সত্য ঘটনার অন্দরমহল: গোয়েন্দাপীঠ লালবাজার - পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়



বই: গোয়েন্দাপীঠ লালবাজার – এক ডজন খুনের রুদ্ধশ্বাস নেপথ্যকথা

লেখক – সুপ্রতিম সরকার

প্রকাশন – আনন্দ পাবলিশার্স

প্রকাশকাল – জানুয়ারী ২০১৮

প্রচ্ছদ – কাকলি গুহ ও  মীর মোসতাফিজুর  রহমান

পৃষ্ঠা – ১৮৫

মুদ্রিত মূল্য – ২৫০/-

 

পাঠ প্রতিক্রিয়া শুরু করার আগে এই বইয়ের বিষয়ে লেখকের নিজস্ব বয়ানে কিছু কথা উদ্ধৃত করি –

 

"সত্যিটা স্বীকার করা যাক, গল্পের ফেলুদা-ব্যোমকেশ-এরকুল পোয়ারো-শার্লক হোমসের রহস্যভেদের রোমাঞ্চ বা রোমান্স বাস্তবের তদন্তে থাকে কদাচিৎ। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘটনাস্থলে আধপোড়া সিগারেটের টুকরো থাকে না, থাকে না বাগানের ঝোপঝাড়ের কাদায় পায়ের ছাপ, থাকে না হুমকি চিরকুট বা সমগোত্রীয় কিছু। কল্পনার গোয়েন্দা গল্প খুবই উপভোগ্য, গোগ্রাসে গেলার মতো। বাস্তবের তদন্ত কিন্তু ভিন্ন, অন্তত নব্বই শতাংশ ক্ষেত্রে। প্রতি পদে উত্তেজনায় আচ পোহানো নেই, নির্মোহ পরিশ্রম আছে। রুদ্ধশ্বাস রোমাঞ্চ নেই, আপ্রাণ অধ্যবসায় আছে। আপন মনের মাধুরী নেই, মরিয়া একাগ্রতা আছে। নির্মাণের জগত মূলত, সৃষ্টির নয় ততটা।"

 

বেশ কয়েক বছর আগে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের পুলিশ জন সচেতনতা গড়ে তোলার উদ্দেশ্যেই বা জনসাধারণের সাথে সহজে যোগাযোগ তৈরির উদ্দেশ্যে সামাজিক মাধ্যমে নিজেদের প্রোফাইল ও পেজ তৈরি করেন। সুপ্রতিম সরকার যিনি প্রথম জীবনে আনন্দবাজার পত্রিকায় সাংবাদিকরূপে পেশাগত জীবন শুরু করলেও পরবর্তীকালে কলকাতা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনাররূপে দায়িত্ব পালন করেন। কলকাতা পুলিশে কর্মরত অবস্থায় কলকাতা পুলিশের ফেসবুক পেজে “ রহস্য রবিবার” নাম দিয়ে  সিরিজ আকারে নিয়মিত কলকাতার জটিল কেসগুলির বিষয়ে লিখতে শুরু করেন। পুরনো বহু অপরাধের ঘটনা তাঁর লেখার মাধ্যমে সাধারণ পাঠক জানতে পারেন। লেখাগুলির উচ্চমান পাঠক মহলে বিপুল উত্তেজনার সৃষ্টি করলে তাঁর কাছে বই আকারে প্রকাশ করার দাবী আসতে থাকে। এই থেকেই তিনি কলকাতায় ঘটে যাওয়া রোমহর্ষকারী বারোটি ঘটনাকে সংকলন আকারে প্রকাশ করতে উদ্যোগী হন। এই বই লেখকের লিখিত প্রথম বই হলেও ভাষা ও বর্ণনার গাঁথুনিতে এক অসাধারণ সংকলনে পরিণত হয়েছে।

বাংলা সাহিত্যে পুলিশের কেস ডাইরি  বা অপরাধেমূলক সত্য ঘটনা লিপিবদ্ধ করে সংকলন প্রায় নেই বললেই চলে। এই বিষয়ে এখনও পঞ্চানন ঘোষাল, প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় বা বাঁকাউল্লার দপ্তর বইগুলিই একমাত্র ভরসাযোগ্য হয়ে রয়েছে। সুব্রত বসু রচিত “ না লেখা পুলিশ ডাইরি” বইটি কিছু অংশে পুলিশ প্রসিডিউরাল সম্পর্কে আলোকপাত করলেও তা শুধুমাত্র ওনার কর্মজীবনেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে। সেদিক থেকে সুপ্রতিম সরকার লিখিত এই বই সম্পূর্ণ এক অজানা অনাস্বাদিত অপরাধ জগতের উন্মোচন ঘটাতে সক্ষম হয়েছে।

বইটিতে মোট বারোটি গল্প আছে।

১) এভাবেও মেরে ফেলা যায়! (পাকুড় হত্যা— অমরেন্দ্র পাণ্ডে)
২) মানুষ বড়ো শস্তা, কেটে, ছড়িয়ে দিলে পারত(বেলারানি দত্ত-কে হত্যা)
৩) অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো (পঞ্চম শুক্লা-কে হত্যা)
৪) বণিকবাড়ির অন্তরমহলে (দেবযানী বণিক-এর হত্যা)
৫) লাশই নেই,খুন কীসের? (অনুরাগ আগরওয়াল-কে অপহরণ ও হত্যা)
৬) করুণাধারায় এসো (নওলাখা দম্পতি-কে লুণ্ঠন ও হত্যা)
৭) মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে (বিশ্বনাথ দত্ত'র হত্যা)
৮) কী বিচিত্র এই দ্বেষ! (হারুন রশিদ-এর হত্যা)
৯)মধ্যরাতের কিড স্ট্রিটে(ফরওয়ার্ড ব্লক বিধায়ক রমজান আলির হত্যা)
১০) বয়স হয়েছিল পঁয়ত্রিশ (সার্জেন্ট বাপি সেন-এর হত্যা)
১১) দ্য বিলিয়ন ডলার কেস (তপন দাস-এর হত্যা)
১২) অতি পুরাতন ভৃত্য (রবিন্দর কাউর লুথরা-র হত্যা)

বইয়ের সুচিপত্র দেখলেই সহজেই নজরে আসে কিছু অতি প্রাচীন ও জটিলতম কেসের নাম। প্রাঞ্জল ভাষায়, তথ্যনির্ভর, ঘটনার অতিরঞ্জন ও অতি নাটকীয় রূপদানে বিরত থেকে অত্যন্ত সহজবোধ্য ভাবে ঘটনাগুলির বর্ণনা করেছেন লেখক। উপরি পাওনা জুটেছে কেস সংক্রান্ত আদালতের রায়ের প্রকৃত অবিকৃত  গুরুত্বপূর্ণ অংশের ফটোকপি। এছাড়াও আছে ক্রাইম সিনের ছবি, যেগুলি দেখলে এখনও গায়ে কাঁটা দিতে বাধ্য। কীভাবে অপরাধ নজরে এল, কিভাবে ধাপে-ধাপে এগোনো হয়েছিল তদন্তের পদ্ধতি এবং শেষে আদালতে কিভাবে সেই কেসকে পেশ করে অপরাধীর কি শাস্তি হয়েছিল তার বর্ণনার সাথে সংযোজিত হয়েছে বিভিন্ন মামলার নথিযে কোনও অপরাধের ঘটনায় পাদপ্রদীপের আলো থেকে দূরে, অজস্র সীমাবদ্ধতার মধ্যে যে মানুষগুলো অক্লান্ত পরিশ্রমে অপরাধীকে আইনের সামনে পেশ করেন সেই পুলিশকে সাধারণ মানুষ এক অন্য চোখে দেখতে বাধ্য হবেন এই বই পড়লে। কিছু ঘটনার বিবরণ আজও অত্যন্ত পীড়াদায়ক। যেমন দেবযানী বণিক ও বাপী সেন হত্যাকাণ্ড। অত্যন্ত অসহায় লাগে সেই কাহিনী পড়ে যখন রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে একজন খুনি অপরাধী পুলিশের যাবতীয় পরিশ্রমে জল ঢেলে সামান্য শাস্তি পেয়ে পার পেয়ে যায়। বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যেতে হয় জেনে যে প্রায় দেড়শ বছর আগে জীবাণু প্রয়োগে হত্যার মত ঘটনা ঘটেছিল এই বাংলার বুকেই। রোমাঞ্চিত হয়ে যাবেন পাঠক যখন জানতে পারবেন যে বর্তমানের ফেস রেকগনিশন প্রোগ্রামের হাতেকলম অ্যানালগ ভার্সন 'ফটোগ্রাফিক সুপারইম্পোজিশন'ও প্রথমবার ব্যবহৃত হয়েছিল কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দাবিভাগেই উদ্ধার হওয়া কঙ্কালের পরিচয় আবিষ্কার করার জন্য।

একদা কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ লালবাজারকে যে স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের সাথে তুলনা করা হত তার প্রমাণ এই বইয়ের প্রতি পাতায় পাওয়া যাবে। গা হিম করে দেওয়া ঘটনার বর্ণনা পড়লে পাঠকের মন দ্বিধাহীনভাবে স্বীকার করতে বাধ্য হবে - Truth is stranger than fiction .       


 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন