"ওফ্ আর পারা যায়
না! এবার একটা হেস্তনেস্ত করতেই হবে। সব কিছুর একটা লিমিট আছে। এই ছেলেটা সব লিমিট
ক্রশ করে গেছে।" গজগজ করতে থাকেন বড়বাবু।
বড়বাবুর টেবিলের উল্টো দিকের চেয়ারে বসে থাকা অফিস ম্যানেজার দত্তবাবু উদ্বিগ্ন ভাবে প্রশ্ন করেন, "কি হয়েছে স্যার, এনি প্রবলেম?"
"কি আর হবে! মানস আবার লিভ অ্যাপ্লিকেশন পাঠিয়েছে। আর ছুটি দেব না। সামনে ইয়ার এন্ডিং, এসময়ে কোনো মতে ছুটি দেওয়া যাবে না। ইমপসিবল।" একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলতে থাকেন বড়বাবু, "বছরে দু’একবার বেড়াতে গেলে মানা যায়। কিন্তু ওর বছরে চার পাঁচ বার ছুটি চাই স্রেফ বেড়াতে যাবে বলে! এটা অফিস, নাকি ওর মামার বাড়ি? আর বরদাস্ত করব না। দত্ত বাবু আপনি এবার একটা স্টেপ নিন।"
"মানস ছেলেটা
অত্যন্ত সরল। তাছাড়া এমন চাইল্ডিস কথাবার্তা বলে যে ওর ওপর রাগ করা যায় না। তবে
অফিসের স্বার্থে এবার আমাকে কড়া হতেই হবে। কাউকে বেশি বাড়তে দেওয়া উচিত নয়।"
বড়বাবুর বিরক্তি কমানোর চেষ্টা করেন দত্ত বাবু।
"এখন কোনো মতেই আমি কাউকে ছুটি দেব না। আপনি ফোন করে মানসকে ডাকুন। ওকে পরিষ্কার ভাবে জানিয়ে দিই, এখন ছুটি হবে না।" কিছুতেই রাগ কমছে না বড়বাবুর।
"কিন্তু স্যার আমার ট্রেনের টিকিট কাটা হয়ে গেছে, হোটেল বুকিং হয়ে গেছে। এখন ছুটি না দিলে আমার অনেক লস হয়ে যাবে। এইবারের মত ছুটিটা মঞ্জুর করে দিন। আর কোনো দিন বেড়াতে যাওয়ার জন্য ছুটি চাইব না। এবারেরটা হলে আমার সারা ভারত ঘোরা হয়ে যাবে। তারপর আর কোথাও যাবো না। আমি এক জায়গায় দু’বার যাই না। এটা আমার ভীষ্মের প্রতিজ্ঞা।" মানস কাকুতি মিনতি করতে থাকে।
"ওসব আমি জানি না। আমি আমার কোম্পানীর কথা ভাবছি। এইতো দু’মাস আগে কোথায় যেন বেড়াতে গিয়েছিলে, আমার জন্য একটা গামছা এনেছিলে।" একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলেন বড়বাবু।
"সেতো স্যার চার মাস আগের কথা। পুরীতে গিয়েছিলাম। আরো অনেক ভালো ভালো জিনিস ছিল। ভেবেছিলাম আপনার জন্য নিয়ে আসব। সব ছেড়ে গামছাটাই কিনলাম। কারন বিবেকের দংশন স্যার।" হাতজোড় করে কথাগুলো বলে মানস।
"বিবেক বাবু হঠাৎ সবাইকে ছেড়ে তোমাকে কামড়ালো কেন?" গরম হয়ে ওঠা মাথাটা আস্তে আস্তে ঠান্ডা হচ্ছে বড়বাবুর। মৃদু হাসির রেখা দত্তবাবুর মুখে।
"গত বছর কানহা ন্যাশনাল পার্কে গিয়ে ছিলাম। শুনেছি সেখানে চোরা শিকারিরা বাঘ, হরিণ মেরে চোরা বাজারে পশুর ছাল বিক্রি করে। ভেবেছিলাম আপনার জন্য একটা বাঘছাল নিয়ে আসবো। অনেক খুঁজেছিলাম কিন্তু পেলাম না। সেই দুঃখটা এখনো মনে রয়ে গেছে।" আক্ষেপ ঝরে পড়ে মানসের গলায়।
মানস থামতে দত্তবাবু বলে উঠলেন, "আইডিয়াটা দারুন স্যার। আপনাদের ঐ বিশাল বনেদি বাড়ি ঠাকুর দালানের দেওয়ালে একটা বাঘ ছাল টাঙানো থাকলে খুব সুন্দর দেখতে লাগবে।"
বড়বাবুর দিকে তাকিয়ে মানস বলতে শুরু করে, "আমি অন্য কথা ভেবেছিলাম। এই যুগটা প্রচার সর্বস্ব যুগ। আপনি কোট প্যান্ট ছেড়ে যদি বাঘ ছাল পরে অফিসে আসেন, কত লোক আপনার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকবে! ইলেকট্রনিক মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়া আপনার পেছনে পড়ে যাবে। খবরের কাগজের হেড লাইন হবে - বিদেশী পোশাক ত্যাগ করে আদি সনাতন ভারতীয় পোশাককে ফিরিয়ে এনেছেন লোটাস বিস্কুট কোম্পানীর কর্ণধার। তাহলে ভেবে দেখুন স্যার বিনা খরচে আমাদের কোম্পানীর প্রচার কোন পর্যায়ে পৌছে যাবে! কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য বাঘ ছাল পেলাম না। সেজন্য পরের বার পুরীতে গিয়ে আপনার জন্য গামছা আনলাম। ঐ যাকে বলে নাকের বদলে নরুণ।"
"ইয়ার্কি হচ্ছে, তুমি কি আমাকে বাঘ ছাল পরিয়ে জোকার সাজাতে চেয়েছিলে?" উত্তেজিত হন বড়বাবু।
"শিব ঠাকুরও তো বাঘ ছাল পরে, শিব ঠাকুর কি জোকার?" পাল্টা প্রশ্ন মানসের।
নিষ্ঠাবান ব্রাহ্মণ বড়বাবু শিব ঠাকুরের সঙ্গে তুলনা শুনে থমকে যান। বড়বাবুকে থমকাতে দেখে দত্তবাবু ময়দানে নামেন। সরাসরি মানসকে প্রশ্ন করেন, "তুমি কি উত্তর ভারত গেছ কোনো দিন?"
"চার বছর আগেই ওদিকে ঘুরে এসেছি। কাশ্মীর, বৈষ্ণোদেবী মন্দির, পাঞ্জাবের স্বর্ণ মন্দির হয়ে মথুরা, বৃন্দাবন। তারপর আর একবার গিয়ে দিল্লি, আগ্রা, এলাহাবাদ। তার কয়েক মাস পরে বেনারসে গেছি।" সপ্রতিভ উত্তর মানসের।
"পশ্চিম ভারতে গেছ কোনো দিন?" প্রশ্ন দত্তবাবুর।
"হ্যাঁ। মুম্বই, অজন্তা, ইলোরা। তারপর দ্বারকাধিস মন্দির, কছ। রাজস্থানের জয়পুর, জয়সলমীর, বিকানির, আজমের, দিলওয়ারা মন্দির, পুস্কর সব
দেখেছি।" বেশ গর্বের সঙ্গে বলে মানস।
"খুব ভালো। আর দক্ষিণ ভারত?" আবার প্রশ্ন দত্ত বাবুর।
"আরাকু ভ্যালি, ভাইজাগ, রামেশ্বরম দেখা হয়ে গেছে।" একটা সাফল্যের হাসি ছড়িয়ে পড়ে মানসের মুখে।
"উত্তর পূর্ব ভারত কি ঘুরেছ?" আবার একটা প্রশ্নবাণ ধেয়ে আসে।
"গ্যাংটক, পেলিং, ডুয়ার্স, দার্জিলিং আমার কাছে পুরনো হয়ে গেছে। এক জায়গায় আমি দু’বার যাই না। তাই বিভিন্ন জায়গায় যাই।" উত্তর দিতে দিতে একটু যেন ক্লান্ত বোধ করে মানস।
"তোমার এখন ছাব্বিশ বছর বয়স। এর মধ্যে তোমার প্রায় সারা ভারত ভ্রমণ হয়ে গেছে। এবারে গেলে আর কিছুই বাকি থাকবে না। তুমি তো আবার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এক জায়গায় দু’বার যাবে না। তাহলে ভবিষ্যতে যখন বিয়ে করবে, তখন তোমার বউকে নিয়ে কোথায় বেড়াতে যাবে?" কথার জাল গোটাচ্ছেন দত্তবাবু।
দত্তবাবুর বাক চাকুরিতে উত্তেজিত হয়ে ওঠেন বড়বাবু। সিংহ বিক্রমে আস্ফালন শুরু করেন, "বলো, বলো। দত্ত স্যারের প্রশ্নের উত্তর দাও। স্পিক আপ বোহেমিয়ান ইয়ং ম্যান, স্পিক আপ। ভবিষ্যতে যাকে বিয়ে করে ঘরে আনবে, তার সুখ শান্তি দেখা তোমার কর্তব্য। এবার বলো তোমার বউকে নিয়ে কোথায় বেড়াতে যাবে?"
অনেক ভেবে চিন্তে মাথা চুলকে মানস বলে, "মনে পড়েছে, এখনো একটা জায়গা আমার যাওয়া হয় নি। ছোটবেলায় বাবা মা নিয়ে গিয়েছিল কিনা মনে নেই। তবে জ্ঞানত কোনো দিন যাই নি।"
"এখনো একটা জায়গা বাকি আছে!" অবাক হন দত্ত বাবু।
"দারুন জায়গা স্যার। সীজনে হাজার হাজার মানুষ যায়। এনজয় করে। ছেলে বুড়ো নির্বিশেষে অনাবিল আনন্দে ভেসে যায়। যদি আমার জীবনে চরম দুর্ঘটনাটা ঘটে যায়, অর্থাৎ আমার বাবা মা কোন দিন ধরে বেঁধে আমার বিয়ে দিয়ে দেয়, তখন আমার বৌকে নিয়ে আমি সেখানেই বেড়াতে যাবো।"
"সেটা কোথায়?" প্রচন্ড জোরে ধমকে ওঠেন বড়বাবু।
টেবিলের উল্টো দিক থেকে উত্তর আসে, "চিড়িয়াখানায়।"
চিত্র সৌজন্যঃ আন্তরজাল থেকে সংগৃহীত
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন