আইফেল টাওয়ার কিনবেন? সস্তায় বিক্রি আছে!
বিশ্বাস হল না তো? না হওয়ারই কথা, কারণ আমি ভিক্টর লাস্টিগ নই। ভিক্টর লাস্টিগ এই কথাটাকেই এমনভাবে বলতেন যে আপনারা বিশ্বাস করতে বাধ্য হতেন। তিনি ছিলেন মিথ্যে কথার শিল্পী, যিনি জালিয়াতিকে আর্টের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন।
আর হ্যাঁ, লোকজনকে টুপি পরিয়ে সত্যি সত্যিই তিনি ফ্রান্সের জাতীয় সম্পদ আইফেল টাওয়ারকে বেচে দিয়েছিলেন। তাও, একবার নয়, দু-দু'বার।
ভিক্টর লাস্টিগের (Victor Lustig) জন্ম হাঙ্গেরিতে। জীবনকাহিনী বিশদে বলছি না। তবে পড়াশোনায় তিনি ছিলেন তুখোড় আর স্কুলে অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছাত্র হিসেবে নাম করেছিলেন। পড়াশোনা প্যারিসে। বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় ভাষায় চৌকস। সঙ্গে বেশভূষা আদবকায়দা সবেতেই চোখে পড়ার মত স্মার্ট। এগুলো সবই তাঁর জালিয়াতি শিল্পের অঙ্গ। উনিশ বছর বয়স থেকে জুয়া খেলায় জোচ্চুরি করে হাত পাকান। তারপর ফ্রান্স থেকে নিউ-ইয়র্ক যাওয়ার (ট্রান্স-আটলান্টিক লাইনার্স) জাহাজকে তাঁর শিল্পের প্রথম ক্যানভাস বানিয়ে নেন।
ফ্রান্স থেকে আটলান্টিক পেরিয়ে এই জাহাজে যাতায়াত করত
মূলতঃ উচ্চবিত্ত ফরাসি ও আমেরিকানরা। লাস্টিগ তাদের টার্গেট করতেন না।
উচ্চবিত্তদের মধ্যেও একেবারে টপক্লাস বড়লোকেরা ছিল লাস্টিগের শিকার। তারা প্রায়
মাসখানেকের ক্রূজ ভ্রমণে ধীরে ধীরে লাস্টিগের সঙ্গে পরিচিত হত। লাস্টিগও নিজেকে
ওইরকমই এক টপক্লাস বড়লোক বলে পরিচয় দিতেন। বলতেন, তিনি হচ্ছেন একজন খ্যাতনামা সঙ্গীত পরিচালক। ব্রডওয়ে প্রোডাকশনের মালিক। এই
নামে আদৌ কোনো কোম্পানির অস্তিত্বই ছিল না। টপক্লাস বড়োলোকেরা ভাবতেন বিপুলা এ
পৃথিবীর কতটুকুই বা জানি? তখন ইন্টারনেটও ছিল
না, আর একমাসের
জার্নিতে জাহাজে ভাসতে ভাসতে লাস্টিগের কথা যাচাই করার কোনো উপায়ও ছিল না। কেউ
আবার অজ্ঞতা ঢাকতে বলেই দিত, ওহো, আপনিই তবে ব্রডওয়ের
মালিক? কি সৌভাগ্য, নাইস টু মিট ইউ।
মিট যতই নাইস হত, লাস্টিগ ততই ফেনিয়ে ফেনিয়ে তাঁর কোম্পানির সুখ্যাতি করে যেতেন। বলতেন, ব্রডওয়েতে ইনভেস্ট করার জন্য বড় বড় আমেরিকান
ব্যবসায়ীরা তো মুখিয়ে আছে। প্রফিট ই প্রফিট! কিন্তু আমি চাই যারা একটু শিল্প-টিল্প
বোঝে এমন ইনভেস্টর আমার কোম্পানিতে টাকা ঢালুক। এই ধরুন আপনার মত। এইভাবে চাগাতে
চাগাতে এক্সট্রিম পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে লাস্টিগ বলতেন, যাকগে! জাহাজ পোর্টে ভিড়লেই তো ইনভেস্টররা ছেঁকে ধরবে। তার আগে একটু রেস্ট
নিয়ে নিই।
চাগা বড়লোকেরা ভাবনা-চিন্তা বন্ধ করে দৌড়ে গিয়ে কেবিন
থেকে চেকবই এনে বলতেন, অ্যামাউন্টটা বলুন
জাস্ট। কত ইনভেস্ট করতে পারি? লাস্টিগ তাও ইতস্তত করে বলতেন, এত বড় অংকের টাকা কি আপনি ইনভেস্ট করতে পারবেন? থাক, এখন কম করেই দিন।
ধরুন এই হাজার দুয়েক ডলার। চাগা বড়লোক ব্যবসায়ী হইহই করে উঠতেন, বলেন কি মশাই, দু'হাজারে কীই বা হয়? আপনি এই পাঁচহাজারের চেকটা রাখুন। প্রফিট তো হবেই, ব্রডওয়ে বলে কথা!
আগেই বলেছি এই ব্রডওয়ে প্রোডাকশনের কোনো অস্তিত্বই
ছিল না। আর জাহাজ পোর্টে আসার সঙ্গে সঙ্গে লাস্টিগ চেক নিয়ে হাওয়া। টাকা তুলে আবার
ফিরতি জাহাজে চেপে বসতেন। নতুন শিকারের অপেক্ষায়। সেই চাগা ব্যবসায়ী আমেরিকা
পৌঁছনোর কিছুদিন পর লাস্টিগের স্বরূপ বুঝতে পেরে মাথার চুল ছিঁড়তে আরম্ভ করতেন।
ঘটনাটা যেহেতু ফ্রান্স ও আমেরিকার মাঝে হত, তাই দুদেশের পুলিশ একে অন্যের ওপর দায়িত্ব চাপিয়ে নিশ্চিন্তে বসে থাকত। মাঝ
থেকে ভিক্টর লাস্টিগ তাঁর ব্যবসা চালিয়ে যেতেন।
ব্যবসা ভালই চলছিল, বাধ সাধলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। ট্রান্স আটলান্টিক লাইনার্স তাদের জাহাজ পরিষেবাই
বন্ধ করে দিল। লাস্টিগ তখন জালিয়াতির অন্য ধান্ধায় প্যারিসে এসে থিতু হলেন।
১৯২৫ সাল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ করে ফ্রান্স তখন অর্থনৈতিকভাবে ধুঁকছে। এদিকে কয়েক বছর আগে ওয়ার্ল্ড ফেয়ারের দোহাই দিয়ে ঘটা করে আইফেল টাওয়ার বানানো তো হয়ে গেছে, এখন তাকে মেন্টেন করতে কালঘাম ছুটছে সরকারের। ওই লোহার দৈত্যকে রঙ করতেও যে বিপুল খরচ হয়, প্যারিস সিটি কাউন্সিলের কাছে সে এক বিশাল অংক। শুরুতে প্ল্যান ছিল আইফেল টাওয়ারকে জং থেকে বাঁচাতে প্রতি সাত বছর অন্তর অন্তর রঙ করতেই হবে। কিন্তু অর্থাভাবে রঙ না করায় আইফেল সেই জৌলুশ হারাতে লাগল। প্যারিসের জনগণ আর বিরোধী রাজনৈতিক দল উঠেপড়ে সরকারের পেছনে লাগল, কই হে! অত আড়ম্বর করে লোহার দৈত্য বানিয়ে তাকে কি এখন না খেতে দিয়ে মারবে?
ভিক্টর লাস্টিগ
এইসব নিয়ে বেশ কিছু লেখালেখি হল প্যারিসের সংবাদপত্রে। লাস্টিগের তা চোখে পড়ল, মনেও ধরল। তখন তিনি আইফেল টাওয়ারকেই বানিয়ে নিলেন নিজের জালিয়াতি শিল্পের সবচেয়ে বড় ক্যানভাস।
জালিয়াতির প্রস্তুতি হিসাবে লাস্টিগ সরকারি স্ট্যাম্প পেপার, লেটারহেড, সিলমোহর সবকিছু নকল করলেন। তারপর প্যারিসের ভীষণ দামি একটি হোটেলে স্যুইট বুক করে এক গোপন মিটিং ডাকলেন। মিটিংয়ে আহ্বান করলেন ফ্রান্সের কিছু লোহা ব্যবসায়ীকে। নিজেকে ডাক ও টেলিগ্রাফ মন্ত্রকের ডেপুটি ডিরেক্টর হিসাবে পরিচয় দিলেন। লাস্টিগ দুঃখের সঙ্গে বললেন যে আইফেল টাওয়ারের রক্ষণাবেক্ষণ ফরাসি সরকারের পক্ষে খুব বেশি ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে। তাই সরকার এটিকে ভেঙ্গে লোহার দরে বিক্রি করে দেওয়ার প্ল্যান করছে। কিন্তু এই চুক্তি জনসাধারণের মধ্যে ভীষণ অসন্তোষ ডেকে আনতে পারে বলে সরকার গোপনে কাজটা সেরে ফেলতে চাইছে। বিস্তারিত বিবরণ বাইরে কোথাও প্রকাশ করা যাবে না। এই লোহার বিশাল দৈত্যকে কে ভাঙা লোহার দরে কিনবে তা ঠিক করার জন্যেই সরকার তাঁকে দায়িত্ব দিয়েছে। সৎ লোহা ব্যবসায়ী হিসাবে খ্যাতির কারণে লাস্টিগ তাঁদের নাম নির্বাচন করেছেন। তাঁর কথাবার্তা, আদবকায়দা, বিশেষ করে কাগজপত্রের নিখুঁত নকলের ফলে মিটিংয়ে উপস্থিত একজনও ভাবতে পারেনি লাস্টিগ একজন ঠগ। বরং তারাও লাস্টিগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলল, ভেঙে ফেলাই উচিত। প্যারিসের অন্যান্য দুর্দান্ত গথিক সৌধগুলোর সঙ্গে আইফেল এক্কেবারে বেমানান। মাঠের মধ্যে দাঁড় করানো এক পেল্লাই লোহার টাওয়ার, না আছে ছিরি, না আছে ছাঁদ!
ব্যবসায়ীদের দলের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল, কে আইফেল
টাওয়ার ভাঙা লোহার দরে কিনবে। সকলে দরপত্র জমা দিল। সবটাই খুব গোপনে। কিছুদিন পর
তাদের মধ্যে আঁদ্রে পোইসন (André Poisson) নামের এক উঠতি ব্যবসায়ী আলাদা করে লাস্টিগের সঙ্গে দেখা করল। বলল, স্যার, সরকারি কাজ। টেন্ডারটা প্লিজ পাইয়ে দিন। দরকারে আপনাকে যদি আলাদা করে কিছু
দিতে হয় সে নাহয় আমি দেব।
লাস্টিগ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, কী? আমার মত একজন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীকে ঘুষ দিতে চাইছেন?
পোইসন থতমত খেয়ে বলল, ইয়ে, না স্যার। চটবেন না। বলতে চাইছি আপনি কত বড় পদে অধিষ্ঠিত, অথচ সরকারি নিয়মের গেরোয় তেমন বিলাসী জীবন যাপন করতে পারেন না! দেখে বড্ড খারাপ লাগে স্যার।
লাস্টিগ ধপ করে চেয়ারে বসে বললেন, সে তো বটেই, কপাল! শেষমেশ প্রারম্ভিক দাম বারো লক্ষ আর ঘুষ হিসাবে আরো সত্তর হাজার ফ্রাঙ্কে (সব মিলিয়ে আজকের দিনে প্রায় এক কোটি দশ লক্ষ ভারতীয় টাকা) রফা হল। পোইসন ভাবলেন,জলের দরে আইফেল টাওয়ার কিনে নিয়েছি! লাস্টিগ বললেন, এই টাকার পাকা বিলটা ঠিক দু'দিন পর অফিস থেকে নিয়ে নেবেন। আর হ্যাঁ, ব্যাপারটা কিন্তু খুবই গোপনীয়।
পোইসন কান এঁটো করে হেসে বলল, সে আর বলতে স্যার? বউকেও বলব না। এই আপনি আর আমি, ব্যস।
পোইসন নগদ টাকা লাস্টিগের হাতে তুলে দিল। লাস্টিগও নকল সরকারি রশিদ লিখে দিলেন।
দুদিনের মধ্যে পোইসন মিস্ত্রি-মজুর আর লোহা কাটার বিশাল বিশাল যন্ত্রপাতি নিয়ে আইফেলের মাঠে উপস্থিত। শুধু পাকা বিলটা পেলেই হয়। সরকারি অফিসে গিয়ে খুব গোপনে তাদেরকে বিশদে বলার পর তারা তো আকাশ থেকে পড়ল। তারা বলল, আইফেল ভাঙা তো দূরের কথা একটু চটা উঠিয়ে দেখুন কি অবস্থা করি আপনার! পোইসন বুঝল সে ভীষণভাবে ঠকে গেছে। সঙ্গে সঙ্গে ছুটল সেই হোটেলে যেখানে লাস্টিগ ছিলেন। হোটেল জানালো তিনি তো দুদিন আগেই চেক-আউট করে চলে গেছেন।
লাস্টিগ তখন ফ্রান্সের সীমানা পেরিয়ে জন্মভূমি অস্ট্রিয়ায় গা-ঢাকা দিয়েছেন।
লাস্টিগ জানতেন পোইসন সব ধরে ফেললেও নিজের মান আর ব্যবসা বাঁচাতে পুলিশের কাছে যাবে না। ফরাসি লোকেদের ইগো মারাত্মক। জনগণ যখন জানতে পারবে পোইসন কত বড় ধোঁকা খেয়েছে, তারা তো তাকে নিয়ে মশকরা করবে। লাস্টিগের ধারণাই সঠিক ছিল। ফ্রান্সের কোনো সংবাদপত্রে এই খবর বেরোল না। লাস্টিগ তক্কে তক্কে ছিলেন, ব্যাপারটা থিতিয়ে যেতেই আবার সন্তর্পণে ফ্রান্সে ফিরে আসেন। তারপর আবারও একই পন্থায় আরেকদল ব্যবসায়ীর কাছে আইফেল বিক্রির কাজ শুরু করেন।
দ্বিতীয়বারে আর সবকিছু প্ল্যানমাফিক হল না। এবার হাতেনাতে ধরা পড়ে গেলেন ফরাসি পুলিশের হাতে। কিন্তু লাস্টিগকে ধরা অত সহজও ছিল না। তিনি ফরাসি পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে আসেন আমেরিকায়।
আমেরিকায় আগে থেকেই তিনি মোস্ট ওয়ান্টেড, কাজেই রিস্ক না নিয়ে এবার তিনি ছোটোখাটো জালিয়াতিতে মন দেন। তিনি টম শ' নামে এক খ্যাতনামা রসায়নবিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে জাল ডলার বানাতে আরম্ভ করেন।
এবারেও সবকিছু ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু গন্ডগোল পাকালো লাস্টিগের প্রেমিকা বিলি। জালিয়াতিতে পার্টনার হলেও রসায়নবিদের স্ত্রীর প্রতি লাস্টিগ একটু আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলেন। আর তাতেই বেজায় চটে গিয়ে বিলি পুলিশে ফোন করে সব ফাঁস করে দিল। লাস্টিগ জীবনে অজস্র মানুষের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলেন, কিন্তু যাকে তিনি নিজে সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করতেন সেই বিলি শেষ পর্যন্ত তাঁকে পুলিশে ধরিয়ে দিল।
দেখতে দেখতে ভিক্টর লাস্টিগের সমস্ত জালিয়াতি প্রমাণ সমেত ধরা পড়ে যায়। শুরু হয় বিচারের জন্য অপেক্ষা। কিন্তু বিচারের ঠিক দু'দিন আগে অসুস্থতার ভাণ করে নিউ ইয়র্কের সুরক্ষিত জেল থেকেও পালিয়ে যান। কিন্তু এবার আর শেষরক্ষা হল না। একমাসের মধ্যেই আবার ধরা পড়লেন এবং বিচারে তাঁর কুড়ি বছরের জেল হল। তখন তাঁর বয়স মাত্র পঁয়তাল্লিশ বছর।
জেলে থাকাকালীন নিজেই তাঁর সাফল্যের চাবিকাঠি বলে গেছেন। তাঁর মতে, ধৈর্য্যশীল শ্রোতা হতে হবে। মানুষের রাজনৈতিক বিশ্বাস, ধর্মবিশ্বাস এসব নিয়ে মতভেদে যেতে নেই। সবেতেই তালে তাল মেলাতে হবে আর অপেক্ষা করতে হবে কখন উল্টোদিকের মানুষটা আপনাকে বিশ্বাস করে তার গোপন কথাগুলো নিজে থেকেই বলতে শুরু করে। ক্যালিফোর্নিয়ার আলকাট্রাজ দ্বীপে নির্বাসিত থাকাকালীন বারো বছরের মাথায় জেলেই তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁকে বলা হয় বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ধোঁকাবাজ!
সবই তো শুনলেন। এবার থেকে বাড়িতে ফেরিওয়ালা ভাঙা লোহার জিনিস কিনতে এলে তাঁকে যখন ভাঙা বালতি কি কলের মাথা বেচবেন, দেখবেন তো একটু হলেও নিজেকে ভিক্টর লাস্টিগ মনে হচ্ছে কিনা?
তথ্যসূত্র :
https://www.toureiffel.paris
https://www.mirror.co.uk
https://www.smithsonianmag.com
https://bonjourparis.com
https://www.britannica.com
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন