তখন বিকেল সাড়ে চারটে, ছোট্ট বাড়ির দরজায় বেলটা বাজলো l বাড়িটা
ছোট, একপাশে একটা টিনের চালের গ্যারেজ l ভেতরে পুরোনো ভাঙাচোরা একটা অস্টিন গাড়ি l
সুপ্রতিম দরজা খুলে দেখে আগন্তুক একজন বয়ষ্ক মানুষ, বছর ষাটেক বয়েস l মাঝারি হাইট,
ভালো স্বাস্থ্য, কাঁচাপাকা চুল l সাজসজ্জায় অর্থনৈতিক স্বাচ্ছল্যর ছাপ বেশ পরিষ্কার
l
ভদ্রলোক ভারিক্কি আওয়াজে বললেন,'মিস্টার সুপ্রতিম সেন?' সুপ্রতিম
বলল,'হ্যাঁ, আমি'l ভদ্রলোক বললেন,'নমস্কার l আমি জয়দেব বসু l আপনি কাগজে পুরোনো গাড়ির
একটা বিজ্ঞাপন দিয়েছেন l আজ সকালে ফোন করেছিলাম l সেই ব্যাপারেই আসা l' সুপ্রতিম বলে,'ভেতরে
আসুন'l বসার ঘরে ঢুকে ভদ্রলোক বলেন,'আমার শখ পুরোনো গাড়ি কেনা l তাই এলাম l যদি দেখে
পছন্দ হয়, তবে দাম নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না l' সুপ্রতিম বলে,'দেখুন, গাড়িটা আমার বাবার
l বাবার মৃত্যুর পরে ওটা ওরকমই পড়ে আছে প্রায় তিরিশ বছর l' জয়দেব বাবু বললেন,'গাড়িটা
একবার দেখা যায়?' সুপ্রতিম বলল,'নিশ্চয় তবে তার আগে কয়েকটা ব্যাপার একটু ক্লিয়ার করে
নেওয়া ভালো l আশা করি, আপনি আমার বিজ্ঞাপনটা ভালো করে পড়েছেন l গাড়িটা প্রায় তিরিশ
বছর ধরে পড়ে আছে, কোনো মেন্টেনেন্স ছাড়াই l এর কন্ডিশনের কথা বলতে পারব না l আমার কিছু
টাকার দরকার তাই বেচে দিচ্ছি l আমি কিন্তু ত্রিশ লাখ দর দিয়েছি l আর দাম নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া
আমার ভালোলাগেনা l' ভদ্রলোক গুরুগম্ভীর গলায় বললেন,'আমি বিজ্ঞাপন খুঁটিয়ে পড়েই এসেছি
আর আমিও দামাদামি ভালোবাসি না l স্পেশালি এটা যখন আমার শখের ব্যাপার l তবে হ্যাঁ, আগে
পছন্দ হওয়া চাই l' সুপ্রতিম বলল,'চলুন, গাড়িটা দেখে নিন l'
গ্যারেজের দরজা খুলতেই প্রাণান্তকর অবস্থা l তালা এবং দরজা
জং ধরে খুবই খারাপ হাল l গাড়ির অবস্থা আরো খারাপ l ধুলোয় ধুলোয় তার রঙ চেনা দায়! সুপ্রতিম
নাকে একটা রুমাল বেঁধে নিয়েছে ধুলোর হাত থেকে বাঁচতে l কিন্তু জয়দেবের সেসবে কোন ভ্রূক্ষেপ
নেই l জহুরির চোখে ঘুরে ফিরে দেখছেন গাড়িটা, সামনে থেকে, পেছন থেকে l শেষে বললেন,
'একটা কাপড় পাওয়া যাবে? ধুলো মুছে গিয়ার টিয়ারগুলো দেখতাম l' সুপ্রতিম সঙ্গে একটুকরো
কাপড় এনেইছিল l ভদ্রলোক জামার হাতাগুলো গুটিয়ে লেগে পড়লেন ঘষে ঘষে স্টিয়ারিং আর গিয়ার
নব মুছে ভালো করে সাফ করতে l তারপর জিজ্ঞেস করলেন,'অরিজিনাল পার্টস কিছু পাল্টাননি
তো?' সুপ্রতিম বলল,'আপনাকে তো আগেই বলেছি, বাবা মারা যাওয়ার পর, কেউ এ গাড়ি ছোঁয়নি
l' জয়দেব বললেন,'দেখা হয়ে গেছে আমার l গাড়ি পছন্দ হয়েছে l' সুপ্রতিম বলল,'চলুন, ঘরে
বসে কথা বলা যাক 'l গ্যারেজ বন্ধ করে ওরা ফিরে এল বসার ঘরে l
জয়দেব বাবু বললেন,'আমার কালেকশনে এ মডেলটা নেই l পছন্দও যখন
হয়ে গেল, তখন ডিল ফাইনাল l কিভাবে পেমেন্ট চান, বলুন l' সুপ্রতিম একটু হেসে বলল,'সব
যখন পজিটিভ, তখন প্রথমে একটু চা হয়ে যাক, তারপর কথা হবে l' জয়দেব বাবু বললেন,'চা হলে
মন্দ হবে না'l সুপ্রতিম বলল,' আসলে আমি একা মানুষ l বানিয়ে আনতে মিনিট দশেক লাগবে
l ততক্ষণ আপনি খবরের কাগজটায় একটু চোখ বোলাতে থাকুন, আমি আসছি l' জয়দেব বাবু বললেন,'আরে
তাহলে থাক না হয় l পরে একদিন হবে l' সুপ্রতিম বলল,'তা কেন, আমিও তো সন্ধ্যের চা খাবো
l' ঢুকে গেল বাড়ির ভেতরে l
চা হাতে নিয়ে হাল্কা গল্প চালু হল l সুপ্রতিম বলল,'আমি এদেশে
থাকি না l থাকি জার্মানিতে l মাস খানেকের জন্যে এখানে এসেছি একটা পড়ে থাকা কাজ সেরে
নিতে l' জয়দেব বাবু জিজ্ঞেস করলেন,'আপনি একা? মানে...' সুপ্রতিম বলে,'আমার শৈশবে মা
মারা যায়, তখন আমার জ্ঞান হয়নি l আমার বাবা আর এক বিধবা পিসি - এঁরাই ছিলেন l আমার
বাবার ছিল জুয়েলারির দোকান, এক বন্ধুর সঙ্গে পার্টনারশিপে l এই গাড়ি যে দেখছেন, এ আমার
দাদুর l'
চায়ে চুমুক দিয়ে বলে চলে সুপ্রতিম,'আমার তখন ছ বছর বয়েস, একদিন এক কান্ড ঘটে গেল l একদিন অনেক
রাতে পলাশ কাকু, মানে আমার বাবার ব্যবসার পার্টনার এলেন আমাদের বাড়ি l কী নিয়ে যেন
দুজনে প্রচন্ড বাগবিতন্ডা হল l শেষে পলাশ কাকু খুব রেগেমেগে বাবাকে শাসাতে শাসাতে বাড়ি
থেকে চলে গেলেন l বাবার অভ্যেস ছিল ডিনারের পরে সামনের গলিতে মিনিট পনেরো হাঁটার l
সে রাতেও বেরিয়েছিলেন l কিন্তু কে বা কারা ওনাকে খুন করে যায় l পুলিশ চেষ্টা করেছিল,
কিন্তু খুনির হদিস করতে পারেনি l সন্দেহের তীর পলাশ কাকুর দিকেই ছিল l কিন্তু তিনিও
হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যান l অনেক চেষ্টা করেও পুলিশ তাঁর খোঁজ পায়নি l'
'পরে পিসির কাছে শুনেছিলাম কী একটা দামী হীরে নিয়ে ঝামেলাটা
হয়েছিল l দোকানে বাবা আর পলাশ কাকু কারো কাছ থেকে একটা খুব দামী চোরাই হীরে কেনেন
l তখনকার দিনে তার দাম নাকি ছিল পঞ্চাশ লক্ষ টাকা l কিন্তু সেদিনই পুলিশ খোঁজ পেয়ে
দোকান রেড করে l বাবা কোনভাবে নীচে গিয়ে গাড়িতে হীরেটা লুকিয়ে ফেলে l পুলিশ খানাতল্লাশী
করে খালি হাতে ফিরতে বাধ্য হয় l আর রাতেই ঘটে ওই কান্ড!'
জয়দেব বাবু বলেন,'সত্যিই আপনার বাবার মৃত্যুর ব্যাপারটা খুব
ট্রাজিক l তবে মেনে নেওয়া ছাড়া কীই বা করার আছে l' সুপ্রতিম বলল,'কিন্তু আমি আজও মেনে
নিইনি l আর সত্যি বলতে কি খুনির খোঁজ আমি পেয়েও গেছি পলাশ কাকু, থুড়ি জয়দেব বাবু'l
জয়দেব বাবু রেগে উঠে বললেন,'মানে? কী বলতে চাইছেন?' সুপ্রতিম শান্ত স্বরে বলে,'ঠিকই
বলছি l কাগজে বিজ্ঞাপনটা আমায় তিন বার দিতে হয়েছে, শুধু আপনার নজরে আনার জন্যে l বিজ্ঞাপনে
আমার বাবার নামটাও মেনশন করেছিলাম সেই কারণেই l জানতাম, এই ভাঙাচোরা গাড়ি এত টাকা দিয়ে
সে-ই কিনতে আসবে, যে হীরের খবর জানে l আর এ দুনিয়ায় এক পলাশ বরণ বসুই সেই জীবিত ব্যক্তি
l' জয়দেব বাবু উত্তেজিতভাবে বললেন,'সে তো শুধু আপনার ধারণা l' সুপ্রতিম হেসে বলল,'প্রমাণ
আপনার বাঁ হাতের ফোরআর্মে আঁকা ট্যাটু - পি বি বি l পলাশ বরণ বসু l আপনি যখন হাতা গুটিয়ে
ড্যাশবোর্ডের ধুলো মুছছিলেন, তখনই চোখে পড়ে গেল l আপনার সকালের ফোন আসতেই পুলিশকে জানিয়ে
দিয়েছিলাম l চা করার সময় ফোন করে দিয়েছি l ওই যে ওনারা এসে গেছেন l আমার এত বছরের অপূর্ণ
কাজ অবশেষে সম্পন্ন হতে চলল l'
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন