুম নাম্বার সেভেনটিন সাহাবকা রেসিডেন্স হ্যায়। চাবি লো আউর সাহাবকো সবকুছ সমঝা দেনা।

লোকটা চাবি নিয়ে রোহিতকে বলল, আইয়ে জী, ম্যায় হুঁ রাজ শ্রীনিবাসন, কেরলসে আয়া।

-- ম্যায় রোহিত আঢ্য। পশ্চিম বঙ্গালসে।

হাতজোড় করে নমস্কার করল রোহিত। লোকটা হয়তো ভুলেই গিয়েছিল। তাড়াতাড়ি হাতদু'টোকে বুকের কাছে এনে বলল, নমস্তে সাহাবজী।

বেশ কয়েকটা ঘর পার হয়ে একটু ফাঁকা মতো জায়গায় দাঁড়াল ওরা। এখান থেকে সমুদ্রটাকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। আদিগন্ত নীল জলরাশি। বিকেলের সোনালী রোদ যেন মায়াবী আলোয় রাঙিয়ে দিয়েছে নীল সমুদ্রকে। পাশেই একটা ক্যান্টিন। কিছু স্ন্যাকস্, চা এবং লস্যির ব্যবস্থা রয়েছে বলে মনে হল।

শ্রীনিবাসন রোহিতকে বলল, লস্যি লিজিয়ে না সাহাব, মুম্বাইকা লস্যি বহুত মিঠা হোতা হ্যায়।

-- ঠিক হ্যায়, লিজিয়ে। লেকিন খর্চ ম্যায় দুঙ্গা।

-- ও সাহাব, আপকো খাতিরদারি করনেকা মওকাভি নেহি দেঙ্গে? বাঙালি লোগ বহুৎ ঈমানদার হোতা হ্যায় য্যায়সে বিবেকানন্দ, সুভাষ বোস কি মাফিক।

বিবেকানন্দ, সুভাষ -- বাঙালির আইকন। কিন্তু আজ দুনিয়ার সেরা ধান্দাবাজ, দুর্নীতিগ্রস্তরা হল নব্য বাংলার আইকন।

শ্রীনিবাসন দু'গ্লাস লস্যি নিয়ে এল। সমুদ্রের দিকে চেয়ে রয়েছে রোহিত। বেশ ভালো লাগছে ওর। শ্রীনিবাসন লোকটাও বেশ। কতো তাড়াতাড়ি একজন অপরিচিতকেও বন্ধু বানিয়ে নিতে পারে।

 

(৩)

 

শ্রীনিবাসন ওকে ঘরে পৌঁছে দিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে কোথায় কি আছে সেটাও বুঝিয়ে দিল। রোহিত দেখল ব্যবস্থা বেশ উত্তম। একটা বেডরুম, ড্রয়িং, কিচেন, আ্যটাচড্ ওয়াশরুম -- সবই আছে। সমুদ্রের দিকে খোলা বারান্দা। কাকে ধন্যবাদ দেবে? ভাগ্যকে না দ্য এশিয়ানকে? অবশ্য তার ভাবনাটা ভেবেছিলেন সুমন্তবাবু। সুযোগটা এনে দিয়েছিলেন তিনিই। একটু ফ্রেশ হওয়ার পরে স্যারকে ফোন করে প্রণাম জানিয়ে বলল, স্যার আপনি যদি এটাকে আমার উন্নতির প্রথম ধাপ বলেন তো এর কারিগর আপনিই। আপনার জন্যই এখানে আসতে পেরেছি।

-- ব্রাভো, মাই বয়। তোমাকে আরও ওপরে উঠতে হবে। আরও, আরও --

অনেককিছু বললেন স্যার। স্যারের সঙ্গে কথা শেষ করে বাবা মাকেও ফোনে প্রণাম ও কুশল জানাল সে।

সবশেষে সায়ন্তিকা। ও ফোন ধরেই বলল, যাক বাবা মনে পড়েছে।

-- হাঁ পড়েছে। কিন্তু --

-- কিন্তু আবার কি? তুই না বড্ড ভীতু।

-- না রে, তা নয়। আসলে -- একা এই এতো দূরে আরব সাগরের তীরে আমি খুঁজে ফিরি যারে --

-- এই সাবধান, আর কাউকে খুঁজছিস না তো ?

-- যাহ, তুই না বড্ড বেরসিক। তোর সঙ্গে আর কথাই বলব না।

কলটা কেটে দিল রোহিত।

এবার ফোন করল সায়ন্তিকা। বলল, প্লীজ রাগ করিস না। জানিসই তো, আমি ঠিকঠাক কথা বলতে পারিনা।

-- জানি বলেই রাগ করিনি। এখন রাখি। সারাদিন খুব ধকল গেছে। এখন স্নান করতে হবে।

-- বেশ রাখছি। তুই ভালো থাক।

আর কোনও কথা হল না। স্নান সেরে বুঝতে পারল এবার খিদে পেয়েছে। ফুড সাপ্লাইয়ের চেইনের একটা নাম্বার দিয়েছিল শ্রীনিবাসন। সেটায় ফোন করতেই ওরা খাবার দিয়ে গেল। বেশ সুস্বাদু। তবে ঘরানাটা কোন্ প্রদেশের মনে করতে পারল না।

পরদিন ঠিক দশটাতেই ও অফিসে এসে আ্যডমিনিস্ট্রেশনে আসল। অফিসার জগন্নাথ সুব্রহ্মনম যেন প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। বললেন, আপ রোহিত আঢ্য ?

-- ইয়া।

-- আপকো রেগুলার ইহা আকে রেজিস্টারমে সিগনেচার করনে পড়েগা। উসকে বাদ আপকা প্ল্যানিং সেকসনমে -- আপকা সিনিয়র ভূপেন্দ্রজী আপকো হেল্প করেগা। কোঈ দিক্কত হোনেসে মুঝে ফোন করনা।

ফোন নাম্বারটা নিল রোহিত।

অফিসের সাজানো গোছানো ঝাঁ চকচকে পরিবেশ বেশ ভালো লাগে তার। বেশ কয়েকটা সেকশন পার হয়ে প্ল্যানিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সেকশনে এল সে। সিনিয়র অফিসার ভূপেন্দ্রবাবুর সঙ্গে আলাপ হতেই বুঝতে পারল অমায়িক ভদ্রলোক তিনি। বিহারের ভাগলপুরের বাসিন্দা। কিন্তু বিয়ে করেছেন মালদা জেলার একটি মেয়েকে। মেয়েটি ট্রেনে ভিক্ষে করত। পুলিশ এবং স্টেশনের হকারদের দ্বারা অত্যাচারিত হত। যাওয়া আসার পথে একদিন বলেছিলেন, "তুই যদি একটা সম্মানজনক কাজ পাস, করবি?" মেয়েটি রাজী হয়েছিল। এক প্রাইভেট স্কুলে সাফাইয়ের কাজ। লেখাপড়া শেখার ইচ্ছেও হয়েছিল তার। শেষপর্যন্ত ভুপেন্দ্রবাবুই ব্যবস্থা করলেন। তারপর একদিন দ্য এশিয়ানে চাকরি পেলেন। মেয়েটিকে নিয়ে পড়লেন আতান্তরে। কি করা যায়? অগত্যা মেয়েটিকে বললেন, তুই বিয়ে করবি?

-- আপনি বললে করব।

-- কেন তোর নিজের ইচ্ছে অনিচ্ছে বলে কিছু নেই?

-- না। আপনি সাহায্য না করলে এতদিনে আমাকে শিয়াল কুকুরে ছিঁড়ে খেয়ে নিত। তাই আপনি যা বলবেন --

মেয়েটি জানতে চায়নি কাকে বিয়ে করতে হবে। কিন্তু মন্দিরে গিয়ে বরকে দেখে আশ্চর্য হয়েছিল। ওঁর পায়ে পড়ে কেঁদে বলেছিল, আপনি মানুষ না, ভগবান।

সে একটা গল্প বটে। তবে মানুষটা ভালো সেটা সে অনেকের মুখেই শুনেছে। অফিসের যে কেউ বিপদে পড়লেই ভূপেনদাদা হাজির।

বেশ কয়েকদিন হল সে কাজে যোগ দিয়েছে।‌‌ কিন্তু এখনো তার বস্ সিইও'র সঙ্গে দেখা হয়নি। নাম শুনেছে। ওনার নাম গার্গী বোস। বাঙালি। তবে মিস্ না এসএমটি জানে না। কারণ নামের আগে তিনি কিছু লেখেন না। অফিস কলিগদের মুখে শুনেছে, বেশ সুন্দরী এবং মেজাজী। কাজের ব্যাপারে তেমন তাড়াহুড়ো নেই। তবে ভুল হলে ছেড়ে কথা বলেন না।

সেদিন একটা মেসেজ পেল রোহিত। চেয়ারম্যান এবং সিইও ঠিক দু'টোর সময় ফিনান্স অ্যান্ড প্ল্যানিং নিয়ে কিছু বলতে চান। তাই ওই দুই সেকসনের অফিসারদের দু'টোর মধ্যে মিটিং হলে উপস্থিত থাকতে হবে।

রোহিত ভাবল, যাক এবার দেখা হবে। তবে এই ক'দিনের মধ্যে একটা প্রজেক্টের ব্যাপারে কিছু আউটলাইন তৈরি করেছে। যদি সে ব্যাপারে গ্রীণ সিগন্যাল পাওয়া যায় তবেই এগোবে সে। এ ব্যাপারটা ভূপন্দ্রবাবুকে বলা যেত। কিন্তু ব্যাপারটা হল, প্রেজেন্টেশনের ওপরে এর সাফল্য নির্ভর করছে।

ঠিক দু'টোতেই ওর প্রজেক্ট ফাইল এবং একটা পেনড্রাইভ নিয়ে মিটিং হলে এল রোহিত। সিইও গার্গী বোস যে বাঙালি তার কথাবার্তায় তা বোঝার উপায় নেই। হিন্দি এবং ইংরেজিতে চোস্ত, এমনকি অন্যান্য ভাষাতেও। সুন্দরী এবং স্মার্ট। পোশাক পরিচ্ছদেও। তবে বয়স বলা যাবে না। আলাপ পরিচয়ের পরে সিইও রোহিতকে বললেন, আপনি বাঙালি এবং আপনি বলছেন প্রজেক্টটা সাকসেসফুল হবে?

-- হোয়াই নট? কেন হবে না?

-- আসলে এতোটা আত্মবিশ্বাস সাধারণ বাঙালিদের মধ্যে দেখা যায় না। ঠিক আছে, ইউ মে গো ফরওয়ার্ড। আপনি এগিয়ে চলুন। আমি একটা অ্যাপ্রুভ অর্ডার পাঠিয়ে দেব।

 

(৪)

 

পরদিন অফিসে এসেই অ্যাপ্রুভ অর্ডারটা পেয়ে গেল রোহিত। ওর প্রজেক্টের বিষয় দ্য এশিয়ানের সমস্ত প্রডাক্টগুলোকে একই ছাতার তলায় রেখে পাবলিসিটির ব্যবস্থা করা। তার জন্য একটা গাইড লাইন তৈরি করা। বেশ কয়েকজনকে নিয়ে সে একটা টিম তৈরি করল। আর সমস্ত ব্যাপারটা তার মস্তিষ্কপ্রসূত বলে অন্যান্যরা তাকেই টিমলিডার হতে বলল। সে যে নতুন কিছু একটা করতে চায়, তার কোম্পানিকে সেরাটা দিতে চায় এটা সে বোঝাতে পেরেছে।

সেদিন দুপুরে বস্ তথা সিইও গার্গী বোসের চেম্বার থেকে একটা কল এল। এক্ষুনি যেতে হবে। কি ব্যাপার বুঝতে পারল না রোহিত। যেতেই হবে। বস্ বলে কথা। রেগে গেলে যদি যদি চাকরি থেকে নট করে দেয়!

কি বলবে গার্গী বোস!

ওর চেম্বারে আসতেই ডোর কিপার বলল, আপ অন্দরমে যাইয়ে। আপকো জরুরী এত্তেলা দিয়া গ্যায়া হ্যায়।

জরুরী এত্তেলা ? কিন্তু কেন ?

বুকটা কেমন ঢিপ ঢিপ করতে লাগল। দরজা ঠেলে বলল, মে আই কাম ইন ?

-- আইয়ে। ম্যায় আপকে ইন্তেজারমে থী। ও হো, আপনি তো বাঙালি। আমি আপনার জন্যই অপেক্ষায় ছিলাম। বসুন।

রোহিত বসল। বেশ আরামদায়ক ব্যবস্থা। পায়ের তলায় নরম গালিচা। ঘরে একটা নরম আলো। আর তার মাঝে সুন্দরী বস্। কি বলবেন ?

বসার পরেও বুকের মধ্যে ঢিপঢিপানি রয়ে গেছে। স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলল, কিন্তু কারণটা এখনো বলেননি।

-- কোন্ কারণটা ? ও হো ! আপনাকে ডেকেছি কেন ? কারণ আছে। তবে সেটা এখনি বলা যাবে না। লাঞ্চ করেছেন ?

-- না। দু'টোর সময় ক্যান্টিনে গিয়ে করে নেব।

-- দরকার নেই। আমি লাঞ্চ আনিয়ে রেখেছি।

-- না মানে --

-- না, মানের -- দরকার নেই। আসুন, বসের সাথে লাঞ্চ করতে আপত্তি আছে নাকি ?

-- না, তা নেই।

গার্গী বোস কলিংবেল টিপে ডোর কিপারকে বললেন, এখন তিনি লাঞ্চ করবেন। কেউ যেন না আসে।

সিইও'র চেম্বারের সঙ্গেই একটা রেস্ট রুম। সেখানে ছোট একটা বেড, চেয়ার, টেবল, এবং প্রসাধনের সব ব্যবস্থাই ছিল।

-- বসুন। আপনি এখানে চাকরি করতে এসেছেন, আমিও তাই। আপনি চান সেরাটা দিতে, আমিও তাই। সেই সঙ্গে বস্ আর অধস্তনের সীমারেখাটাও আমি ভেঙে ফেলতে চাই। তাছাড়া আপনিও বাঙালি, আমিও বাঙালি। সুতরাং -- খাবারটা দু'টো প্লেটে সাজিয়ে নিল গার্গী বোস। ভাত, ডাল, পাঁচমিশালি সবজি এবং মাছের কালিয়া। গন্ধটাও বেশ। বিশুদ্ধ বাঙালিখানা বলেই মনে হচ্ছে। প্রায় দিন পনের হল এসেছে এখানে। হোটেল ক্যান্টিনের রান্নাও যেন একঘেয়ে। নিজেকে এখন ভাগ্যবান বলে মনে হল তার। সুন্দরী বস্ তাকে তাঁর নিজস্ব চেম্বারে ডেকে এনে লাঞ্চ করাচ্ছেন ; একি কম সৌভাগ্যের ব্যাপার ? কিন্তু মনের কোণে একটা সন্দেহও উঁকি দিচ্ছে। তাকে এতো তোয়াজ কেন ? কোনও দুরভিসন্ধি নেই তো ? আবার পরক্ষণেই মনে হয়, দূর , তা কেন হবে । তার প্রজেক্টটা বসের ভালো লেগেছে তাই।

খাওয়ার শেষে ওই বিশেষ ঘর থেকে চলে আসছিল রোহিত। গার্গী বোসই বললেন, এখনো লাঞ্চ টাইম শেষ হয়নি। সুতরাং আপনি রেস্ট নিতেই পারেন।

তবু একটু ইতস্তত করছিল সে। বসের সাথে এতখানি অন্তরঙ্গতাকে কি তার সহকর্মীরা ভালো চোখে দেখবে ? মানুষের বাঁকা দৃষ্টির ধার যে বেশি। জীবনটাকে কেটে ফালা ফালা করে দেয়।

আসলে কি জানেন --

বলতে বলতে নিজের মেকাপটা ঠিক করে নিচ্ছিল গার্গী -- আমি তো এখানে একা। কাজ করতে করতে মাঝে মাঝে খুব বোর ফিল করি। তখন নিজের ভাষাভাষী কাউকে পেলে অনেক কথা বলতে ইচ্ছে করে। তাই আপনাকে এতো তোয়াজ করছি।

-- কি যে বলেন, আমি এক অতি সাধারণ --

-- স্টপ ইট। সাধারণ ভাবলে চলবে না। নিজেকে একস্ট্রা অর্ডিনারি ভাবতে হবে। নিজের কাজ দিয়ে প্রমাণ করতে হবে আমি সাধারণ নই, অসাধারণ।

সামনে ফিরল গার্গী। হ্যাঁ, ওকে দেখে তাই মনে হয়। আর পাঁচটা সাধারণ মেয়ের মতো নয় সে। হয়তো বসিঙ করার জন্যই জন্ম ওর।

কিছুক্ষণ রেস্ট নেওয়ার পর নিজের ডেস্কে ফিরে এল সে। না, তার কলিগরা তার এই বেশ কিছুক্ষণের অনুপস্থিতির জন্য কোনও প্রশ্ন করল না। সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত। তার প্রজেক্টের ব্যাপারে টিমমেম্বারদের সঙ্গে আলোচনা করে নিয়েছে। তারা এখন নিজেদের মতো করে ভাববে। দু'দিন পরে সবাই মিলে একটা মিটিং করে সিদ্ধান্ত নেবে। এ পর্যন্তই ঠিক হয়ে আছে।

কিছুক্ষণ কম্পিউটারটা ঘাঁটাঘাঁটি করল। কয়েকজনের সঙ্গে অনলাইনে মিটিং করল। কিন্তু কাজটা যেন এগোল না। বারবার গার্গী বোসের সঙ্গে লাঞ্চ করাটা নিয়ে একটু এলোমেলো ভাবনা আসতে লাগল। কখনো মনে হল বস্ হয়তো স্টাফের সঙ্গে লাঞ্চ শেয়ার করতেই পারেন। কিন্তু এতখানি অন্তরঙ্গতা আশা করা যায় কি ? এমনকি তার পার্সোনাল রুমে বাইরের কাউকে ? কিন্তু বস্ তাকে মোটিভেট করার চেষ্টা করেছে। আজ হঠাৎ সায়ন্তিকার কথা মনে পড়ল।

 

(৫)

 

সায়ন্তিকা তাকে মোটিভেট করতে চায়নি। মোটিভেটেড হতে চেয়েছে। বসিঙ করতে চায়নি। তবু গার্গী বোসকে ভালো লাগছে তার। তাহলে সেকি সায়ন্তিকার কাছ থেকে দূরে চলে যাচ্ছে ?

ইতিমধ্যে অনেকখানি সন্ধ্যে হয়ে গেছিল। তবে অফিসের ভেতর থেকে সন্ধ্যে হয়েছে কি দিনের আলো আছে তা বোঝা যায়নি। প্রায় আটটা। কাজ করতে করতে সময়টা দেখতেও ভুলে গেছে সে। কেয়ারটেকার এসে মনে করিয়ে দিতেই বলল, হ্যাঁ তাইতো।

লিফট্ বেয়ে অফিসের বাইরে এল সে। না মুম্বাইয়ের রাস্তাঘাট দেখে কেউ বলবে না যে রাত্রি। এখানে মধ্যরাত্রিতেও শহর পুরোপুরি জেগে থাকে। উদ্দেশ্যহীন ভাবে ঘুরতে ঘুরতে জুহুর সমুদ্র সৈকতে এসে বসল। সামনে আদিগন্ত নীল সমুদ্র। তবে রাতের বেলায় সমুদ্রকে নীল বলে মনে হয় না। মুম্বাইয়ের এই এলাকায় দিন ও রাতের মধ্যে কোনও ফারাক থাকে না। নানারকমের মানুষ -- দেশী ও বিদেশী, সবাই সমুদ্রতীরে হাজির হয়েছে। নানারকমের মোটর চালিত নৌকায় সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তারা। আর মাঝসমুদ্র থেকে সাদা ফেনার মুকুট পড়ে এক একটা ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে তীরভূমিতে।

হঠাৎ মনে পড়ল বাবা মায়ের কথা। গত দু'দিন ভালো করে কথা বলা হয়নি ওদের সঙ্গে। আজ বলল। অনেক কথা। প্রথমে মায়ের সঙ্গে, পরে বাবার সঙ্গে। তবে ওর বিশেষ উৎকণ্ঠার কথা কাউকে বলল না। এমনকি সায়ন্তিকাকেও না। শুধু বলল, বেশ ভালো আছি।

মুম্বাইয়ের কয়েকটা ছবিও পাঠাল ওদের।

সায়ন্তিকা বলল, তুই ভালো থাকলেই আমার আনন্দ।

-- সত্যি বলছিস ?

-- সত্যি না তো কি ? তুই কি বিশেষ কিছু ভাবছিস ?

-- না তো। নতুন চাকরি। বুঝতেই পারছিস; এখনো অফিসের ব্যাপারস্যাপার ভালো করে বুঝে ওঠা সম্ভব হয়নি। সেজন্য একটু চাপে আছি -- এই আর কি !

-- বেশ আজ আর বকবক করব না। তুই আনন্দে থাক এবং ভালো থাক। এটাই ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি।

না, আর বেশি কথা হল না। মোবাইলটা অফ করতে গিয়ে দেখল, দশটা বেজে গেছে। তবে মুম্বাইয়ের ক্ষেত্রে এটা সন্ধ্যে রাত।

উঠে পড়ল সে। কিছুটা হাঁটতেই একটা বাজার পেল সে। সাবান, টুথপেস্ট এবং কিছু শুকনো খাবারের দরকার ছিল। সেগুলো নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে রেসিডেনসিয়াল আ্যপার্টমেন্টে এল রোহিত।

সিকিউরিটি গার্ড বলল, আপ পায়দলমে গ্যায়ে থে?

-- নেহি। অফিসকা কারমেই গ্যায়া থা। লেকিন ঘুমনেকে বাদ পায়দলমেই আ গ্যায়া।

গার্ডরা আর কিছু বলল না।

ঘরে এসে একটু ফ্রেশ হয়ে বসেছে এমন সময় কলিংবেলের টুং টুং আওয়াজ হল। খুলতেই দেখে ফুড ডেলিভারির লোক। লোকটা একগাল হেসে বলল, আপ ক্যায়সে হ্যায় সাব ? খানা আচ্ছা হ্যায় কেয়া ?

-- ঠিক হ্যায়। লেকিন নমক থোরা জাদা থা।

-- জাদা থা ? ম্যায় কুককো বতা দেঙ্গে। কালসে অ্যায়সা হোগা নেহি।

টাকা দিয়ে খাবারটা নিল রোহিত। না, আজ বেশ হয়েছে। ঘ্রাণেই বেশ বোঝা যাচ্ছে। খাওয়ার পরে বিছানায় শুয়ে যথারীতি সবাইকে ফোন করল। শেষে ঘুমাবার চেষ্টা করলেও সফল হল না। পায়ে পায়ে উঠে এল। ওদের বিল্ডিংটা শুধু মাত্র মেল রেসিডেন্টদের জন্যই। সবাই দ্য এশিয়ানেরই কর্মী। মোট বারোটা ফ্লোর রয়েছে। চারপাশের বিল্ডিংগুলোর থেকে এটাই কম ফ্লোরের। লিফট্ তখনও সচল ছিল। টপ ফ্লোরে উঠে এল রোহিত। সমুদ্রকেও এখান থেকে বেশ দেখা যায়। রাত্রি প্রায় বারোটা। তবু সমুদ্র সৈকতে তখনও লোকের ভিড় কম ছিল না।

হঠাৎই মোবাইলটা রিং হল। দেখল গার্গী বোস। বস্! সুতরাং ধরতেই হল।

-- হ্যালো, ম্যাডাম বলুন --

-- কি ব্যাপার, দুপুরের পর থেকে দেখা করেননি যে --

-- আসলে ওই প্রজেক্টের ব্যাপারে টিমমেম্বারদের সঙ্গে আলোচনায় ব্যস্ত ছিলাম।

-- খুব ভালো কথা। আপনার এই একাগ্রতা দেখে খুব ভালো লাগছে। একটা কথা, অফিসে আমি বস্ হলেও এমনিতে তো বন্ধু হতে পারি, নাকি ?

-- তা না হওয়ার কোনও কারণ নেই।

-- মুখে বলছেন। অথচ প্রয়োজনে আমাকে ভুলে যাচ্ছেন। নতুন স্টাফদের কোম্পানি থেকেই কিছু আ্যডভান্সের ব্যবস্থা করা হয়। কালই ফিনান্স সেকসনকে একটা নোট দেব।

-- না ম্যাডাম, এতোটা দরকার হবে না।

-- কোনো কথা নয়। কাল ডিউটি শেষে আমার সঙ্গে দেখা করবেন। গুডনাইট। ফোনটা কেটে দিল গার্গী বোস। কথা বলার সুযোগই দিল না।

রোহিত ভাবল, গার্গী বোস তার প্রতি এতটা দয়ালু কেন ? ম্যাডাম কি তার মার্কেটিং করা দেখেছে ? গার্গী বোস কি সব স্টাফের ব্যাপারেই এতোখানি খোঁজ খবর রাখেন? না, শুধু তার ব্যাপারেই ? এমনিতে ওনার সান্নিধ্য মন্দ লাগে না। কিন্তু বস্ বলে কথা। তার সঙ্গে অন্তরঙ্গতা ভালো দেখায় না। একটা সীমারেখা থাকা দরকার। কিন্তু উনি বন্ধুত্ব চান ?

 

(৬)

 

পরদিন কাজের মধ্যেই ডুবে রইল রোহিত। প্রজেক্টের আউটলাইন আগেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এখন সেটা কিভাবে প্রয়োগ করা হবে সেটাই টিম মেম্বারদের বোঝানোর চেষ্টা করছিল সে। মেম্বাররা নিজেরা কিছু ভেবেছিল বটে, তবে শেষ পর্যন্ত রোহিতের পরিকল্পনাকেই গ্রহণ করল। এখন এই পরিকল্পনাকে কিভাবে বাস্তবায়িত করা যাবে তারও রূপরেখা তৈরি করল। যদিও হাতে এখনও তিনদিন সময় আছে, তবু সে তাড়াতাড়িই শেষ করতে চাইল।

এসব করতে করতে কখন যে লাঞ্চ টাইম এসে গিয়েছিল তা বুঝতে পারেনি। সহকর্মীরা একে একে ক্যান্টিনে গিয়েছিল। কিন্তু কম্পিউটারের সামনে বসেই ছিল রোহিত। হঠাৎই গার্গী বোসের কথা মনে হল তার। বস্ তার প্রতি একটু বেশিই আগ্রহী। সেটা মন্দ নয়। কিন্তু আসল ব্যাপারটা হল সে সায়ন্তিকার জায়গায় আর কাউকে ভাবতে পারছে না সে। আবার কাজের সুবাদে বস্ এর সঙ্গে সম্পর্ক রাখাটাও জরুরী। পরিস্থিতিটা কোন্ দিকে যাবে কে জানে ?

যা হয় হবে ! দেখাই যাক। উঠতে যাবে, এমন সময় দেখে অফিসের অপর প্রান্ত থেকে হেঁটে আসছে গার্গী বোস। যারা তখনও ডেস্কে ছিল, তারা উঠে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানাল।

রোহিতের দিকে এগিয়ে এল গার্গী বোস। বলল, আপনি এখনো লাঞ্চে যাননি ?

-- এই উঠছিলাম -

-- আপনি তো কথা শুনবেন না। আসুন --

সহকর্মীদের উৎসুক চোখের সামনে দিয়েই বসের নিজস্ব কেবিনে গেল রোহিত। ইচ্ছে ছিল না, আবার প্রত্যাখ্যানও করতে পারল না।

সেদিনের লাঞ্চে ছিল আলু বিরিয়ানি এবং কষা মাংস। এখানেও যে এতো ভালো রান্না করা খাবার পাওয়া যায় সেটা ভাবতে পারেনি রোহিত। বেশ ভালো লাগলো তার। বস্ যখন নিজের থেকে এতো কিছু করছে তখন তা প্রত্যাখ্যান করা উচিত হবে না।

গার্গী বোস বলল, খেয়ে নিন।

একবার ওর দিকে চেয়ে দেখল রোহিত। ওকে বেশ সুন্দরী বলেই মনে হয়। সঙ্গে আধুনিকা। ব্লেজারের নিচে একটা ছোটখাটো টপ্। ফর্সা বুকের ভাঁজটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। না, ম্যাডামের শরীর দেখানোতে কোনও কুণ্ঠা আছে বলে মনে হল না।

খাওয়া শেষ হল রোহিতের। গার্গী বোস বললেন, আপনার কিন্তু এই পোশাক এখানে চলবে না। আজ আমার সঙ্গে কাজের শেষে আপনাকে বেরোতে হবে।

-- কিন্তু !

-- কোনও কিন্তু নয়। আই অ্যাম ইওর ফ্রেণ্ড অ্যান্ড আই লাভ ইউ।

শেষের কথাটা চার দেওয়ালের মধ্যে বারবার প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে আসতে লাগল ওর দুই কানে। বস্ তাকে ভালোবাসে! সামান্য একজন কর্মীকে ? এতো অসম্ভব পাওয়া ! রাজ্য এবং রাজকন্যা একসঙ্গে ! রোহিত স্তম্ভিত, মুগ্ধ। অনেক কিছু বলতে চাইছে সে । কিন্তু পারছে না। জিভটা বুঝি আড়ষ্ট হয়ে পড়েছে।

নিজের ডেস্কে এল সে। টিম মেম্বাররা এখনো আসেনি। গার্গী বোসের কথাটা এখনো তার কানের কাছে বেজে চলেছে। না, এর আগে এতখানি অন্তরঙ্গতার সঙ্গে কেউ তাকে কাছে টেনে নেয়নি। কি আছে তার মধ্যে, যার জন্য এক সুন্দরী, শিক্ষিতা, স্মার্ট, উচ্চপদস্থ কর্মরতার তাকে ভালো লাগলো ?

সময়টা কখন কিভাবে কেটে গেল বুঝতে পারল না রোহিত। বেশ কিছুক্ষণ আগে ফিরে এসেছে। বিছানায় এলিয়ে দিয়েছে নিজেকে। মাথাটা কেমন যেন ধরে এসেছিল। চুপচাপ শুয়ে রইল সে। একটু চা পেলে ভালো হতো। আ্যপার্টমেন্টের ক্যান্টিনে চা এবং স্ন্যাকসের অর্ডার দিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই চা এবং ভুজিয়া নিয়ে এল প্রায় দশ বারো বছরের একটি ছেলে।

রোহিত ওকে ডেকে বসাল। জিজ্ঞেস করল, তুমহারা নাম ক্যায়া হ্যায় ?

-- সত্যানন্দ। বিহার কি এক গাঁওসে আয়া হুঁ।

খুব অভাব ছিল ওখানে। তিনভাই। সে বড়। তারই দায়িত্ব। মাসে মাসে টাকা পাঠায় সে।‌‌ যার এখন লেখাপড়া শেখার কথা সে এখন চায়ের দোকানে ! সমগ্র ভারতে কতো কতো শিশুর যে চায়ের দোকানে শৈশব কাটে; কে জানে ?

চা এবং ভুজিয়ার দাম দিতেই চলে গেল সত্যানন্দ। চা-টা খেয়ে এখন মাথাটা বেশ ফ্রেশ মনে হল। জানালাটা খুলে দিতেই দেখল নীল সমুদ্র আর অজস্র রঙিন মানুষের ভিড়।

কমার্স নিয়ে পড়ার সময় অন্য স্ট্রিমের বন্ধুরা বলত ওদের নাকি শিল্পবোধ নেই। মানুষের দুঃখ, কষ্ট, অসহায়তা -- এসব ওদের চোখে পড়ে না। ওরা নাকি টাকাপয়সা সংক্রান্ত নীরস বিষয় নিয়েই ব্যস্ত থাকে। মনে মনে একটু হাসলো সে। মানুষের জীবনবোধ নিয়ে তার ভাবনা কম নয়। কিন্তু সেটা একজন শিল্পী সাহিত্যিকের মতো করে প্রকাশ করতে পারে না। রাজনৈতিক নেতাদের মতো মিথ্যে ভড়ং দেখাতে পারে না। সে এটা বুঝতে পেরেছে যে টাকা না থাকলে সব 'বোধ'ই মিথ্যে হয়ে যায়।

আজ আবার বেরোতে হবে গার্গী বোসের সঙ্গে। গার্গী বোস তার বন্ধুত্ব চায়। আপত্তি নেই। কিন্তু ও হল বস্। আর সে তারই অধস্তন কর্মী। বন্ধুত্বের কারণে সেই সীমারেখাটা মুছে গেলে সমীকরণটা কেমন হবে কে জানে !

 

(৭)

 

রাত্রি প্রায় আটটা। তবে রাত্রি না বলে সন্ধ্যে বলাই ভালো। একটু তন্দ্রা মতো এসেছিল। হঠাৎই মোবাইলে একটা মেসেজ দেখে উঠে পড়ল। "আই অ্যাম অ্যাট ইওর ডোর স্টেপ"! বস্ মানে গার্গী বোস তার জন্য অপেক্ষা করছে! প্যান্ট শার্টটা পড়ে নিয়ে বেরিয়ে এল।

ম্যাডাম ওর জন্য ওয়েট করছে। না জানি এবার কি হবে ! আ্যপার্টমেন্টের বাইরে এসে একটা দুধসাদা মার্সিডিজ বেঞ্জ দাঁড়িয়ে রয়েছে। স্টিয়ারিঙয়ে স্বয়ঙ গার্গী বোস। কাছে আসতেই গাড়ির দরজাটা বাঁ হাত দিয়ে খুলে দিলেন তিনি।

-- এক্সকিউজ মি !

-- নো এক্সকিউজ। কাম ইন।

ম্যাডামের পাশেই বসতে হল। ভিতরটা বেশ ঠাণ্ডা এবং একটা মিষ্টি গন্ধে ভরা।

-- ঘুমাচ্ছিলে ?

-- হাঁ। এর জন্য দুঃখিত।

-- হোয়াই?

-- আপনাকে ওয়েট করতে হল এর জন্য ।

-- ও হো, এরজন্য !

হাসল গার্গী। এখন ওকে বেশ সুন্দরী দেখাচ্ছে। ব্লু জিনস এবং ওপরে একটা সাদা রঙের টপ। না টাইট ফিটিং নয়। ওতে ওর বুকের সৌন্দর্যটা যথেষ্ট অনাবৃত। চুলগুলোও খোলা। বেশ উড়ছে।

কিছুটা ছোঁয়া বাঁচিয়ে বসেছিল রোহিত। কেমন যেন একটা সংকুচিত হয়ে। গার্গী বোসের মতো একজন মহিলা তার পাশে -- এটা তার কল্পনারও অতীত ছিল। গাড়িটা মসৃণ গতিতে এগিয়ে চলেছে। স্পীড কখনো পঞ্চাশ অথবা ষাট। ড্রাইভিঙয়ে চোস্ত বলতেই হবে। হঠাৎই গার্গী তার বাঁ হাতটা রাখল ওর হাতে। বলল, আর ইউ আ্যকসেপ্টিঙ মি ?

-- হোয়াই নট ?

-- তাহলে এতো দূরে কেন ? আপনার কি কোনও গার্লফ্রেন্ড আছে ?

-- গার্লফ্রেন্ড ? কি যে বলেন -- আমার মতো একজন চালচুলোহীন ব্যক্তির কে গার্লফ্রেন্ড হতে চাইবে ?

-- আমি তো চেয়েছি।

-- সেটা আপনার বদান্যতা। আমি জানি, আমি আপনার --

-- ডোনট্ সে ফারদার।

বেশ কিছুক্ষণ চলার পর গাড়িটা একটা শপিং মলে এসে থামল। মলের সিকিউরিটির লোকেরা এগিয়ে এসে পার্কিংয়ের জায়গাটা দেখিয়ে দিল। ওদের কথাবার্তা শুনে মনে হল ম্যাডাম বেশ পরিচিত।

ঝাঁ চকচকে একটা মল। এর আগে রোহিত মল দেখেনি এমন নয়। তবে এ যেন অনেক বড় ব্যাপার। 'শয়ে 'শয়ে লোক আসছে, যাচ্ছে। তবে সবাই গাড়িতে চড়েই। বাণিজ্যিক গাড়িও আছে, সেই সঙ্গে আছে ব্যক্তিগত গাড়িও।

রিসেপশনে একজন সুন্দরী মহিলা বললেন, আইয়ে জী, বহোৎ দিনো কে বাদ --

হাসল রোহিত। এই মলে সে প্রথম এল। ওরা হয়তো এভাবেই সবাইকে রিসিভ করে।

চলমান সিঁড়ি। চলেই যাচ্ছে। উঠে দাঁড়ালো সে। গার্গী বোস ভারসাম্য রাখতে না পেরে রোহিতের হাত ধরতে বাধ্য হল। সে লক্ষ্য করল ম্যাডাম অনেক কাছে সরে এসেছে। পিঠের ওপরে ওর বুকের ছোঁয়া। ইতিপূর্বে কোনও মহিলা এতোখানি কাছে আসেনি। সিঁড়িটা যেখানে শেষ হল সেখানে আবার একবার ম্যাডামকে ধরতে হল। হাত ধরেই মলের ভেতরে প্রবেশ করল ওরা। রোহিতের মনে হল ম্যাডাম বুঝি তার কতো কাছের মানুষ। মাত্র অল্প সময়ের মধ্যেই তাকে কতো আপন করে নিয়েছে। এখন সায়ন্তিকার মুখটা বুঝি ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে।

হঠাৎই এক মহিলার সঙ্গে দেখা হল গার্গী বোসের। মহিলা হেসে বলল, হাই গার্গী কেমন আছো ?

-- খুব ভালো। আপনি ?

-- ভালো। তো ইনি ?

-- মাই ফ্রেণ্ড। রোহিত আঢ্য।

"হাই" বলে মহিলা হাত এগিয়ে দিলে রোহিত বাধ্য হল করমর্দন করতে। ভদ্রমহিলা সাজপোশাকে বেশ বেপরোয়া। এখানে মহিলাদের দেখে মনে হয় তারা বুঝি শরীর দেখানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে।

গার্গী বোস এগিয়ে এসে বলল, আজ ব্যস্ত আছি। বেশ কিছু মার্কেটিং করতে হবে।

রোহিতকে একপ্রকার টেনে নিয়ে অন্যদিকে চলে গেল সে। মৃদুকণ্ঠে বলল, এই ধরণের মহিলাদের একদম পাত্তা দেবেন না।

আশ্চর্য হল রোহিত। গার্গী বোস কি স্রেফ প্রেম চায় ? না, আরও কিছু ?

গার্মেন্টস সেকসনে আসে ওরা। এখানে শুধুমাত্র পুরুষদের জন্য। ঘুরে ঘুরে দু'টো ব্লেজার, দু'টো প্যান্ট এবং দু'টো শার্ট পছন্দ করল গার্গী। রোহিতের গায়ে মাপ দিয়ে দেখল -- না, ঠিকই হবে বলে মনে হল তার। ট্রলিতে রেখে দিল সে। পুরুষদের বেশ কয়েকটি অন্তর্বাস, গেঞ্জি -- এসবও নিল । মহিলাদের পোশাক বিভাগে এসে নিজের জন্যও কিছু নিল।

রোহিত ওর অনেকটা কাছে সরে এসে বলল, ম্যাডাম, আমি আপনার জন্য কিছু নিতে চাই।

-- ম্যাডাম নয়, গার্গী, ওনলি গার্গী।

-- কিন্তু আপনি যে আমার বস্।

-- সেটা অফিসে। আর অফিসের বাইরে ফ্রেণ্ড, ওনলি ফ্রেণ্ড। আর আপনি নয়, তুমি।

রোহিত গার্গীর দিকে চেয়ে থাকে। সীমারেখাটা বুঝি অষ্পষ্ট হয়ে আসছে। এখন থেকে আর আপনি বলা যাবে না। বলতে হবে তুমি। সে বুঝি এক অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয় গল্পের নায়ক। যা নাকি রূপোলী পর্দায় সম্ভব।

-- অ্যাই, হোয়াট আর ইউ থিঙ্কিং ?

-- কুছ নেহি।

-- ফির শোচতে ক্যায়া ?

-- আমি স্বপ্ন দেখছি না তো ?

-- হাসল গার্গী। বলল, না গো। আই অ্যাম ইওরস , চলো --

স্টেশনারি সেকসনে এল ওরা। গার্গী পুরুষদের প্রসাধনের জন্য অনেক কিছু নিল। ট্রলিটা ভর্তি হয়ে এসেছে প্রায়। ঠেলে ঠেলে সেটা কাউন্টারে নিয়ে এল। কাউন্টারের মহিলা কম্পিউটারে হিসাব লিখতে ব্যস্ত হল।

পেমেন্ট অ্যাপের মাধ্যমে টাকাটা মিটিয়ে দিল গার্গী। রোহিত এগিয়ে এসে বলল, আপনি, স্যরি তুমি পে করলে যে ? আজই কোম্পানি আমাকে পঞ্চাশ হাজার আ্যডভান্স করেছে।

-- গুড নিউজ। আর এটা আমার বন্ধুত্বের উপহার। আপনি, স্যরি তুমি কি এটা স্বীকার করবে না?

অভিভূত রোহিত। এই অযাচিত, অকৃত্রিম বন্ধুত্বকে স্বীকার করতেই হবে।

 

(৮)

 

বন্ধুত্ব ক্রমশই গাঢ় থেকে গাঢ়তর হতে থাকল। গার্গী বোসের বন্ধুত্বে যতটা না নিখাদ প্রেম ছিল, তার থেকেও বেশি ছিল পাওয়ার বাসনা। না, টাকাপয়সা বা প্রেম নয়। বাসনা ছিল শরীরের। বয়স প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি হলেও শারীরিক সৌন্দর্যে মনে হবে কুড়ি পঁচিশের মধ্যে। যার ফলে কমবয়সী ছেলেদের ফাঁদে ফেলতে পারত। আর ওর অপারেশনের কথা কেউ ঘুণাক্ষরেও টের পেত না। নিজে ওপরতলার অফিসার হওয়ার সুবাদে ওর জানাশোনাও ছিল প্রচুর। তবে একই পদমর্যাদার লোকেদের সঙ্গে ওর মেলামেশা ছিল না। ও চাইত একটু গরীব এবং ট্যালেন্টেড ছেলেদের। তাদের নিখাদ প্রেম এবং শরীর দু'টোই উপভোগ করত সে। রোহিত তার পঞ্চম শিকার। বেশ ভালো লাগছে তার। একটা রোমান্টিকতার আবহে রোহিতের নেশায় মশগুল সে। তবে কাজের ক্ষেত্রে একশো শতাংশ পেশাদার। তবে সন্ধ্যে হলেই চাই পুরুষের ‌

সান্নিধ্য। কিন্তু যে কোনও পুরুষ নয়, তার পছন্দের পুরুষ এবং যে শুধু তাকে নিয়েই ভাববে।

বেশ কিছুক্ষণ আগেই রোহিতকে ফোন করেছে। আজ সানডে নাইট ক্লাবে যাবে বলে ঠিক করেছে। শহর থেকে বেশ কিছুটা দূরে। একটু নির্জন এলাকায়। শহরের ভিড় এবং কোলাহল দু'টোই অনুপস্থিত। রোহিতকে আর একবার ফোন করতেই সে বলল, আমি গান্ধিজীর স্ট্যাচুর সামনে দাঁড়িয়ে আছি।

-- ঠিক আছে। আমি আসছি।

কিছুক্ষণের মধ্যেই রোহিতের পাশেই একটা গাড়ি এসে থামল। এটা আগের গাড়িটা নয়। এটা হয়তো কোনও ট্যুরিষ্ট কোম্পানির গাড়ি। ভাড়ায় নেওয়া হয়েছে। রোহিত আজ গার্গীর পছন্দের স্যুট পরে নিয়েছে। না, ওকে আর সেই আগের গরীব গরীব চেহারায় দেখা যাচ্ছে না। বেশ সফিস্টিকেটেড। গাড়ির দরজাটা খুলেই গার্গী বলল, খুব খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে। এস।

পাশে বসতেই ওকে একটা ছোট্ট কিস করল গার্গী। বেশ ভালো লাগলো রোহিতের। কোনও বিশেষ নারীর কাছ থেকে এটা তার প্রথম পাওয়া। না, সায়ন্তিকার কখনো এরকম দুঃসাহস হয়নি। তারও না। নির্জনে ওরা অনেক গল্প করেছে বটে, তবে শারীরিক স্পর্শ ছিল না।

গাড়িটা ছুটে চলেছে। কোথায় সে জানে না। গার্গী অনেক কাছে সরে এসেছে। আজ আর ও জিনস টপ পরেনি। একটা লঙ স্কার্ট আর টপ। দু'টোই সাদা। চুলগুলোও খোলা। বেশ সুন্দর লাগছে। শহরের কোলাহল পেরিয়ে ছোট্ট একটা টাউনশিপের পাশ দিয়ে ছুটতে লাগলো গাড়িটা। দু'পাশে নানারকমের বাহারি ফুলের গাছ -- আর তার মাঝ দিয়ে পথ। গার্গীর চুলগুলো ওর নাকেমুখে এসে পড়ছে। কেমন যেন এক রোমান্টিকতায় ভেসে যাচ্ছে সে। সায়ন্তিকার কথা আজ বারবার মনে পড়ছে। তাকে নিয়ে অনেক রোমান্টিক স্বপ্ন দেখলেও সময় হয়নি ওর। বারবার বলেছে, এখন না। আফটার ম্যারেজ আই উইল গিভ ইউ অল অফ মাইন। লক্ষীটি, জেদ কোরো না।

না, সে জেদ করেনি। সে ধৈর্য্য ধরতে পারে। সায়ন্তিকা তো তারই। কিন্তু আজ মনে হয় সে বুঝি এক ভিনগ্রহের বাসিন্দা। আর গার্গী খুব কাছের ; ছোঁয়া যায়, অনুভব করা যায়।

গাড়িটা বিরাট একটা বাড়ির সামনে এসে থামল। নিয়ন লাইটের সাইনবোর্ডে লেখা "সানডে নাইট ক্লাব", মেম্বার্স ওনলি। তাহলে ম্যাডাম নিশ্চয় এখানকার মেম্বার এবং নিয়মিত এসে থাকে। আসতেই পারে। সিইও। সুতরাং লাইফটাকে এনজয় করতেই পারে। এখানে আসা তার কল্পনারও অতীত ছিল। নেহাৎ ম্যাডামের সুনজরে পড়েছে বলেই। গাড়িটা ওদের নামিয়ে দিয়েই চলে যায়।

ওরা ভেতরে এল। রোহিতের হাত গার্গীর হাতে, যেন কতো আপনজন। ডান্স ফ্লোরে তখন কি একটা ইংরেজি গান বাজছে। সেই গানের তালে তালে নারীপুরুষ একে অপরের কাঁধে কোমরে হাত রেখে বিশেষ রকমের ডান্স করছে। এরকম সে সিনেমায় দেখেছে।

গার্গীকে দেখে অনেকেই হাই বলল, যেন সে সবার পরিচিত। রোহিতকে সে সবার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল। এখানে এসে রোহিতের নিজেকে অনেক ভাগ্যবান বলে মনে হল। এরকম যে একটা লাইফ আছে, এটা সে ভাবতেই পারেনি কখনো।

গার্গী প্রথমে নাইট ক্লাবের অফিসে গিয়ে কিছু কথা সেরে নিল। তারপর রোহিতকে নিয়ে এল ড্রিঙ্কস কিয়স্কে। সুদৃশ্য কাঁচের গ্লাসে নানা রংয়ের পানীয়ে ভর্তি। মদ ! রোহিত রোমাঞ্চিত। মদ কখনো খায়নি সে। কিন্তু আজ বস্ কে খুশি করতে -- গার্গী দু'টো গ্লাস তুলে নিল। একটা রোহিতের হাতে দিয়ে বলল, চিয়ার্স !

-- চিয়ার্স ! রোহিত একটু একটু করে গলায় ঢেলে নিল সবটা। বেশ ঠাণ্ডা। না, দেশী মদের মতো গন্ধ নেই। কিন্তু একটা ভালোলাগা আছে।

পাশের একটা পাত্রে পকোড়া জাতীয় কিছু একটা ছিল। গার্গীর দেখাদেখি সে নিজেও দু'একটা তুলে নিল। বেশ সুস্বাদু। আরও দু'টো গ্লাস নিল গার্গী। রোহিতকে বলল, টেক ইট।

না, ফেরাতে পারল না সে। আজ সে যেন ভেসে যেতে চায়। আজ সে তার আবাল্য লালিত আদর্শও ভুলে যাচ্ছে।

গার্গী ওর কোমরে হাত রেখে বলল, লেটস ডান্স।

মৃদু এবং মায়াবী নীল আলোয় গার্গীর চোখে চোখ রেখে অন্যদের মতোই গানের তালে তালে নাচতে থাকল। কতক্ষণ হিসাব ছিল না।‌ এর আগে সে কখনো মদ খায়নি। তাই স্টেপগুলো একটু এলোমেলো হয়ে হচ্ছিল। এরই মধ্যে গার্গী আরও কয়েক গ্লাস খেয়েছে। সে আর নাচতে পারছে না। ডান্স ফ্লোর থেকে চলে এল সে। ওর জন্য নির্দিষ্ট ঘরে এসে শুয়ে পড়ল।

ইতিমধ্যে এক এক করে অনেকেই নিজেদের ঘরে চলে গেল। ক্লাবের কর্মীরা জিনিসপত্র সব গুছিয়ে নিচ্ছে। কিছুক্ষণ একা একাই ফ্লোরে দাঁড়িয়ে রইল রোহিত। ও এখন সায়ন্তিকার সাথে মিলিয়ে দেখছে গার্গীকে। না, গার্গী অনেক বেশি সুন্দরী। অনেক বেশি হট।

দরজাটা বন্ধ করে পোশাকটা খুলে ফেলল। গার্গীকে ভালো করে শুইয়ে দিতে গিয়ে দেখল, ও বিড়বিড় করে কি যেন বলছে। ওর মুখের কাছে ঝুঁকে পড়ল রোহিত। গার্গী জড়ানো গলায় বলছে, আই লাভ ইউ, আই -- লাভ -- ইউ --

গার্গীর পাশেই শুল সে। প্রায় নগ্ন গার্গী অনেক কাছে সরে এল। জড়িয়ে ধরল রোহিতকে। চুম্বনে চুম্বনে ভরিয়ে দিল ওকে। এই প্রথম কোনও নারীকে একান্তভাবে কাছে পেল সে। উদ্দাম যৌনতায় ভেসে গেল ওরা। পরদিন সকাল হতেই ওরা দেখল, না নিজেদের মাঝে আর কোনও আড়াল নেই। সুতরাং ওরা বারবার অনেকবার মিলিত হল।

 

(৯)

 

রোহিত অনেকটাই অগোছালো হয়ে পড়েছে। নাইট ক্লাব থেকে ফিরে স্নান সেরে অফিসে এলো বটে, কিন্তু কাজে মন বসাতে পারল না। সে কাজ করতে এসেছিল। কিন্তু কোথা থেকে যে কি হয়ে গেল, বস্ এর নজরে পড়ে তার আদর্শ, একাগ্রতা সব এলোমেলো হয়ে গেলো। বস্ এর সঙ্গে দেখা করবে না, তাই বা কি করে হয় ! এই সংস্থায় ম্যাডাম গার্গীই তো তার হেড। সুতরাং তার নির্দেশমতোই তাকে চলতে হবে। কিন্তু এভাবে চললে তার কর্মদক্ষতাও কমে যাবে।

কাজে মন দেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু বারবার গার্গী বোসের কথা মনে পড়তে লাগল। অন্যদিন লাঞ্চের জন্য ম্যাডাম ডাকত। কিন্তু সেদিন তখনও ডাকেনি। তাই একটু চিন্তায় ছিল।‌‌ লাঞ্চ ব্রেকের সময় ক্যান্টিনে যাওয়ার পথে দেখল বস্ এর কেবিন বন্ধ। তার অর্থ নিশ্চয় বাইরে কোথাও। ক্যান্টিনে খেতে খেতে শুনল, বেশ কয়েকটা ওয়ার্কশপ ভিজিট করবে ম্যাডাম। তাই সেদিন আসেনি।

পরপর কয়েকদিনই ম্যাডাম এল না। মালয়েশিয়া গেছে। এই কয়েকদিন সায়ন্তিকার কথা ভাবল রোহিত। মনে করল গার্গীর কথা ভুলে যাবে। মনে করবে ওটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিন্তু তা সম্ভব হল না। দিন পনের পরে ফিরল গার্গী বোস। আবার রোহিতকে ডাকল। না, কাজের কথা বলল না। বলল, কেমন আছো ? আরও বলল, ডোনট্ ট্রাই টু ফরগেট !

ওর ঘরে যেতে বলল। ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু বস্ এর অর্ডার। সুতরাং যেতেই হল। গার্গী যেখানে থাকে সেটা একটা আবাসন। একটাই বিল্ডিং। মোট ছাব্বিশটি ফ্লোর রয়েছে। ম্যাডাম থাকে এইটটিনথ্ ফ্লোরের একশো বাহাত্তর নাম্বার ফ্ল্যাটে। না, খুঁজে পেতে দেরি হল না। রাত্রি তখন প্রায় ন'টা। ফ্ল্যাটে একাই থাকে। তবে সর্বক্ষণের জন্য একজন মহিলা থাকেন তাকে সাহায্য করার জন্য।

কলিংবেলের শব্দে স্বয়ঙ ম্যাডামই দরজা খুলল। একেবারে ঘরোয়া পোশাকে। একটা পাতলা সিফনের নাইটি -- ভেতরে অন্তর্বাস আছে বলে মনে হয় না। বুকের বেশ কিছুটা অনাবৃত। না , এর জন্য কোনও সংকোচ নেই।

-- অফিসের মিটিংয়ে হঠাৎই মালয়েশিয়া যেতে হল। তোমাকে বলাও হয়নি। ভেতরে এস।‌‌ নাইটে এখানেই খেয়ে যাবে।

রোহিত গার্গীর দিকে চেয়ে রয়েছে। বেশ কিছুদিন না দেখার পর ওকে বেশ মোহময়ী লাগছে, যেন সব পতঙ্গকেই ধ্বংস করতে পারবে সে। ম্যাডামের সান্নিধ্যে বেশ কয়েকঘণ্টা কেটে গেল। তবু ম্যাডাম যেন ওকে ছাড়তেই চায় না।

লিফট্ সার্ভিস বন্ধ হয় রাত্রি বারোটায়। তার আগেই রোহিত বিদায় জানিয়ে ফিরে এল। রাত্রেও বেশ কিছুক্ষণ গার্গী ওকে ফোন করল। ম্যাডামের পিপাসাটা যেন বেড়েই চলেছে। পরদিন অফিসে বস্ ওকে ডেকে পাঠাল। ভেবেছিল যাবে না। কিন্তু ও হল বস্। তাই ওর ইচ্ছে অনুযায়ী সে চলতে বাধ্য। এখন অফিসের কাজের বদলে বস্ কে এন্টারটেইন করাই তার প্রধান কাজ।

কয়েকদিন পরে ঠিক হল ম্যাডামের সঙ্গে তাকে গোয়ায় যেতে হবে। ম্যাডামের কিছু অফিসিয়াল কাজ সারার পর ওরা সমুদ্রতীর সংলগ্ন হোটেলে একদিন ছুটি কাটাবে। রোহিতের আপত্তি ছিল না। কারণ সে কখনো গোয়ায় যায়নি। গোয়ার সুন্দর বেলাভূমির ছবি সে দেখেছে।

সেটা ছিল অক্টোবরের মাঝামাঝি। দিনটাও ছিল মনোরম। বিকেলের দিকে এল ওরা। খুব হট পোশাক পরেছিল গার্গী। আর সে ছিল ক্যাজুয়াল পোশাকে। বেলাভূমিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল অসংখ্য মানুষ। মহিলারা বেশিরভাগই সুইমিং কস্টিউমে।‌‌ কেউ একটু জড়তায়, আবার কেউ কেউ উদ্দামতায় ব্যস্ত।

সি বিচেই রয়েছে কিছু রেষ্টুরেন্ট, যেখানে মাছ এবং চিকেনের নানারকমের ফ্রাই সঙ্গে ড্রিঙ্কসের ঢালাও ব্যবস্থা। পড়ন্ত রোদে বেশ ঝলমলে দেখাচ্ছিল বেলাভূমি। ওরা দু'টো চেয়ারে বসতেই স্টলের ছেলেটা কিছু ফ্রাই এবং দু'টো রঙিন গ্লাসে বিদেশী ওয়াইন ওদের হাতে তুলে দিল। আরও, আরও খেল ওরা। এরই মধ্যে রোহিতের অলক্ষ্যে কি একটা ট্যাবলেট ওর গ্লাসের পানীয়ে মিশিয়ে দিল গার্গী। সে আজ খুব অন্তরঙ্গ। রোহিতের হাত ধরে সে এগিয়ে গেল উত্তাল সমুদ্রের দিকে। একজন বোটওয়ালা এগিয়ে এল। বলল, আইয়ে জী।

রোহিত বেশ কিছুটা নেশাগ্রস্ত হয়েছিল। পা-টাও টলছিল। কথাগুলোও জড়িয়ে যাচ্ছিল। সে বোটে উঠে বলল, গার্গী কাম।

-- আমি আসছি, তুমি শুরু করো।

রোহিতের মোটর বোট চলতে থাকল। দুরন্ত গতিতে বড় বড় ঢেউ অতিক্রম করে বোটটা ক্রমশই এগিয়ে গেল উত্তাল গভীর সমুদ্রের দিকে।

তীরে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে ওকে বিদায় জানাল গার্গী। না, রোহিত আর ফিরবে না। নেশার ঘোরে নিয়ণ্ত্রণ হারাবে সে। তারপর গভীর সমুদ্রে হারিয়ে যাবে রোহিত। এভাবেই হারিয়ে গেছে আরও কয়েকজন। না, তাদের খবর কেউ পায়নি। পুলিশ একটু আধটু খোঁজাখুঁজি করেছিল বটে। কিন্তু গার্গী বোস প্রত্যেকটা নিখোঁজের জন্য মাত্র দশ লক্ষ টাকা দেওয়ায় পুলিশ আর খোঁজাখুঁজি করেনি। এবারেও করবেনা।

বোটওয়ালাকে টাকা দিয়ে একটু ক্রুর হেসে হোটেলে ফিরে এল সে।

 

(১০)


নিশ্চিন্তে হোটেলে ফিরে এসে পোশাক বদলে নিল গার্গী। হোটেলের অফিসে ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলে সিসিটিভি ফুটেজের বেশ কিছুটা অংশ ডিলিট করে দিতে বলল। ম্যানেজার প্রথমে রাজী ছিল না। বলল, হোটেলের এতোগুলো স্টাফ, তাদের মুখ বন্ধ করা সহজ নয়।

-- সেজন্যই তো বলছি, আপনি আমার ঘরে আসুন ব্যবস্থা হয়ে যাবে। এমনিতেই ম্যানেজারের একটু নজর ছিল ওর প্রতি, এটা গার্গীর বুঝতে দেরি হয়নি। এখন ওর মুখ বন্ধ রাখতে রিস্ক নিতেই হবে।

ম্যানেজার ঘরে আসতেই বলল, দেখুন আপনার হোটেলের অনেক নাম শুনেছি। ক্লায়েন্টদের নিয়ে আসতেই হয়। অনেক সময় তারা নিজের থেকেই কোথাও চলে যায়।

-- বুঝতে পেরেছি। ঠিক আছে ডিলিট হয়ে যাবে। কিন্তু --

-- ঠিক আছে, আপনি এটা রাখুন। এতে বিশহাজার আছে।

-- ঠিক আছে, ঠিক আছে। আপনি ভাববেন না।

টাকাটা নিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে পকেটে ভরে নিল ম্যানেজার। এটা তার বাড়তি রোজগার। আর এই রোজগারেই সে ফুলেফেঁপে উঠছে।

-- আপনি কি আজই চেক আউট করবেন ?

-- হাঁ। আমি যে আপনার হোটেলে এসেছিলাম তার কোনও প্রমাণ রাখা চলবে না।

-- সে আর বলতে! এরকম আমরা প্রায়ই করে থাকি। কাষ্টমারের স্বার্থটাই আমাদের কাছে শেষ কথা।

-- ঠিক আছে। হোটেলের বিল তো আগেই পে করে দিয়েছি। এখন সিসিটিভির ফুটেজটা --

-- বসুন না। আমি এক্ষুনি করে দিচ্ছি।

বসল গার্গী। দেখল ম্যানেজার মাউসটা ঘুরিয়েই চলেছে। শেষপর্যন্ত গার্গী নিজেই কীবোর্ডটা টেনে নিয়ে সিসিটিভির দু'দিনের ম্যাটারটা একেবারে ডিলিট করে দিল।

-- পুরোটাই ডিলিট করে দিলেন ?

-- তাতে কি হয়েছে ! আমি তো আছি। আপনাকে আমার খুব ভালো লেগেছে। চাইলে একঘণ্টার জন্য --

-- কি যে বলেন !

-- আসুন না।

 

ম্যানেজার আর না করল না। বাড়তি কিছু টাকা পেয়েছে। এখন যদি আরও কিছু পাওয়া যায় ক্ষতি কি ! তাছাড়া পুরুষ্টু শরীরের স্বাদ! সুযোগ বারবার আসে না। সুতরাং সে সুযোগ নিল।

ফিরে এল গার্গী। তখন রাত্রি প্রায় সাড়ে এগারোটা এরকম হবে। লিফট তখনও চালুই ছিল। নিজের ঘরে এসে ফ্রেশ হয়ে নিল।

আজ খুব ধকল গেছে। এর আগে তার জীবন থেকে আরও চারজন হারিয়ে গেছে। না, তাদের জন্য তেমন কষ্ট হয়নি। কিন্তু রোহিতের জন্য বুঝি -- এসব দুর্বলতা তার জন্য নয়। নতুন নতুন পুরুষ তার উপভোগের বস্তু। ওসব নিয়ে তার ভাবার সময় নেই।

পরদিন অফিসে এল ঠিক আগের মতোই। যেন কোথাও কিছু ঘটেনি। একটা কাগজে রোহিতকে দিয়ে সই করানো ছিল। সেটাতেই একটা রেজিগনেশন লেটার টাইপ করে নিল। স্বাক্ষর রোহিত আঢ্য। তারিখ তিনদিন আগের। সুতরাং সে জানে না রোহিত রিজাইন দিয়ে কোথায় গেছে ।

কর্মীরাও আর রোহিতের ব্যাপারে তেমন খোঁজখবর করল না। তার বাড়ির লোকেরাও জানল না, রোহিত কোথায়। এভাবেই কেটে গেল বেশ কিছুদিন। প্রায় ধামাচাপা পড়ে গেল ব্যাপারটা। কিন্তু গোয়া কোষ্টাল গার্ডের ইন্সপেক্টর লিঙ্কন ডিসুজা হঠাৎই একদিন গার্গী বোসকে ফোন করে জানতে চাইল, রোহিত আঢ্য বলে কাউকে চেনেন?

-- চিনি। কিন্তু উনি তো আমাদের সংস্থা থেকে গত ১২ই অক্টোবর রিজাইন দিয়ে চলে গেছেন।

-- আমরা তাঁর লাশটা খুঁজে পেয়েছি। পচাগলা। আপনাকে সনাক্ত করতে হবে।

-- কিন্তু.., আচ্ছা ওটাকে বেওয়ারিশ লাশ বলে চালানো যায় না ? তার জন্য --

-- যেতে পারে , কিন্তু --

-- আপনি আসুন না এখানে। মুম্বাইয়ের কোনও একটা হোটেলে। তারপর আমাকে ফোন করবেন।

-- ওকে। আমি আজই বিকেলের মধ্যেই আসছি।

-- হাঁ, তবে আজই লাশটার একটা ঠিকানা করে দিন।

-- ওকে ম্যাম !

হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো গার্গী। সত্যিই লাশটা তাকে ভাবিয়ে তুলেছে। কত টাকা খসবে কে জানে ? হোটেল সি ফেস এ একটা এসি রুম বুক করে রাখল সে। লিঙ্কন ডিসুজার এন্টারটেইনমেন্টের সব ব্যবস্থাই রাখতে হবে। আগের মতোই সব চলতে থাকল। কেউ তাকে সন্দেহ করল না। পচাগলা লাশটা নিশ্চয়ই শকুন শিয়ালের ভক্ষ্য হয়ে জীবনলীলা সাঙ্গ করেছে।

ইতিমধ্যে দেওয়ালী এসে গেল। অফিস স্টাফদের জন্য একটা স্পেশাল বোনাসের ব্যবস্থা হল। তারা তাদের বস্ কে অনেক অনেক ধন্যবাদ জানাল।

সেদিনটা ছিল কালীপুজোর রাত। মানে ভূতচতুর্দশীর রাত। ভূতেরা নাকি সেদিন বেশি সক্রিয় হয়। তবে সেসব নিয়ে গার্গীর ভাবনা ছিল না। শহরটা সেদিন আলোকমালায় সেজে উঠেছিল। মাল্টিস্টোরিড বিল্ডিংগুলোকে অনেক অনেক আলো দিয়ে সাজানো হয়েছিল। অন্যান্য আবাসিকদের সঙ্গে সেও ছাব্বিশতলার একেবারে শেষতলায় উঠে এসেছিল। বেশ সুন্দর লাগছিল চারপাশটাকে। দূরের সমুদ্রটাও যেন রঙিন হয়ে উঠেছিল। অনেক রাত পর্যন্ত সে ছাদেই রইল। কখন যে অন্যান্য আবাসিকরা নেমে গেছে সে বুঝতে পারেনি। হঠাৎই কেমন যেন একটা বিকট আওয়াজ হল। আর সঙ্গে সঙ্গে কারেন্ট চলে গেল। মনে হল পুরো শহরটা বুঝি অন্ধকারে ডুবে গেছে। মোবাইলটাও সঙ্গে ছিল না। হাতড়ে হাতড়ে এগোতে লাগল। কোথাও কোনো শব্দ নেই। কেমন যেন ভুতুড়ে পরিবেশের মতো। লিফটও চলছে না। নিশ্ছিদ্র অন্ধকারের মধ্যে থেকে মনে হল যেন ছায়ামূর্তির মতো কেউ এগিয়ে আসছে।

-- কে ?

কিন্তু ওর গলা থেকে বুঝি কোনও স্বর বেরোচ্ছে না। গলাটা বুঝি শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। না, ও কথা বলতে পারছে না। প্রচণ্ড ভয়ে ও পিছোতে লাগল আর ছায়ামূর্তিটাও যেন এগিয়ে আসতে লাগল। পিছোতে পিছোতে ও একেবারে ছাদের শেষপ্রান্তে এসে পৌঁছাল।

-- কে, কে তুমি ? কেন এগিয়ে আসছ আমার দিকে ?

কান ফাটানো পৈশাচিক হাসির শব্দ চারদিকে। ও আরো পিছোতে লাগল। ছাদের ওই অংশটায় কোনও দেওয়াল ছিল না। গার্গী বোস পিছোতে পিছোতে ছাদের সেই অংশ থেকেই তীব্র আর্তনাদ করে পড়ে গেল একেবারে নীচে। সবাই প্রথমে একটা আর্তনাদ, পরে একটা 'ধপ' শব্দ শুনতে পেল। কারেন্ট এল, আলো জ্বলল। সবাই দেখল একেবারে নীচে রাস্তার ওপরে গার্গী বোসের ছিন্নভিন্ন দেহটা পড়ে রয়েছে। মাথা থেকে তখনো গলগল করে বেরিয়ে আসছে তাজা রক্ত।

মারা গেল গার্গী বোস। সমাপ্তি ঘটল এক পিপাসার।




ছবি আন্তরজাল থেকে সংগৃহীত 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন