কিন্নর কৈলাস
কিন্নর দেশে : কল্পা – ০১
কিন্নর দেশের কথা প্রথম পড়ি শ্রদ্ধেয় উমাপ্রসাদ
মুখার্জীর বইতে, তারপর রাহুল সাংকৃত্যায়নের বই ও পড়া হয়।
তখন থেকেই সেই কিন্নর দেশে যাওয়ার ইচ্ছেটা ছিল, এত বছর পর সেই সুযোগ এল।
দিল্লি থেকে সিমলা হয়ে, সেই প্রাচীন কালে যার নাম ছিল হিন্দুস্তান - তিব্বত
রোড (NH - ২২), সেই পথে নাড়কান্ডা, রামপুর হয়ে যাত্রা। প্রায় পুরো পথেই শতদ্রু নদী সঙ্গী। দু‘পাশেই পাহাড়, অপরূপ রূপ দেখতে দেখতে পৌঁছে যাই কিন্নর প্রদেশের দ্বারে।
এখন কিন্নর দেশ হিমাচলের উত্তর পূর্ব কোণে একটি জেলা। উত্তরে স্পিতি, পূবে তিব্বত সীমা, দক্ষিণে উত্তরাখন্ড আর পশ্চিমে কুলু ও সিমলা জেলা।
কিন্নর দ্বার – পাহাড় কেটে কিন্নরে যাওয়ার রাস্তা
শতদ্রু, স্পিতি ও বাষ্পা এই তিনটি উপত্যকার দেশ। হিমালয়ের তিনটি পর্বত শ্রেণীও এখানে, উচ্চ, জাস্কর আর ধৌলাধার। তিব্বত থেকে শতদ্রু নদী এই পর্বত শ্রেণী গুলি ভেদ করে
নেমে এসেছে।
করচামের
কাছে ডান দিক থেকে বাষ্পা নদী নেমে এসে শতদ্রুতে মিশেছে। ওই দিকে বাষ্পা বা সাংলা
উপত্যকা। শতদ্রু নেমে আসছে বাম দিক থেকে, সেদিকে স্পিতি যাবার রাস্তা। সে পথে শতদ্রু পেরিয়ে, রিকং-পিও হয়ে কল্পা প্রথম গন্তব্য।
পথে মাঝে মাঝেই দেখা দেয় কিন্নর কৈলাশ, বিশাল উঁচুতে বরফাবৃত। অনেক আকৃতির মধ্যে একটি অনেকটা কৈলাশ পর্বতের মতই।
রিকং-পিও থেকে বাম দিকে চড়াই ভেঙ্গে উপরে কল্পা
পৌঁছলাম। শান্ত শিষ্ট জায়গা, চারদিকে পাইন বন, “চিলগোজা” বলে। এই গাছের ফলকে বলে ‘ন্যাজা’, আপেল আর এই ন্যাজা
এখানকার বিখ্যাত ফসল।
অনেক আগে পড়া বইয়ে শুধু গ্রামের
উল্লেখ ছিল। এখন অনেক আধুনিক
দপ্তর, বাজার ইত্যাদি দেখতে পাওয়া যায়। প্রাচীন গ্রাম এখনো আছে এক পাশে। হোটেলে ঘরে
ঢুকেই দীর্ঘ যাত্রার ক্লান্তি এক নিমেষে উধাও। জানলার সামনেই দিগন্ত জুড়ে সেই
কিন্নর কৈলাশের দৃশ্য। সারা রাস্তা কতবার থেমেছি যে দৃশ্য দেখার জন্য, সে দৃশ্য সর্বদা চোখের সামনে এখন। আসা সার্থক।
কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর চললাম রোঘি গ্রামের দিকে। অনেক শুনেছি এই গ্রামের কথা। আপেল আর ন্যাজার জন্য বিখ্যাত। ফল ভর্তি সেই
আপেলের গাছ চারিদিকে, যাকে ক্রিমসন রং
বলে সেই রঙের আপেল। কিছু সবুজ আপেল ও দেখতে পেলাম। হাত বাড়ালেই পেড়ে নেওয়া যায়।
রোঘি গ্রামের বাড়ি
রোঘি গ্রাম এই আপেল এর জন্য বেশ সমৃদ্ধ। ট্রাক ভরে
চালান হচ্ছে। তবে গ্রামে অনেক বাড়ি-ঘর খালিই দেখি। সরকারি হিসেবে জনসংখ্যা ৩৫০
মাত্র। হিমাচলি স্থাপত্যের স্লেট পাথরের ছাওয়া ছাদের বাড়ি ও কিছু নজরে আসে। ভেবে
অবাক লাগে এত দূরে, এত উঁচুতে, নিভৃতে বেশ চলছে এদের জীবন। ছোটবেলায় পড়া সেই গ্রামে
আজ এতদিন পরে আসা হল তবে !
কৈলাশের মাথায় শিবলিঙ্গ
হোটেলে ফিরে কিন্নর কৈলাশের রূপ দেখি আর গল্প শুনি। প্রায় ৪৮০০ মিটার উঁচু, হিন্দু আর বৌদ্ধ, দুই ধর্মেরই পূজ্য। শিব পার্বতীর আবাস, পার্বতী কুন্ড বলে একটি কুন্ডও নাকি আছে। দূর থেকে একটি খাড়া পাথর দেখা যায়। সেটিকে শিবলিঙ্গ বলে মান্যতা দেওয়া হয়। প্রায় ৮০ ফিট উঁচু, সূর্যের আলোয় রং বদলায়। শিবভক্ত অসুররাজা বান নাকি এই শিবলিঙ্গ প্রতিষ্ঠা করেন।
এই কৈলাশেরও পরিক্রমা হয়, তীর্থযাত্রীরা করেন।
সাহসী পর্যটকেরাও যান। এই পর্বতশ্রেণী
বেশির ভাগই ন্যাড়া, সামান্য কিছু
সবুজের ছোপ। একে ডিঙ্গিয়ে মৌসুমী মেঘ ওপারে যেতে পারে না বলেই, স্পিতি এলাকা বৃষ্টিশূন্য।
জানালার সামনে বসে বসে দেখি কৈলাশের শোভা। কিছু নিচে প্রাচীন কল্পা গ্রাম নজরে আসে, কাল ওদিকে যাওয়া।
অন্ধকার হয়ে আসে, ঘন অন্ধকারে মাঝে মাঝে আলোর আভা নজরে আসে। সেই আলো আছে বলেই বুঝি যে একাকী নই এখানে। নিস্তব্ধ চারিদিকে। অন্ধকারেও কিন্নর কৈলাশের
বিশালতার ছায়ালেখ অনুভূতিতে আসে।
মনে এক অদভুত প্রশান্তি আসে, অনেকের মধ্যে আরেকটি ইচ্ছাপূরণের প্রশান্তি। তাই অনায়াসে ঘুমের দেশে চলে যাই।
কিন্নর দেশে : কল্পা – ০২
কিন্নর দেশে কল্পায় দ্বিতীয় দিন।
ঘুম ভাঙ্গতেই সূর্যের প্রথম রশ্মিতে উদ্ভাসিত কিন্নর
কৈলাশ দর্শন। যেন একমুখ হাসি নিয়ে সুপ্রভাতের সম্ভাষণ।
আজ এসেছি প্রাচীন কল্পা গ্রামে। আগে নাম ছিল চিনি।
বহু পুরানো, বহু পরিচিত।
প্রাচীন, নবীন স্থাপত্যের ঘর
-বাড়ি মিলে মিশে বেশ আছে। অবাক হলাম প্রচুর
হোম স্টে দেখে। কিন্নর অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মের এখনো বেশ প্রভাব আছে। হিন্দু আর বৌদ্ধ
পাশাপাশি এক সাথে থাকে। তাই মন্দির ও আছে, মঠ ও আছে।
বৌদ্ধ মঠের নাম হু -বু -লান -কার মঠ। অতি প্রাচীন (
৯৫০-১০৫৫ AD ), প্রতিষ্ঠাতা রিনচেন
- সাং -পো যিনি অনেক সংস্কৃত পুস্তকাদি তিব্বতিতে অনুবাদ করেন। তিব্বতি স্থাপত্য, প্রবেশপথে প্রার্থনা চক্র। এখনো খোলে নি, কিন্তু আমাকে দেখে, এক মহিলা এসে দরজা
খুলে দিলেন, ফটো ও তুলতে দিলেন।
কিন্তু ভিতরে প্রবেশে মানা, তাই বোঝা গেল না বুদ্ধের
কোন রূপ। যাই হোক
বুদ্ধমূর্তি সব সময় মন শ্রদ্ধায় ভরিয়ে দেয়।
কিছুটা দূরেই নারায়ণী নাগিনী মন্দির। কাঠের তৈরী তিব্বতি স্থাপত্য। মন্দির বন্ধ, কিন্তু বাইরের কাঠের কারুকার্য দেখে মোহিত হয়ে যাই। নারায়ণী অর্থাৎ লক্ষী আবার নাগিনীর মন্দির বলে, দুটোই বলে। ব্যাপারটা ঠিক পরিষ্কার হল না, ভেতরে প্রবেশ ও নিষিদ্ধ। তবে সব জায়গায় নাগিনীর প্রতিমূর্তি দেখি, কাঠে খোদাই করা বা প্যাগোডা স্থাপত্যের বিভিন্ন অংশে।
কল্পা দুর্গ
আরেকটু এগোলেই এ জায়গার সবচেয়ে উঁচু কল্পা দূর্গ। দেবী চন্ডিকা দূর্গ বলে। দূর থেকে দেখা যায় এই বিশেষ
গড়নের হিমাচলী স্থাপত্য। পাথর ও কাঠের তৈরী
একটি টাওয়ার। উপরের অংশ কাঠের
তৈরী, ঢালু ছাদ। সুন্দর
প্রবেশ দ্বার। আসল প্রাচীন দূর্গটি বোধ হয় ধ্বংস হয়ে গেছিল, এটি ২০১৪ সালে তৈরী। করচামের কাছে সাপনিতেও আরেকটি প্রাচীন
ধ্বংসপ্রাপ্ত দূর্গ আছে শুনলাম।
পাশেই স্কুল। ১৮৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত কিন্নর জেলার
প্রথম স্কুল। মনে পড়ে গেল উমাপ্রসাদ মুখার্জীর বইয়ে পড়েছিলাম, এক বাঙালী শিক্ষকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল এখানে। তার
নাম ছিল লেফটেন্যান্ট মিত্র।
কিন্নরী দল
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন