গাছগাছালি সমৃদ্ধ সবুজ প্রকৃতি, মৃদুমন্দ বাতাস, পাখির কলকাকলি অথবা বরফে ঢাকা হিমশৈল কিংবা উচ্ছল তরঙ্গে প্লাবিত সমুদ্রসৈকত, ঘুরতে যাওয়ার কথা চিন্তা করলে এরকম জায়গার কথাই প্রথম ভাবনায় আসে। কিন্তু এসব থেকে কিছুটা আলাদা রুক্ষ শুষ্ক প্রকৃতির দর্শন করে এলাম গত অক্টোবরে। তবে শুধু যে প্রকৃতির জন্য সেই জায়গা বিখ্যাত তা একেবারেই নয়। সেই শহর বিলাসিতার শহর, আভিজাত্যের শহর, জাঁকজমকের শহর, যার নাম বললে একবাক্যে সবাই চিনবে – Vegas! Las Vegas!
হাতে সময় খুব বেশি ছিল না। মেয়ের স্কুলের ছুটি, তার ফাঁকেই
যাওয়া। তবে একদিক দিয়ে ভালোই হয়েছে। যতো বেশিদিন সেখানে কাটাবো ততো দ্রুত পকেট
হালকা হতে থাকবে। বিদেশের বড়লোকী শহরে আমাদের মতো মধ্যবিত্তদের অনেক হিসেব করে পা
ফেলতে হয়। তাই যাওয়ার আগে ইউটিউবের নানান ভিডিও দেখতে হয়েছে এবং ইন্টারনেটে
বিস্তর রিসার্চ করতে হয়েছে। ভেগাসে আমরা গিয়েছিলাম ৪ দিন ৩ রাতের জন্য। ইউএসএ
ডালাসের বাসিন্দা আমরা। যাতায়াতের ফ্লাইটের টিকিট কেটে রেখেছিলাম প্রায় দু'মাস আগে থেকে।
নয়তো যাওয়ার দিন যত ঘনিয়ে আসবে, বাড়তে থাকবে টিকিটের দাম। হোটেল বুকিংও সেরে রেখেছিলাম।
সঙ্গে যাবে পাঁচ বছরের কন্যারত্ন। তার কথা চিন্তা করে আমাদের attached kitchen রুম নেওয়া। টুকটাক রেস্টুরেন্ট থেকে খেলেও ঘরে দিব্যি ডাল ভাত ফুটিয়ে
খাওয়া যাবে। প্রাতরাশ হোটেল থেকেই দেওয়া হবে, সে নিয়েও কোনো চিন্তা নেই।
প্রথম দিনঃ
হোটেলে গিয়ে ভালোমত বিশ্রাম নেওয়ার পর সন্ধ্যেবেলায় বেরোলাম শহর দর্শন করতে। পাঁচ মিনিট হাঁটলেই বাস পরিষেবা। ঝকঝকে তকতকে বিশালাকার ডাবল ডেকার বাস। তরতরিয়ে দোতলায় উঠে গেলাম। কুড়ি মিনিট মতো সময় লাগলো শহরের কেন্দ্রবিন্দুতে পৌঁছতে। পূর্বে themed হোটেলের কথা উল্লেখ করেছি। শহরে যাওয়ার উদ্দেশ্য সেটাই। প্রথমে দেখলাম বেলাজিও হোটেলের ফোয়ারা শো। গানের তালে তালে ফোয়ারার নাচ।
অপূর্ব সে দৃশ্য! একে একে দেখে নিলাম প্যারিসের আইফেল টাওয়ার, মিশরের ফ্যারাও, নিউ ইয়র্কের স্ট্যাচু অব লিবার্টি, আরব্য রজনীর স্বপ্নপুরী, রোমের কলোসিয়াম, গ্রীসের নদীতে নৌকাবিহার। সবই থিমড হোটেলের সৌজন্যে। এসব দেখতে কিন্তু এক পয়সাও, থুড়ি এক সেন্টও খরচ হয় না। খরচ হয় gambling-এ। অধিকাংশ মানুষ যদিও সেই কারণেই ভেগাসে যান। হোটেলগুলোর একতলায় রয়েছে সেসবের সুব্যবস্থা। আমরা এই বিষয়ে একেবারেই কাঁচা। তাই আর ও পথে পা বাড়াইনি। তবে নতুন রকমের অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য কেউ খেলতেই পারেন।
দ্বিতীয় দিনঃ
দ্বিতীয় দিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন চাক্ষুষ করতে যাবো। বাসের বুকিং আগে থাকতেই সেরে নিতে হয়। সেইমত সকাল সাড়ে ছ'টায় সপরিবারে হাজির হয়ে গেলাম পূর্বনির্দেশিত স্থানে, বাস এসে সেখানেই দাঁড়াবে। বাস এসে হাজির হলো। বড়ো বড়ো আরামদায়ক সিট, দীর্ঘ যাত্রাপথের জন্য একেবারে আদর্শ। বাসের বুকিংয়ের সাথে প্রাতরাশ যৌথভাবে ছিল। ঘন্টাখানেক যাওয়ার পর একটি রেস্টুরেন্টে গিয়ে বাসযাত্রীরা সকলে মিলে প্রাতরাশ সেরে নিলাম। আরও প্রায় তিনঘন্টা যাওয়ার পর হাজির হলাম গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে। সে দৃশ্য বর্ণনাতীত! বইতে যেমন ছবি দেখছি তার সাথে কোনো তুলনাই হয় না।
ফেরার সময় সকলেই বেশ ক্লান্ত। যাত্রাপথও বেশ দীর্ঘ। কেউ কেউ ঘুমিয়ে পড়েছেন। আমাদের বাসের গাইড মহাশয় অত্যন্ত মজার একজন মানুষ, এক মুহূর্তের জন্যও আমাদের একঘেয়েমি অনুভূত হতে দেননি। সারাটা রাস্তা আমাদের সকলের সঙ্গে গল্প করে গেছেন। যেখান থেকে বাসে উঠেছিলাম, সেখানেই বাস এসে নামিয়ে দিয়ে গেলো। তখনও সন্ধ্যা নামেনি। ভাবলাম কিছুক্ষণ শহর দর্শন করে যাই। আজকের গন্তব্য Chocolate World। ব্যস, শুনেই আমাদের কন্যা নিমেষের মধ্যে তরতাজা হয়ে গেলো। চলো চলো! দেরি করছো কেন! এ যেন পাঁচতলা মল, পুরোটাই চকোলেট! ছোট বড় মেজ সেজ কতরকমের চকোলেটের বাহার! Hershey's, Reese's, Sugar ইত্যাদি নামীদামী ব্র্যান্ডের চকোলেটে ভর্তি। সবগুলো থেকেই কিছু কিছু কিনলাম। এবার হোটেলের দিকে যাত্রা করা যাক।
তৃতীয় দিনঃ
পরেরদিন চলে যাওয়া। এদিকে দেখার মত আরো অনেক কিছু বাকি
রয়ে গেছে। আজকের গন্তব্য Valley of Fire
State Park। এখানে আবার বাস যায় না। গাড়ি ভাড়া নিয়ে নিজেকে চালিয়ে যেতে হয়।
অগত্যা তাই করলাম, একদিনের জন্য গাড়ি ভাড়া নিলাম। প্রায় দু’-আড়াই ঘণ্টার পথ। চারপাশের নৈস্বর্গীক সৌন্দর্য্যের
মধ্যে দিয়ে গাড়ি চালাতে বেশ লাগছিল। মাঝেমধ্যে গাড়ি থেকে নেমে মুঠোফোনের মধ্যে
প্রকৃতিকে বন্দী করার চেষ্টা করছিলাম। তবে একটা সাবধানবাণী – ওখানে টয়লেটের
ব্যবস্থা থাকলেও পানীয় জলের কোনো বন্দোবস্ত নেই। তাই যথেষ্ট পরিমাণে পানীয় জল
সঙ্গে নিয়ে তবেই ওখানে যেতে হবে। আরেকটা ব্যাপার হলো, বিকেল চারটের পর ওখানে আর ঢুকতে দেওয়া হয় না। তবে
নির্ধারিত সময়ের আগে যারা পার্কের মধ্যে প্রবেশ করেন তাঁরা অনেকেই সেই রাতটা
ক্যাম্পিংয়ের জন্য ভেতরে থেকে যান, পরদিন সকালে রওনা হন।
আমাদের শহরে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যে ছ'টা বেজেছিল।
দ্য মিরাজ নামক একটি হোটেলের বাইরের চত্বরে ভলক্যানো শো হবে। না দেখে কখনও ফিরে
আসা যায়! প্রচুর মানুষের ভিড় জমে গেছে দেখার জন্য। আমরাও কষ্টেসৃষ্টে জায়গা করে
নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম। শো শুরু হলো। গানের তালে তালে আগুনের ঝলকানি। মনুষ্যনির্মিত
পাহাড়ের গা বেয়ে লাভা গড়িয়ে পড়ছে। সবই আলোর খেলা। তবে আগুনটা সত্যিই ছিল। এখন
শুনছি এই শো-টা বন্ধ হয়ে গেছে।
ভলক্যানো শো দেখার পর চলে গেলাম Fremont Street এর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে। এখানকার বিশেষত্ব হলো, বিশালাকৃতি LED ছাদ যেখানে গানের ছন্দের সঙ্গে মানানসই চলমান ছবি, ভিডিও
পরিদর্শিত হচ্ছে। এই ছাদের তলায় রয়েছে অসংখ্য দোকান, রেস্টুরেন্ট। কোথাও আবার গানের লাইভ শো চলছে। গায়ক
গায়িকাদের সঙ্গে গলা মেলাচ্ছেন পর্যটকরা, স্থানীয়রা। অভিজ্ঞতা শেষে ফিরে চললাম হোটেলের
উদ্দেশ্যে।
চতুর্থ দিনঃ
আজ ভেগাস থেকে ফিরে যাওয়ার দিন। মনটা একটু খারাপ। দেখতে দেখতে ঝড়ের বেগে যেন দিনগুলো কেটে গেলো। ওদিকে আবার ভাড়ায় গাড়ি নেওয়া আছে, সেটাও সময়ের মধ্যে ফেরত দিতে যেতে হবে। কিন্তু আমাদের যে এখনও আরেকটা দর্শনীয় স্থান দেখা বাকি – সেভেন ম্যাজিক মাউন্টেইনস। এখানে যেতে হলে নিজে ড্রাইভ করে যেতে হবে। সুতরাং ভাড়ার গাড়ির সদ্ব্যবহার করে ফেলা যাক। দূরত্ব খুব বেশি নয়, আমাদের হোটেল থেকে আধ ঘণ্টার পথ। ওখানে পৌঁছে মনে হচ্ছিল, এখানে না এলে বড় একটা আফসোস রয়ে যেতো। ধূ ধূ পাথুরে উপত্যকায় বিরাজমান হয়ে রয়েছে সাতখানা রংবেরংয়ের টিলা। ঠিক একটানা টিলা নয়। এক রঙের পাথরের উপর অন্য রঙের পাথর বসানো, তার উপর আবার আরেক রঙের। সত্যিই ম্যাজিকাল! ভালো করে ফটো তোলার পর গাড়ি জমা দিয়ে ফিরে এলাম হোটেল রুমে।
ফেরার ফ্লাইট ধরতে এখনও অনেকটা সময় বাকি। এদিকে আবার
হোটেল থেকে সকাল এগারোটার ভেতর চেক আউট। রুম থেকে চেক আউট করে ওদের কাছেই
জিনিসপত্র গচ্ছিত রেখে আরেকবার শহরটা টহল দিতে বেরোলাম। যেসব জায়গায় ছবি রাতের
বেলায় তোলা ছিল, তার মধ্যে কিছু কিছু ছবি দিনের বেলায় তুললাম। ওদিকে ঘড়ির কাঁটা ঘুরছে।
পুনরায় হোটেলে ফিরে এসে ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিয়ে উবের ডেকে রওনা হয়ে গেলাম
এয়ারপোর্টের দিকে।
চারদিনের ঘোরা সমাপ্ত। এবার বাড়ি ফেরার পালা। আবার
কাজের জগতে ডুব দেওয়ার পালা। ভ্রমণ দিনপঞ্জি শেষ হওয়ার কথা ভেবে খানিকটা মুষড়ে
পড়লেও বাড়ির জন্য মনটা যে একেবারে টানছিল না তাও নয়। যাক, ভেগাস ট্রিপের
নটেগাছটা নাহয় মুড়ালো, পরেরবার যাওয়া যাবে নতুন কোনো শহরে, নতুন উদ্দীপনা
নিয়ে।
কলমে - তুহিন ব্যানার্জী
চিত্র সৌজন্য ঃ লেখক
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন