মাতৃত্বকালীন অবসাদ - সুকৃতি দাস




চলতি কথায় আমরা অনেকসময় বলি “মা হওয়া কি মুখের কথা। ”সত্যি মা হওয়া কোন সাধারণ ব্যাপার নয়। সন্তানের জন্ম দেওয়ার সময় ও পরে একজন নারীকে বিভিন্ন রকম শারীরিক- মানসিক পরিবর্তনের সম্মুখীন হতে হয়। শারীরিক পরিবর্তন তো আমরা দেখেই অনুধাবন করতে পারি। কিন্তু মানসিক সমস্যা? মানসিক সমস্যাকে বোঝার জন্য প্রয়োজন বিশেষ অনুভব ক্ষমতা।


সন্তানের জন্ম পর্যন্ত পরিবারের সকল সদস্যের নজর থাকে হবু মায়ের উপর। কিন্তু সন্তানের জন্মের পর আর্কষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে সদ্যজাত শিশুটি। এমনকি মা নিজেও নিজের সমস্ত কামনা বাসনা ত্যাগ করে কাছে টেনে নেয় কোলের সন্তানটিকে। এই অবস্থায় মায়ের মানসিক ও শারীরিক অবস্থা হয়ে যায় মূল্যহীন আর এই অবস্থা থেকেই বিস্তার লাভ করে অবসাদ। এই অবসাদকে বলে পোস্টপারটাম ডিপ্রেশন (postpartum depression) । বর্তমান বিশ্বে এই মানসিক সমস্যার দ্বারা আক্রান্ত প্রতি সাতজনের মধ্যে একজন মা।




লক্ষণঃ

  • অবসন্নতা
  • অকারণে কান্নাকাটি করা
  • অনিদ্রা
  • পরিবারের সাথে দুরত্ব বৃদ্ধি
  • অস্থিরতা
  • মনোসংযোগ করতে না পারা
  • দুশ্চিন্তা
  • নিজের এবং সন্তানের ক্ষতি করার ভাবনা
  • আত্মহত্যা করার চেষ্টা


কতদিন এই অবসাদ স্থায়ী হয়?

শিশুর জন্মের পর দু-তিন সপ্তাহ‌ বিভিন্ন মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হয় একজন মা। এই পরিবর্তন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ক্ষণস্থায়ী হয়। একে বলা হয় বেবি ব্লুস। কিন্তু এই সমস্যা যদি দীর্ঘস্থায়ী এবং মারাত্মক আকার ধারণ করে তবে সেটিকেই বলে পোস্টপারটাম ডিপ্রেশন। এটি এক বছর স্থায়ী হয়। তবে তার মানে এটা কখনোই নয় যে এক বছর পর এটি সম্পূর্ণরূপে সেরে যাবে। এই সমস্যার সমাধানের জন্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া আবশ্যক।


মাতৃত্বকালীন অবসাদ কি রোধ করা যায়?


শিশুর জন্মের সময় মায়ের দেহে ইস্ট্রোজেন এবং প্রজেস্টেরন হরমোনের মাত্রা দশ গুণ বেড়ে যায়। আবার শিশুর জন্মের পর এই হরমোনের মাত্রা আবার পূর্বাবস্থায় ফিরে আসে। গর্ভসঞ্চারের ফলে এই আকস্মিক হরমোনের পরিবর্তনের ফলে মানসিক অবস্থার পরিবর্তন দেখা যায়। তাছাড়া পরিবারের কারোর এই সমস্যা থাকলে বা পূর্বে অবসাদের মতো মানসিক সমস্যা থাকলে এটির সম্ভাবনা বহুগুণ বেড়ে যায়। তবে কিছু পন্থা অনুসরণ করে এটি রোধ করা‌ সম্ভব –


  • নিয়মমাফিক খাওয়া দাওয়া করা
  • নেশাদ্রব্য গ্রহণ না‌ করা
  • ধ্যান এবং যোগাভ্যাস
  • নিয়ম মেনে ঘুমানোর অভ্যাস
  • নিজের মনের কথা প্রিয়জনের সাথে ভাগ করে‌ নেওয়া


অনেকক্ষেত্রেই মায়েরা ভাবে সন্তানের সমস্ত দায়িত্ব তার একার আর এই ভাবনার ফলে কোন কর্তব্যে বিন্দুমাত্র ত্রুটি হলে মায়ের মনে জন্ম নেয় হীনমন্যতা। তখন সে খাওয়াদাওয়া ও ঘুমকে ভুলে গিয়ে নিজের ক্ষমতার থেকেও অধিক পরিশ্রম করে ফেলে। এটিও অবসাদের অন্যতম কারণ। তাই সবসময় মনে রাখতে হবে মা হওয়ার আগে আপনি একজন মানুষ। মানুষ মাত্রই ভুল হয়, ক্লান্তি আসে। তাই মা হওয়ার পর যদি সম্ভব হয়, পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কিছু দায়িত্ব ভাগ করে দিন। এরফলে আপনি ভালো থাকবেন এবং আপনার ছোট্ট সোনার সাথে অনেকটা বেশি সময় কাটানোর সুযোগ পাবেন।

মাতৃত্বকালীন অবসাদ কি চিকিৎসাযোগ্য?

  • হ্যাঁ, সন্তান জন্মের পূর্বে ও পরে উভয় প্রকার অবসাদ চিকিৎসার দ্বারা সারিয়ে ফেলা‌ সম্ভব। এক্ষেত্রে মনোবিদের দ্বারা প্রেসকাইবড ওষুধ সন্তান ও মায়ের কোনরকম ক্ষতি করে না। তাছাড়া শিশু দুগ্ধপান করলেও এটি কোন সমস্যা সৃষ্টি করে না।
  • ওষুধের পাশাপাশি সাইকো থেরাপিও এক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়।
  • মানসিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা বা চিকিৎসা এখনও বহুক্ষেত্রে নিষিদ্ধ বিষয় হয়েই রয়ে গেছে। তাছাড়া সমস্যাটা যখন নতুন মায়েদের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তখন অনেকসময় সেটিকে সাধারণ সমস্যা বলে অগ্রাহ্য করা হয়। কিন্তু এটি মনে রাখা প্রয়োজন যে মন ও শরীর একে অপরের পরিপূরক। তাই সন্তান জন্মের তিনমাস আগে মানসিক ও শারীরিক দুই প্রকার স্বাস্থ্য পরীক্ষা ভীষণ জরুরী। তাছাড়া সন্তান জন্মের পরও এটি করাতে হবে। এরফলে মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার পূর্বেই সেটি রোধ করা সম্ভব।



Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন