মনের শখে পত্রিকার অফিসে চাকরি নেই। বড্ড শখ ছিল, দেশবরেণ্য সাংবাদিক হব। সবসময় সত্যের সন্ধানে; সত্যের পক্ষে কাজ করবো। মানুষের জীবনের সত্য - মিথ্যা খুঁজতে গিয়ে নিজের জীবনের সত্য - মিথ্যা কবে যে বিলীন হয়ে গেছে সেটা স্বয়ং ঈশ্বর ছাড়া আর কেউ জানে না। পত্রিকার অফিস বলতে এখন তেমন কিছুই নেই। যা আছে তা হল কর্পোরেট দুনিয়া। লাভ লোকসানের হিসাব ছাড়া এই দুনিয়ায় আর তেমন কিছুই নেই। পত্রিকার পাতা খুলে সবাই খুশি হয়ে বলে, "বাহ্! কী সুন্দর মানবতার কথা এই পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। মানবদরদী পত্রিকা বলে কথা!" বাস্তবিক চিত্রটি কিন্তু ভিন্ন। সবচেয়ে অমানবিক কাজগুলো হয় আজকাল পত্রিকার সকল অফিসে। যেমন ধরুন, পত্রিকার অফিসের কর্মচারীদের কথাই বলি। শুক্র, শনি কোনদিন ছুটি নেই। বছরে মাত্র দিনচারেক ছুটি পাওয়া যায়। সেটাও আবার ছুটি না। অনলাইনে কাজ করতে হয়। মোদ্দা কথা কোন ছুটি নেই। কাজ আর কাজ। পত্রিকার অফিসের সকল কর্মচারী যেন মানবিক রোবট। মানবতা বলতে এখানে তেমন কোনকিছুই পাওয়া যায় না। পত্রিকার অফিসে যারা কাজ করে আসলেই তারা আধুনিক যান্ত্রিক রোবট। তাদের জীবন খিস্তিতে ভরপুর। বউকে ঠিকভাবে সময় দিতে না পারায় বউয়ের হাতে সকাল সন্ধ্যা খিস্তি। আমাকে বিয়ে করে জীবনে সে নাকি সবচেয়ে বড় ভুল করেছে, এটা তার কমন ডায়লগ। বাবা, মা এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের কথা নাহয় বাদই দিলাম। অফিসে বসের খিস্তি। বাইরে রাজনৈতিক দলের খিস্তি। নেতাদের খিস্তি। সাধারণ পাঠকের খিস্তি। এ যেন খিস্তির শহর। যাইহোক, একথা বলে লাভ নেই। আসল কথায় আসি।
গতকাল সোমবার ঈদ উপলক্ষে রাতে গ্রামের বাড়িতে এসেছি।
সকালে ঈদের নামাজ পড়ে একটু ঘুমিয়ে এইমাত্র রাস্তাতে আসলাম, একটু ঘোরাঘুরি করবো
বলে। ছোট ছোট পোলাপান কোথা থেকে ছুটে এসে কেউ ছবি নিচ্ছে, কেউ বা ভিডিও। এ কী
কাপধাপ। এলাকার ছেলেমেয়েদের টিকটক, ফেসবুক, ইউটিউব ইনস্টাগ্রাম ইত্যাদিতে আমি থেকে
আমিময় হয়ে উঠলাম। সত্যি নিজে নিজেই গর্ববোধ মনে হতে লাগলো। তাহলে কী সত্যি আমি
দেশবরেণ্য সাংবাদিক হতে পেরেছি? হয়তো বা পেরেছি।
অনেক দূর থেকে আলি চাচার বড়ছেলে হারুন বাচিক মিয়া হাত ইশারা
করে আমাকে ডাকছে। আমি তার হাতের ইশারা দেখে কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, "কেমন
আছেন মিয়া ভাই?"
আলি চাচা মারা যাওয়ার পর এখন গ্রামের মাথা (মোড়ল) হারুন
বাচিক মিয়া। সবাই তাঁরে মিয়া ভাই বলে সম্বোধন করে।
- এই তো আছি। আল্লাহ্ যেমন রাখে। তবে খুব একটা ভালো নেই।
- কেন মিয়া ভাই? কী হয়েছে?
- শুইনো না, শাবলু । তুমি তো দেশে-ভুইত তেমন একটা আসো
না। তাই অনেক কিছুই জানো না। গত মাসে আমাদের গ্রামে একজন বিদেশী মানুষ এসেছেন। নাম
শুফম। সবাই এখন তারে শুফম পাগল বলে ডাকে। আবার কিছু কিছু নেশাখোর মানুষ তাকে শুফম
পাগল বাবা বলে পীর সাহেব হিসেবে মানতে চায়। তুমি তো ভালো করেই জানো আমি পীর মুরিদ
মাজার ইত্যাদিতে বিশ্বাসী নয়। আমার কাছে এইসব কাজ ভণ্ডামি হিসেবে মনে হয়। এইজন্য
অনেকেই আমাকে গ্রামের প্রধান হিসেবে মানতে চায় না। তাদের কাছে আমি নাকি নাস্তিক।
সে যাইহোক। প্রধান সমস্যায় আছি ঐ লোকটাকে নিয়ে। বলো তো কী করি?
- সমস্যাটা কী মিয়া ভাই? আর লোকটা থাকে কোথায়? আমি তাকে
দেখতে চাই?
- আচ্ছা চল আমার বাড়িতে। সে এখন আমার বাড়িতে আছে।
চলতে চলতে মিয়া ভাই তার সম্বন্ধে অনেক কিছুই বললো।
- প্রথমে যখন শুফম পাগল ঐ গ্রামে আসে তখন দিনের বেলায়
বাজারে থাকতো আর রাতের বেলায় প্রাইমারি স্কুলের বারান্দায় ঘুমাত। দেখলে কেউ পাগল
বলবে বলে মনে হয় না। সারাদিন চুপচাপ থাকতো। এই অদ্ভুত লোকটা হঠাৎ একদিন সকালে
পুরোহিত গোপাল ঠাকুরের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। "এই শালা মালায়ন গোসল
কর" এই বলে পুরোহিত গোপাল ঠাকুরকে ধাক্কা দিয়ে রাস্তার পাশের পুকুরের পানিতে
ফেলে দেয়। তাই দেখে মোল্লা বাড়ির মসজিদের ইমাম সাহের এগিয়ে আসে; পাগলকে তাড়িয়ে
দিতে। পাগল ইমাম সাহেবকে ইচ্ছে মতো গালিগালাজ করে – "শালা তুই আগে জাহান্নমে
যাবি। শালা সুদখোরদের দানের টাকা হাতে পেলে জোরে জোরে লিল্লাহি তাকবির। দানবীর
দানবীর বলে চিল্লাও। শালা হারামখোরদের মসজিদে ইমামতি করো। অবিবাহিত অনামিকার পেটে
বাচ্চা এসেছিল বলে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেও। এই ইমাম সাহেব কুত্তার বাচ্চা। ঐ মেয়ের
পেটের বাচ্চা কার ছিল তাতো কাউকে বললি না, শালা ইমাম। ওটা তো তোর ছোট ভাই কালামের
বাচ্চা। কালামের অপরাধ মাথায় নিয়ে মেয়েটি দেশ ছেড়েছে। বিদেশে গিয়ে ফাঁসির দড়িতে
ঝুলে জীবন দিলো। তোদের জন্য আজ বাংলাদেশের হিন্দুরা সুখে শান্তিতে থাকতে পারে না।
তোদের মত লোভী, হিংসুক, জমি ও নারীলোভী নেতা, মোল্লা, মুছুল্লি, পীর, কামেল, দলের
চাটুকারের কুদৃষ্টির জন্য হাজার হাজার হিন্দু দেশ ছেড়ে পলাতে বাধ্য হয়েছে। এ ইমাম
তোর দৃষ্টি ঠিক কর। নাদুসনুদুস মেয়ে হালিমার নাভী এবং বুকের দিকে না তাকালে বুঝি
তোর পেটের ভাত হজম হয় না। আমার চোখের সামনে থেকে সরে যা। ইমান ঠিক করে ইমামতি কর।
নইলে তোর কপালে জাহান্নম আছে। এ পুরোহিত পানিতে ডুব দে। গোকুল চন্দ্র বসুর স্ত্রীর
পেটে বাচ্চা দিবি বলে আজ সারা রাত ধরে মন্দিরে তার স্ত্রীকে ধর্ষণ করেছিস। তুমি
শালা শয়তানের হাড্ডি। ভগবানের নামে নানা কুকর্ম করছিস; মানুষের চোখের আড়ালে। গোসল
করে শপথ নে। আজ থেকে ভালো হয়ে যাবি।"
সে যাত্রায় পুরোহিত বেঁচে গেলেও তার কিছুদিন পরে তিনি দেশ ছেড়ে ভারতে চলে গেলেন। মোল্লা
বাড়ির মসজিদের ইমাম সাহেব পলাতক আছেন। আরো কী যে সব বলে তাতে গ্রামে থাকা দুষ্কর
হয়ে যাচ্ছে। কখনো আওয়ামী লীগ বিরোধী কথা বলে। কখনো বা বিএনপি জামাত কিংবা জাতীয়
পার্টির সমালোচনা করে। এইতো গত মঙ্গলবারে বিশাল এক তর্ক সৃষ্টি করে দেয় বাজারে সকল
চায়ের দোকানে। তথ্যমন্ত্রী টেলিভিশনে কী যেন বলছিল তাতেই চটে যায় এই পাগল। অকথ্য
ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে তথ্যমন্ত্রীকে। এই পাগলের সায় দিয়ে বিএনপি করে এজাজের
ছেলে মামুন কিছু কথা বলতেই মহিউদ্দিন মাস্টারের ছেলে ছাত্রলীগের নেতা তাকে বেদম
মারধর করে। সেই নিয়ে কী যে কাণ্ড ঘটে যায় তা বলার মত নয়। বিএনপির মহাসচিব মির্জা
ফখরুল ইসলামকে সে মিথ্যাবাদী বলে নানা কথা বলে। আমার মনে হয় এই পাগলের সত্যবচনে
কবে যে গ্রামে আওয়ামী লীগ বিএনপি দাঙ্গা লেগে যায়। দয়া করে এই পাগলের হাত থেকে
আমাদের রক্ষা কর শাবলু।
মনে প্রাণে ইচ্ছে করছিল সবাইকে এই পাগলের হাত থেকে রক্ষা
করবো। মিয়া ভাইয়ের বাড়িতে গেলাম। পাগলের রুমের দরজায় টোকা দিয়ে রুমে ঢুকতেই পাগল
আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, "কী সাংবাদিক শাবলু, কেমন আছেন?"
- আলহামদুল্লিল্লাহ, ভালো। তুমি কেমন আছো, শুফমদা?
কথাটি শেষ করে আমি বড় আশ্চর্য হলাম। এই পাগল কেমনে আমার
নাম জানলো! আমি তো কোনকালেও ওর মুখ দেখি নাই। এমনকি সে আমার পেশাও জানে।
- কী শাবলু মিয়া এতো আশ্চর্য হওয়ার কিছুই নেই। আমি আপনার
সম্বন্ধে অনেক কিছুই জানি। যেমন, প্রথম জীবনে আপনি ছিলেন ছাত্র শিবির। সেই সূত্রে
জাতীয় দৈনিক সংগ্রামে চাকরি পেয়ে যান। কিছুকাল সেখানে কাজ করার পড়ে একটা অভিজ্ঞতা
অর্জন হয়। সেটাকে পুঁজি করে জীবনের উচ্চাকাঙ্ক্ষায় লিপ্ত হয়েছেন। তারপরে নয়া
দিগন্ত, দিগন্ত টিভি, আমাদের সময়। কালক্রমে ভোরের কাগজ, প্রথম আলো সহ আওয়ামী লীগ
সুবিধা দিলো। কিছু দিন বলেই কাজ করলেন তাদের পত্রিকায় দৈনিক ইত্তেফাক, বাংলাদেশ
প্রতিদিন, কালের কণ্ঠ সহ ৭১ টেলিভিশনে। আজ এ পত্রিকা, কাল ঐ পত্রিকা। আজ এ টিভি,
কাল ঐ টিভি। এভাবে নিজের ভিত করেছেন অনেক মজবুত। র, মোসাদ থেকে শুরু করে আমেরিকা
ইনটেলিজেন্সের এদেশিও এজেন্টও হয়েছো বটে। রাজনীতি থেকে দুর্নীতি, দুর্নীতি থেকে
সুনীতি, সুনীতি থেকে অবৈধ অর্থনীতি সব তোমাদের মত সাংবাদিকদের হাতে ধরা। কী এমন
বেতন পাও! যা দিয়ে ঢাকার শহরে সাত তলা একাধিক নামে বেনামে ভবন নির্মাণ করো?
বিএমডব্লিউ ছাড়া চলতে পারো না। সাংবাদিক সাহেব সাবধান হও। একদিন মরতে হবে।
শুফমের সামনে আমি আর বসে থাকতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল
ওর মুখ দিয়ে অগ্নিশিখার লেলিহান রশ্মি বের হচ্ছে। আমার দৃশ্যমান লোকসমাজে যত
গুণকীর্তন আছে সব যেন সেই আগুনে পুড়ে বিনাশ হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং এখান থেকে পালিয়ে
যাওয়াই উত্তম।
"মিয়া ভাই চলেন উঠি" বলে আমি দাঁড়িয়ে গেলাম।
পাগলে কিনা বলে ছাগলে কী না খায়। এই কথা বলে মিয়া ভাইয়ের কাছে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার
চেষ্টা করলাম। উঠে চলে আসতেই শুফম পিছন থেকে আমাকে ডাক দিয়ে বললো, "সাংবাদিক
সাহেব বলে তো গেলেন না, আমি আর কতদিন টিকতে পারবো এই গ্রামে? নাকি হাসান-রুমির মত
আমাকে টানতে হবে জীবনের ইতি!"
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন