এখনও ১৫ ই আগস্টের দিনটি এলে মেজর রানাপ্রতাপ সিংয়ের চোখে জল দেখা যায়। দু'টি পা দেশকে রক্ষা করতে গিয়ে সঁপে দিয়েছেন তিনি। আজ পঁয়ষট্টি বছর বয়সে সম্পূর্ণ একা। দেখার জন্য একটি মেয়ে ছিল সেও কিছুদিন আগে চলে গিয়েছে। মনের জোরে লাঠির উপর ভর দিয়ে সব কাজই করার চেষ্টা করেন। তিনি বাড়ির উঠোনে ১৫ই আগস্টে পাড়ার বাচ্চাদের নিয়ে পতাকা তোলেন, স্যালুট করেন, বক্তৃতা দেন, গান করেন -- "সারে জাহান সে আচ্ছা হিন্দুস্তান হামারা"। কোন বছর গান করেন-- "ও আমার দেশের মাটি তোমার 'পরে ঠেকাই মাথা"। চোখের জলে পতাকা আবছা হয়ে আসে তাঁর। মনে পড়ে বিএসএফের চাকরি করার প্রথম দিনগুলির কথা।
১৯৭৫ সাল। মেজর রানাপ্রতাপ সিংয়ের বয়স কুড়ি বছর। পোস্টিং ছিল লাদাখে। লাদাখের অসাধারণ সুন্দর প্রকৃতি মেজরকে সব সময় আনন্দ দিত। তাঁর মনে হতো, আমার ভারতমাতা এত সুন্দর যে বিশ্বের সব সৌন্দর্য এখানেই আছে। ঠান্ডার ভিতর নিয়ম মেনেই আপন কর্তব্য পালন করতেন তিনি। শত্রুর হাত থেকে ভারতবাসী ও ভারতমাতাকে রক্ষা করার জন্য সদাজাগ্রত প্রহরীর মতো ছিলেন তিনি। হাতে দূরবীন নিয়ে সবসময় বর্ডারের দিকে নজর রাখতেন। তিনি যেখানে ছিলেন তার পাশেই চীনের বর্ডার। সাধারণত উভয় দেশের মধ্যে খুব একটা ঝামেলা হয় না। কিন্তু একটা ঠান্ডা লড়াই দীর্ঘদিন যাবৎ দুই দেশের মধ্যেই চলছে। ফলে একেবারে বিশ্বাস করা যায় না চীনকে।
তাঁর যখন লাদাখে পোস্টিং ছিল, তখন বাড়িতে নিজের বলতে ছিল বাবা-মা ও দুই বোন। বাবা সামান্য চাষ বাস করতেন ও মা পরের বাড়িতে রান্নার কাজ করতেন। দুই বোন পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত ছিল। তাই সংসারের সাথে সাথে বোনদেরও পড়াশুনোর একটা গুরুদায়িত্ব ছিল মেজরের উপর। বোনদের বিয়ে না দিয়ে তিনিও বিয়ে করবেন না বলে পণ করেছিলেন। ছয় মাস পর এক মাসের জন্য ছুটিতে বাড়িতে আসবেন বলে কথা দিয়েছিলেন মাকে। এপ্রিল মাসের দশ তারিখে লাদাখে জয়েন করেছিলেন, তখন একজন সামান্য জওয়ান ছিলেন তিনি।
পাঁচ মাস অতিবাহিত হয়ে যায়। আগস্ট মাসের এক রাত্রে প্রচন্ড ঠান্ডার মধ্যে তিনি নিজের ডিউটি করছিলেন। রাত তখন একটা। চীনের বর্ডারের দিক থেকে হঠাৎই কয়েকটি গোলাবর্ষণ হয় এবং গুলি চলে ভারতীয় জওয়ানদের লক্ষ্য করে। মেজরদের তাঁবুর পাশে এসে পড়ে একটা গোলা। তাঁবুতে আগুন লেগে যায়। যদিও সেটির মধ্যে কেউ ছিল না। পাশের দু'টি তাঁবুতে আগুন লেগে চারজন জওয়ান জীবন্ত জ্বলে শহীদ হয়েছিলেন। মাঝরাত বলে ভারতীয় জওয়ানদের তেমন প্রস্তুতি ছিল না। বেশিরভাগ জওয়ানই তখন ঘুমাচ্ছিলেন। বারুদের ও গুলির শব্দে যখন সকলের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল, তার আগেই এই বিপত্তি ঘটে গেছে। সকালবেলা ভোরের আলোতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বোঝা যায়। মোট দশজন ভারতীয় জওয়ান গোলাবর্ষণে ও গুলিতে মারা যায়। মেজর রানার মন এই দৃশ্য দেখে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। অন্যান্য ভারতীয় জওয়ানরা কাঁদছে। কারো কারো বুকের মধ্যে প্রতিশোধস্পৃহা। এই ঘটনাকে চীন সরকার পরদিন পুরোপুরি অস্বীকার করেন। তাঁরা বলেন, কোন জঙ্গি সংগঠন এই অপারেশন চালাতে পারে। চোখের সামনে সঙ্গীদের মরদেহ দেখে প্রথমে পাথরের মত হয়ে গিয়েছিলেন মেজর। পরে বুঝতে পেরেছিলেন তাদের জীবনে যেকোনো মুহূর্তে এরকম হতেই পারে। কারণ তারা তো ভারত মায়ের জন্য উৎসর্গীকৃত। পরদিন ১৫ই আগস্টের পতাকা তোলা হয়েছিল, কিন্তু কারো মনে আনন্দ ছিল না।
এই ঘটনার এক সপ্তাহ পরে ভারতীয় জওয়ানরাও একরাত্রে যুদ্ধবিমান নিয়ে চীনা জওয়ানদের তাঁবুতে গোলা বর্ষণ করেন। একশোরও বেশি চীনা জওয়ান মারা গিয়েছিল। মনের মধ্যে যে যন্ত্রণা ও প্রতিশোধস্পৃহা ছিল মেজরদের, এই ঘটনায় খানিকটা প্রশমিত হয়। পরদিন ভারত সরকারও এই ঘটনাকে পুরোপুরি অস্বীকার করেন। চীন ও ভারতের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক আরো তলানিতে এসে ঠেকে। এই ঘটনার একমাস পর অর্থাৎ সেপ্টেম্বর মাসের শেষে, একমাসের ছুটি নিয়ে মেজর রানাপ্রতাপ বাড়িতে এসেছিলেন। মাকে যেমন কথা দিয়েছিলেন, তেমনি রেখেছিলেন। লাদাখে চাকরি করেছিলেন সাত বছর। তারপর তাঁর পোস্টিং হয়েছিল পাঞ্জাবে।
পাঞ্জাবে ছিলেন দশ বছর। তাঁর বীরত্ব ও বুদ্ধিমত্তার জোরে প্রমোশন হয়েছিল। চীনের সঙ্গে ঠান্ডা লড়াই চললেও, এখানে অপর দেশ পাকিস্তানের সঙ্গে আদায়-কাঁচকলায় সম্পর্ক ছিল। বিকেলবেলা উভয় দেশের প্যারেড হত। সেখানে প্রত্যেকে খুব সিরিয়াস থাকতেন। মাঝেমধ্যে মারামারি বেঁধে যেত উভয় জওয়ানদের মধ্যে। একদিন মাঝরাতে তিন পাকিস্তানি অনুচর তারকাঁটা পেরিয়ে ভারতবর্ষে ঢুকেছিল। গুলির লড়াই চলেছিল তাদের সঙ্গে। মেজরের কানের কাছ থেকে একটা গুলি চলে যায়। অল্পের জন্য প্রাণে বাঁচেন তিনি। তবে তাঁর গুলিতে একজন পাকিস্তানী জঙ্গি মারা গিয়েছিল। একটু ভয় পেলেও পরে নিজেকে সামলে নিয়েছিলেন তিনি। সাতাশ বছর থেকে সাঁইত্রিশ বছর পর্যন্ত পাকিস্তানের বর্ডারের নিকটে ছিলেন মেজর রানাপ্রতাপ। এখানে থাকাকালীন প্রতিটি মুহূর্তে প্রাণ হাতের মুঠোয় নিয়ে চলতে হয়েছে। আশা-আতঙ্কের মধ্যে দিয়ে জীবন অতিবাহিত হয়েছে। ১৫ই অগাস্টের দিন পতাকা তোলা হতো এখানে অনেক নিয়ম করে, অনেক সময় ধরে। বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এইদিন বর্ডারে আসতেন।
পাঞ্জাবে পোস্টিং থাকাকালীন বেশ কয়েকবার বাড়িতে ছুটি নিয়ে এসেছেন তিনি। তাঁর দুই বোনকে বিয়ে দিয়েছিলেন সুপাত্র দেখে। নিজে বিয়ে করবেন ভেবেছিলেন, কিন্তু করেননি। বাবা মারা গিয়েছেন অসুখে। মাকে দেখাশোনার জন্য একটি মেয়েকে রেখেছিলেন। তিনি যে কেন বিয়ে করেননি তার একটা কারণ ছিল। স্কুলে পড়ার সময় একটি মেয়েকে ভালোবাসতেন তিনি। মেয়েটি ছিল কোটিপতি বাপের একমাত্র মেয়ে। তাঁদের বিএসএফের চাকরি পছন্দ ছিল না। মেয়েটি রাজি থাকলেও তার বাবা-মা রাজি ছিলেন না। তাঁকে বলেছিলেন চাকরি ছেড়ে দিয়ে ঘরজামাই হয়ে থাকার জন্য। কিন্তু মেজর রানাপ্রতাপ রাজি হননি। দেশমায়ের প্রতি তাঁর যে নাড়ির টান এবং ভালোবাসা ছিল, তার জন্য নিজের ভালবাসার মেয়েটিকে ছেড়ে দিতে একবিন্দু ভাবেননি তিনি। শুনেছিলেন মেয়েটির নাকি এক বিরাট কোম্পানির মালিকের একমাত্র ছেলের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। প্রথম প্রথম মেজরের মনটা ভারাক্রান্ত হলেও বর্তমানে কিছু মনে করেন না। দেশের কথা ভেবে তাই কাউকে জীবনসঙ্গিনী করেননি।
পাঞ্জাবের পর পোস্টিং পড়েছিল নিজের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের পেট্রাপোল বর্ডারে। ওপারে বাংলাদেশের বর্ডারের নাম বেনাপোল। মেজর এখানেও চাকরি করেন দশ বছর। সারা জীবনে সবথেকে ভালো ছিলেন এখানে। এখানে থাকাকালীন বাংলাদেশের সঙ্গে কোনো ঝামেলা ভারতীয় জওয়ানদের বাঁধত না। একটা সৌজন্যমূলক সম্পর্ক ছিল তাদের সঙ্গে। শুধুমাত্র সমস্যায় পড়তে হতো গরু পাচার করার সময়। যারা পাচার করত তাদের অনেকবার হাতেনাতে ধরেছেন তিনি। একবার দু'জন যুবক মাঝরাতে তারকাঁটা পেরিয়ে বাংলাদেশে ঢুকছিল। বারবার বারণ করলেও তারা শোনেনি। তাদের উদ্দেশ্য করে গুলি করেছিলেন ভারতীয় জওয়ানরা। কিন্তু তারা বসে পড়ায় তাদের বুকে গুলি লেগেছিল এবং তারা মুহূর্তের মধ্যে মারা যায়। এই ঘটনা মেজরকে খুব দুঃখ দিয়েছিল। এখানেও তাঁর বেশ কিছু বীরত্বমূলক কাজের নজির গড়ে উঠেছিল। তাঁকে আরেকটু এগিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছিল।
এরপর কর্মজীবনের শেষ পাঁচ বছর তাঁর কেটেছিল কাশ্মীরে। দীর্ঘ চাকরি জীবনের এই পাঁচ বৎসর তার সবচেয়ে স্মরণীয় রাখার মত। পাহাড়ের উপর এই সময় বেশিরভাগ সময়টা কাটাতে হয়েছিল। এই পাঁচ বছরেই ঘটে গেছে তাঁর জীবনে অনেক মর্মান্তিক ঘটনা। ছোট বোন বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায়। বড় বোনের স্বামী গাড়ি দুর্ঘটনায় দু'টি হাত হারায়। মা পরলোকগমন করেছেন। মারা যাওয়ার আগে ছেলেকে দেখার জন্য খুব ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, কিন্তু দেখতে পাননি। কর্তব্যের কাছে ছেলে পরাধীন ছিলেন। মায়ের শেষসময় পাশে থাকতে না পারায় ও মুখে জল দিতে না পারায় খুব কান্নাকাটি করেছিলেন তিনি। এক মাকে রক্ষা করতে আর এক মায়ের অন্তিম সময়ে থাকতে পারেননি। সালটি ছিল ১৯৯৯। তিনি তখন মেজর। পাকিস্তানের সাথে ভারতের কাশ্মীর নিয়ে যুদ্ধ হচ্ছে। বিএসএফের জওয়ানরা ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে একজোট হয়ে যুদ্ধ করছে। প্রতিটা মুহূর্তে হাতের মুঠোয় জীবন। চোখের সামনে কত জওয়ানের লাশ কফিনবন্দি হয়ে চলে যাচ্ছে নিজের মানুষদের কাছে। চোখের জলে বাঁধ মানে না, তবুও মনকে শক্ত করে 'ভারত মাতা কি জয়' স্লোগানে শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়েছিলেন। নিজের রেজিমেন্টের জওয়ানদের বলেছিলেন 'যব তাক হ্যায় জান, হাম নেহি ছোড়েঙ্গে'। মেজর কণাদ, ক্যাপ্টেন রনিক, মেজর জীবন সকলেই ভারতমাতার জন্য নিজেদের প্রাণ বলিদান দিয়েছিলেন। অনেকদিন ধরে দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ চলেছিল।
মেজর জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয় দিনটি ওই বছরের ১৫ই জুন। সকাল থেকে যুদ্ধ চলছে। তিনি ও তাঁর জওয়ানরা লড়াই করছেন। হঠাৎ পাঁচ জন সশস্ত্র পাকিস্তানি জওয়ান তাদের সামনে রকেট লঞ্চার, বন্দুক নিয়ে চলে আসে। গুলি করে চারজনকে মারা গেলেও একজনকে সম্ভব হয়নি। তার রকেট লঞ্চারের গোলা এসে পড়েছিল মেজরের পাশে। অনেক চেষ্টা করেছিলেন লাফিয়ে প্রাণ বাঁচানোর। প্রাণ বেঁচে ছিল, কিন্তু যখন জ্ঞান এসেছিল তখন দেখলেন, তাঁর দু'টো পা নেই। প্রথমে আতঙ্কিত হয়েছিলেন ও প্রচণ্ড চিৎকার করে কান্নাকাটি করেছিলেন। কিন্তু তাঁর এই বলিদানের জন্য সকলে তাঁকে স্যালুট জানিয়েছিল। তারপর এক মাস পর মেজরকে বাড়িতে পৌঁছে দেন জওয়ানরা। সেই মেয়েটি যে তাঁর মাকে দেখতো সেই তাঁকে দেখাশোনা করত। প্রতিবছর ১৫ই আগস্ট দিনটি এলেই কিছু করার জন্য তাঁর মন সাংঘাতিক চঞ্চল হয়ে উঠত। একাকী জীবন, অসহায় জীবনেও লড়াই দেওয়ার চেষ্টা করতেন তিনি। দু'টি পা না থাকলেও হাল ছেড়ে দেননি। গ্রামের মানুষ তাঁকে প্রচন্ড সম্মান করতো। তাঁকে সম্মান জানিয়ে তাঁর একটা পাথরের মূর্তি বসিয়েছিলো বাজারে। যেখানে লেখা ছিল, "আমরা তোমার মত মানুষকে পেয়ে ধন্য। জয় মেজর রানাপ্রতাপ সিং। জয় ভারত।"
ছবি - আন্তরজাল থেকে সংগৃহীত
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন