দেশ বিদেশের বড়দিন- তমালিকা ঘোষাল ব্যানার্জী

 

বড়দিনের সজ্জায় সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল চার্চ কলকাতা

ডিসেম্বর – বর্ষশেষের মাস, উদযাপনের মাস, বড়দিনের মাস। শীতের আমেজে শহর, শহরতলী, অলিগলি সেজে ওঠে আলোর রোশনাইয়ে। আলোর ঝর্নাধারায় ভেসে যায় কলকাতা, বিশেষ করে পার্ক স্ট্রিট চত্বরসহ দ্বিতীয় হুগলি সেতু, হাওড়া ব্রিজ এবং গঙ্গার দুই তীর। সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল থেকে শুরু করে ব্যান্ডেল চার্চ, শ্রীরামপুর চার্চ, নিউটাউন, বিধাননগর, সল্টলেক, কৃষ্ণনগরে মানুষের ঢল নেমে পড়ে রাস্তায়। সঙ্গে চলে বড়দিনের বিশেষ প্রার্থনা। বন্ধুদের আড্ডা জমে ওঠে কফিশপগুলোতে। মনে একরাশ খুশি নিয়ে শুভেচ্ছা জানায় একে অপরকে – মেরি ক্রিসমাস

বড়দিনের সজ্জায় পার্ক স্ট্রীট কলকাতা

 ক্রিসমাস অর্থাৎ বড়দিন, ২৫শে ডিসেম্বর। তবে এর কয়েকদিন আগে থাকতেই নানা রঙের হরেকরকম আলোয় ঝকমকিয়ে ওঠে রাস্তাঘাট, দোকানপাট। বড়ো বড়ো শপিংমলের সাজসজ্জা চোখে পড়ার মতো। পথের ধারের দোকানগুলোয় সাজানো থাকে ক্রিসমাস উপলক্ষ্যে নানারকমের পসরা। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে বাচ্চারা মা বাবার হাত টেনে ধরে – "দেখো মা, ওই ক্রিসমাস ট্রি-টা কী সুন্দর!" আবদার ঝরে পড়ে গলায় – "আমি ওটা নেবো!" মা বাবাও তাঁদের সন্তানদের মুখ চেয়ে সাধ্যের মধ্যে কিনে দেন সেই ক্রিসমাস ট্রি। সঙ্গে লাল জামা পরা ছোট্ট সান্তাক্লজ, ঘর সাজানোর রঙিন কাগজ। বলা বাহুল্য, বড়দিন উপলক্ষ্যে শুধুমাত্র বাড়ির বাইরেই নয়, ঘরের ভিতরটাও সেজে ওঠে সমানভাবে


 কলকাতা বো-ব্যারাকে বড়দিনের আলোকসজ্জা

ক্রিসমাসের আগে ও পরে আলোর মেলায় রাতের কলকাতার মায়াবী রূপ আমাদের কারোরই অজানা নয়। এই প্রসঙ্গে বড়দিনের ইতিহাস অনুসন্ধান করলে জানা যায়, ভারতবর্ষে প্রথম ক্রিসমাস পালন করা হয়েছিল ১৬৬৮ সালে। জব চার্ণক প্রথম বড়দিন পালন শুরু করেছিলেন বলে শোনা যায়। তারপর থেকেই চলে আসছে উদযাপন। বড়দিন অর্থাৎ ক্রিসমাস খ্রীষ্টান ধর্মাবলম্বীদের উৎসব হিসাবে শুরু হলেও বহুকাল আগে থেকেই সেসবের ঊর্ধ্বে উঠে গেছে। ক্রিসমাস এখন সকলের উৎসব। এই বিশেষ দিনটির উদযাপনের তালিকায় থাকে বিভিন্ন স্থানের লাইটিং দেখা, আড্ডা মারা, কেনাকাটি, সিনেমা দেখা, আরও অনেক কিছু। সঙ্গে সান্তা টুপিতে সেলফি আবশ্যিক। নামীদামী হোটেল ও রেস্টুরেন্টগুলিতে থাকে ক্রিসমাসের বিশেষ ডিনার মেনু। এই সময়কালে কলকাতার ছবিটা আমাদের সকলেরই চেনা। কিন্তু তার বাইরে? সেই ব্যাপারেও জানতে মন চায় বৈকি!

 কলকাতা ছাড়া ভারতে যে বড়ো বড়ো শহরগুলো রয়েছে সেখানেও ধুমধাম করে বড়দিন পালন করা হয়ে থাকে, যেমন মুম্বাই, দিল্লি, বেঙ্গালুরু ইত্যাদি। এসব জায়গায় সমস্ত শহর আলোকসজ্জা এবং ক্রিসমাস ট্রি দিয়ে সুন্দরভাবে সাজানো হয়। তবে ক্রিসমাস উদযাপনের জন্য ভারতের মধ্যে সর্বোত্তম স্থান হলো গোয়া। প্রচুর গীর্জা আছে এখানে। বড়দিনের উৎসব জমকালোভাবে উদযাপন করা হয়। এইসময় অসংখ্য রকমারি আলো এবং পয়েনসেটিয়া ফুলে সেজে ওঠে গোয়া। ক্রিসমাস পালনের অন্যতম স্থান হলো কেরালা। এখানেও অনেক গীর্জা রয়েছে এবং সেগুলো সুন্দর আলো দিয়ে সাজানো হয়। এছাড়া তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশে গ্রামাঞ্চল এবং শহরতলীর মানুষেরা ঘরের ছাদে ছোট ছোট মাটির প্রদীপ জ্বালায়

 


ভ্যাটিকান সিটি বড়দিনের সজ্জায়

এবার দেশের বাইরের কথা ধরা যাক। ইতালিতে বড়দিন উদযাপন করা শুরু হয়ে যায় ১লা ডিসেম্বর থেকে। এখানে বড়দিনকে বলা হয় নভেনা। সেদিন ওখানকার সবাই ক্রিসমাস ট্রি তৈরি করে। সঙ্গে বানায় মা মেরি, জোসেফ, যিশু, একটি গাধা ও একটি হাঁস। এই মূর্তিগুলোকে বলে প্রিসেপে। এগুলো তৈরির মাধ্যমে তারা যিশুর জন্মের সময়কার ছবি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করে। ইতালিতে বড়দিনের অন্যতম আকর্ষণ হলো, ওখানকার বাচ্চারা বড়দিনে রাখাল সেজে পাইপ বাজিয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে বড়দিনের গান গায় আর ছড়া কাটে। বিনিময়ে সব বাড়ি থেকে তাদেরকে টাকা দেওয়া হয় আর সেই টাকা দিয়ে ওরা বড়দিনের উপহার কেনে

জার্মানির মানুষজন বড়দিন উপলক্ষ্যে তাদের ঘর সাজাতে বেশি পছন্দ করে। ঘর সাজানোর জন্য বেশ সুন্দর সুন্দর জিনিস ব্যবহার করা হয়। এখানের লোকেরা বাড়ির জানালায় কাঠের ফ্রেমে ইলেক্ট্রিক মোমবাতি জ্বালিয়ে তার সামনে কাগজ বা প্লাস্টিকের রঙবেরঙের ছবি টাঙিয়ে দেয় যেগুলো রাতের বেলা বাইরে থেকে দেখতে অত্যন্ত মনোরম লাগে

 

আমেরিকায় বড়দিন পালন

ঘর সাজানোর ক্ষেত্রে আমেরিকানরাও কম যায় না। আমেরিকাতে ক্রিসমাসের আগেরদিন বাচ্চারা ক্রিসমাস ট্রি-র নীচে স্টকিংস ঝুলিয়ে রাখে যাতে সান্তাক্লজ উপহার রেখে যায়। বাচ্চাদের বিশ্বাস, সান্তাক্লজ ছ'টি রেইন ডিয়ারে টানা গাড়ি চড়ে বিশাল ঝোলাভর্তি চকোলেট, ক্যান্ডি আর উপহার এনে বাড়ির চিমনি দিয়ে নেমে এসে স্টকিং আর ক্রিসমাস ট্রি-র নীচে সেসব রেখে যাবে। প্রতিদানে তারা সান্তাক্লজের জন্য একটি ট্রে-তে কিছু কুকিজ আর একগ্লাস দুধ রেখে রাতে ঘুমোতে যায়

আমেরিকায় বড়দিন উদযাপনের ক্ষেত্রে আমাদের দেশের তুলনায় সামান্য পার্থক্য রয়েছে। বড়দিনে ভারতের বড়ো বড়ো শহরের দোকানগুলোয় যেমন উপচে পড়া ভিড় চোখে পড়ে, আমেরিকার দোকানপাটে আবার এইদিনে ছুটি থাকে যাতে দোকানের কর্মচারীরা নিজেদের পরিবার পরিজনের সঙ্গে বিশেষ এই দিনটি আনন্দের সাথে কাটাতে পারে। ক্রিসমাস উপলক্ষ্যে বিভিন্ন পার্ক সেজে ওঠে আলোর মালায়। কিছু কিছু জায়গায় ঘরবাড়ি এমন চমৎকার সাজানো থাকে যে সেসব দেখার জন্য রীতিমত বাইরে থেকে লোক আসে গাড়িতে চেপে

ফ্রান্সের বড়দিন পালন

এবার আসা যাক ফ্রান্সের ক্রিসমাসের কথায়। এখানে ক্রিসমাসকে বলা হয় নোয়েল আর সান্তাক্লজকে বলা হয় পেরি নোয়েল। ফ্রান্সের লোকেরা ক্রিসমাস ট্রি-কে পুরনো ধাঁচে সাজাতেই বেশি ভালোবাসে। তারা ট্রি-র ওপরে লাল রঙের ফিতে দিয়ে মুড়ে তার সঙ্গে সাদা মোমবাতি দিয়ে ক্রিসমাস ট্রি সাজায়। অন্যদিকে পর্তুগালে বড়দিনের অন্যতম আকর্ষণ সান্তাক্লজ বা ক্রিসমাস ফাদারের উপহার। বড়দিনের আগের দিন সন্ধ্যায় অর্থাৎ ক্রিসমাস ইভে ট্রি-র নীচে বা চিমনির সামনে স্টকিংসের মধ্যে ফাদার উপহার দিয়ে যানক্রিসমাস ইভে মাঝরাতে সিদ্ধ আলু আর নোনতা শুকনো কড মাছ দিয়ে তারা ভোজ সারে

স্কটল্যান্ডের বড়দিন

স্কটল্যান্ডে বড়দিন উদযাপিত হয়ে আসছে ষষ্ঠদশ শতক থেকে। খ্রীষ্টধর্মের আগে এখানে বড়দিনের বদলে পালন করা হতো প্যাগান উৎসব। পরবর্তীতে সেটাই বড়দিন হিসেবে পালন করা হয়। এখানেও ক্রিসমাস ট্রি, উপহার আদান-প্রদান ইত্যাদির মাধ্যমে বড়দিন পালন করা হয়। একত্রে প্রীতিভোজ সারার পর প্রিয়জনদের দেওয়া হয় ক্রিসমাস কার্ড। দেশজুড়ে ব্যবস্থা থাকে বিশেষ আলোকসজ্জার। ক্রিসমাসের এই আলোকসজ্জার জন্য স্কটল্যান্ড বিখ্যাত

 নাইজেরিয়ায় বড়দিনের ছুটি শুরু হলেই শহর ছেড়ে মানুষজন যে যার গ্রামের দিকে রওনা দেয়। ফলে কয়েকদিনের মধ্যেই ফাঁকা হয়ে যায় শহর। কেনাকাটার দোকানগুলোতে ভিড় ছেয়ে যায়। আমাদের দেশে বড়দিন বলতে যেমন কেক থাকতেই হবে, নাইজেরিয়ায় কিন্তু বড়দিনে কেক সেভাবে গুরুত্বপূর্ণ নয়। ওখানকার লোকেরা রান্না করে নানারকমের সুস্বাদু মাংস, যেমন জুলোফ রাইস, টুয়ো, ফুফু ইত্যাদি। সঙ্গে থাকে ভিন্ন প্রকারের পানীয়

 

অস্ট্রেলিয়ায় বড়দিন পালন

 অস্ট্রেলিয়ার ক্রিসমাস আবার গ্রীষ্মকালে। ওখানে বিশেষ খাবার হিসাবে থাকে টার্কি ডিনার। তবে ওদের খাবারদাবারের মধ্যে একধরণের দারুণ পুডিং থাকে। এর একটি বৈশিষ্ট্য আছে। পুডিংয়ের মধ্যে থাকে একটি সোনার টুকরো। সবাই মিলে সেই পুডিং খাওয়ার সময় যার ভাগ্যে সেটি জোটে তাকে সৌভাগ্যবান বলে ধরা হয়। অস্ট্রেলিয়ায় সান্তাক্লজকে ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিয়ে দেওয়া হয়ে থাকে, সান্তার মাথায় থাকে ঐতিহ্যবাহী ‘আকুব্রা’ হ্যাট। আর সেই ঐতিহ্যবাহী সান্তার স্লেজ গাড়িটি টানে অস্ট্রেলিয়ার প্রতীক ক্যাঙ্গারু! অস্ট্রেলিয়ায় ক্রিসমাসের দিন দু’টি বড় বড় খেলাও অনুষ্ঠিত হয়। ডিসেম্বরের ২৫-২৬ তারিখকে ওরা বলে বক্সিং ডে, আর সেদিন কোনো না কোনো টেস্ট ম্যাচ অস্ট্রেলিয়া প্রতি বছরই খেলে

                 
               ঐতিহ্যময় মিষ্টি   ‘ব্রিগেডেইরো                                       ব্রাজিলে বড়দিন পালন

 

অস্ট্রেলিয়ার মত ব্রাজিলেও ক্রিসমাসের সময় গ্রীষ্মকাল। সাও পাওলো, রিও ডি জেনিরোর মতো বড় বড় শহরগুলো বড়দিন পালনের জন্য একেবারে সেজেগুজে প্রস্তুত। ক্রিসমাসের অতি মনোরম একখানি দৃশ্য হলো তুষারপাত, যেহেতু এই সময়ে সাধারণত শীতকাল থাকে। কিন্তু গ্রীষ্মকালে বড়দিন হলে কী আর করা যাবে! অগত্যা ক্রিসমাস ট্রি-র উপরে তুলো দিয়ে বরফের মতো বানিয়ে রাখাই একমাত্র পন্থা! ভারি ভালো লাগে দেখতে। তবে এখানে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু কিউরিতিবা শহর। সেখানে ঘরবাড়ি সাজানোর প্রতিযোগিতা হয়। বড়দিনে বিচারকরা বাড়ি বাড়ি ঘুরে সবচেয়ে সুন্দর করে সাজানো বাড়ি খুঁজে বের করে সেটিকে বিজয়ী নির্বাচিত করেন। ওখানে সান্তাক্লজকে পাপাই নোয়েল নামে অভিহিত করা হয়। ২৪শে ডিসেম্বর রাত ১২টা বাজলেই গীর্জাগুলিতে ‘মিসা দ্য গ্যালো’ উদযাপন করা শুরু হয়ে যায়। ব্রাজিলে খাবারের তালিকাতে থাকে বিশেষ একটি খাবার যা চকলেট আর কনডেন্সড মিল্ক দিয়ে তৈরি। এই খাবারটির নাম ব্রিগেডেইরো

 

রাশিয়ার বড়দিন পালন

 রাশিয়াতে ক্রিসমাস পালনের সময়কাল আবার ৭ই জানুয়ারি। এর কারণ দেশটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের তারিখ নির্ধারণের ক্ষেত্রে পুরনো জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করে থাকে। নিউ ইয়ার পালনের মধ্য দিয়ে তাদের উৎসব শুরু হয়। রাশিয়ার ক্রিসমাসের মজা হলো, ওখানে ক্রিসমাস আর নববর্ষ একসঙ্গে পালন করা হয়। আর তাই ওখানে নববর্ষের উদযাপনের ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায় ঠিক মধ্যিখানে একটা ক্রিসমাস ট্রি আছে। রাশিয়ানরা ক্রিসমাস ট্রি-কে বলে ইয়োল্কা আর ওরা ক্রিসমাস ট্রি হিসেবে পাইন গাছের পরিবর্তে অধিকাংশ সময়েই ব্যবহার করে স্প্রাস গাছ

উৎসবমুখর বাঙালি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দুর্গাপুজোর জন্য যেভাবে বছরভর অপেক্ষমান থাকে, বড়দিনের অপেক্ষাও কিন্তু কম কিছু থাকে না। প্রত্যেক উৎসবকে কেন্দ্র করে যেমন লক্ষ লক্ষ মানুষ নিজেদের জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করে, ঠিক তেমনি বড়দিন পালনের উপর নির্ভর করেও বিশ্বের অসংখ্য মানুষের জীবন-জীবিকা নির্বাহিত হয়। আমাদের দেশে বড়দিনকে কেন্দ্র করে ঘর সাজানোর জিনিস থেকে শুরু করে দোকানে দোকানে বসে ছোটো বড়ো কেকের পসরা। দোকানগুলোতে অন্যান্য সময়ের তুলনায় কেনাবেচা হয় একটু বেশিই। মানুষজন তাদের পরিবার পরিজনের জন্য  উপহার সামগ্রী কেনে বলে এই সময়ের পূর্বে প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন বৃদ্ধি পায় এবং নতুন নতুন সামগ্রী বাজারে আসে। সেদিক থেকে যেকোনো বৃহত্তর উৎসব অনুষ্ঠান উদযাপনের সামাজিক গুরুত্বের সঙ্গে অর্থনৈতিক গুরুত্বও অসীম। প্রভু যীশুর কাছে এটুকুই প্রার্থনা, বড়দিনের ঝলমলে আলোর মেলায় খুশির আলো জ্বলে উঠুক সমাজের সকল স্তরের প্রতিটি মানুষের ঘরে


কলমে - তমালিকা ঘোষাল ব্যানার্জী

চিত্র সৌজন্য - আন্তরজাল

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন