মোহনপুর রাজবাড়ির মাঠে রোজ ভোরে সাতপাক হাঁটা আমার বরাবরের
অভ্যাস। শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা কোনো ঋতুতেই আমার এই রুটিনের কোনো পরিবর্তন হয়নি। শহরের
মধ্যে এত বড়ো খোলা মাঠ আর দ্বিতীয়টি নেই বলে এখানে প্রাতঃভ্রমণ করতে আসা মানুষের
সংখ্যা নেহাত কম নয়। অনেকেই হাঁটেন। কেউ ডাক্তারবাবুর নির্দেশে আবার কেউ শরীর ফিট
রাখার জন্য। এখানে যাঁরা হাঁটতে আসেন তাঁদের সকলেরই মুখ চিনি। আলাপও আছে অনেকের
সাথে। তো সেদিন হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম এক মধ্যবয়স্কা মহিলা হাতে মোবাইল নিয়ে
হাঁটছেন। কানে অবশ্য হেডফোন নেই। এর আগে ওঁকে এখানে হাঁটতে দেখেছি বলে মনে করতে
পারলাম না। সম্ভবত নতুনই হবেন।
আজকাল হাঁটতে আসা মানুষের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছে। এ মাঠে সকাল
বিকেল সন্ধ্যা পালা করে মানুষ হেঁটেই চলেছে। আমি অবশ্য শরীর ফিট রাখার জন্য হাঁটি।
আমার চেহারা দেখে অনেকেই ঈর্ষা করেন। আমার বাবা ভীষণ দূরদর্শী মানুষ ছিলেন বলেই
হয়তো অনেক ভেবেচিন্তে আমার নাম রেখেছিলেন চিরকুমার। নাম চিরকুমার হলেও আমি
বিবাহিত। শুধু আমাকে নিয়ে নয়, আমার স্ত্রীকে নিয়েও আমার ভীষণ
গর্ব। কত জনমের কঠোর তপস্যায় যে এমন লক্ষীমন্ত বৌ পাওয়া যায় তা ভেবে অনেকেই
কূলকিনারা পান না। তাতে অবশ্য আমি খুব একটা বিচলিত হই না। বরং ব্যাপারটা তারিয়ে
তারিয়ে উপভোগ করি।
ভদ্রমহিলা আমার স্ত্রীর মতো অপরূপা না হলেও বেশ সুন্দরী।
একবার তাকালে চোখ ফেরানো মুশকিল। তার উপর এই সাতসকালে মেক আপের বহর দেখে বিস্মিত
না হয়ে পারলাম না। আড়চোখে তাকাতে খুব একটা পটু না হলেও চেষ্টা করে দেখলাম, কপালে সিঁদুর
নেই। এখন অবশ্য এসব দেখে বিবাহিত অবিবাহিত বোঝার উপায় নেই। যুগ এগোচ্ছে। ছেলে আর
মেয়েরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে চলেছে সাম্যের সন্ধানে। হঠাৎ গানের সুরে আমার
ভাবনার প্রবাহের দিক বদল হল।
ভদ্রমহিলা পাশ দিয়ে যেতেই শুনতে পেলাম ওঁর হাতের মোবাইলে
বাজছে "এক পলকের একটু দেখা আরও একটু
বেশি হলে ক্ষতি কী.... " এখানেই শেষ নয়। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মনে হল আড়চোখে
আমার দিকে তাকিয়ে ভদ্রমহিলা মুখ টিপে হাসলেন। এমন গান আর এমন প্রশ্রয়ের হাসি
ভবিষ্যতে বিড়ম্বনার কারণ হতে পারে ভেবে বারবার নিজের স্ত্রীর শ্রীমুখ কল্পনা করে
উত্তেজনা প্রশমনের চেষ্টা করলাম।
পরের দিন হাঁটতে যাওয়ার উৎসাহ আপনা-আপনি কেমন যেন
অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গেল। যথাসময়ে মাঠে পৌঁছে দেখি, হ্যাঁ, যা ভেবেছিলাম
তা-ই। ভদ্রমহিলার সাজের বহর
আরও বেড়েছে। আমি আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম উনি হাসতে হাসতে আমার দিকেই এগিয়ে আসছেন।
হ্যাঁ, আজও ওঁর হাতে মোবাইল। তবে আজ
নতুন গান বাজছে। " তখন তোমার একুশ বছর বোধহয়... আমি তখন অষ্টাদশীর ছোঁয়ায়...।
" এই গান শুনে একটু চিন্তায় পড়ে গেলাম। তাহলে উনি কি আমায় আগে থেকেই চেনেন ? অনেক ভেবেও
পুরনো স্মৃতি হাতড়ে কোনো কিছু মনে করতে পারলাম না। কিন্তু খচখচানিটা রয়ে গেল।
তৃতীয় দিনেও মাঠে গিয়ে দেখি, নতুন পোশাকে
ভদ্রমহিলা হাজির। নিজেকে সুন্দর করে সাজিয়ে তোলার ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র কার্পণ্য
করেননি। এসবই আমার জন্য ভেবে আমার চিরকুমার নামটার জন্য গর্ব অনুভব করলেও গিন্নির
কথা মনে হতেই তা উধাও হয়ে গেল। দেখলাম উনি হাসিমুখে এগিয়ে আসছেন। কাছে আসতেই
শুনলাম মোবাইলে বাজছে --- " লাগা চুনারি মে দাগ....." এই মধ্যবয়সে
মনে দাগ লাগানোর জন্য উনি যে এভাবে উঠেপড়ে লাগবেন তা আমার ধারণার বাইরে ছিল। আরও
ভয়ঙ্কর ব্যাপার হল, ডাক্তারবাবু হাজার বার করে
হাঁটতে বললেও যে গিন্নি হাঁটার ত্রিসীমানায় যায়নি, সেই গিন্নি
ভোরে উঠে আমার জন্য চা করে দিয়ে বলল, " কাল থেকে
আমিও তোমার সাথে হাঁটতে যাব। " ঢোঁক গিলে বললাম, " তুমি হাঁটতে
যাবে এতো আনন্দের কথা ! " কথাটা শুনেও গিন্নির গম্ভীরমুখের পরিবর্তন না দেখে
বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম।
পরের দিন ভোরবেলা মাঠে আমার সাথে পাল্লা দিয়ে হাঁটছিল
গিন্নি। আর বারবার এদিক ওদিক তাকিয়ে কী যেন খুঁজছিল। ভদ্রমহিলা তখনও এসে পৌঁছাননি।
আমি নিশ্চিত হাঁটার মাঠের এই ভদ্রমহিলার বিষয়টা কোনোক্রমে নিশ্চয় গিন্নির কানে
উঠেছে। তা না হলে গিন্নির আমার সাথে হাঁটতে আসার কথা নয়। আমি নিরীহ নিপাট ভদ্রলোক
হিসাবে আমার মোবাইলটা বার করে ইউটিউব থেকে একটা গান ডাউনলোড করে রাখলাম। এটাই আমার
একমাত্র অস্ত্র হিসাবে কাজ করতে পারে বলে মনে হল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই মাঠে
ভদ্রমহিলার আবির্ভাবে বুকের মধ্যে ধড়াস ধড়াস করা শুরু হলেও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার
আপ্রাণ চেষ্টা করছিলাম। উল্টোদিক থেকে ভদ্রমহিলা হাঁটা
শুরু করতেই মোবাইলটা হাতে নিয়ে গানটা সেট করে রাখলাম। তারপর গিন্নির পাশাপাশি
হাঁটতে হাঁটতে উনি কাছাকাছি আসতেই ফুল ভল্যুমে গানটা চালিয়ে দিলাম-- " আজ
দুজনার দুটি পথ ওগো দুটি দিকে গেছে বেঁকে... "। তারপর থেকে আর মোহনপুর
রাজবাড়ির মাঠে ভদ্রমহিলাকে দেখতে পাইনি।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন