এই বর্ষা এখন শেষের পথে পাড়ি দিচ্ছে। যবনিকার অন্তরালে হারিয়ে যাবার আগে কিছু কিছু প্যাঁচ পয়জার কষে যেন অস্তরাগের খেলাখেলিতে মনোযোগী হয়েছে। কিছু আগেই ঝমাঝম এক পশলা ধারাপাত হয়ে গেল। এখন চারিদিক ঝকঝকে। নীল গগনে কিছু হালকা ধূসর পেঁজা তুলার ইতিউতি আনাগোনা। বাড়ির পাশের তালাওটা জলে টইটম্বুর। মনে হচ্ছে খেলাচ্ছলে একটা ঢিল ছুঁড়লেই উপচিয়ে পাশের আলপথকে বানভাসিতে সুসিক্ত করে তুলবে।
গ্রীষ্মবেলায় এটি
হাঁটু জলের মালকিন। কিশোরেরা ঝপাং ঝপাং আওড়াতে আওড়াতে একে ওকে ঠেলতে ঠেলতে এপার
ওপার করে। কিছুটা বয়স্কেরা লুঙ্গি আদ্ধেক তুলে, বা পাতলুন পরলে তা
আদ্ধেক গুটিয়ে নিয়ে সাবধানে পার হয়। নীচে রয়েছে যে কিছুটা তুলতুলে কাদা। রাখালেরা
গরু, মোষ নিয়ে হ্যাট হ্যাট করতে করতে পেরোয়। স্থানীয় বিধায়ক বা পঞ্চায়েতের ব্যাপক
সময়াভাবে একটু ছোটো সাঁকো করা আর হয়ে উঠছে না। বিগত কয়েক দশক ধরেই কারোরই সময় আর
হয়ে ওঠেনি- কাজের যা ঠ্যালা, খুব মুশকিল। ওদিকে সাঁকোর বাজেটের টাকা বছরের
পর বছর অনুমোদিত হয়েও কোথায় আসছে বা কোথায় যাচ্ছে, তার খবর সাধারণ
গ্রামবাসীর কাছে একেবারেই নেই।
চিত্ত ঘরের বাইরেই
বর্ষায় দাপাদাপি উপভোগ করতে চায়। কিন্তু ওই যে তারপর হ্যাঁচ্চো আর
হ্যাঁচ্চো, আর নিদ্রাতুরা মায়ের রাতভোর তার উষ্ণ কপালে
জলপট্টির মোলায়েম প্রলেপের দুর্ভোগ এড়াতে টিপটিপ বর্ষায় ছাদে ছুটে যাবার পরিকল্পনার ছুটি দেয়। তবে তালাওটা এক নিষিদ্ধ আকর্ষণে চিত্তর চিত্তকে দুর্বার করে তোলে। হাতছানিটার
প্রবলাবেগ চিত্তকে ছুটিয়ে নিয়ে চলে বর্হিবিশ্বে। চিত্ত সবভুলে দেয় ঝাঁপ। শীতল এক
শিরশিরানি পদতল থেকে মস্তিষ্ক পর্যন্তকে সাদর আহ্বান জানায়। ধীরে ধীরে সহবাসের
আন্তরিকতায় তালাও আর চিত্ত একাত্ম হয়ে ওঠে।
চিত্তর জলকেলির সোহাগ তালাওয়ের সর্বব্যাপীময়। উথালী পাথালী করে চিত্ত তালাওয়ের
সর্বত্র দাপাদাপি চালাতে থাকে।
কিন্তু একি? চিত্তর মনে হয় কেউ তাকে ক্রমশ নীচে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। প্রবল হাত পা ছুঁড়েও, সন্তরণের সমস্ত কৌশল প্রয়োগ করেও চিত্তর নিম্নগমন কিছুতেই আর বাধাপ্রাপ্ত হয়
না। এদিকে হাতও যায় না সম্পূ্র্ণ ঘোরানো। এ কি হচ্ছে? প্রথমে পায়ের আঙ্গুল ডোবে কাদায়, তারপর ধীরে ধীরে তলপেট, অতঃপর বুক শরণ নেয় ভুঁয়ে। থুতনি মাটি ছুঁলেই, হাতগুলি আটকে পড়ে
কাদায়। ওই দিকে পদযুগলের অবস্থাও তথৈবচ- না ঘরকা, না ঘাটকা। চিত্তর চিত্তাকর্ষণ ঘটে যে তালাওতে আর জলই নেই। সম্পূর্ণ জলশূন্য
তালাও হাহাকার করছে। এমন তো ঘটেনি কখনও। প্রখর দাবদাহেও এই তালাও কখনই শুকিয়ে
যায়নি। হাঁটুজল নেমে গিয়ে বড়জোর চরণধৌতের ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু তাকে সম্পূর্ণ
উলঙ্গর দৃষ্টিকটুতা উপলব্ধি করতে হয়নি। এদিকে শুধু চিত্তরই চিত্তহানি ঘটেনি, চারপাশের জলজীবদেরও নাভিশ্বাস উঠেছে। পানা, শালুক, পদ্ম ইত্যাদি মুখ থুবড়ে তলে পড়ে আছে। আকুলিবিকলি করছে পোনা মাছ, ধেড়ে মাছ। ছটফট করছে কেন্নো, জলঢ়োড়া ইত্যাদিরা। কারে ছেড়ে কারেই বা দেখে।
সবাই যে মরোমরো। চিত্ত নিজেকে নিয়েই বা কি করে? এ কি বিশ্বউষ্ণায়নের
এক রূপ? তা কি করে হয়? এত জল তো নিমেষে বাষ্প হতে পারে না। তবে কি
অসুখী বসুন্ধরার কোনো অতৃপ্ত ক্ষোভ উপশমের নির্বাপণে এই তালাওয়ের জল ভূগর্ভস্থ হলো?
চতুস্পদী হয়ে চিত্ত, এখন দ্বিপদীর প্রচেষ্টায়।
"মা- মা দেখো আমি হাঁটতে চলেছি।"
"আস্তে মনা, আস্তে। এই এই দেখো
যেন পিছলে পড়ো না।"
একদা জলচর, আবার উঠবে ডাঙ্গায়। কিন্তু জলজদের কি হবে এবার? ফুসফুস নেই যে
তাদের। আঁতকে ওঠে চিত্ত। দু'হাত ভরে মাছ, ঢ়োড়া, কিলিবিলিদের ডাঙ্গায় ওঠাতে গিয়ে থমকে যায়।
বসে পড়ে। দু'হাতে পাগলের মতো কাদা সরাতে থাকে। এই জলচরদের জীবনের জন্য় মা ধরিত্রীর
কাছ থেকে এক আঁজলা জল ছিনিয়ে আনার পণ করেছে যে।
চিত্র সৌজন্যঃ আন্তরজাল থেকে সংগৃহীত
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন