“কথঞ্চিৎ ইতিহাস নির্ভর আখ্যান” – কৃষ্ণাদ্বাদশীর মেঘ

 

 



বই - কৃষ্ণাদ্বাদশীর মেঘ

লেখক – সন্মাত্রানন্দ

প্রকাশক – ধানসিড়ি

প্রকাশকাল – রথযাত্রা ১৪২৯

প্রচ্ছদ – সেঁজুতি বন্দ্যোপাধ্যায়

মুদ্রিত মূল্য – ২৭৫ /-

পৃষ্ঠা – ১৭৫

সন্মাত্রানন্দ মহারাজের বই আগে যারা পড়েছেন তাঁরা সকলেই জানেন যে উনি এক ভিন্ন ঘরানার লেখক। ওনার লেখার সাথে পরিচিতি ঘটে ‘নাস্তিক পণ্ডিতের ভিটা’র মাধ্যমে। এই একটি বই পড়েই মুগ্ধতায় ভরে যাই। তাই ওনার লেখা আরও বই পড়ার ইচ্ছা থেকেই এবারের কলকাতা ভ্রমণে মহারাজের লেখা দুটি বই কিনলাম।যার একটি “কৃষ্ণাদ্বাদশীর মেঘ”। এই বইয়ের নামের মধ্যে আংশিকভাবে লুকিয়ে আছে বইয়ের বিষয়।যারা মহারাজের লেখার সাথে পরিচিত, তাঁরা জানেন যে ওনার রচনা শুধু গল্প বলে না, একটি সুন্দর চিত্রও অঙ্কন করে। পাঠক খুব সহজেই গল্পে বর্ণিত চরিত্র, পরিবেশ, পরিস্থিতি সম্পর্কে ধারণা করতে পারেন। সন্মাত্রানন্দ মহারাজের যে কোনও লেখা পড়লে চোখের সামনে একটা দৃশ্যপট রচিত হয়। সেখানে পণ্ডিতের গ্রামীণ টোল থেকে শুরু করে কলকাতার সংস্কৃত কলেজ যেমন দৃশ্যমান হয়, তেমনি রাজ দরবারের কার্যকলাপ থেকে শুরু করে বৌদ্ধ স্তূপের ধর্মাচারণের মন্ত্রাবলীও যেন শুনতে পাওয়া যায়। এই বইও ব্যতিক্রম নয়।

“কৃষ্ণাদ্বাদশীর মেঘ” নামটি শুরুতেই পাঠকের মনে এক আবেশ সঞ্চার করে। সাথে স্বপ্নালু প্রচ্ছদও যোগ্য সঙ্গত করে দেয়। এই বই মূলত বারোটি গল্পের সংকলন। অতীতের সাধারণ থেকে কিংবদন্তী চরিত্র ও তাঁদের জীবনকাহিনী বা জীবনে ঘটা সামান্য বা অসামান্য ঘটনাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে এক একটি কাহিনী।এই প্রসঙ্গে বইয়ের শুরুতে লেখক লিখেছেন –

“আমার পূজনীয় বিদ্যাগুরু আচার্যগণ আমাকে শাস্ত্রাদি পড়ানোর পাশাপাশি গল্পচ্ছলে আমাদের দেশের প্রাচীন পণ্ডিত, কবি, দেশপ্রমিক, সাধক ও দার্শনিকদের জীবনকথা বলতেন। পড়ে নানা মুদ্রিত গ্রন্থে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত অবস্থায় সেসব আখ্যান আমি খুঁজে পেয়েছি। বহুদিন ধরে তাঁদের সঙ্গে থেকেছি। তাঁদের সময়, তাঁদের পৃথিবীকে মনশ্চক্ষে দেখবার চেষ্টা করেছি। এই সংকলনের বারোটি গল্প আমার সেই ‘দেখা’-র নির্যাস।“

 

বইয়ের বারোটি গল্প হল –

১। কাশজ্যোৎস্না

২। শিখিবৈবশী ও লাল পাথরের বাটি   

৩। তর্কালংকারের পাতড়া

৪। কালান্তর

৫। বিদ্যালংকারের বিভ্রাট 

৬। বঙ্গাল

৭। একনয়ন 

৮। টুপটীকা 

৯। শসার ফুলের নূর

১০। ভাজা মৌরির কৌটো 

১১। নষ্টনাটক

১২। কৃষ্ণাদ্বাদশীর মেঘ 

 

বারোটি গল্পই মূলত ইতিহাস নির্ভর।না ইতিহাসের সত্য ঘটনার বিবরণ নয়। ঐতিহাসিক চরিত্র, সময়কালের সাথের কল্পনার রঙ মিশে ঘটনা প্রবাহের জাল বিস্তার করেছে।এতে আছে, এক সুন্দর স্বপ্নের মত পরিবেশে কোনও এক অজ্ঞাতপরিচয় কবি দিবাকর চক্রবর্তী নিজের কাব্য রচনা প্রসঙ্গে জানিয়েছেন অন্নদামঙ্গল কাব্যের রচয়িতা রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রর কাহিনী।আছেন তক্ষশীলা বৌদ্ধবিহারের মহাচার্য অতীশ দীপংকর শ্রীজ্ঞান ও  অমোঘবজ্রা।আছেন শ্রীনাথ তর্কালঙ্কার ও রামমাণিক্য বিদ্যালংকার। আছেন রসময় দত্ত, বিদ্যাসাগর, বিবেকানন্দ, মহাপ্রভু চৈতন্য ও রঘুনাথ শিরোমণি। আছেন পরিতোষ মহারাজসহ মির্চা এলিয়াদ, আছেন সুবিমল শাসমল ও শহিদ বিনয় – বাদল – দীনেশ, শাম্ভবী ও বিরূপাক্ষ এবং অবশ্যই আছেন কৃষ্ণবেণীসহ লেখক স্বয়ং।

 

গল্পের বিষয়বস্তু সম্পর্কে সম্পর্কে বলতে গেলে, লেখকের নিজের ভাষাতেই এই গল্পগুলির সঠিক বর্ণনা পাওয়া যায় -  “কথঞ্চিৎ ইতিহাস নির্ভর আখ্যান”।ভিন্ন ভিন্ন কালে রচিত, বহু চরিত্রের মেলায় জড়িয়ে আছে মায়াকুহক, প্রণয়ব্যাকুলতা, বেদনা, বিচ্ছেদ, স্বপ্নরাজ্য, ভক্তিভাব, জীবনদান, অস্তিত্বের সংগ্রাম, জীবন সংকট, আধিভৌতিক, অলৌকিক -পরাবাস্তব ঘটনাসহ আরও বিভিন্ন বিচিত্র মানব অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা। ছোট ছোট গল্পগুলি ধীরে সুস্থে বুঝে শুনে পড়তে হয়। কিছু গল্প যেমন চিন্তার জগতে নতুন আলোর সঞ্চার করে, কিছু তেমনি গভীরভাবে চরিত্রদের হাসি- কান্না – আনন্দ – বেদনা অনুভব করায়।কিছু গল্প থেকে গভীর জ্ঞান প্রাপ্ত হয়। একঘেয়ে জীবন থেকে কিছু মুহূর্ত বিরাম পেতে হলে এবং মস্তিস্ককে নিজেদের জীবনের নিত্যকার জীবনযুদ্ধের থেকে খনিক বিশ্রাম দিতে হলে এই বই উপযোগী ভূমিকা নেবে। ইদানিং কালের একঘেয়ে ভুত – প্রেত – পিশাচ – তন্ত্র – মন্ত্র – রহস্য – খুন – গোয়েন্দা নিয়ে লেখা পাঁজা পাঁজা গল্পের ভিড়ের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক রসের গল্পগুলি মনকে শান্ত করে, মস্তিস্ককে জীবনকে অন্য আঙ্গিকে ভেবে দেখার খোরাক যোগায়।

   

কিছু ব্যক্তিগত উপলব্ধি যা হয়ত অন্য পাঠকদের সাথে মতের অমিল ঘটাতে পারে। এই বই ঠিক সাধারণমানের পাঠকদের জন্য নয়। ইতিহাস নির্ভর বা ইতিহাস আশ্রয়ী আখ্যান মঞ্জরী হওয়ার কারণে বইয়ে সাধু ভাষা প্রয়োগ করার প্রয়োজন হয়েছে এবং সেই একই প্রয়োজনে বর্তমানে প্রায় অপ্রচলিত বিশুদ্ধ বাংলা শব্দও ব্যবহৃত হয়েছে। যা সাধারণ পাঠকের বুঝতে বেশ বেগ পেতে হয়। সাথে পাঠকের বেদ, উপনিষদ, দর্শন প্রভৃতি বিষয়ে সম্যক ধারণা থাকাও দরকার। প্রাচীন বাংলা ভাষা, সমাজ, সামাজিক রীতিনীতি সম্পর্কেও জ্ঞান থাকা দরকার। তা নাহলে বই পড়ার সময় অর্থ বোঝার জন্য তাই বারবার অভিধান ঘাঁটার প্রয়োজন হয়, যা পড়ার গতি রোধ করে। বইয়ে ব্যবহৃত বিভিন্ন প্রাচীন শব্দের উপযুক্ত টিকার বড় অভাব বোধ করলাম।   তাই তুলনামূলকভাবে বেশ খানিকটা বেশি মূল্যের বইটি কেনার আগে সাধারণ পাঠকের একবার ভেবে দেখা দরকার। অবশ্য বিজ্ঞ পাঠকমণ্ডলীর জন্য এই মতামত গ্রাহ্যের বিষয় নয়।    

এই বইয়ের একটি গল্পের বিষয়ে পৃথকভাবে উল্লেখ করতে ইচ্ছা হল। বছর দশেক আগে স্বল্প দৈর্ঘ্যের একটা অ্যানিমেশন ছবি দেখেছিলাম। নাম ছিল “অ্যালমা”।পরবর্তীতে বছর ছয় আগে সেই ছবির অনুসরণে “অহল্যা” বলে একটি স্বল্প দৈর্ঘ্যের হিন্দি ছবি নির্মাণ হয়েছিল।  ছবিটির মুল বিষয়বস্তুর সাথে বেশ খানিকটা মিল পেলাম  “শিখিবৈবশী ও লাল পাথরের বাটি” গল্পটির। ভিন্ন আঙ্গিকে, ভিন্ন পরিবেশ ও চরিত্রের সমাবেশে।

 

কলমে - পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন