সব অভিভাবকরাই আকাঙ্ক্ষা রাখেন, তাঁদের সন্তান সবদিক থেকে শ্রেষ্ঠ হোক, পাঁচজন মানুষ তার প্রশংসা করুক, ভালো বলুক। কিন্তু একটি শিশু তার জন্মের পর থেকে একেবারে নিখুঁত হবে, কোনো কাজে ভুল করবে না, এমনটা আশা করা একেবারেই অযৌক্তিক। বাচ্চাদের আচরণগত বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে বাবা মায়েদের অনেকসময়ই বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়। তার মধ্যে অন্যতম হলো মিথ্যে কথা বলার প্রবণতা।
অনেক ক্ষেত্রে বাচ্চারা মিথ্যে কথা বললে চট করে ধরা যায় না, যেহেতু আমরা বিশ্বাস করি বাচ্চাদের মন জটিল নয়, তারা সত্যিটাই বলবে। অধিকাংশ শিশুই কখনও না কখনও মিথ্যে বলে। কিন্তু এটাই যদি তার সর্বক্ষণের স্বভাব হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে তো চিন্তার ব্যাপার বৈকি! এমন পরিস্থিতির মধ্যে বাবা মায়েদের প্রায়ই পড়তে হয়, যেখানে সকলের সামনে তাঁদের শিশুটি এমন একটি মিথ্যা বলে বসলো যা অন্যরা সহজেই বুঝে ফেললেন এবং এই নিয়ে তৈরি হলো অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। তখন বাবা মা অপমানিত বোধ করে তাঁদের সন্তানকে আড়ালে ডেকে নিয়ে গিয়ে বকাঝকা অথবা মারধোর করেন। এটা কিন্তু সমস্যার সমাধান নয়। আগে চিন্তা করতে হবে বাচ্চাটি এমন কেন করলো! সেইসব সম্ভাব্য কারণ এবং তার সমাধানগুলি নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হলো।
১) বড়দের প্রথম এবং প্রধান ভুল, তাঁরা মনে করেন বাচ্চাদের কোনো সম্মান অসম্মান বোধ হয় না। সহজ ভাষায় বলতে গেলে, বাচ্চাদের কোনো প্রেস্টিজ জ্ঞান হয় না। এই ধারণা সম্পূর্ণভাবে ভুল। বাচ্চাদের মধ্যে যখন থেকে অন্যান্য বোধবুদ্ধি তৈরি হয়, তখন এই অনুভূতিটাও তৈরি হয়। সেক্ষেত্রে শিশুরা কোন ভুল করলে তা নিয়ে লজ্জায় পড়ে, অস্বস্তিবোধ করে। এছাড়া শিশুকে যদি আগে কখনও তার কাজের জন্য লজ্জা দেওয়া হয়ে থাকে বা সকলের সামনে তার উদ্দেশ্যে লজ্জাজনক মন্তব্য করা হয়ে থাকে তাহলেও তারা মিথ্যা বলে। লজ্জা ও অস্বস্তিবোধ থেকে বাঁচতে বড়রা কি মিথ্যা বলে না! সেইজন্য প্রথমে বড়দের দায়িত্ব, নিজেদের এমন ধারণা ত্যাগ করা।
২) আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ, শিশুটির সঙ্গে আগে এমন কোন অভিজ্ঞতা হয়ে থাকলে যেখানে সে প্রত্যক্ষ করেছে সত্য স্বীকার করলে শাস্তি পেতে হবে, বকুনি খেতে হবে বা তাকে মারধোর করা হবে তখন সে নিশ্চিতভাবে মিথ্যে বলবে। কারণ সে তার পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে উপলব্ধি করেছে যে দোষ স্বীকার না করাই ভালো। শিশু কোনো কাজে ভুল করে ফেলে দোষ স্বীকার করলে আমরা যদি তাকে শাস্তি দিই তাহলে পরবর্তীতে শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য ভয়ে সে বারবার মিথ্যা বলবে।
৩) সব শিশু সমান হয় না। অনেক বাচ্চাই থাকে attention seeker। তারা বারংবার মিথ্যা বলে নিজের দিকে বড়দের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চায়, সে তার নিজের বাড়িতে হোক বা স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকাদের কাছেই হোক। এরকমটা হলে তাকে বকাবকি না করে শান্তভাবে বোঝাতে হবে যে মিথ্যা বলা কতটা খারাপ এবং এরকম করতে থাকলে তাকে কেউ আর পছন্দ করবে না।
৪) আমরা প্রায়শই বাড়িতে বাচ্চাদের সামনেই মিথ্যা কথা বলে থাকি। অসাবধানতাবশত তাদের সামনে স্বীকারও করে ফেলি। যেমন ধরা যাক, কেউ তাঁর কোনো বন্ধুকে বা কর্মক্ষেত্রে কোনো কারণে মিথ্যা বলে সেই ঘটনা বাড়ির অন্য একজন সদস্যর কাছে বিবৃত করছেন। সামনে কোনো বাচ্চা থাকলে সবটা শুনে সে সহজেই ব্যাপারটা বুঝে ফেলবে। ক্রমে তার মধ্যেও এই প্রবণতা তৈরি হবে। সেই কারণে শিশুদের সামনে যতটা সম্ভব মিথ্যা কথা বলা এড়িয়ে চলতে হবে। শিশুদের শিক্ষা কিন্তু নিজেদের বাড়ি থেকেই প্রথম শুরু হয়। বাড়ির বড়দের অনুসরণ করেই তারা শেখে।
৫) অনেকসময় কোনো কিছু পাওয়ার আশায় বা বায়না করে শিশুরা মিথ্যা বলে। তাকে বোঝাতে হবে যে মিথ্যা বললেই কিছু পাওয়া যায় না এবং তার এমন ব্যবহারে আপনি হতাশ হয়েছেন। শিশুদের মন অত্যন্ত কোমল। তারা যাকে ভালোবাসে সে দুঃখ পেয়েছে শুনলে পরবর্তীতে এহেন কাজ থেকে সে বিরত থাকবে।
৬) বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, শিশুর মিথ্যা বলার সঙ্গে স্কুলের পরিবেশ সম্পর্কযুক্ত। যেসব স্কুলে বেশি শাস্তি দেওয়া হয় সেখানকার পড়ুয়া শিশুরা বেশি মিথ্যা বলে। কারণ, সেখানে শাস্তি বেশি হওয়ার কারণে ছাত্রছাত্রীরা শাস্তি এড়ানোর জন্য মিথ্যার আশ্রয় নেয়।
৭) শিশুরা কল্পনাপ্রবণ হয়ে থাকে। কল্পনার আবেশে তারা এমন অনেক কথা বলে যেগুলো শুনে আমাদের মনে হতে পারে যে তারা মিথ্যা বলছে। আট বছর বয়সের কমবয়সী শিশুরা বাস্তবতা ও কল্পনাকে আলাদা করতে পারে না। তাই কোনটা মিথ্যা আর কোনটা কল্পনা, তা আগে বড়দের বুঝতে হবে। এইসব কল্পনা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে কেটে যায়। কাজেই ছোটখাটো কল্পনাকে মিথ্যা ভেবে অযথা দুশ্চিন্তা করা একেবারেই অমূলক।
৮) অনেকসময় সত্য-মিথ্যার ধারণাটা আমরা নিজেরাই শিশুদের মধ্যে গুলিয়ে দিই। যেমন, বাড়ির কোনো বড়কে মিথ্যা বলতে দেখে বাড়ির বাচ্চাটি তাঁর কাছে জানতে চাইলো যে উনি মিথ্যা বললেন কেন। তখন ওই সদস্য জানালেন, মাঝে মাঝে প্রয়োজনে মিথ্যা বলা যায়। বাচ্চাটি তখন সেটাই শিখবে এবং বুঝবে যে অন্যরা মিথ্যা বলে যখন কোন সুবিধা পাচ্ছে বা কোন সমস্যা এড়িয়ে যেতে পারছে, তাহলে সেও সেটা করতে পারে। এভাবে সে মিথ্যা বলতে উৎসাহিত হবে। আবার কিছুদিন পর তাকে কড়া করে বকে দিয়ে বলা হলো সে যেন মিথ্যা না বলে। এভাবে একেকসময়ে একেকরকম নির্দেশ দিলে সে আদপে কিছু শিখবে না।
শিশুদের মধ্যে যাতে মিথ্যা কথা বলার প্রবণতা তৈরি না হয় তার জন্য বড়দের অনেক কিছু করণীয় রয়েছে। প্রথমত, সে কখনও অসত্য বললে তাকে "মিথ্যুক" বলে সম্বোধন করা হলে সেটা আগে বন্ধ করতে হবে। বাড়ির বড়দের কথায় কথায় মিথ্যা বলার স্বভাব ত্যাগ করতে হবে। শিশু সত্য বললে তার সততার জন্য প্রশংসা করতে হবে, এতে সে সত্য বলতে উৎসাহ পাবে। শিশুকে কোনো বিষয়ে কথা দেওয়ার পর সেই কথা রাখতে না পারলে তার কারণ ব্যাখ্যা করে তাকে বুঝিয়ে বলুন যাতে সে আপনাকে মিথ্যাবাদী না মনে করে। তাকে মনীষীদের জীবনী, ঈশপের গল্প, নীতিকথার গল্প পড়ে শোনান। এতে সে শিখবে, মিথ্যা বিষয়টা গ্রহণযোগ্য নয়।
অনেক ক্ষেত্রেই বাবা মায়েরা শিশুদের মিথ্যে বলার এই স্বভাবকে অবহেলা করে থাকেন এবং সেই নিয়ে কোনরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করেন না। ফলস্বরূপ, এই সমস্যা পরবর্তীকালে বড়সড় আকার ধারণ করে। শুধু তাই নয়, কথায় কথায় মিথ্যা বলার এই স্বভাব শিশুর জীবনেও নানা ক্ষতি করে। ছোট থেকে তা রুখে না দিলে এই অভ্যাস খুব বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে শিশুটিকে অবশ্যই বোঝাতে হবে। বোঝানোয় কাজ না হলে এবং শিশুর বলা মিথ্যার জন্য শিশু বা তার পরিবারকে বারবার বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হলে, শিশু ও তার পরিবার একসঙ্গে ফ্যামিলি কাউন্সেলিং ও শিশু একা ইন্ডিভিজুয়াল কাউন্সেলিংয়ের জন্য যেতে পারে। সেক্ষেত্রে সমস্যার যথাযথ সমাধান হয়ে যাবে এমনটা আশা করাই যায়।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন