প্রতিদিনের মতো এক ক্লান্ত দুপুর। মাসদুয়েকের বাচ্চাকে ঘুম পাড়িয়ে বাগানের নিরাপদ একটি স্থানে রেখে খানিকটা দূরে বাগানের কাজেই ব্যস্ত তার মা। সঙ্গে আরও অনেকে সেই কাজে নিয়োজিত। কিছুক্ষণ পর বাচ্চাটির ঘুম গেলো ভেঙে। ঘুম ভেঙে যাওয়ার কারণেই হোক বা স্নেহের পরশ না পেয়ে, কাঁদতে শুরু করলো সে। এদিকে তার মা জানে না। ইতিমধ্যে বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেছে। বাচ্চাটির মা ভাবলো, যাই গিয়ে দেখে আসি, কী করছে আমার সোনা। ঘুম থেকে উঠে পড়লো নাতো! হন্তদন্ত হয়ে সেই স্থানে গিয়ে তো তার চক্ষুস্থির! একরত্তিকে কোলে নিয়ে তার সঙ্গে শিশুসুলভ দুর্বোধ্য ভাষায় কথা বলছেন, খেলছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী! প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু! ওই দৃশ্য দেখে তো ভয়ে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে বাচ্চাটির মা। যদিও বাচ্চাটি পণ্ডিত নেহেরুর কোলে উঠে যারপরনাই খুশি। তার খিলখিলিয়ে হাসি দেখে খুশি পণ্ডিত নেহেরুও। প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনের বাগানচত্বরে দুপুরবেলায় কাজের ফাঁকে একটু এদিক ওদিক হাঁটতে বেরিয়েছিলেন তিনি। কান্নার আওয়াজ শুনে কৌতূহলী হয়ে দেখেন কী কাণ্ড! একরত্তি একটা বাচ্চা একলা শুয়ে কেঁদে চলেছে! তক্ষুনি বাচ্চাটিকে কোলে তুলে তার সঙ্গে খেলা করতে লাগলেন তিনি, আর বাচ্চাটিও তাঁর স্নেহের স্পর্শ পেয়ে কান্না থামিয়ে দিল।
হ্যাঁ, শিশুদের প্রতি এমনই অকৃত্রিম স্নেহ ছিল পণ্ডিত নেহেরুর। শিশুদের সংস্পর্শে এলে তখন তিনি প্রধানমন্ত্রীসুলভ ভারিক্কি ব্যক্তিত্বকে একপাশে সরিয়ে রেখে অনায়াসে মিশে যেতেন সেইসব কচিকাঁচাদের সঙ্গে। তাঁকে ভালোবেসে "চাচা নেহেরু" বলে বাচ্চারা কি আর এমনি এমনি ডাকতো! সে একসময়ের কথা। পন্ডিত নেহেরু চেন্নাইয়ের (তখন মাদ্রাজ) পথে গাড়িতে চলেছেন। প্রধানমন্ত্রীকে দেখার অভিপ্রায়ে রাস্তার দু'ধারে সারি দিয়ে অগুনতি মানুষের সমাগম। এরই মধ্যে অনেক বাচ্চা রাস্তার পাশের গাছ বেয়ে উঠে পড়েছে তাদের প্রিয় চাচা নেহেরুকে একঝলক দেখার আশায়।
এই ভিড়ের মধ্যেই বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে এক বেলুনওয়ালা। তার হাতে রয়েছে লাল নীল সবুজ হলুদ বিভিন্ন রঙের বিভিন্ন আকারের বেলুন। তৎক্ষণাৎ গাড়ি থামাতে বললেন পণ্ডিত নেহেরু। দরজা খুলে গাড়ি থেকে নেমে বেলুনওয়ালাকে হাতের ইশারায় ডাকলেন। ওদিকে বেলুনওয়ালার তো হৃদকম্পন শুরু হয়ে গেছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাকে ডাকছেন! সে কী ভুল করে ফেলেছে কেজানে! এবার যে তার কপালে কী আছে! মনে মনে ইস্টনাম জপ করছে সে।
কিন্তু বেলুনওয়ালাকে অবাক করে পণ্ডিত নেহেরু তাঁর সহকারীর মাধ্যমে তাকে জানালেন যে তিনি সবক'টি বেলুন কিনে ফেলতে চান। বেলুনওয়ালা তো নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এতবছর ধরে বেলুন বিক্রি করে আসছে সে। কেউ কেনে, কেউ কেনে না। আর আজ তার বেলুনের ক্রেতা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী! পন্ডিত নেহেরু তাঁর সহকারীর মাধ্যমে বেলুনওয়ালাকে দাম মিটিয়ে দেওয়ার পর নির্দেশ দিলেন আশেপাশে যতো বাচ্চা রয়েছে তাদের মধ্যে বেলুনগুলি বিলিয়ে দিতে। বেলুনওয়ালা এক লম্বা সেলাম ঠুকে তাঁর নির্দেশ পালন করলো। রংবেরংয়ের বেলুন পেয়ে খুশিতে আনন্দে হইহই করে উঠলো বাচ্চারা "চাচা নেহেরু, চাচা নেহেরু!"
শিশুরা তাঁর কাছে যতখানি প্রিয় ছিল, সেরকমই তিনি প্রিয় ছিলেন শিশুদের কাছে। তাই ১৪ই নভেম্বর ভারতে শিশুদিবস উদযাপন সর্বতোভাবে যুক্তিযুক্ত। কিন্তু ১৪ই নভেম্বর কেন? অন্য দিন কেন নয়? এটা ঠিকই যে আন্তর্জাতিক শিশুদিবস ১লা জুন উদযাপন করা হয়। তুরস্কে সর্বপ্রথম ১৯২০ সালের ২৩শে এপ্রিল শিশুদিবস পালিত হয়েছিল। পরবর্তীকালে রাষ্ট্রসংঘ ১৯৫৪ সালের ২০শে নভেম্বর বিশ্ব শিশুদিবস পালনের জন্যে ঘোষণা করে। সেই ঘোষণা অনুযায়ী ভারতেও পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত ২০শে নভেম্বর শিশুদিবস পালিত হতো। ১৯৬৪ সালে নেহেরুর মৃত্যুর পর তাঁকে উপযুক্ত সম্মান জানানোর জন্য একটি বিল পাস হয় যেখানে বলা হয়েছিল, তাঁর জন্মবার্ষিকী এবং শিশুদিবস একসাথে পালন করা হবে। ১৮৮৯ সালের ১৪ই নভেম্বর তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সেই থেকে ১৪ই নভেম্বর ভারতে শিশুদিবস পালিত হয়ে আসছে। সেই সঙ্গে বিশেষ এই দিনটিতে তাঁর জন্মবার্ষিকীও পালন করা হয়ে থাকে।
শিশুদের প্রতি নেহেরুর গভীর স্নেহ ও ভালোবাসার কথা সকলেরই জ্ঞাত। তিনি বলেছিলেন "শিশুরাই দেশের ভবিষ্যত"। শিশুদের শিক্ষা ও কল্যাণের উপর সর্বদা গুরুত্ব দিতেন তিনি। স্নেহ ভালবাসার পাশাপাশি তাদেরকে সঠিকভাবে বড় করার ব্যাপারেও অনেক বেশি জোর দিতেন। তিনি এও বলেছিলেন, “আজ আমরা যেভাবে শিশুদের বড় করবো কাল তারা সেভাবেই দেশ চালাবে”। তাঁর বলা প্রতিটি শব্দ প্রতিটি বাক্য সঠিক। তাঁকে স্মরণ করে প্রতিবছর তাঁর জন্মদিনে শিশুদিবস উদযাপন করা সবদিক থেকে উপযোগী।
ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন দিনে শিশুদিবস উদযাপন করার পাশাপাশি সেই উদযাপনেও কিন্তু লক্ষ্য করা যায় ভিন্নতা। যেমন আমাদের দেশে বিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষগুলিকে সুন্দরভাবে সাজানো হয়ে থাকে। ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিভিন্ন অনুষ্ঠান, ক্যুইজ শো ইত্যাদির ব্যবস্থা করা হয়। তাদের জন্য থাকে উপহার, খাওয়াদাওয়ার আয়োজন। বিভিন্ন শপিং মল, বিনোদন পার্ক, রেস্তোরাঁতেও শিশুদের জন্য বিশেষ আকর্ষণ থাকে। অনলাইন অথবা অফলাইনে বাচ্চাদের কেনাকাটায় থাকে বিশেষ ছাড়।
অন্যান্য দেশের প্রসঙ্গে বলতে গেলে, জাপানে শিশুদিবসে প্রত্যেকের বাড়ি থেকে রংবেরংয়ের ঘুড়ি ওড়ানো হয়। গোটা আকাশ ছেয়ে যায় রঙের মেলায়। বাচ্চারা আনন্দ করে খায় জাপানের জনপ্রিয় খাবার রাইস কেক। গোটা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আয়োজন করা হয় বাচ্চাদের জন্য নানারকম ক্রীড়া প্রতিযোগিতার এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের। মেক্সিকোতে আবার এইদিন স্কুলগুলোতে পড়াশোনার পরিবর্তে বন্দোবস্ত থাকে খাবারদাবারের ও হরেকরকম খেলাধূলার। গানবাজনা, পুতুলনাচ, ব্যানার ফেস্টুন ওড়ানো এসব দিয়েই হইহই করে কেটে যায় বিশেষ এই দিনটা। থাইল্যান্ডে তো এইদিন বাচ্চাদের জন্য সবরকমের বিনোদন বিনামূল্যে। বাসের ফ্রি টিকিট থেকে শুরু করে বিনোদন পার্ক, চিড়িয়াখানার টিকিটও ফ্রি। শুধু তাই নয়, সরকারি বাসভবন, আর্মি, নেভি এবং এয়ারফোর্সের বিভিন্ন কক্ষে প্রবেশ করে ঘুরে দেখার বিশেষ অনুমতিও পায় তারা। তুর্কিতে এইদিন অনেক জায়গায় মেলা বসে। দেশবিদেশের বাচ্চাদের আহ্বান জানানো হয় যে যার নিজেদের দেশের সংস্কৃতির নাচ গান পরিবেশন করতে।
এভাবেই আনন্দ উৎসবের মধ্যে দিয়ে কেটে যায় শিশুদের জন্য বিশেষ এই দিনটি। আমাদের দেশে গত দু'বছর অতিমারীর কারণে স্কুল বন্ধ থাকলেও অনলাইনের মাধ্যমে অনেক স্কুলেই যথাসম্ভব আনন্দের সঙ্গে উদযাপিত হয়েছে শিশুদিবস। এই বছর থেকে তো আবার আগের মতই শুরু হয়ে গেছে স্কুল। তাই আশা করা যায় ১৪ই নভেম্বর ছোটদের জন্য তাদের শিক্ষাক্ষেত্রগুলিতে নানারকম আয়োজন থাকবে। এই প্রসঙ্গে একখানি ঘটনা দিয়ে লেখা শেষ করি। ঘটনাটি একজন ছাত্রের দ্বারা বিবৃত। তার নাম মহম্মদ আইমান শিরোজ।
অন্যান্যদিনের মতোই বিদ্যালয়ে নির্দিষ্ট সময়ে সে ও তার সহপাঠীরা উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু পৌঁছনোর পর তাদের বিস্ময়ের অবধি থাকে না। তাদের শ্রেণীকক্ষ লাল রঙের গোলাপ ফুল দিয়ে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। কক্ষের টেবিলের উপর ফুলদানিতে রয়েছে একগুচ্ছ লাল গোলাপ। ব্ল্যাকবোর্ডের চারিধার এবং দরজার চারপাশ গোলাপ দ্বারা সুসজ্জিত। যারপরনাই অবাক হয়ে তারা তাদের শিক্ষককে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলো এবং জানতে পারলো আজ তাদের বিদ্যালয়ে বিশিষ্ট একজন অতিথি আসবেন। সকল ছাত্রছাত্রীরা যেন যে যার জায়গায় গিয়ে চুপ করে বসে থাকে এবং কোনো শোরগোল না করে। সেইমতো সকলে নিজ নিজ স্থানে বসে অধীর আগ্রহে অপেক্ষমান। সহপাঠীদের মধ্যে আলোচনা করতে ভারি ইচ্ছে করছে যে কে এই বিশিষ্ট অতিথি। এদিকে শিক্ষক মহাশয় কোনরকম শোরগোল করতে মানা করেছেন। অগত্যা অপেক্ষা ছাড়া গতি নেই।
খানিক পরে হঠাৎই শ্রেণীকক্ষের বাইরে থেকে হইহট্টগোলের আওয়াজ এলো। শিক্ষক মহাশয় ব্যস্ত হয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। ব্যস, ছোটদের আর পায় কে! তারাও কক্ষের জানলা দিয়ে উঁকিঝুঁকি মেরে বোঝার চেষ্টা করতে লাগলো যে ব্যাপারখানা কী। স্কুলের বাইরে একটা গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে। না না, একটা তো নয়। সামনে পেছনে আরও গাড়ি। লোকে লোকে ছয়লাপ। পুলিশ রয়েছে, সাংবাদিকরাও রয়েছে। ওকি! গাড়ি থেকে কে নামছেন! নেহেরু চাচা! ইনিই তাহলে আজকের বিশিষ্ট অতিথি!
অমনি সকলে গিয়ে নিজেদের জায়গায় বসে পড়লো। পন্ডিত নেহেরু শ্রেণীকক্ষে
প্রবেশ করলেন, সঙ্গে শিক্ষক মহাশয়। নেহেরু সাহেব নীল রঙের একটি
জ্যাকেট পরেছিলেন, সেটির গায়ে আটকানো ছিল একখানি লাল গোলাপ। প্রত্যেক
ছাত্রছাত্রীকে তিনি জিজ্ঞাসা করলেন যে তাদের নামের অর্থ কী, অবসর সময়ে তারা কী করে, তাদের কোন পাখি
ভালো লাগে। সব বাচ্চাদের সঙ্গে অনেক গল্প করলেন তিনি, নানারকম খেলাও করলেন। বাচ্চারাও তাঁর সঙ্গে সময় কাটাতে পেরে মহাখুশি। তাদের
সঙ্গে পণ্ডিত নেহেরু মধ্যাহ্নভোজও করেছিলেন সেদিন। খাওয়াদাওয়ার শেষে
ছাত্রছাত্রীরা তাদের প্রিয় চাচা নেহেরুর সঙ্গে ফোটোও তুলেছিল। বিদায় নেওয়ার আগে
তিনি প্রত্যেক বাচ্চার হাতে তুলে দিয়েছিলেন একটি করে ফাউন্টেন পেন এবং অতি সুস্বাদু
লাড্ডু।
উপরোক্ত এই ঘটনার সমস্তটাই কল্পিত। ঘটনাটি শিশুদিবসকে এবং পণ্ডিত নেহেরুকে
কেন্দ্র করে The Hindu Young World পত্রিকায় একজন
স্কুলছাত্রের কল্পনার অক্ষরে লেখা। বর্তমান এবং আগামী প্রজন্মের তাঁকে সামনাসামনি
প্রত্যক্ষ করার কোনো সুযোগ তো নেই, কিন্তু শিশুদের প্রতি তাঁর অগাধ স্নেহ ভালোবাসাকে সকলে মনে রেখেছে। চাচা
নেহেরুর সঙ্গে বাস্তবের পৃথিবীতে না-ই বা সাক্ষাৎ হলো, কল্পনার জগতে দেখা হতে কোনো বাধা তো নেই।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন