।। ১ ।।
ঘড়িতে রাত বারোটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকী। ফেলুদা তার ড্রয়িং
রুমের সোফায় বসে রয়েছে একা। হাতে একটা আধ-খাওয়া জ্বলন্ত সিগারেট। পাশে
অ্যাকুয়ারিয়ামের মধ্যে রঙিন মাছগুলো আপনমনে খেলা করছে। ফেলুদা নিজের হাতঘড়িটা
দেখে। বারোটা বাজতে আর মাত্র চার মিনিট বাকী। সারা ঘরটা সিগারেটের ধোঁয়ায় ভরে
রয়েছে।
বাইরে একটা গাড়ী থামার শব্দ হল। ফেলুদার দৃষ্টি যেন একটু
সজাগ হয়ে ওঠে। সে আবার হাতঘড়িটা দেখে, - কাঁটায়
কাঁটায় বারোটা। কয়েক মুহূর্ত পরেই হঠাৎ কলিং বেলটা বেজে ওঠে। ফেলুদা তৎক্ষণাৎ সোফা
ছেড়ে উঠে যায় দরজা খুলতে।
দরজায় ব্রিফকেস হাতে দাঁড়িয়ে এক বৃদ্ধ। তাঁর
মাথায় টাক, চোখে চশমা, আর একমুখ
সাদা দাড়িগোঁফ।
ফেলুদা : আসুন প্রোফেসর! আপনার প্রতীক্ষাতেই ছিলাম।
প্রোফেসর ভিতরে ঢোকেন। ফেলুদা দরজাটা বন্ধ করে দেয়।
।। ২ ।।
সকাল দশটা। ফেলুদার ড্রয়িং রুম। সোফায় জটায়ু ও তোপসে পাশাপাশি বসে। উল্টোদিকে খবরের কাগজ হাতে বসে ফেলুদা। তার চোখ খবরের কাগজের পাতায়।
তোপসে : হ্যাঁ ফেলুদা। প্রোফেসরের শর্ত অনুযায়ী, উনি শুধু তোমার সঙ্গেই দেখা করতে চেয়েছিলেন। তাই আমিও কাল রাতে লালমোহনবাবুর বাড়িতে ছিলাম। কিন্তু, এবার তো অন্তত বলো, কী কথা হল...
জটায়ু: প্রোফেসর ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কু আর গোয়েন্দা ফেলু মিত্তির মুখোমুখি... উফফ্! ভাবলেই কেমন যেন একটা ইয়ে লাগছে!
ফেলুদা এবার খবরের কাগজটা নামিয়ে সেন্টার টেবিলে রেখে একটা
সিগারেট ধরায়। তারপর সোফা ছেড়ে উঠে খোলা জানলাটার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।
এবার ফেলুদা বলতে শুরু করে। -
।। ৩ ।।
মধ্যরাত। মুখোমুখি বসে ফেলুদা ও প্রোফেসর।
প্রোফেসর : মিস্টার মিত্তির!... আমি কিন্তু প্রথমেই আপনার সহকারী ভাইটির প্রশংসা করবো। ও যেভাবে বুদ্ধি খাটিয়ে আমার গোপন আস্তানা খুঁজে বের করলো, তাতে... I must praise his intelligence. ও যে আপনার যোগ্য উত্তরসূরি, একথা বলাই বাহুল্য।
ফেলুদা : হ্যাঁ। ও তো আপনার সাথে দেখা করার জন্য উদগ্রীব ছিল। কিন্তু আপনার শর্ত অনুযায়ী ওকে আজ অন্য জায়গায় চলে যেতে হল।
প্রোফেসর : আসলে কী জানেন মিস্টার মিত্তির... আজকাল আর কারোর সাথেই সাক্ষাৎ করতে মন চায় না। নেহাত “আপনি” তাই রাজি হলাম।
প্রোফেসর : সে এক দীর্ঘ ঘটনাক্রম। সেসব পরে না হয় একদিন বলবো। এখন আপনি বলুন কেন আমার সাথে দেখা করতে চাইলেন। ফোনে কী বিশেষ জরুরি দরকার বললেন...
প্রোফেসর : ওহ! এক মিনিট!... আপনার জন্য একটা সামান্য উপহার এনেছি।
এইবলে পকেট থেকে একটা সুন্দর দেখতে হাতঘড়ি বের করে ফেলুদাকে
দেন। ঠিক এখনকার smart watch –এর মতো দেখতে।
প্রোফেসর : একটা আমার সামনেই আপনি হাতে পরলে আমার ভালো লাগবে।
ফেলুদা লক্ষ করে যে, প্রোফেসরও
হাতে ঠিক হুবহু এক রকম দেখতে একটা ঘড়ি পরে রয়েছেন। ফেলুদা ধন্যবাদ জানিয়ে ঘড়িটা
হাতে পরে নেয়।
ফেলুদা : আসলে বুঝতেই তো পারছেন চারপাশের কী ভয়ানক পরিস্থিতি। বিগত দুবছরে অদৃশ্য শত্রুর আক্রমণে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু। আর এখন, অতিমারির তিন তিনটে ঢেউয়ের ধাক্কায় গোটা বিশ্বেই অর্থনৈতিক মন্দা। পাশাপাশি সেই অদৃশ্য শত্রুর গুপ্ত স্রোত তো এখনও চলছেই। (কয়েক মুহূর্ত থেমে) এখন এ-হেন পরিস্থিতিতে আপনার মতো একজন বিজ্ঞানীর কি এভাবে আড়ালে চুপচাপ বসে থাকলে চলে?...
প্রোফেসর : আমি কিন্তু দিব্যি সুস্থ রয়েছি মিস্টার মিত্তির।
প্রোফেসরের কথার মানেটা ঠিক বুঝতে পারে না ফেলুদা। ফেলুদার মনের দ্বন্দ্বটা যেন পড়ে ফেললেন প্রোফেসর। তারপর বললেন –
প্রোফেসর : হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন... বিজ্ঞান সাধনা আমার কোনোদিনই থামে নি। আর এই হল আমার latest inventions...
এই বলে প্রোফেসর তাঁর সঙ্গের briefcase
থেকে তিনটে ছোট ছোট ampoule বের করে
সেন্টার টেবিলের উপর রাখলেন।
ফেলুদা সেগুলোর দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবে, এগুলো কি তবে
স্বয়ং প্রোফেসর আবিষ্কৃত কোভিডের vaccine...?
প্রোফেসর এবারেও অদ্ভুতভাবে ফেলুদার মনের প্রশ্নটা যেন পড়ে
ফেললেন। তারপর বললেন
প্রোফেসর : ঠিকই ধরেছেন মিস্টার মিত্তির! তবে এগুলোর মধ্যে
একটা হল সেই জিনিস, বাকী দুটো অন্য।
এই বলে তিনি একটা ampoule হাতে তুলে
ফেলুদাকে দিলেন। ফেলুদা তাতে লেখা নামটা পড়লো, - “SHONCOV 19”।
প্রোফেসর : এর একটা ডোজই যথেষ্ট। কোভিডের যেকোনো
ভ্যারিয়েন্টের বিরুদ্ধে মোকাবিলা করতে সক্ষম।
ফেলুদা : তাহলে এটা আপনি সর্বসমক্ষে কেন আনছেন না?... স্বয়ং আপনার আবিষ্কার... আর যেখানে এতো মানুষের মৃত্যু ঘটছে...
প্রোফেসর : মানে... বিগত দুবছর ধরে আমি কয়েকশো কোভিড আক্রান্তের নমুনা সংগ্রহ করে, আমার বিশেষ যন্ত্রে দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছি। - যত মিউটেশন হয়ে নতুন ভ্যারিয়েন্ট তৈরি হচ্ছে, তত এই ভাইরাসের শক্তিক্ষয় হচ্ছে এবং মারণ ক্ষমতাও কমছে। তাই এরপর যে ভ্যারিয়েন্টই আসবে, তারা নিজেরা টিকে থাকার জন্য জীবিত মানুষের শরীর খুঁজবে... মানুষ মারবে না। তাই, এরপর সংক্রমণ বাড়লেও মৃত্যুহার হবে শূন্য। সুতরাং, ভয়ের কোনও কারণ নেই মিস্টার মিত্তির।
ফেলুদা : কিন্তু, শরীরের মধ্যে ভাইরাস থাকলে তো শরীরের ক্ষতি হবেই?
প্রোফেসর : হ্যাঁ... সে তো অবশ্যই। আর সেটা ঠেকাবার উপায় হল - self-awareness. ভিড়ের মধ্যে মাস্ক অবশ্য-পরিধেয়। সঠিক মাস্ক সঠিকভাবে পরতে হবে। ব্যস... এটুকুই যথেষ্ট।
ফেলুদা : যাক, আপনার কথা শুনে বেশ কিছুটা নিশ্চিন্ত বোধ করছি প্রোফেসর।
এবার ফেলুদার চোখ যায় বাকী দুটো ampoule -এর দিকে।
প্রোফেসর তার মধ্যে একটা হাতে তুলে নিলেন।
প্রোফেসর : এর নাম – “SHONKU’S SECULARIS” । এর একটা ডোজ শরীরে inject করলে মানুষের মস্তিস্কের মধ্যে থাকা ধর্মীয় বিভেদমনস্কতা কয়েক মুহূর্তের মধ্যে উধাও হয়ে যাবে। তখন মানুষের মনের মধ্যে শুধু একটাই ধর্ম থাকবে, - মনুষ্যত্ব।
এবার প্রোফেসর তৃতীয় ampoule টাও আরেক
হাতে তুলে নিলেন।
এবার ফেলুদা মনে মনে ভাবে, লোকটা সত্যিই
পাগল। এসব আবিষ্কার তো নোবেল এনে দেবে!
প্রোফেসর : (অদ্ভুতভাবে আবারও ফেলুদার মনের কথা পড়ে ফেলে
বলেন) আপনি আমায় পাগল ভাবতেই পারেন। কিন্তু, পুরস্কারের
লোভ আমার কোনোকালেই ছিল না। ... আর তাছাড়া, আমি চাই না
এগুলোর প্রয়োগ হোক। তাতে ধর্মীয় বিভেদ মুছে যাবে, সমাজ
দুর্নীতিমুক্ত হবে ঠিকই... কিন্তু মানুষগুলো যন্ত্রে পরিণত হবে। ওই হীরক রাজার
মগজধোলাইয়ের মতো আর কি! তার চেয়ে, আমার বিশ্বাস মানুষই নিজেকে
বদলাবে... একদিন নিশ্চয়ই বদলাবে।
এই বলে প্রোফেসর উঠে দাঁড়ান। ফেলুদাও উঠে দাঁড়ায়।
প্রোফেসর : আপনাকে যে উপহারটা দিলাম, এটা তারই অংশ... These are not mere watches Mr. Mitter! এটা একটা যন্ত্র। নাম – Mind Connector. আপনার কাজ তো মগজাস্ত্রের?... Interrogation-এর সময় এটা কাজে দেবে। In fact, আপনার কথা ভেবেই এটা বানিয়েছিলাম। লক্ষ করেছেন কি?... আপনার মনের কথাগুলো আমি কেমন পড়ে ফেলছিলাম।
ফেলুদার চোখেমুখে বিস্ময়।
প্রোফেসর : Anyways.... আর আশা করি, আমার গোপন আস্তানার কথা আর কেউ জানবে না। কি... ভরসা করতে পারি তো?
প্রোফেসর ফেলুদাকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে যান।
।। ৪ ।।
জটায়ু : (উত্তেজিতভাবে) কি বলছেন মশাই! এতগুলো নতুন
আবিষ্কারের খবর! ওই ঘড়ি থুড়ি যন্ত্রখানা একবার দেখা যায়?...
ফেলুদা : ওটা আপাতত তুলে রেখেছি। তাছাড়া, আমার মগজাস্ত্রের উপর আমার যথেষ্ট ভরসা আছে লালমোহনবাবু।
তোপসে : কিন্তু ফেলুদা, উনি তো তোমার বুদ্ধির ব্যাপারে ওয়াকিবহাল। তা সত্ত্বেও ওটা দিলেন কেন?
ফেলুদা : কারণ উনি জানেন যে, একজন বিশেষ মানুষকে interrogate করতে গেলে ওটার প্রয়োজন হতে পারে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন