অশরীরীর আশীর্বাদ - গৌতম রায়



ভুত শব্দটার সঙ্গে ছায়া কথাটা যেন অঙ্গাঙ্গি ভাবে যুক্ত। আমরা যেমন আমাদের অতীতকে মাঝে মাঝে স্মরণ করি, সেরকমই ভুতের উপস্থিতি আমাদের অবচেতন মনের মধ্যে এসে হানা দেয়। সেইরকমই একটি ঘটনা হটাৎ আমার মনে এসে গেল। ঘটনাটা আমার বিয়ের বেশ কিছু দিন আগের কথা। আমার জ্যাঠতুতো ভাই মিঠুর বিয়ে হয়েছিল আমার বিয়ের একবছর আগে। চাকরী সুত্রে দুরে থাকার জন্য বাড়ী থেকে ঠিক মত যোগাযোগ হচ্ছিল না। আর তার ফলে শুভমুহুর্তও বারবার পিছিয়ে যাচ্ছিল। শেষের বারে তো বন্ধই হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছিল। সব ঠিক হয়ে গেছে। এমন সময় জেঠু অসুস্থ হয়ে পড়লেন। তড়িঘড়ি নার্সিংহোমে ভর্তি করা হল। বাড়ী থেকে অফিসের এক্সচেঞ্জে ফোন এল। সেই সময় মোবাইলের নামই কেউ শোনেনি। বড় শহরে পেজার সবে সবে উঠেছিল। কিন্তু কাজের থেকে লোকদেখানো ব্যাপারটাই লোকের কাছে বেশি গুরুত্ত্ব পেত। কোলকাতা থেকে তখন আমি অনেকটাই দূরে থাকতাম। একটা অফিসের কাজে এমন ফেঁসে ছিলাম যে কিছুতেই ছুটি পাচ্ছিলাম না। বাইরের দেশ থেকে বিশ্বব্যাঙ্কের কিছু হাই প্রোফাইল লোকজন এসে গেছে। সেখানে আমার নিজের প্রয়োজনটা গুরুত্ত্ব পেল না। কি আর করি, দুঃখটা চেপে রেখেই কাজ করতে লাগলাম।

  

সেদিন মিটিং শেষ করে ফিরতে বেশ রাত হয়ে গেল। খাওয়ার ইচ্ছাও ছিল না। শুয়ে পড়লাম। তখনও কোম্পানী কোয়ার্টার পাইনি। বাইরে কোর্ট চত্বর পেরিয়ে রেল লাইনের পাশে একটা বাড়ী ভাড়া করে ছিলাম। তিনতলা বাড়ী। একতলায় আমি থাকতাম আর বাড়ীর মালিক ওপরের তলায় থাকত। ঘরটায় দুটো বেডরুম আর সাথে ড্রইং কাম ডাইনিং রুম এমন ভাবে ছিল যে ডাইনিং থেকে দুটো বেডরুমের অনেকটাই দেখা যেত। পূর্বদিকের বেডরুমটায় একটা সিঙ্গল বেড ছিল। ওটা আমার চাকরী জীবনের শুরু থেকেই আমার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছিল। যাইহোক, রাতে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। অত্যধিক পরিশ্রমে ঘুমও আসছিল না। খালি মনটা কোলকাতায় চলে যাচ্ছিল। কি জানি জেঠু কেমন আছে এখন কে জানে। জেঠু আমায় খুবই ভালবাসত। ছোটবেলা থেকে আমিই জেঠুর মাছ ধরার চেলা ছিলাম যে। চার বানানো থেকে পিঁপড়ের ডিম জোগাড় করা সবেতেই আমাকেই দরকার পড়ত। আর মাছ ধরা পড়লে তাকে খেলিয়ে তোলার আনন্দই আলাদা ছিল। তবে পিঠের গুলির ক্ষতটা সারাজীবনই বয়ে বেড়াতে হয়েছিল। তখন বৃটিশ বিরোধী আন্দোলন চলছে। এয়ারফোর্সের চাকরী ছেড়ে ভারত ছাড় আন্দোলনে জেঠুও যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু যুদ্ধ করবে কি করে? বাংলার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে অস্ত্র টাকা এসব কিছুই তো প্রায় নেই। সেবারে ঠিক হয়েছিল ট্রেজারী লুঠ করা হবে। অস্ত্র বলতে একটা পিস্তল আর কয়েকটা বোমা। কিন্তু মনের জোর সাংঘাতিক। কাজ হয়েও গিয়েছিল। কিন্তু পালাবার সময় সিকিউরিটি গার্ডের বন্দুকের রেঞ্জের মধ্যে পড়ে গেল। গুলিটা একটা ফুসফুসকে অনেকটাই খারাপ করে দিয়েছিল। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার পর জেলেই থাকতে হল, যতদিন না স্বাধীনতা আসে। সেই থেকে শ্বাসপ্রশ্বাসের কষ্টটা আর সঙ্গ ছাড়ল না।  


আমার ভাড়ার বাড়ীটায় ঢোকার দুটো রাস্তা ছিল। একটা বেডরুমের সঙ্গের বারান্দা দিয়ে আরেকটা বাথরুমের পাশ দিয়ে। দ্বিতীয়টার সামনে ওপরের তলায় আর ছাদে যাওয়ার সিঁড়ি ছিল। আমার আবার একতলার ঘর। পূর্ব আর উত্তর দিকে বড় বড় গাছে ভর্তি। দক্ষিণ দিকে বড় একটা বাড়ী। দিনের বেলাই আলো জ্বেলে রাখতে হয়। সূর্য কখন ওঠে ঘড়ি না দেখলে বোঝাই যায় না। অফিসের সবাই তো ফরেস্ট বাংলো বলে। ফিল্ডে যাওয়ার দিনে তো ঘড়িতে এ্যালার্ম দিয়ে রাখতে হয়। একবার একটা মজার ঘটনা হয়েছিল। শীতের জন্য জানালায় মোটা পর্দা ঝুলিয়ে ছিলাম। এর ফলে ঘরে যতটুকু আলো আসছিল, সেটাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। টেলিফোনের আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। হাতড়ে হাতড়ে সুইচটা খুঁজে পেয়ে আলোটা জ্বালালাম। রিসিভার তুলতে বসের আওয়াজ।


-   কোথায় তুমি? ফিল্ডের লোকজন এসে বসে আছে তোমার জন্য। ঘড়িতে দেখি প্রায় একটা। ফার্স্ট হাফ শেষ হওযার সময় হয়ে এসেছে। আমার কান্ড শুনে সেদিন সবাই খুবই হাসাহাসি করেছিল। 


রাত কটা হবে জানিনা। হটাৎ ঘুম ভেঙে গেল। কেমন যেন একটা অস্বস্তি হতে লাগল। কালিপুজোও চলে গেছে। হাল্কা ঠান্ডার আমেজ এসে গেছে। একা থেকে থেকে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। তাই অন্য কেউ ঘরে থাকলে একটা অনুভুতি হত। তবে এটা সবারই যে হবে তা বলছি না। কিছুটা মনের একাগ্রতারও প্রয়োজন হয়। আর রাতে চারিদিক শান্ত হয়ে গেলে অনুভুতিটা আরো ভাল ভাবে বোঝা যায়। মনে হল কেউ যেন ঘরে আছে। কান খাড়া করে শুয়ে রইলাম। একটা ক্ষীণ আওয়াজ বাথরূমের দিক থেকে শুনতে পেলাম। মনে হল কেউ কষ্ট করে শ্বাস নিচ্ছে আর ছাড়ছে। মনে মনে ভেবে নিলাম ওদিকের দরজা তো খোলা থাকার কথা নয়। সকালে তো খুলিই নি ওদিক। আর বিকালে তো অফিস থেকে সোজা বারান্দা দিয়ে ঢুকলাম। হটাৎ কেন যেন ভেতর থেকে কেউ বলে উঠল, শান্ত থাক ভয় নেই। এরকম অনুভুতি আমার আগে অনেকবার হয়েছে। প্রায় প্রত্যেকবারই অদৃশ্য কিছুর উপস্থিতির প্রমাণ পেয়েছিলামআমার পরিচিত কেউ কি এসেছে!


এবার একটা হাল্কা পা ঘষার আওয়াজ কানে এল। অনেকটা অসুস্থ মানুষ যেমন করে পা ঘষে ঘষে চলে সেই রকম। ওপরেও তো কোন অসুস্থ লোক নেই। ডাক্তার বাবু, মানে বাড়ীর মালিকের দাদা অনেক রাত পর্যন্ত জেগে থাকেন। একটু পা ঘষে ঘষে চলেন ঠিকই, কিন্ত উনি তো আমার ঘরে আসেন না। বরঞ্চ মাঝে মাঝে ছুটির দিনে আমাকে ওপরে ডেকে নেন। গল্প করতে উনি খুব ভালবাসতেন। আর তা ছাড়া দরজা খোলা থাকার কোন প্রশ্নই নেই। একটু সতর্ক হয়ে গেলাম। আওয়াজটা এগিয়ে আসছে।


ড্রইংরুমটা একদম ঘন অন্ধকার নয়। এখনও মোটা পর্দাগুলো লাগান হয়নি। হাফ পর্দার ওপর দিয়ে হাল্কা আলোর আভাস নিকষ কালো অন্ধকারটাকে পাতলা করে দিয়েছে। বিছানাতে শুয়ে শুয়েই দরজা দিয়ে ড্রইংরুমের দিকে তাকিয়ে রইলাম। আওয়াজটা একদম দরজার কাছে চলে এসেছে। শরীরের পেশীগুলো কেমন যেন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। হাত পা মাথা কিছুই আর নাড়াতে পারছি না। ড্রইংরুমের অন্ধকার ভাবটা ক্ষণে ক্ষণে পাল্টাচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন অন্ধকার আর আলো কোন বালতিতে নিয়ে মেশাচ্ছে। কাউকে দেখতে পেলাম না। এমনকি কারোর কোন প্রতিচ্ছবিও নয়। ভাবলাম এসব মনের ভুল হবে নিশ্চয়ই!!


হঠাৎ একটা গভীর শ্বাস নেওয়ার শব্দে শরীরটার মধ্যে দিয়ে যেন একটা ঠান্ডা জলের স্রোত চলে গেল। আওয়াজ তো ঘরের মধ্যে থেকে এল। চোখটা বন্ধ করে ফেললাম। নিজের শরীরের অস্তিত্বটাই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। আরেকবার নিঃশ্বাস ছাড়ার আওয়াজ। একেবারে আমার বিছানার পাশেই। একটা হাল্কা মাছের গন্ধ নাকে এল। শরীর সাড়া না দিলেও চিন্তা কাজ করে চলেছে। মাছতো আমি খাই না। বহুদিন ছেড়ে দিয়েছি। তাহলে গন্ধ কোথা থেকে আসছে।


হঠাৎ গন্ধটা চলে গেল। শরীরের ওপর দিয়ে মোলায়েম ঠান্ডা একটা হাওয়া বয়ে গেল। নাহ! এবার আর ঠান্ডা লাগল না। বরঞ্চ মনে হল কেউ মাথায় হাত দেওয়ার চেষ্টা করছে। শরীরের অসাড় ভাবটা আস্তে আস্তে কেটে যাচ্ছে মনে হচ্ছে। আবার পা ঘষার আওয়াজ। এবার দরজার বাইরে মনে হল। চোখ খুললাম। ড্রইংরুমটা আবার ঘন অন্ধকার হয়ে গেছে। শব্দটা এবার পূর্বদিকের বাগানের বন্ধ দরজার কাছে মনে হল। ওই দরজাটা ছুটির দিনে থাকলে খুলি। বাগানটা অপরিষ্কার, তাও গাছপালার মধ্যে দিয়ে কিছুটা হলেও রোদ আসে। আঙুলগুলো নড়ছে দেখে ওঠার চেষ্টা করলাম। নাহ! শরীরের ক্ষমতাটাই চলে গেছে মনে হচ্ছে। চোখ আর খুলে রাখতে পারলাম না। 


বারান্দার গেটে ঠক ঠক আওয়াজ শুনে উঠে পড়লাম। বই বিক্রী করার মেয়েটা এসেছে। ওর কাছ থেকে স্ট্যানডা্র্ড লিটারেচারের বই কিনতাম। জেঠুর গল্প লেখার শখ আছে জেনেই ওকে ওয়ান্ডারস অফ ওয়ার্ল্ড বইটা নেব অনেক আগেই বলে রেখেছিলাম। তখন তো আর ইন্টারনেট ছিল না। জ্ঞান বাড়াতে গেলে বইই একমাত্র ভরসা ছিল। কিন্তু, কোথাও পাওয়া যাচ্ছিল না। আমার হাতে বইটা দিয়ে বলল, “আউট অফ স্টক, অনেক কষ্টে পাওয়া গেছে। বইটা হাতে নেওয়া মাত্র কেমন যেন একটা অনুভুতি হল। মনে মনে ভাবলাম, যাক, জেঠু ভাল হয়ে বাড়ী ফিরলে বইটা দেব। খুব খুশি হবে।  


অফিসে এসে টেবিলে বসামাত্র এক্সচেঞ্জ থেকে ফোন এল। বলল, “আপনার ঘর থেকে ফোন এসেছে, ধরুন।

মায়ের গলা, তোর জেঠু কাল রাতে চলে গেলেন।

একটা ঝটকা লাগল যেন কানে। আমি কোন উত্তর দেওয়ার আগেই মা বলে উঠল, “তাড়াহুড়ো করে এসে লাভ নেই। অতক্ষণ বডি রাখা যাবে না। খোকা ট্রেনে উঠে পড়েছে।

খোকা মানে আমার বড়দা। মাইথনে ডিভিসিতে চাকরী করে। ওদিক থেকে কেটে গেল দেখে ফোনটা রেখে দিলাম। ফোনটা আবার বাজছে দেখে রিসিভার তুললাম। ডিপার্টমেন্টাল হেডের গলা, রুমে এসো, কথা আছে।

দরজা ঠেলে ঢুকে দেখি একাই বসে আছেন। কি ব্যাপার, এত সকালে কোথা থেকে ফোন এল। ধীর গলায় বললাম, “আমার জেঠামশায় কাল রাতে নার্সিংহোমে মারা গেছেন। মা ফোন করে জানাল।

বস কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, “খুব খারাপ সময় যাচ্ছে। আমার মাও কাল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। বয়স হয়েছে। কি হবে জানিনা। এদিকে ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্কের লোকেরা চলে এসেছেন। কি করব বুঝতে পারছি না।

কানের কাছে একটা সুন্দর সুর বেজে উঠল। মনের কষ্টটা অনেকটা কম হয়ে গেল। আপনার মা ভাল হয়ে যাবেন। কথাটা হঠাৎ মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল। আমি নিজেও অবাক হয়ে গেলাম।

-   তুমি বাড়ী যাও। আমি এদিকটা সামলে নেব। ফাইল আর রিপোর্ট আমার টেবিলে রেখে যাও”, বস বলে উঠলেন। 

সেদিন আর গেলাম না। পরের দিন সকালের ট্রেন ধরলাম। বিকালে আমার জাড়তুতো ভাই মিঠু এল। জেঠুর বাড়ীটা পাশের পাড়ায়। হামেশাই যাতায়াত করতাম। মিঠু আর আমি একসঙ্গেই যাদবপুরে পড়তাম। ও স্টেট গভর্নমেন্টের চাকরী পেয়ে কোলকাতায় থেকে গেল। আমাকে সেন্ট্রাল গভর্নমেন্টের চাকরীর জন্য দূরে চলে যেতে হয়েছিল। কোমরের আসনটা পেতে আমার পাশের চেয়ারটায় বসে পড়ল।

-   কালকে ভালই ছিল। মাছ খাবে বলেছিল, তাই কাকীমা মাছের ঝোল বানিয়ে নিয়ে গিয়েছিল”, একটু থেমে মিঠু আবার বলে উঠল, “রাত নটায় একটু মাছ খেয়ে তোর কথা জিজ্ঞাসা করছিল। কানের কাছে মুখ নিয়ে শুনলাম, গৌতম একটা বই দেবে বলেছিল, এনেছে নাকি? কি বই দিবি বলেছিলিস?” মিঠু বলে উঠল

 

ভেতরে গিয়ে ব্যাগ থেকে বইটা বার করে মিঠুর হাতে দিয়ে বললাম, “ শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠানে এটা জেঠুর প্রিয় জিনিসের সঙ্গে রাখিস।

বইটা হাতে নিয়ে মিঠু বলল, “ বাবা একটা নতুন লেখা সবে শুরু করেছিল। খালি বলছিল, গৌতম কবে যে বইটা আনবে কে জানে? শুনে বললাম, বইয়ের নাম বল, কলেজ স্ট্রীটে দেখছি। তাতে বাবা কি বলল জানিস?”

আমি ওর দিকে তাকাতে বলে উঠল, "না, ওর হাত থেকে না নিলে এ লেখাটা আমার হাত থেকে বেরোবে না"। আবার কানে গুনগুন আওয়াজ শুনতে পেলাম। মনে মনে জেঠুকে স্মরণ করে বললাম, “ গল্পটা এবার আমি লিখব।      

 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন