মুখার্জী বাড়ি - সহেলী মল্লিক



নবীগঞ্জের মুখার্জী বাড়িকে এ চত্বরের সবাই 'চিড়িয়াখানা' নামে এক ডাকে চেনে। কিন্তু এই চিড়িয়াখানাটাই একান্নবর্তী পরিবার নামে এই গোটা গ্রামে আজও বিরাজমান। কত ঝগড়া, বিবাদ-দ্বন্দ্ব, চিৎকার-চেঁচামেচির পরও এটা একান্নবর্তী। এর পিছনে কোন শ্বশুর শাশুড়ির কড়া ধমক বা আদেশ নেই, এর কারণ তারা নিজেরাই। হ্যাঁ প্রথমে বুঝতে পারেনি ঠিকই, কিন্তু এখন তা বেশ বুঝতে পারে। এই বাড়ির বড় ছেলে দীপক কোন কিছুতেই তার চোখ যায় না শান্ত ধীর স্থির, যখন তার গিন্নি কোন বিষয়ে নালিশ করেন বীনের তালে তালে নাচতে থাকা সাপের মতো তিনি কেবল মস্তক নাড়াতে থাকেন। বাড়ির মেজো ছেলে নিতিন কথায় কথায় খালি কাঁদে, কবে কোন ছেলেবেলায় মাথায় চোট পেয়েছিলেন তা আজও ভুগিয়ে চলেছে। তাকে কোন কথা বলতে গিয়ে তার গিন্নিকে দু'বার ভাবতে হয়, এই বুঝি আবার কেঁদে ফেলে। আর সবথেকে মহাপাজি রাজাধিরাজ মহারাজ অতীন্দ্র তার নাকি ঝগড়া দেখতে বেশ লাগে, তাই দুই বউদির মধ্যে ঝগড়া লাগানোটা তার অন্যতম পেশা ও নেশা। আসল কথা হলো হাসি কান্না ঝগড়া ভালোবাসার ঘেরা এই পরিবার, এককথায় সবার সাথে সবার টক ঝাল মিষ্টির সম্পর্ক। আর আমি হলাম.......

- গেলো গেলো, আমার সাধের ফুলদানিটা গেলো। বলি ও বড়দি তুমি বুঝি চোখের মাথা খেয়েছো, আমার এত বড় দামী ফুলদানিটা তোমার চোখে পড়ল না গো!

- না রে মেজো, আমি না ঠিক দেখতে পাইনি, কি করি বল আমার তো আর চারটে চোখ না।

- এই বড়দি তুমি আবার.. আবার আমাকে চারটে চোখ নিয়ে কথা শোনালে, বলি তোমার কোন কাজ নেই! আমি জানি তো তুমি ইচ্ছে করে করেছো।

      

ব্যস, শুরু হয়ে গেল আবার। ও... আমি এই আস্ত চিড়িয়াখানার ছোটো বউ, রাজাধিরাজ অতীন্দ্র আমার স্বামী। দেখছি আমাকেই থামাতে হবে।

- কী হয়েছে? বলি এত ঝামেলা কি নিয়ে শুনি..

- দেখনা ছোটো, বড়দি আমার সাধের ফুলদানিটা ভেঙে..

- ও...মেজদি এটা..! এটা না আমার হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেছে।

- ছোটো!

- আচ্ছা বড়দি তুমি তো সে কথা বললেই পারতে। আমার জন্য তোমাদের মধ্যে অশান্তি হচ্ছে আমার কিন্তু ভারী দুঃখ হচ্ছে। মেজদি তুমি কিছু মনে করোনি তো?

- ও.. এটা তোর কাজ! সে যাকগে, আবার নতুন চলে আসবে। তুই মনখারাপ করিস না ছোটো।

- ছোটো এটা কি হল... ওটা তো আমার হাত থেকে পড়ে, তুই মিথ্যে বললি...

- বড়দি যদি একটা মিথ্যে বললে শান্তি আসে তবে আমি ওমন হাজারটা মিথ্যে বলতে রাজি বুঝলে…

-- বোকা বোন আমার, আয় বুকে আয়।

- আহা! বড়দি তুমি বুঝি একাই ভালোবাসো ছোটোকে ! আমিও তো কত ভালোবাসি।

তিন জায়ে গলা জড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম উঠনে। চিড়িয়াখানার এ এক বিরল চিত্র বটে। তবে বড়দা বলে আমি আসার পর এমন অনেক অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্যের সাক্ষী হতে পেরেছে এই মুখার্জী বাড়ি, ভালোবেসে নাকি এক সুতোয় বেঁধে রেখেছি টালমাটাল চিড়িয়াখানাটিকে। চোখ গেল উঠানের মোটা থামটার দিকে। হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে বড়দা, মেজদা আর মহারাজ। রাজাধিরাজের মুখ ভার, আসলে তিনি বুঝেছেন তার সাম্রাজ্য একটু একটু করে হারাচ্ছে। হঠাৎ মাথাটা চিনচিন করে উঠল, চোখের সামনে অন্ধকার। একটিবার মনে হলো তবে কি সময় শেষ! তারপর.....

    

জ্ঞান ফিরতে দেখি আমি আমার ঘরে, মাথার কাছে বসে আছে দুই মা – বড়দি আর মেজদি। অতীন্দ্র দূরে…আলমারির কাছে, চোখদু'টি ছলছল করছে।

 

"অতীন্দ্রটা বড্ড বোকা

কিছুতেই বুঝতে চায় না,

যার যাবার সময় হয়

আর যাই হোক তাকে

কোনভাবেই আটকে রাখা যায় না।"

তিন মাস আগে ধরা পড়েছে ব্রেন টিউমার, জানি আর বেশিদিন না, এটি তারই পূর্বাভাস মাত্র। তাও নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম......

- কি ব্যপার, তোমাদের মুখ এমন ভার কেন? ও... তোমরা ভাবলে আমি সত্যি সত্যি জ্ঞান হারিয়েছিলাম? আরে না না, আমি তো নাটক করছিলাম।

- চুপ কর তুই, তিন ঘন্টা পর তোর জ্ঞান ফিরল আর তুই বলছিস নাটক করছিলিস।

আমি একটু অপ্রস্তুতে পড়লাম।

- হ্যাঁরে ছোটো, পারলি এমনধারা বলতে!

ঘরের আবহাওয়া কিছুটা স্বাভাবিক করতে বললাম...

- আচ্ছা বড়দা, পুজোর তো আর এক মাসও বাকি নেই। তা এবছর পুজোয় কে কি করবে তা ঠিক করা হয়নি তো এখনও। আমি কিন্তু পুজোর সব জোগাড়জন্তি করব নিজের হাতে বলে দিলাম। মনে মনে ভাবলাম পরের বছর যদি আর না থাকি..... অতীন্দ্র যেন মনের কথা বুঝতে পেরে বলল.. অপা....

- আচ্ছা শোন বড়দি মেজদি, তোমরা আমাকে একটু একটু সাহায্য করবে পুজোর কাজে। ও বড়দি তুমি কিন্তু নাড়ু বানাবে। নারকেল, তিল, খই, চাল! দারুণ হবে। আর মেজদি তোমার হাতে বেসনের লাড্ডু আর বোঁদে কিন্তু চাই-ই চাই। আহা! রসে টুসটুসে বোঁদে মুখে গেলেই পুরো..এই দেখো না ভাবা মাত্রই কেমন মনটা আনন্দে ভরে গেল। আর আমি কি বানাবো, রাবড়ি আর পোলাও। তিন্নি আর পুপান তো খুব ভালোবাসে। তাহলে রিনির জন্য পান্তুয়া করব আর বুবানের জন্য, ও মেজদি তুমি না দু'টো মিহিদানাও বানিও বুঝলে! বড়দা, তোমার কুমোরকে বলা হয়েছে তো? আর মেজদা, তোমাকে কিন্তু পুরো খাবারদিকটা দেখতে হবে, দেখো আগের বারের মতো যেন কুমড়োতে ছাগলের ভুড়ি না দিয়ে দেয়, নয়ত আমাদের উপোস করেই থাকতে হবে অষ্টমীতে। আর এই যে রাজাধিরাজ মহারাজ অতীন্দ্র কুমার মন্ডপ সাজানো থেকে পুরো ঘরের সুন্দর করে সাজানোর দায়িত্বটা কিন্তু আপনার, কোন কাজই তো করেন না অন্ততপক্ষে এটা করে উদ্ধার করুন আমাদের।

- কাম্মা কাম্মা আমরা কি করব?

 আমাদের ঘরের সবথেকে খুদে সদস্য বড়দা মেজদার ছেলে মেয়ে তিন্নি, রিনি, পুপান আর বুবান।

 - তোমরা কাকাইকে সাহায্য করবে। কি হলো, তোমরা আমার মুখের দিকে এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?

- ছোট বউমা এবছর পুজো হবে না।

- পুজো হবে না মানে!

- না হবে না। তোমার তো শরীর ভালো নেই…

- এমন বলবেন না বড়দা, অতীন্দ্র জানে দুর্গাপুজো আমার কাছে ঠিক কি। আমি মন খুলে এ বছরটাকে উপভোগ করতে চাই, পরের বছর আর সুযোগ থাকবে কিনা জানা নেই। অতীন্দ্র.... দাদা কে বল না।

- অপা.. চুপ চুপ তুমি সুস্থ হয়ে যাও, পরের বছর ধুমধাম করে পুজো হবে।

- তুমি বুঝতে পারছো না, আমার হাতে অত সময় নেই।

- তুই চুপ কর ছোটো। তুই কি চাস পুজো হবে তাই তো? আচ্ছা বেশ পুজো হবে। হয়েছে? এমন অলক্ষুণে কথা বলা বন্ধ কর।

  

       অবশেষে বড়দির কথায় সবাই রাজি হলো। মুখার্জী বাড়িতে আবারও সাজ সাজ রব। দেখতে দেখতে কাশফুলে ভরে গেল চারিদিক। কাশবন মুখার্জী বাড়িকে এমনভাবে ঘিরে রেখেছে যেন লক্ষ্মণ বনে যাবার আগে সীতাকে লক্ষ্মণরেখা টেনে দিয়ে গেছে, সীতার অধিকার নেই তা পার করার.. পার করলেই মহা বিপদ। ঠিক যেভাবে মুখার্জী বাড়ি আমাকে ঘিরে রেখেছে। কিন্তু রাবণরূপী যমরাজ ভিখারীর বেশে এলে আমাকে যে যেতেই হবে! কোনভাবেই আর আটকে রাখা যাবে না।

         মা দুর্গার আগমনে ঝলমল করে উঠল গোটা মুখার্জী বাড়ি, পুজো চলে এল। মাঝে আর একবার অসুস্থ হয়েছিলাম, তবে আমি খুব বেশি পাত্তা দিইনি। ডাক্তারকাকু ধমক দিয়ে বলে গেলেন একটু বিশ্রাম নিতে, এত ঘোরাঘুরি নাকি উচিত না, আমি অবশ্য তাতে কান দিইনি। তবে টিউমারটা আরও বেড়েছে হয়ত অপারেশন করাতেই হবে। বাঁচার চান্স ১০% মানে না বাঁচার সম্ভাবনা বেশি। তাই খুব খুব খুব মজা করব, আমার জীবনের অন্যতম সেরা পুজো হয়ে থাকবে এটি। আর মুখার্জী বাড়িকে দেওয়া সেরা উপহার এই পুজো… তাইতো ভিডিও ক্যামেরা করেছি, আমি না থাকি আমার স্মৃতি থাকবে মুখার্জী বাড়িতে আজীবন।

 

      একে একে পুজোর দিনগুলি হাসতে হাসতে পার হয়ে যাচ্ছে ষষ্ঠীতে মায়ের বোধন, সপ্তমীতে মায়ের পুজো, অষ্টমীতে অঞ্জলী.. সন্ধি পুজো.. কুমারী পুজো, নবমীর হোম। অতীন্দ্রর দুষ্টুমি একটুকুও কমেনি, পুপান বুবানের থেকে বেশিবার বকা আর কানমলা খেয়েছে সে। সত্যি বলতে অতীন্দ্র দুষ্টুমি না করলে বেশি দুঃখ পেতাম, এই আধপাগলটাকে বড্ড ভালোবাসি। মেজদার বেসুরে বাজানো ঢাকের আওয়াজ শুনে ভট্টাচার্য মশাই কড়া গলায় ধমক দিয়ে উঠলেন, মেজদা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন। বড়দার সুগারটা নির্ঘাৎ বাড়বে, যে হারে মিষ্টি খেয়ে যাচ্ছে। বড়দিকে ঠিক যেন মা দুর্গার মতো লাগছে, যেভাবে দশহাতে সবদিক সামলাচ্ছে। আর মেজদিও কম যায় না। তিন্নি আর রিনির মলের আওয়াজ গোটা বাড়ি ছমছম শব্দে ভরে উঠেছে। পুপান আর বুবান টোটা খেলতে ব্যস্ত। স্মৃতির পাতায় বন্দি করলাম এক একটা মুহূর্তকে, কে বলতে পারে হয়ত ক্যামেরাবন্দিকে দেখার সুযোগই হলো না আর। তাই যতটা পারলাম স্মৃতিতে রেখে দিলাম মুহূর্তদের।

       অবশেষে মায়ের বিদায়ের সময় হল... দশমীটা আমার কাছে মনখারাপের পাশাপাশি খানিকটা সুখকরও বটে, কেননা দশমীর মতো খিচুড়ি আর কখনোই হয় না। আহা! দশমীর খিচুড়িতে দারুণ তৃপ্তি। দশমীতে অতীন্দ্রর থেকে একটা সদ্য গোলাপ পেলাম, রেখে দিলাম গোলাপটা নিজের কাছে খুব যত্নে খোঁপায়। ঠাকুরমশাই পুজো শেষে বলে গেলেন পরেরবার মা যেন তোমার কোল পূর্ণ করে রাখে। একটিবারের জন্য অনেক আশা নিয়ে লজ্জা পেয়েছিলাম, পরের মুহূর্তেই মনে হয়েছিল না...না... এটা সম্ভব না। মায়ের বিসর্জনের সাথে সাথে যে আমার বিসর্জনেরও সময় হয়ে এসেছে বুঝতে পারিনি।

      মাকে বিসর্জন করে ফিরেই আসছিলাম এমন সময়.....

চোখ খুলতে দেখি হসপিটালের কেবিনে ভর্তি। এখন ঘড়িতে রাত্রি দশটা, বাড়ির কেউ নিশ্চয়ই খায়নি। নিজের ওপর ভারি রাগ হলো, সাথে মনখারাপ। একে তো চলেই যেতে হবে, তার ওপর খিচুড়িটাও খাওয়া হলো না। শুনলাম কাল বিকেল পাঁচটায় আমার অপারেশন, হাতে আর মাত্র ১৯ ঘন্টা আছে। তারপর.... চিরঘুম। অপা হয়ে বেঁচে থাকার সময় শেষ, পাগল অতীন্দ্রর স্ত্রী হয়ে বেঁচে থাকার সময় শেষ, সর্বোপরি আমার সাধের মুখার্জী বাড়ির ছোটো বউ হয়ে বেঁচে থাকার সময় শেষ। তাই নার্সকে বলে আনালাম আমার প্রিয় ডাইরি আর পেন, লিখে ফেললাম বাকি অসমাপ্ত অংশটুকু। জানি মুখার্জী বাড়ি নিয়ে পুরোটা লেখার ভাগ্য আমার হলো না তবে যদি কেউ পূর্ণ করে তখন নাহয় পুরো গল্প শুনবে।

 

    তবে যতটা শুনলে কি মনে হলো মুখার্জী বাড়ির মতো চিড়িয়াখানায় নাহয় বেঁচে থাক যা ভালোবাসতে জানে বেঁধে রাখতে জানে। আমার না তাও ভয় করে আমাকে ছাড়া এরা কি আদৌ ভালো থাকবে!

       অতীন্দ্রর দেওয়া গোলাপটাকে রাখলাম ডাইরির পাশে আর লিখলাম– বিদায়….

          "হারিয়ে যাবো ভেবে ধরিনি তোমার হাত

           একসাথে চলব দু'জন এটাই ছিল সাধ,

           পথচলা একসাথে ছিলো না বুঝি আর…

           বাকি পথটুকু পারলে অন্য কাউকে

           সঙ্গে নিও, দিও তার সাথ…

           হারিয়ে যাবো ভেবে ধরিনি তোমার হাত

           ভালোবাসে থাকব পাশে এটাই ছিল সাধ।।"

              

       বড়দা-বড়দি, মেজদা-মেজদি, তিন্নি-রিনি, পুপান-বুবান, অতীন্দ্র আমি.... না..না আমি না, শুধু অতীন্দ্র, এই নিয়েই আমাদের মুখার্জী বাড়ি।

      "আছে ঝগড়া আছে আড়ি,

       তবুও হলপ করেই বলি

       শত ঝগড়ার পরেও

কেউ কাউকে ছেড়ে এক বিন্দুও

        থাকতে নাহি পারি।

একে অপরের সুখে দুঃখে

         বিপদে আপদে পাশে ,

সদা সাথে সাথেই ঠিক

থাকবেই এই মুখার্জী বাড়ি।।"

 



ছবি আন্তরজাল থেকে সংগৃহীত 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন