একটি শিশুর সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার জন্য তার খাদ্যতালিকায় কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট, ভিটামিন, মিনারেল, ফাইবার সবকিছু থাকা বাঞ্ছনীয়। তবে তার পুষ্টির উদ্দেশ্যে এতোকিছু একসঙ্গে দিতে গেলে লাভের চাইতে ক্ষতি হওয়ারই আশঙ্কা থাকে। কিন্তু একজন নতুন মা পারিপার্শ্বিক শুভানুধ্যায়ীদের কাছ থেকে স্রোতের মতো আসা নানান রকমের উপদেশের আতিশয্যে মুশকিলে পড়ে যান যে তাঁর একরত্তির জন্য কোনটা ঠিক হবে। সবথেকে গুরুতর বিষয়টি হলো, শিশুর একবছর বয়স পূর্ণ হওয়ার আগে আমরা অজান্তেই তার পুষ্টির কথা ভেবে এমন অনেককিছু তাকে খাইয়ে ফেলি যেগুলো তার জন্য আদপেই স্বাস্থ্যকর নয়। কারণ একটি ছোটো শিশুর পরিপাকতন্ত্রের তখনও পূর্ণ বিকাশ ঘটে না। সেক্ষেত্রে কিছু কথা মনে রাখা একান্ত প্রয়োজন।
গরুর দুধঃ
প্রথমেই আসে গরুর দুধের প্রসঙ্গ
যাকে আমরা শিশুদের জন্য সর্বাধিক স্বাস্থ্যকর বলে মনে করি। কিন্তু চিকিৎসকরাই
নিষেধ করেন শিশুর একবছর বয়স সম্পূর্ণ হওয়ার আগে তাকে গরুর দুধ দিতে। এর কারণ হল, শিশুদের পাচনতন্ত্র উন্নতমানের হয় না। গরুর দুধে
ল্যাক্টোজ সুগার ও কেসিন প্রোটিনের পরিমাণ থাকে অনেক বেশি। এই বিপুল পরিমাণ সুগার
ও প্রোটিন পরিপাকের জন্য প্রয়োজনীয় ল্যাক্টেজ ও কাইমোসিন এনজাইম শিশুদের শরীরে
সাধারণত থাকে না। ফলস্বরূপ, উচ্চমানের
প্রোটিন হজম করতে গিয়ে শিশুদের শারীরিক সমস্যার মুখে পড়তে হতে পারে। এছাড়াও
গরুর দুধে থাকে শিশুদের জন্য সহনীয় মাত্রার তুলনায় উচ্চমাত্রার সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস। একবছরের কমবয়সী শিশুদের কিডনি এমনিতেই অপরিণত থাকে। এই
অতিরিক্ত মাত্রার খনিজ নিষ্কাশনে কিডনি নানারকম সমস্যার সম্মুখীন হয়। আরেকটি
ব্যাপার হল, গরুর দুধে
শিশুদের জন্য উপযুক্ত পরিমাণে আয়রন থাকে না, যেটি তাদের প্রথম বছরের জন্য শারীরিক বিকাশে খুবই দরকার। সেই কারণে একবছর বয়স
সম্পূর্ণ হওয়ার আগে শিশুদের জন্য ব্রেস্ট মিল্ক অথবা ফর্মূলা মিল্কই আদর্শ।
মধু :
আগেকার দিনে তো অবশ্যই, এখনও অনেক জায়গায় শিশুদের মুখে মধু দেওয়ার চল
রয়েছে যা একেবারেই অনুচিত। মধুর মধ্যে থাকে ক্লসট্রিডিয়াম বটুলিনিয়াম নামক
একধরণের ব্যাকটিরিয়া। ছোটো শিশুদের ক্ষেত্রে এটির থেকে বিষক্রিয়া তৈরী হওয়ার
সম্ভাবনা থাকে। মধু খাওয়ার পর তৎক্ষণাৎ শিশুদের মধ্যে অসুস্থতার লক্ষণ দেখা নাও
যেতে পারে, কিন্তু মধুর ক্ষতিকর
প্রভাব ৮-৩৬ ঘণ্টা পরেও হয়।
নুন :
অনেকেই বলেন, নুন না থাকলে খাবারে স্বাদ হবে না, বাচ্চাও খাবে না। একেবারেই ভুল ধারণা। কঠিন খাবার
খাওয়ার আগে অবধি তো শিশু ব্রেস্ট মিল্ক অথবা ফর্মূলা মিল্ক খেয়ে এসেছে। নুন তার
কাছে একেবারে নতুন, ওতে সে আগে থাকতে
অভ্যস্ত নয়। তাও দিতে চাইলে ছয়মাসের পর তার জন্য খাবার রান্না করার সময় খুবই
সামান্য যোগ করা যেতে পারে, না দিলেই বেশি
ভালো হয়। অধিক মাত্রার লবণ শিশুদের কিডনির কার্যক্ষমতাকে দুর্বল করে তুলতে পারে।
এছাড়াও উচ্চ রক্তচাপ, ডিহাইড্রেশন, ভঙ্গুর হাড় এসবের সম্ভাবনা তৈরী হয়। শিশুদের
সোডিয়ামের চাহিদা মায়ের দুধে থাকা লবণই পূরণ করে।
চিনি ও অন্যান্য মিষ্টিজাতীয়
খাদ্য :
একবছরের আগে তো একেবারেই নয়, তার পরেও যতটা সম্ভব চিনি এড়িয়ে চলা উচিত শিশুদের
আহারে। তার সাথেই চকোলেট, ক্যান্ডি, ললিপপ ইত্যাদি মিষ্টিজাতীয় খাবারগুলি। শিশুর শর্করার
প্রয়োজনীয়তাগুলি কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাবার এবং অন্যান্য প্রাকৃতিকভাবে মিষ্টি
খাদ্য যেমন ফল দ্বারাই পূরণ হয়ে যায়। নয়তো ডায়াবিটিস, স্থূলতা, দাঁতের ক্ষয় ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে পারে। চিনির বিকল্প হিসাবে পাকা কলা, আঙ্গুরের রস ইত্যাদি ব্যবহার করা যায়।
বাদাম :
শিশুদের জন্য খুবই স্বাস্থ্যকর
এটি। তবে একবছর বয়স সম্পূর্ণ হওয়ার আগে না দেওয়াই ভালো। অনেক শিশুদের ক্ষেত্রে
অ্যালার্জির সম্ভাবনা থাকে।
ডিম :
এটিও শিশুর একবছর বয়স সম্পূর্ণ
হওয়ার পরেই দেওয়া শ্রেয়। এই বয়সের অ্যালার্জি উৎপাদক খাদ্যসমূহের মধ্যে ডিম
অন্যতম। ডিমের কুসুমে সালমোনেলা নামক একটি ব্যাক্টেরিয়া উপস্থিত থাকতে পারে। তাই
ডিম সম্পূর্ণভাবে সেদ্ধ করার পর তবেই দেওয়া উচিত। হাফ বয়েলড খাওয়াতে হলে শিশুর
বয়স অন্ততপক্ষে পাঁচবছর সম্পূর্ণ হতে হবে।
সামুদ্রিক মাছ :
অনেক সামুদ্রিক মাছে উচ্চ
পরিমাণে পারদ থাকে তাই এগুলো শিশুদের দেওয়া ঠিক নয়। রুই, কাতলা, শিঙ্গি, মাগুর ইত্যাদি
মাছ তাদের জন্য পুষ্টিকর।
চিংড়ি :
সব বয়সের জন্য সবচাইতে বেশি
অ্যালার্জি উৎপাদক খাদ্য হলো চিংড়ি। তাই শিশু বেশ কিছুটা বড় না হওয়া পর্যন্ত এটি
এড়িয়ে চলাই ভালো।
উপরোক্ত তালিকায় থাকা খাবার
ছাড়াও এমন অনেক খাবার আছে যা অন্য শিশুরা দিব্যি হাসিখুশি ভাবে গ্রহণ করছে, কোনরকম সমস্যা হচ্ছে না। অথচ দেখা গেলো, দশজনের মধ্যে একজন শিশু সেই খাবার খেয়েই ভয়ানক
অসুস্থ হয়ে পড়লো। এক্ষেত্রে খাবারটি অস্বাস্থ্যকর না হয়েও সেই বিশেষ শিশুটির
জন্য ক্ষতিকর, কারণ সেই খাবারের
প্রতি তার অ্যালার্জি রয়েছে। সেই কারণে শিশুকে নতুন কোনো খাবার দেওয়ার আগে সেটির
সঙ্গে তার অত্যন্ত সাবধানে ধীরে ধীরে পরিচয় করানো উচিত। পারিবারিক ইতিহাসে যদি
এমন কেউ থাকেন যে বিশেষ কোনো খাদ্য তাঁর অ্যালার্জির উৎস, তাহলে সেটি ছোট শিশুদের ক্ষেত্রে না দেওয়াই ভালো।
বেশ কিছুটা বড়ো হওয়ার পর সামান্য পরিমাণে দিয়ে পরখ করা যেতে পারে যে তার কোনরকম
সমস্যা আছে কিনা। প্রয়োজনে একজন শিশুবিশেষজ্ঞের মতামত নেওয়া যেতে পারে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন