ব্যাগের মধ্যে কিছু জামা কাপড় ও প্রয়োজনীয় জিনিস গুছিয়ে নিচ্ছিল হরিমাধব। বছরে এই একবার শিষ্যবাড়ি ঘুরতে বেরোয়, শিষ্যদের খোঁজখবর নেওয়াও হয় আবার গুরুপ্রণামী হিসেবে কিছু টাকাপয়সা জামাকাপড়ও আদায় হয়। অবশ্য দ্বিতীয়টাই মূল উদ্দেশ্য।
আজ মাঘ মাসের তিন তারিখ, শিষ্যরা বেশিরভাগই চাষীবাসী, কেউ কেউ ব্যবসাদার, এসময় চাষীদের গোলায় ধান এবং হাতে পয়সা দুটোই থাকে। এসময় গেলে
পাওনাগন্ডা ভাল হয়। হরিমাধব, তার বাবা ও
ঠাকুরদাকেও এই সময় শিষ্যবাড়ি ঘুরতে যেতে দেখেছে, চিরাচরিত প্রথা অনুসারে সেও যায়, সত্যি কথা বলতে কি অনেকটা গিন্নীর ঠ্যালাতেই যায়। সে
আরেকটা বড় ব্যাগ ভাঁজ করে ঐ ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে নিল, প্রণামীর জিনিসপত্র নিয়ে আসতে হবে।
দাওয়া থেকে সহধর্মিনীর কণ্ঠস্বর
ভেসে আসছে - “ ভেবে দ্যাখ্ গুরুকে ভূমি দান করলে কত পূণ্যি হবে তোর, সাতপুরুষ উদ্ধার হয়ে যাবে, সংসারের যত আলাই বালাই সব চলে যাবে”। সন্তোষী তখন
গুরুপ্রণাম করতে আসা এক মধ্যবয়স্কা শিষ্যাকে নিয়ে পড়েছে। শিষ্যা এবেলা খাওয়া
দাওয়া করে যাবে। হরিমাধব সেদিকে তাকিয়ে গৃহিনীকে উদ্দেশ্য করে বললে – “আমি তাহলে
আসি গো, আরামবাগ পৌঁছতেই
এগারটা বেজে যাবে”। সন্তোষী গলায় আঁচল জড়িয়ে কপালে হাত ঠেকিয়ে বললে – “ দুগ্গা
দুগ্গা”। তারপর হরিমাধবের
কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বললে-“ই বছর ফসল ভালো হয়েচে, আদায়পত্তর যেন ভালো হয় দেখো, একটু চেয়ে চিন্তে লিবেক”।
হরিমাধব ঘাড় কাত করে গৃহদেবতা
মদনমোহনের মন্দিরে প্রণাম করে বাস ধরতে বেরিয়ে পড়লো।
বিবড়দা থেকে শাল জঙ্গলের মধ্যে
দিয়ে বাসে বিষ্ণুপুর, সেখান থেকে আবার
বাস ধরে আরামবাগ। শিষ্যদের বাড়িগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আরামবাগ,মুথাডাঙ্গা, মায়াপুর এসব অঞ্চলে। কোতুলপুরের দিকেও কিছু আছে, ওগুলো ফেরার সময় ছুঁয়ে যাবে।
আরামবাগের কাছে
বসন্তপুরে প্রথম শিষ্যবাড়িতে যখন পৌঁছলো তখন বেলা বারোটা ছুঁই ছুঁই। শিষ্য
ভোলানাথ দত্ত বেশ অবস্থাপন্ন, চাষবাস ও আছে আবার একটা মুদিখানা দোকানও আছে, ভালই চলে। কাঁসার থালায় পা ধোয়ার জল নিয়ে এল বাড়ির মেয়েরা, পা ধুইয়ে সেই জল মুখে ছেটালো সবাই তারপর তোয়ালে
দিয়ে মুছিয়ে দিলে পা। ষাট বছর বয়স হয়ে গেল হরিমাধব গোস্বামীর, তবু এখনও এসবে কেমন যেন লজ্জা করে তার। বাপ-ঠাকুরদাকে এসব
করতে দেখেছে, সে ও কলের
পুতুলের মতো করে, কিন্তু মন থেকে সায়
পায় না। এক জোড়া ধুতি, এক জোড়া তাঁতের
শাড়ি ও দু’হাজার টাকা প্রণামী দিল ভোলানাথ।
হরিমাধব মুখ ফুটে চাইতে পারে না, যে যা দেয় গ্রহণ করে , কেউ কেউ
যৎসামান্য দেয়। গিন্নির কাছে গঞ্জনাও খেতে হয় এই নিয়ে।
ওখান থেকে
দুপুরের খাবার খেয়ে নির্ভয়পুরে আরেক শিষ্যবাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল হরিমাধব।
এরা আগুরি চাষী, ভাল কথায় বলে উগ্র ক্ষত্রিয়। হরিমাধব কে যথেষ্ট
যত্ন আত্তি করলে, রাতে এখানেই থেকে
যাবে। সন্ধ্যের সময় উঠোনে মাদুর পেতে বসলে সে। এ বাড়ির ছোট ছেলে-মেয়েগুলো গুরুদাদু বলে ডাকে তাকে। হরিমাধবকে
ঘিরে ধরে গল্প শোনার জন্য। হরিমাধব বলে রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবতের গল্প, ওরা হাঁ করে শোনে। মাঝে মাঝে ভাষায় জঙ্গলমহলের টান শুনে মুখ টিপে হাসে।
হরিমাধবও মজা পায় ,বলে – “ইটা বাঁকুড়ার
ভাষা বটেক, আরামবাগের লয়”।
বড়রাও কাজের ফাঁকে গল্প শোনে, কোন জিজ্ঞাস্য থাকলে প্রশ্ন করে। হরিমাধব ভাবে এভাবেই লোকশিক্ষা হবে, আলাদা করে উপদেশ দিতে হয় না।
বাঁকুড়ার রুক্ষ মাটির গুরুদেব
হুগলি বর্ধমানের সংসারের জ্বালায় অস্থির শিষ্যদের সমস্যার কথা শোনে, প্রবোধ দেয়, ঈশ্বরে ভরসা রাখতে বলে, সবশেষে মদনমোহনের
কাছে মনে মনে প্রার্থনা করে – “হে, ক্লেশনাশকারী কেশব, তুমি এদের ভালো রেখো”।
এইভাবে শিষ্যবাড়ি ঘুরতে ঘুরতে
এক সপ্তাহ কেটে গেল, যত দিন যায়
হরিমাধবের ব্যাগ তত ভারী হয়, সেই সঙ্গে পকেট ও। ফেরার পথে জয়পুরের আগে বন কামারপুকুর গ্রামে এক বিধবা
শিষ্যার বাড়ি গেল হরিমাধব। এটাই শেষ বাড়ি এই যাত্রায়। এরপর বাড়ি ফিরতে হবে। শিবানী গরীব এবং ভক্তিমতী, টাকাপয়সা প্রায় কিছুই দিতে পারে না সে। তবু স্নেহবশতই
যায় হরিমাধব।
মাটির বাড়ির দুয়ারে একটা
মোড়ায় বসে কথা বলছিল শিষ্যার সঙ্গে। কথায় কথায় জানতে পারল শিবানীর বড় মেয়েটার বিয়ে আসছে ফাল্গুনে। হরিমাধব
প্রসঙ্গতঃ জিজ্ঞেস করলো – “হাঁ রে ছিল্যা কি করে, দেনাপাওনা কত লাগছে ?”। শিবানী গুরুদেবের হাতে জলখাবারের প্লেটটা তুলে দিয়ে বললে – “ছেলে তেমন কিছুই
করে না, কোতুলপুরে একটা
মিষ্টির দোকানের কারিগর, আমাদের স্বজাতি, তবু পঞ্চাশ হাজার টাকা, হাতের কানের গয়না আর কুড়িখানা প্রণামী লাগছে”।
“জোগাড় করতে
পারলি?” – শুধোলো হরিমাধব।
শিবানী গুরুদেবের পায়ের কাছে
বসে বললে –“আমার অবস্থা সবই তো জানেন আপনি, কিছু টাকা জমানো ছিল, বাকিটা
আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে চেয়ে চিন্তে জোগাড় হয়েছে, গয়না আমার যা ছিল সেগুলো দিলেই হয়ে যাবে। শুধু ঘর
খরচের টাকা আর প্রণামী এখনও জোগাড় করতে পারিনি”।
দুপুরে ভাত খেয়ে রওনা দেবে
হরিমাধব, সামান্যই আয়োজন
করেছে শিবানী।শুক্তো, আলুপটলের তরকারী আর টমেটোর চাটনি। পূর্বপুরুষের আমল
থেকে গোস্বামী বংশের রীতি অনুযায়ী হরিমাধব নিরামিষাশী। খাওয়া দাওয়ার পর বেরোবে
হরিমাধব, শিবানী গুরুদেবের
জন্য পান সেজে এনে কুন্ঠিত ভাবে একটা প্যাকেটের মধ্যে একটা সুতির চাদর পায়ের কাছে
রেখে প্রণাম করল। ধরা গলায় বললে – “এবারে এর বেশি আর পারিনি গুরুবাবা, আশীর্বাদ করুন মেয়েটার বিয়ে যেন সুষ্ঠু ভাবে দিতে পারি”।
হরিমাধব অস্ফুটে আশীর্বাদ করল, তারপর বলল- “আমার এই ব্যাগটায় ধুতি শাড়ী মিলিয়ে
খান পঁচিশেক আছে, ইটা তুই রাখ ,আর চারদিক ঘুরে হাজার দশেক টাকা পাঁয়েচি, ইটাও রাখ, যত্যটুকুন সুবিধে হয়”।
শিবানী কেঁদে মাটিতে মাথা
ঠেকিয়ে বললে –“গুরুর কাছ থেকে নিলে যে মহাপাতক হবে, নরকেও ঠাঁই হবে নি, এ আমি পারবুনি”।
হরিমাধব দৃপ্তস্বরে বললে-
“কিচ্ছু হবেক লাই, আমি বলছি, আর মনে করনা ক্যানে ধার হিসেবে আমার থেকে লিচ্ছিস।
যদি পারিস কখনও ফেরত দিবি, দিতে লারলে দিবার
দরকার লাই। শুধু তোর গুরুমা কে ইটা শুনাবার দরকার লাই”।
অনিচ্ছুক শিষ্যাকে রাজি করালো
হরিমাধব, তারপর
বিয়েবাড়িতে সপরিবারে আসার সম্মতি জানিয়ে বিদায় নিল।
সন্তোষী খান পঁচিশেক প্রণামী
কাপড় আর নগদ দশ হাজারের শোকে উঠোনে শুয়ে পড়লো, তারপর হরিমাধবের কল্পিত সেই ডাকাত দলের উদ্দেশ্যে অভিসম্পাত করতে লাগল।
হরিমাধব কৃত্রিম শোকে মুহ্যমান ভাব দেখিয়ে গৃহদেবতার মন্দিরে ঢুকে প্রণাম করে মনে
মনে বললেন- “ হে মদনমোহন, তুমি তো জানো আমি
মিথ্যেকথা চট করে বলি না, এই ছলনার জন্য
আমায় ক্ষমা কোরো, এ ছাড়া আমার আর
কোনো উপায় ছিল না।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন