সদ্যোজাত শিশুর পেটব্যাথা একটি
অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। প্রতি ৪ জন সদ্যোজাতের মধ্যে ১জন এই প্রকারের ব্যাথা জনিত
উপসর্গে ভুগে থাকে। পরিপাকতন্ত্র অপরিণত থাকায় নবজাতকদের পেটেব্যথা, কোষ্ঠকাঠিন্য, ডায়ারিয়া, বমি, এ সব দেখা যায়। তবে এ কোনও বিরল ঘটনা নয়। কিন্তু শিশু
অবস্থা থেকে ঠিকমতো ব্যবস্থা না নিলে এগুলি তার শরীরে স্থায়ী ভাবে থেকে যায়। সাধারণত শিশু জন্মের দ্বিতীয় সপ্তাহ
থেকে এই ধরনের ব্যাথা শুরু হয়। সাধারণত প্রায়দিন বিকালের দিক থেকেই এই সমস্যা লক্ষ্য
করা যায়। শিশু প্রচণ্ড চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। প্রায় সারারাত ব্যাথার জন্য শুতে বা
ঘুমাতেও পারেনা।
শিশুর চিৎকার করে কান্নার কারণ পেটে ব্যাথা কিনা তা প্রথমে বোঝা দরকার। সুস্থ অবস্থায়
অনেক সময় খিদে পেলে বা মল-মুত্র ত্যাগ করে ভিজে কাপড়ে থাকলেও শিশু কেঁদে জানান দেয়।
কিন্তু যদি দেখা যায় যে এসব কারণ ছাড়াও শিশুর কান্না থামানো যাচ্ছে না তাহলে বুঝতে
হবে পেটের ব্যাথা বা অন্য কোনও শারীরিক অসুবিধার জন্য শিশু কাঁদছে। যদি একটানা ঘণ্টার
পর ঘণ্টা ধরে কাঁদতে থাকে এবং অন্তত লাগাতার কয়েকদিন এমনকি কয়েক সপ্তাহ ধরে কান্না
চলতেই থাকে তাহলে পেটে ব্যাথা হচ্ছে বলে ধরা হয়। সাধারনত
দেখা যায় যে,
পেট
ব্যাথার কান্না ৬ সপ্তাহ বয়সের শিশু থেকে ৬ মাস বয়সের শিশুর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। পেটের
ব্যাথার শিশু এবং স্বাভাবিক শিশুদের কান্নার ধরন একই হয়ে থাকে। তবে পেটের ব্যাথার
শিশু একবার কাঁদতে শুরু করলে সহজে শান্ত হয় না এবং
দীর্ঘ সময় যাবৎ কাঁদতে থাকে। যদিও এটি
দীর্ঘকালীন কোনো সমস্যা সৃষ্টি করে না। সাধারনত
১০-৪০% শিশুর মধ্যে এই সমস্যা দেখা যায়। কৌটার
দুধ পানকারী এবং মায়ের দুধ পানকারী উভয় প্রকার শিশুরই পেটে ব্যাথা হতে দেখা যায়।
কারণ সমূহঃ
১. কিছু শিশুর ক্ষেত্রে দুধ পাচনগত সমস্যা
(lactose intolerance) থাকে। এর থেকে পেটে ব্যাথা হয়।
২. স্তনদুগ্ধের ঘনত্ব কম হলে খুব তাড়াতাড়ি
দুধ হজম হয়ে গিয়ে খিদের সঞ্চার করা।
৩. চিকিৎসকের
মতে, শিশুকে মায়ের
দুধ খাওয়ানোর সময় পজিশন এবং এটাচমেন্ট ঠিক না হলে শিশুর পেটে ব্যাথা হয় যা শিশুর
কান্নার কারন।
৪. হাইপারপেরিস্ট্যালসিস ( hyperperistalsis)
বা শিশুর পাকস্থলিতে অতি দ্রুত খাবার প্রবেশ করার কারনে পেটে ব্যাথার সূচনা হয়। শিশুর
জন্মের পর থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত পাকস্থলি অপরিণত থাকে যার ফলে তাদের বিভিন্ন
ধরনের পাকস্থলির সমস্যা দেখা দেয়। পাকস্থলির সমস্যা গুলোর মধ্যে পেটে ব্যাথা
অন্যতম।
৫. পাকস্থলির
হরমোন যেমন মলিটিন ব্যাথা হওয়ার অন্যতম কারন। ধারনা
করা হয় মলিটিন হাইপারপেরিস্ট্যালসিসের কারন যা পেট ব্যাথা ঘটায়।
৬. একটি
পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে যে, স্নায়ুবিক (neurogenic), হজমের গোলযোগ (gastrointestinal), জীবানুঘটিত (microbial) এবং মানসিক (psyochosocial) উপসর্গ গুলি শিশুর
ব্যাথা হওয়ায় অসুস্থতার কারণ হচ্ছে।
৭. গ্যাস্ট্রোইসোফেগাল রিফ্লাক্স ( gastroesophageal
reflux) অর্থাৎ খাবার পাকস্থলি থেকে উপরের দিকে খাদ্যনালীতে উঠে আসার ফলে পেটে ব্যাথা দেখা দেয়।
প্রতিকারঃ
সদ্যোজাত শিশুদের
এই সমস্যা থেকে রেহাই পাওয়ার জন্য কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়।
সঠিক পদ্ধতিতে স্তন্যপান করানোঃ
সদ্যোজাতকে সঠিক
অবস্থানে স্তন্যপান করানো দরকার। স্তন পানের সময় খেয়াল রাখতে হবে যেন শিশুর মুখ সম্পূর্ণ
অবস্থায় বন্ধ থাকে, পেটে কোনওভাবেই হাওয়া না ঢুকে যায়। শিশু ভুল ভাবে যদি দুধ পান করে তাহলে পেটে
অনেক সময় হাওয়া ঢুকে যায় তার জন্য গ্যাসের সমস্যা আরো বেশি করে দেখা দিতে পারে।
খাওয়ানোর পর ঢেকুর তোলানোঃ
শিশুকে দুধ খাওয়ানোর পরে সবসময় বুকের উপর দাঁড় করানো অবস্থায় তুলে পিঠে আস্তে আস্তে চাপড়ে ঢেকুর তোলানো ( burping) জরুরী। ঢেকুর তোলানোর জন্য কোমরের কাছ থেকে শুরু করে কাঁধ অবধি পর্যায়ক্রমে ধীরে ধীরে আঙুলের হালকা চাপে মালিশ করতে হয়। ঢেকুর উঠে গেলে পেটে ব্যাথা হওয়ার সুযোগ থাকে না।
ছয়মাস পর্যন্ত অবশ্যই স্তনদুগ্ধ পান করানোঃ
শিশুকে ছয়মাস পর্যন্ত শুধু স্তনদুগ্ধ খাওয়ানো জরুরী। অন্য আর কিছুই না। এমনকি জল পর্যন্ত না। ওষুধ দিলে সেটাও ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে দিতে হবে।
মায়ের দুধ ছাড়া কিচ্ছু খাওয়ানো যাবে না।
শিশুকে কম দুধ খাওয়ালে শিশুর পেট ব্যাথা গ্যাসের সমস্যা খুব বেশি হয়। শিশুকে অন্তত দু’ঘন্টার বিরতিতে নিয়মিত
স্তনপান করাতে হবে এবং শিশুর প্রয়োজন হলেই খাওয়াতে হবে। যত স্তনপান করানো হবে শিশু ও মা তত সুস্থ থাকবে। শিশু সারাদিনে ন্যুনতম ৮ বার মূত্রত্যাগ করলে সঠিক পরিমাণ দুধ পান করছে বলে বোঝা যায়। মায়ের স্তনদুগ্ধে অনেক রকমের অ্যান্টিবডি এবং অনেক প্রয়োজনীয়
অ্যামিনো অ্যাসিড ( amino acid ) থাকে যেগুলো শিশুর পেটের জন্য ভালো।
হজম শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়।
স্নানের আগে মালিশঃ
শিশুকে খাওয়ানোর পরে ঢেঁকুর তোলানো এর সাথে সাথে স্নান করানোর আগে
হালকা হাতে একটু তেল মালিশ করতে হবে । পেটে পিঠে হালকা হাতে মালিশ দেওয়া দরকার। শিশুর ঘাড় ধরে একটু উঠিয়ে হাত পা গুলো নাড়াচাড়া করিয়ে পেটে গোল গোলাকারে হালকা মালিশ করা দরকার। এই মালিশ স্নানের
সময় ছাড়াও দিনে অন্তত ৪-৫ বার করতে হবে। এতে শিশুর অন্ত্র সুস্থ থাকে । শিশুর গ্যাস কম হয়। এবং শিশুর গ্যাস নির্গমনেও সুবিধা হয়।
মায়ের জন্য সহজপাচ্য
খাদ্যঃ
প্রসবপরবর্তী সময়
থেকে শুরু করে যে মা স্তনপান করান, তাঁকে খুব ঝালমশলাযুক্ত খাবার খাওয়া
থেকে বিরত থাকতে হবে। যে খাবার সহজপাচ্য না সেগুলো থেকে দূরে থাকতে হবে। খুব সহজপাচ্য খাবার খেতে হবে। ঘরে তৈরি হালকা খাবার খাওয়াই শ্রেয়। দেখা যায় অনেক সময় মা যদি মশলাদার রসুন পেঁয়াজ দেওয়া খাবার বেশি খান তাহলে শিশুর পেটে ব্যাথা, গ্যাস জমে পেটমুচড়ানো প্রভৃতি সমস্যা হয় ।
গ্যাস হলে করণীয়ঃ
১. শিশুর গ্যাস হলে , শিশুকে উল্টে পেটের উপরে শোয়াতে হবে। এতে অনেক সময় গ্যাসের ব্যথা থেকে মুক্তি পায়। গ্যাস অনেক সময় বেরিয়ে যায় এভাবে। বা মলত্যাগ করালেও
সাথে সাথে গ্যাস বের হয়ে
ব্যাথার উপশম ঘটে।
২. পেটে হালকা মালিশ বা হালকা গরম সেঁক দিতে হবে।সেঁক দিতে হবে মোটা
সুতির কাপড় দিয়ে শুকনো অবস্থায় খুব সামান্য তাপের সেঁক দিতে হবে।
৩. এই সমস্ত ঘরোয়া
উপাচারে কাজ না হলে ওষুধ ছাড়া গতি নেই। তখন চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে simethicone
জাতীয় ওষুধের ড্রপ দেওয়া যেতে পারে , (শিশুর ওজন অনুযায়ী আলাদা dose তাই চিকিসকের পরামর্শ নেওয়া বাঞ্ছনীয়)। তবে প্রতিদিনই এই ওষুধ ব্যবহার না করাই শ্রেয়। চেষ্টা করতে হবে অন্যান্য উপায়গুলি অবলম্বন করে শিশুকে সুস্থ রাখতে ।
৪. শিশু কে ভালো করে স্তন্য পান করানো অবশ্যই দরকার। শিশুর মাথা-পা-গা ভালো করে ঢেকে রাখা জরুরী। যাতে শিশু কখনো ঠান্ডা না হয়ে যায়, এমন কি শিশুর হাত পাও না ঠাণ্ডা হয়। শিশুর হাত-পা বা অন্যান্য জায়গার তাপমাত্রা যেন সবসময় সঠিক ও স্বাভাবিক থাকে। শিশুর শরীরের তাপ ঠিক না থাকলে অনেক রকম রোগে ভুগতে থাকে শিশু । শিশুর শরীর খুব সহজে তাপ ছেড়ে দেয়। তাই শিশুর শরীরের তাপ বজায় রাখার জন্য বিশেষ নজর দেওয়া দরকার। শারীরিক যে কোনও অসুবিধাতেই শিশু কাঁদতে
পারে।
খুব অসুবিধার সাথে প্রতিনিয়ত সম্মুখীন হলে অবশ্যই শিশু বিশেষজ্ঞের কাছে পরামর্শ নিতে হবে। একটি শিশুর সুস্থতা সম্পূর্ণ তার বাবা মায়ের হাতেই থাকে। একথা মনে রাখা একান্তই দরকার।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন