সকাল থেকেই মেঘলা করে আছে আকাশটা।বৃষ্টি নামবে নামবে করেও নামছে না।অবশ্য সকালে বৃষ্টি হলে অসুবিধাও অনেক।বরং রাত্রে নামলে অসুবিধা অনেকটাই কম।বাইরের কাজ কর্মও থাকে না, ঘুমটাও খুব ভালো হয়।বৃষ্টির শব্দে কেমন যেন একটা তন্দ্রাচ্ছন্ন ব্যাপার আছে।আর একটু চালে ডালে ফুটিয়ে নিয়ে হালকা খিচুড়ি আর সঙ্গে পাঁপড় ভাজা,আর কি চাই! এর উপর যদি বাড়িতে ডিম থাকে তাহলে তো এক্বেবারে ছয়ে ছক্কা। আজকেও মনে হচ্ছে সেরকমই একটা ব্যাপার ঘটতে চলেছে। বর্ষাকালে সব বাড়িতেই, বিশেষ করে বাঙালিদের ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটা দিনতো রাতে খিচুড়ি হবেই হবে। এখন জুলাই মাস। আজকে আঠাশ তারিখ,বাংলার এগারোই শ্রাবণ। ভরা বর্ষা।তাহলে এখন বৃষ্টি হবে না তো কি ডিসেম্বরে হবে? অবশ্য ডিসেম্বরেও যে হয়না তা নয়,তবে অল্পসল্প। আবার হলে সেও এক জ্বালা। এমনিতেই ঠান্ডা তার উপর বৃষ্টির যুগলবন্দী। নে এবার সামলা বাঙালি। বাঙালির আবার সবকিছুই একটু নিয়ম মেনে পরিপাটি করে হলে ভালো হয়। বর্ষার সময় মাঝারি থেকে অল্প ভারী বৃষ্টি। আবার শীতকালে মোটামুটি পনেরো ডিগ্রি থেকে বাইশের মধ্যে তাপমাত্রা ওঠানামা করবে, যাতে করে দু-ছিপিতেই হয়ে যায়। সুরা তো নয়, টনিক! রাতে শোয়ার আগে একটু গলা ভিজিয়ে মোটা ভেলভেটের বাঘছাল কম্বলটা গায়ের ওপর ফেলে দিয়ে বিছানায় এলিয়ে পড়। নিজেকে বেশ একটা রয়েল বেঙ্গল, রয়েল বেঙ্গল মনে হবে। আর কি চাই। হালকা একটু অফিসিয়াল কাজ কর্ম, মাঝে মধ্যেই সময়ের গ্যাপে গ্যাপে চার থেকে পাঁচ কাপ চা। আট ঘন্টার কাজের ফাঁকে ঘন্টা চারেক একটু মোহনবাগান ইষ্টবেঙ্গল নিয়ে বাঙাল ঘটি তরজা, একটু নন্দন,সত্যজিৎ রায়, ফেলুদা,ঋতুপর্ণা, প্রসেনজিৎ। আর আশেপাশে দু-একজন এট দ্য ভার্জ অফ রিটায়ারমেন্ট থাকলে,মৃণাল সেন,লতা,কিশোর,রফি,মান্না,হেমন্ত,সন্ধ্যা,বলরাম কিংবা চুনী।
আরে দেখুনতো,
একা একাই কেমন বকে যাচ্ছি। এই হচ্ছে বাঙালির এক দোষ। আড্ডা দিতে এতটাই
ভালোবাসে যে কাউকে না পেলে নিজের সাথেই অকারণ বক্ বক্ করে যাবে।
এইরে কি ভুলো মন ভাবুন। এতক্ষণ হয়ে গেল অথচ নিজের পরিচয়টাই আপনাদেরকে দেওয়া হয়নি। আমার নাম সমরেশ বসু। আরে না না; কালকূট নয়। পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া পদবী। আর বাবার নাম মিলিয়ে নাম - কমলেশ,সমরেশ। ছিলাম স্কুল শিক্ষক। একটা সরকারি সাহায্য প্রাপ্ত বাংলা মাধ্যমের স্কুলে বত্রিশ বছর পদার্থ বিজ্ঞান পড়িয়ে গত দু’হাজার কুড়িতে রিটায়ার করেছি। হিসেব মতো বাষট্টি। না না যথেষ্ট বুড়ো হয়ে যাইনি এখনো। মিসেস ও একটি মেয়েদের স্কুলের বাংলার শিক্ষিকা। এই মুহূর্তে বাড়িতে নেই। আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে গেছেন। একটিই ছেলে, কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে মাস্টার্স করে এখন পুণেতে একটা আইটি কম্পানিতে মাসিক হাজার সত্তরের একটা চাকরি করছে। ওখানেই অফিসের আরো তিনজনের সাথে মেস করে থাকে। বছরে খুব বেশি হলে বার তিনেক আসে। এখন ওখানেও যথেষ্ট বৃষ্টি হচ্ছে। স্ত্রী গেছেন লিলুয়াতে ওর মাসতুতো বোনের বাড়ি। ওখানেও এখানকার মতোই মেঘলা আকাশ। সকালে ফোন করেছিল। আমরা থাকি উলুবেড়িয়ায়। এখানেই হাই স্কুলে চাকরি করতাম। ছেলের মা তিন দিনের জন্যে বেড়াতে গেছেন। অবশ্য যাওয়ার আগে প্রয়োজনীয় সব কিছুই,ডাল,সবজি,মাছ,ডিমের ঝোল রান্না করে ফ্রিজে রেখে গেছেন। ফলে রান্না করে খাওয়ার চাপ নেই। একটু দু’বেলা ভাত ফূটিয়ে নিচ্ছি। ভাবছি আজকে রাতে চালের সাথে একটু মুসুর ডাল,নুন,হলুদ,দুটো কাঁচা লঙ্কা আর সামান্য ঘি মিশিয়ে নেবো। সঙ্গে ব্যাট পাঁপড় আর একটা ডিমের অমলেট। আঃ,ভেবেই জিভে জল চলে আসছে। নে বাঙালি,যত না খেলি তার থেকে বেশি ভেবেই মরলি। সারাদিন শুধু খাই আর খাই। কোনো প্রভিন্সের খাওয়া খেতে বাদ দিলনা। বিরিয়ানি, ধোসা, ইডলি, পাওভাজি, ব্যাম্বু-চিকেন; কি নেই পাতে!
আবার পাস্তা,বার্গার,চাউমিন,মোমো,
দেশী বিদেশী কি নেই তাতে। কখনো শুনেছেন,ফ্রান্সের
লোকেরা ডালভাত,মাছভাত,পায়েস,পিঠে
খাচ্ছে? কে
বোঝাবে! এত
যেমন তেমন জিভ নয়, খাদ্য
রসিকের জিভ। সুগার,প্রেশার,বিপি-লো,হাই
আছে; থাক না,
ডায়ালিসিস চলছে চলুকনা। একদিকে ফাস্ট ফুড,আরেক
দিকে ডাক্তারের প্রেস্কিপশন মেনে গোটা দিনে আট দশটা ক্যাপশুল কিংবা ট্যাবলেট। বাঙালি মরবিই যদি
খেয়েই মর। না
খেয়ে খামোকা মরবি কেন? ঐ
দেখুন কথা বলতে বলতে কখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে খেয়ালই করা হয়নি। নাঃ,জানালা
গুলো বন্ধ করতে হবে। বৃষ্টি
নেমে গেছে। সঙ্গে
একটু ভারী বাতাসও দিচ্ছে। টিভির খবরে গতকালই বলেছিল হাল্কা থেকে
ভারী বৃষ্টিপাত হবে। আর
হওয়াটাইতো স্বাভাবিক। বছরের
এই সময় হবে না তো কখন হবে। এই রে,আলোটাও
গেল। আমাদের
বিদ্যুৎ দপ্তরের লোকগুলোকেই আবহাওয়া দপ্তরের যৌথ দায়িত্ব
একসাথে দিয়ে দেওেয়া উচিত। এরা সবার আগে জেনে যায়
যে ঠিক কোন সময়ে কোন দিক থেকে ঘন্টায় কত কিলোমিটার গতিবেগে ঝড় আসছে। এক মাইনায় দু-দুটো
কাজ একত্রে। সরকার
পক্ষ একটু ভেবে দেখতে পারেন। কোষাগারের যা দৈন্য অবস্থা,জনসাধারণের
ট্যাক্সে আর কতদিন চলবে। সরকারি চাকরি,সেও
তো চার বছরে একবার ঘটা করে প্রস্তুতি,তারপরে
লোয়ার কোর্ট,হাইকোর্ট,
সুপ্রিমকোর্ট,নিজের
ছেলে,পরিতোষ
বাবুর মেয়ে - মানে
সবকিছু ঘেটে ‘ঘ’। তুই ব্যাটা চুষে খা। কিছু বলবি তো সোজা চালান
করে দেব। কয়েদী
নাম্বার –’হ
য ব র ল’। নে এবার পচে মর। আর যদি পারিস তো এর পা
চাট, ওর পা চাট,হুর
হুর করে উপরে। টুল
থেকে রিভলভিং চেয়ারে। কোনোরকমে প্র্যাকটিস করে
অতি কষ্টে নিজের নামের বানানটা শুধু সই করা শিখে নিতে হবে। স্পষ্ট করে লেখার ও দরকার
নেই। কয়েকটা
আঁকিবুকি এবং তলায় একটা লম্বা টান। ব্যাস,কেল্লা
ফতে। সুইস
ব্যাঙ্ক,ওভারসীস
ব্যাঙ্ক।
কত খাবি,শুধু
জমিয়ে যা। আলমারী
খুলবি আর হুড়মুড়িয়ে পরতে থাকবে,আর পরতেই থাকবে। তবে
সাবধান,হার্টটাকে একটু বিদেশ থেকে খরচা করে ভালোভাবে ঝালাই করে আনতে হবে। কারণ
কম বয়সে আধপেটা খেয়ে বড় হয়েছে,কুকুরে শোয়না,সেই বিছানায় শুয়ে। সামালকে
ভাই,কুকুরের পেটে ঘি সহ্য হতে একটু তো সময় নেবে, ঠিক কিনা?
সবে
রাতের খাওয়াটা খেয়ে অম্বলের সিরাপটা দু-চামচ গলায় ঢেলে শুয়েছি। একটু
ঘুমও এসে গেছিল মনে হয়। রাত
তখন ক’টা
হবে? খুব
বেশি হলে সাড়ে এগারোটা কি বারোটা। মোবাইলের
আলোটাই সম্বল। চার্জও
তেমন বেশি নেই। সন্ধ্যা
থেকেই তো লোডশেডিং ছিল। ইনভার্টারটাও
বেশিক্ষণ টানতে পারেনা। পুরোনো
হয়ে গেছে। প্রায়
বছর ছয়েক হয়ে গেছে। রোজই
ভাবি পাল্টাতে হবে। দোকানের
ছেলেটাকে বলেছিলাম ব্যাটারীটা
পাল্টে দেওেয়ার জন্যে। বলেছিল
আসবে,কিন্তু আসেনি। আর
আসবেই বা কি করে। দৈনিকই
তো দফায় দফায় বৃষ্টি হচ্ছে। ভেবেছিলাম
ফোন করবো,কিন্তু এক্কেবারে ভুলে গেছি। আসলে
বাঙালির কুঁড়েমি প্রতিটি
মজ্জায় মজ্জায়। বিপদে
না পড়লে নড়বেই না। এতটাই আরাম প্রিয়। তাই একটু তাড়াতাড়িই,
বোধহয়
সাড়ে দশটা নাগাদ শুয়ে পড়েছিলাম। বাড়িতে মোমবাতিও রাখার অভ্যেস নেই। কোনো কোণা
খামচিতে পরে থাকলেও এই অন্ধকারে আন্দাজে খুঁজে পাওয়া
সম্ভব নয়। ধোঁয়া
গেলার নেশাও নেই, তাই
দেশলাইয়েরও বালাই
নেই। তবে
হাড়েহাড়ে বুঝতে পারছি যে সবকিছুর জন্যই মানসিক ভাবে প্রস্তুত থাকা দরকার। তা একটু ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করেই
ঘুমটা ভেঙ্গে গেল। সদর
দরজায় কে যেন কড়া নাড়ছে। হ্যাঁ, স্পষ্ট
শোনা যাচ্ছে। বেশ
জোড়েই ডাকছে। আবার
আমারই নাম ধরে।
-”সমরেশ
বাবু বাড়ি আছেন,একটু
দরজাটা খুলুন না, প্লিজ। খুব বিপদে পড়েই
আপনার কাছে এসেছি।”
হুড়মুড়িয়ে বিছানায়
উঠে বসলাম। ভুল শুনছি নাতো? নাঃ,
ওই তো
আবার, এবার আরো জোড়ে। তাড়াতাড়ি
করে বিছানা থেকে নেমে
অন্ধকারে মোবাইলের হালকা আলোয় এগিয়ে গেলাম দরজার কাছে। জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে’?
-”প্লিজ দরজাটা খুলুন। ভেতরে
ঢুকে সব বলছি।”
আমি দরজা খুলে
পর্দার ফাঁক দিয়ে বাইরে তাকালাম। ঝরঝরিয়ে
বৃষ্টি পড়ছে। মাঝে মধ্যেই বিদ্যুৎ চমকানোর আলো, সঙ্গে গুরুগম্ভীর মেঘের গর্জন। কিন্তু
কেউ কোথাও নেই। গেল
কোথায়? উবে গেলো, নাকি
ভুল শুনলাম? স্বগতোক্তি করলাম।
-” আমি
এখানে,ঘরের
ভেতরে। আপনি
দরজা বন্ধ করে দিন। আর
একটা তোয়ালে বা গামছা থাকলে দিন। পুরো শরীর বেয়ে জল পড়ছে।
আমি চমকে উঠলাম। আমি তো দরজায় দাঁড়িয়ে। কখন কিভাবে ঢুকল!
একটু জড়তা নিয়েই বললাম,
“আমি তো আপনাকে ঢুকতে দেখিনি। আপনাকেই বাইরে খুঁজছি। কোথা দিয়ে ঢুকলেন”?
-”আরে
আপনি ডানদিকে পর্দা সরিয়ে বাইরে যখন উঁকি দিয়ে দেখছেন তখন আমি বাঁ-দিকের
পর্দা সরিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়েছি। ভেরী সিম্পল,সমরেশ
বাবু”।
-”কিন্তু
আপনি আমার নাম জানলেন কি করে?”
-”সেটাও
ভেরী সিম্পল। দরজার
গায়েই বাইরে আপনার নেমপ্লেটে তো সিলভার কালারে মেটালে লেখা আছে। বিদ্যুতের আলোয় স্পষ্ট
দেখা যাচ্ছে। এতটাই
বৃষ্টিতে ভিজে গেছি যে বাইরে আর দাঁড়াতে ইচ্ছা
করছিল না। আই
অ্যাম এক্সট্রিমলি সরি,
সমরেশ বাবু। আর বড্ড ঠান্ডাও লাগছিল। হাতের কাছে একটা কাপড় জাতীয়
কিছু থাকলে কাইন্ডলি দিন না। মাথাটা একটু মুছব। আর ভেজা জামাকাপড়গুলোও
একটু ছাড়া দরকার। ভিজে
গিয়ে শরীরের সাথে একেবারে চুপসে রয়েছে”।
- ”সে
নাহয় দিচ্ছি। এবং
এও বুঝলাম যে আপনি নেমপ্লেট দেখে আমার নামটা জেনেছেন। কিন্তু এই ঝড় জলের মধ্যে
এত রাতে আমার বাড়িতেই এলেন কি করে?”
- ”হ্যাঁ,এই
প্রশ্নটা আমারও। আসলে
বৃষ্টির মধ্যে চারিদিক
নিঝুম। কেউ
নেই যে একটু জিজ্ঞেস করবো। আসলে এই এলাকায় আগে কখনও
আসিনি। আমি
আমার অজান্তেই মনে হয় কোনও ভাবে পথ হারিয়ে ফেলেছি। আচ্ছা,
আমরা কি এখানে এভাবেই বাকি রাতটা দাড়িয়ে থাকবো?”
- “ না
না সরি সরি, আসলে
অন্ধকারে বিদ্যুতের আলোয় আপনার অবয়ব দেখতে পাচ্ছি কিন্তু আপনার মুখটাতো দেখতে
পাচ্ছিনা। তাই
একটু যেন কেমন কেমন লাগছে। বাড়িতেও এই মুহূর্তে একা,আর
কেউ নেই। কিছু
মনে করবেন না,বলতে
বাধ্য হচ্ছি,একটু
ভয় ভয় যে লাগছে সেটাও সত্যি।”
- “ আপনি
অহেতুক চিন্তা করছেন। অন্ধকার
কাটুক। হয়তো দেখা যাবে যে আমরা দুজনেই দুজনকে
চিনি।”
আমি ভদ্রলোককে একটা গামছা, যেটি আমার ঘরের চেয়ারের উপরেই মেলে দেওয়া ছিল শুকোনোর জন্য, দিলাম। এবং পরার জন্যে আমারই একটা জামা ও পাজামা দিলাম। অদ্ভুত ভাবেই সেগুলো ওনার গায়ে দারুন ভাবে ফিট করে গেলো। যাক্ একা ছিলাম এবার একজন কথা বলার লোক পাওয়া গেলো। তবে রাতের ঘুমের যে বারোটা বাজলো এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আবার একটু ভয় ভয়ও যে করছে না তাও নয়। মোবাইলের মৃদু আলোয় একটু মুখটা দেখার চেষ্টা করলাম। যেটুকু দৃষ্টি গোচর হচ্ছে তাতে করে কেমন যেন আমারই মতো বছর ষাট– বাষট্টিরই একটু রোগাটে দাড়ি গোঁফ কামানো মুখ। কিছু খাবেন কিনা জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু খেতে চাইলেন না। বললেন থ্যাঙ্কস। আমার খিদে নেই।ওনার নাম জিজ্ঞেস করলাম। উত্তরে বললেন- ‘সমরেশ বসু’। এবার পুরো আঁতকে ওঠার পালা। তুতলিয়ে বললাম, “সে কি, এতো আমারই নাম! “
- “ কেন,দুজন মানুষের একই নাম হতে পারেনা বুঝি? “
- “ আরে না না, এমা,তা নয়। আসলে সমরেশের বাড়িতে আরেকজন সমরেশ। এবং এমনকি পিতৃ প্রদত্ত উপাধিটাও হুবহু এক। একটু অবাক না হয়ে পারলাম না।”
- "দেখুন সমরেশ বাবু,আপনি যদি সঠিকভাবে খোঁজেন তাহলে আপনি দেখবেন একই নামের দুটো লোক আকছার খুঁজে পাবেন। এটা একেবারেই আশ্চর্য হওয়ার মতো কোনো ঘটনাই নয়।”
- “ না,এটাতো হতেই পারে।আর হবে নাই বা কেন; কত নতুন নতুন নাম বাবা-মা’রা খুঁজে বার করবে বলুনতো। নামে কি এসে যায়, ব্যক্তিই আসল। নাম কি ধুয়ে খাব? হ্যাঁ, তার চেয়ে বলুন এতো রাতে এরকম দুর্যোগ মাথায় করে এখানে এলেন কিভাবে?”
- “এই একই প্রশ্ন তো আমি নিজেকেও তখন থেকে করে যাচ্ছি। আমি এখানে এলাম কিভাবে? বিকেলের দিকে বেরিয়েছিলাম দৈনিকের মতোই একটু মাইল খানেক হাঁটার জন্য। রিটায়ার করার পর সেই আগের মতো ব্যস্ত জীবন তো আর নেই। মেঘলা করেছিল সেই সকাল থেকেই। আর বিকেল গড়ার সাথে সাথেই চারপাশের অন্ধকারটা আরো যেন ঘন হয়ে এল। সঙ্গে যে তিন-চারজন একসাথে হাঁটতে যেতেন তারাও আর বেরোতে চাইলেন না। এখন বেড়িয়ে পরেছি আবার বাড়ি ফিরে যাবো? তাই ভাবলাম আজকে বেশী দূর না গিয়ে কাছেপিঠেই একটু ঘুরে তাড়াতাড়ি ফিরে আসবো। কিন্তু সেটা আর হল কোথায়! খানিকটা যাওয়ার পরেই মনে হলো কেউ যেন ডাকছে। কিন্তু কাউকেই দেখতে পেলাম না। চারপাশে মুখটা ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,”কেউ কি আছেন আশেপাশে?” কোনো উত্তর পেলাম না। আর পাবোই বা কিভাবে,কেউ থাকলে তবেই না উত্তর দেবে। এরকমটা আজকাল প্রায়শই হচ্ছে,জানেন। মাঝেমধ্যেই মনে হয় কে যেন ডাকছে। আচ্ছা আপনারও কি এরকমটা মনে হয়? কেউ নেই অথচ মনে হয় যেন কেউ আছে? “
- “ না ঠিক সেরকম সিরিয়াস কিছু নয়। তবে একা একা থাকলে মাঝে মধ্যে যে মনে হয়না তাও নয়। মনে হয় কেউ বুঝি দরজার বাইরের থেকে ডাকছে। বেল বাজাচ্ছে। কতবার ভুল করে দরজা খুলে দেখছি কেউ কোথাও নেই। মনে হয়েছে তাহলে কি ভুল শুনলাম? কিন্তু স্পষ্ট যে শুনলাম কেউ যেন ডাকছে। দরজায় কড়া নাড়ছে। বছর দশেক আগে ছেলে যখন কলেজে পড়তে যেত কোলকাতায়, তখন অনেক সময়ই ওর কলেজ থেকে ফিরতে রাত হয়ে যেত। দুঃশ্চিন্তা হত খুব। কতবার ভুল করে দরজা খুলে ছেলেকে খুঁজেছি – ‘সন্তু আজ এতো দেরি হলো?’ কিন্তু দরজা খুলে কাউকে দেখতে পাইনি। ওকে বলতাম সে কথা। ও বলতো, “আমাকে নিয়ে তোমরা বড্ড টেনশন করো। টেনশন করা ছেড়ে দাও,দেখবে এসব আর হবেনা”। কে বোঝাবে বাপ-মা’র মনের ভেতরে কি হয়। যখন সংসার করবে,ছেলেপুলে মানুষ করবে তখন বুঝবে সব। অবশ্য তখন আমরা হয়তো আর থাকবো না।”
- “ আরে না না কি যে বলেন। শরীরের প্রতি যত্ন নিন। অনায়াসে আরও পনেরো,বিশ বছর হেসে খেলে বেঁচে যাবেন। এখন মানুষের গড় আয়ু পঁচাত্তর হয়ে গেছে, তবে টেনশন করলে হবেনা। যত চিন্তা করবেন তত বিভিন্ন ক্রনিক রোগ – প্রেশার,সুগার ওইসব ধরে যাবে। ছেলে মানুষ হয়ে গেছে, বউ একটা সরকারি স্কুলে চাকরি করেন এখন আপনার অবসর জীবন। হাত পা তুলে মহা আনন্দে থাকুন মশাই। আমাকে দেখছেন না,হারিয়ে গেছি,অথচ নো চিন্তা। ঠিক বাড়ি খুঁজে পেয়ে যাবো। সকালের আলোটা ফুটুক। আর কতক্ষণই বা বাকি। আপনার সাথে কথা বলেও বেশ ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে জন্ম জন্মান্তরের চেনা। ভাবছি আর অবাক হচ্ছি,আপনার সাথে আমার কত মিল। আমিও গত দু-বছর হলো সরকারি স্কুলের চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি। বাংলা পড়াতাম। চাকরি পাওয়ার বছড় তিনেক বাদে বাবা- মা সম্বন্ধ করে যার সাথে বিয়ে দিলেন,অর্থাৎ আমার স্ত্রী। উনিও সরকারি স্কুলের পদার্থ বিদ্যার শিক্ষিকা। একটি মেয়ে, কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে ইউনিভার্সিটি পাশ করে এখন একটি আইটি কম্পানিতে চাকরি করছে।”
- “পুণেতে?”
- “ হ্যাঁ হ্যাঁ, কিন্তু আপনি জানলেন কি করে? আমিতো আপনাকে কিছু বলিনি!”
- “আরে আমিও তো তখন থেকে একই কথা ভাবছি। কারণ কিছু না বলা সত্বেও আপনি দেখলাম আমার স্ত্রী এবং ছেলের ব্যাপারে অনেক কিছুই জানেন। স্ট্রেঞ্জ! “
- “ আরে না, এটা নিয়ে অতো ভাববার কিছু নেই। ইনটিউশন বোঝেন তো? আপনি এই মুহূর্তে যেটা ভাবছেন, দেখবেন সেটা পরবর্তী সময়ে কি অদ্ভুতভাবে প্রায় সবটাই মিলে যায়। আপনি একজন শিক্ষক। আর শিক্ষকরা চাকুরীজীবি মহিলা বিয়ে করলে স্কূলের দিদিমনিই খোঁজে। আর আমার একটা মেয়ে, তাই ভাবলাম আপনারটা ছেলেই হবে, নাহলে ব্যালান্সটা থাকবে কি করে। আবার আপনার এবং আমার প্রায় একই বয়স। সুতরাং আমার মেয়ে শিক্ষা সমাপ্ত করে চাকরি পেয়ে গেলে আপনার ছেলেও নিশ্চই একই রকম কিছু করবে। তবে পুণে ব্যাপারটা কাকতলীয়। সবই যখন প্রায় মিলেই যাচ্ছে তখন ওটাই বা বাকি থাকে কেন। ঠিকই ধরেছেন।”
- “ হয়তো যথার্থই বলেছেন। আবার টেলিপ্যাথির কথাও আমরা জানি। যেখানে একজন ব্যক্তি আরেকজনের মনের কথা পড়তে পারে। তার অতীত,বর্তমান,ভবিষ্যত তার চোখের দিকে তাকিয়ে সব জেনে নিতে পারে। তবে এখনো পযর্ন্ত এর কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি বা বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। সবটাই ধারণা। তবে প্রত্যেকটি প্রাণীর মনই যেহেতু একটা বিশেষ প্রকারের শক্তি,তাই দুটো শক্তির কম্পাঙ্ক একই সুরে ধ্বনিত হলে এটা সম্ভব হতেই পারে। আমাদের মা-বাবারা অনেক সময়ই দেখতাম আমরা সেই মুহূর্তে কি ভাবছি সেটা কিছুটা হলেও আমাদের চোখ মুখ দেখে ধরে ফেলতেন।”
- “একদম ঠিক কথা। আপনার মোবাইল ফোনটা অনেকক্ষণ থেকে রিং হয়ে চলেছে। নিশ্চই প্রয়োজনীয় ফোন। ধরুন।”
- “ হ্যালো হ্যালো,এত সাত সকালে ফোন করেছ কেন?”
- “ সাত সকাল? ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখো। সাড়ে সাতটা বেজে গেছে। দশটায় বিড়লা তারামন্ডলে আজকে তোমার প্যারালাল ইউনিভার্সের উপর সেমিনার আছে না। দেশ বিদেশ থেকে নামি দামী সব পদার্থবিদরা আসবেন, আর তুমি দিব্যি ঘুমিয়ে যাচ্ছ! তোমার জায়গায় আমার থাকা উচিত ছিল। আর তোমার হওয়া উচিত ছিল বাংলার টিচার।”
- “ হ্যাঁ, একদম ঠিক বলেছ। আর আমাদের ছেলে না হয়ে হওয়া উচিত ছিল একটা মেয়ে। আরে ও সমরেশ বাবু কোথায় গেলেন? আরে এখানেই তো সোফার উপর বসে ছিলেন আমার ঠিক মুখোমুখি।”
- “ কি আজেবাজে বকে চলেছ তখন থেকে? তুমি নিজেই তো সমরেশ বাবু। আমাদের বাড়িতে সোফার সামনে তো কাঠের আলমারি। আর তার পাল্লায় আয়না লাগানো। নিজেকেই নিজের নাম ধরে ডাকছ? তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে উঠে চোখে মুখে জল দাও গিয়ে। বিজ্ঞান আর প্যারালাল ইউনিভার্স নিয়ে সারাদিন গবেষণা করতে গিয়ে বুড়োর মাথাটাই গেছে। আমার অত ভালো হীরের টুকরো ছেলে থাকতে বলে কিনা ছেলের জায়গায় একটা মেয়ে থাকলে ভালো হতো!! “
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন