…লাগলো যে দোল - কমলেন্দু সূত্রধর



 
ক্যালেন্ডারের পাতায় মার্চ মাস বড়োই বর্ণময়। একদিকে অফিস-কাছারিতে অর্থবর্ষ শেষের হিসেবনিকেশের ব্যস্ততা, অন্যদিকে পড়ুয়াদের পরীক্ষা শেষের স্বস্তি কিংবা স্কুলে স্কুলে নতুন সেশন শুরুর অপেক্ষা। আবার এই সময়তেই মনোরম বসন্তদিনে রঙের উৎসবে মেতে ওঠার জন্য সকলের মন কমবেশি মুখিয়ে থাকে। শীতের রুক্ষতার শেষে প্রকৃতি এই সময় নিজেকে নতুন বেশে রাঙিয়ে তোলে, প্রকৃতির সেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মানুষও মেতে ওঠে বসন্তের আবাহনে এবং শুরু হয় রঙের উৎসব- কোথাও তা হোলিআবার কোথাও দোলকিংবা বসন্তোৎসবনামে।



দোলযাত্রা। যাত্রা অর্থে গমনআর দোলঅর্থে দোলন’, ঋজুপথে কিম্বা বৃত্তপথে এদিক হইতে সেদিক, সেদিক হইতে এদিক গমনাগমনের নাম দোলন। কে দোলেন? ভগবান বিষ্ণু। সুর্যরূপে বিষ্ণু জগৎপালন করেন। গুণকর্মের বিশ্লেষনে বিষ্ণুকে সূর্য ব্যতিত অনু কোন প্রাকৃতিক বস্তুর শক্তি বলে গণ্য করা চলে না। বিষ্ণু আদিত্যগণের অন্যতম, সুতরাং তিনি অদিতি-পুত্র। ব্রহ্মাণ্ডব্যাপী তেজোরূপা যে শক্তি অদিতি নামে ঋগবেদে খ্যাতা, তারই প্রধান প্রকাশ সুর্যই ঋগবেদের বিষ্ণু। আচার্য  যাস্ক নিরুক্তে বিষ্ণুশব্দের অর্থ করেছেন, “অথ যদ্বিষিতো ভবতি তদ্বিষ্ণুর্ভবতি, বিষ্ণুর্বিশতের্বা ব্যশ্নোতের্বা।” অর্থাৎ, “...যখন আদিত্য রশ্মিসমুহে পরিব্যাপ্ত হন, তখন তাহার নাম হয় বিষ্ণু।” বিষ্ণু আবার ত্রিবিক্রমও, তিন পদক্ষেপে তিনি বিশ্বভুবন পরিভ্রমণ করেন। কি এই ত্রিবিধ পদক্ষেপ? নিরুক্তকার যাস্ক বলছেন, “সমারোহণে বিষ্ণুপদে গয়শিরসীত্যৌর্ণবাভঃ।” অর্থাৎ, “বিষ্ণু যে তিন স্থানে পদন্যাস করেন, ঔর্ণবাভের মতে সেই তিন স্থান হইতেছে- উদয়াচল, অন্তরীক্ষ এবং অস্তাচল, প্রাতঃকালে উদয়াচলে বিষ্ণু(আদিত্য) উদিত হন, মধ্যাহ্নে অন্তরিক্ষে প্রদীপ্ত হন এবং সায়াহ্নে অস্তাচলে অস্তগত হন- ইহাই বিষ্ণুর ত্রিধা পদন্যাস।”

 



সূর্য তথা বিষ্ণুর এই গতি বা যাত্রা'র আরও একটি ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব। ঋগবেদেই পাওয়া যায়, “চতুর্ভিঃ সাকং নবতিং চ নামভিশ্চক্রং ন বৃত্তং ব্যতিরবিবিপৎ।” অর্থাৎ, “বিষ্ণু গতিবিশেষ দ্বারা বৎসরের চতুর্নবতি(অর্থাৎ, চারগুণ নবই বা ৩৬০ দিন) দিবস চক্রের ন্যায় বৃত্তাকারে চালিত করছেন।” স্পষ্টতই, বিষ্ণু স্বয়ং তাঁর চক্রাকার গতির দ্বারা কালবিভাগ করেন, বর্ষপূর্ণ করেন। আচারয যোগেশচন্দ্র রায়ের মতে, “সুর্যের যে শক্তিদ্বারা এই দুই গতি(আহ্নিক ও বার্ষিক) হয়, যাহার ফলে ছয় ঋতু পর্যায়ক্রমে চলিয়াছে এবং পৃথিবী মনুষ্যের বাসোপযোগী হইয়াছে, সে শক্তির নাম বিষ্ণু। চলিষ্ণু সূর্য সেই শক্তির আধার।”





সেই সূত্রে, সুর্যের উত্তর দক্ষিণে গমনাগমনে বিষ্ণূর তিনটি পদক্ষেপস্থান পাওয়া যায়- কর্কটক্রান্তি, মকরক্রান্তি ও বিষুবরেখা। উত্তরায়ণের প্রারম্ভে মকরক্রান্তি রেখায় সুর্যের অবস্থান বিষ্ণুর প্রথম পদক্ষেপ, শরতে বিষুবরেখায় সুর্যের অবস্থান দ্বিতীয় পদক্ষেপ ও দক্ষিণায়ণের প্রারম্ভে কর্কটক্রান্তি রেখায় সুর্যের অবস্থান তৃতীয় পদক্ষেপ রূপে গণ্য হতে পারে। এককথায়, সুর্যের বার্ষিক গতিই হল বিষ্ণুর ত্রিবিক্রম। এইভাবেই, সূর্যের আহ্নিকগতিতে উদয়াচল-অস্তাচলের মধ্যে অথবা বার্ষিকগতিতে কর্কটক্রান্তি ও মকরক্রান্তি রেখার মধ্যে বিষ্ণু দোলায়মানহন। ঋগবৈদিক যুগে ঋষিগণ সুর্যের উত্তরায়ণ আরম্ভে নতুন বছর শুরু করতেন। উত্তরায়ণ যেমন নববর্ষারম্ভ, তেমনই বিষ্ণুর ত্রিপাদ যাত্রাবা আপাত দোলায়মান যাত্রারশুভ সূচনাও বটে। সেদিন সূর্য পুজা ও যজ্ঞের প্রচলন ছিল। বর্তমানের দোলযাত্রাবা হোলি সেই পুরাকালের নববর্ষারম্ভের উৎসবেরই স্মৃতি। নববর্ষ-প্রবেশে হর্ষক্রীড়া স্বাভাবিক। বৈদিককালে সম্বৎসরব্যাপী সত্রের পর সকলে মিলে ক্রীড়াকৌতুক চলত। তবে, দোলযাত্রা একটি নয়, দুটি। একটি দোল, অপরটি হিন্দোল। উত্তরায়ণের শুরুতে যেমন বিষ্ণুর দোলযাত্রা, তেমনই দক্ষিণায়নের শুরুতেও হিন্দোল পালিত হত। এই হিন্দোলই পরবর্তী কালে ঝুলনযাত্রানামে পরিচিত ও পালিত হয়ে আসছে।

 

কিন্তু, প্রশ্ন হল বর্তমানে উত্তরায়ণ শুরু হয় ২২ ডিসেম্বর বা ৭-৮ পৌষ থেকে। আর দোলযাত্রা পালিত হয় ফাল্গুন মাসের শেষের দিকে ফাল্গুনী পুর্ণিমাতে। দুটির মধ্যে এতোটা  ব্যবধান চলে আসছে কিভাবে? এর কারণ অয়নচলন। সুর্যের আপাত গতিপথ বা ক্রান্তিবৃত্তের ভিতর দিয়ে বিষুববিন্দুদ্বয়ের পশ্চিমাভিমুখে ধীর গতিতে চলনকেই বলে অয়নচলন। এর মান ৭০ বছরে প্রায় ১ অংশ(বা ডিগ্রী) হয়। ভারতীয় জ্যোতিষে দিনগণনা নাক্ষত্রবর্ষের ভিত্তিতে হয়ে থাকে। এই অয়নচলনের ফলে নাক্ষত্রবর্ষ ও ক্রান্তিবর্ষের মধ্যে ২০ মিনিটের তফাৎ বর্তমান। এর ফলে ভারতীয় বর্ষপঞ্জিতে ঋতুরা ৭০ বছরে একদিন, কিঞ্চিদধিক ২০০০ বছরে এক মাস, ১৩০০০ বছরে প্রায় ৬ মাস পিছিয়ে আসে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই অয়নচলনের জন্যই ১৩ হাজার বছর পরে বাংলা ক্যালেণ্ডারে মাসের সঙ্গে ঋতুর সম্পর্ক বিপরীত হয়ে যাবে (যথা আশ্বিন মাসে বসন্ত আর চৈত্র মাসে শরৎ ঋতু হবে)। অতএব, আজ থেকে কমবেশি পাঁচহাজার থেকে ছয়হাজার বছর পুর্বে উত্তরায়ণ ফাল্গুনী পুর্ণিমাতে শুরু হত, তাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকেনা।

 

বিষ্ণুর এই যে দোলন উৎসব, এর শিকড় সুদূর অতীতে বৈদিক যুগে প্রোথিত। তবে কালচক্র স্থির নয়। কালের নিয়মেই উৎসবের আচার-বিচার, সংস্কার, চরিত্রাদির পরিবর্তনও সাধিত হয়েছে। সেই যুগের নববর্ষোৎসবের বর্তমানে নানান রঙে রঙিন বসন্তোৎসবে পরিণত হয়েছে। প্রাচীনকালে বৈশাখী শুক্লাচতুর্থীতে সুগন্ধি যবচূর্ণ পরস্পরের গায়ে মাখিয়ে আমোদ করা হত। ফাল্গুনী পুর্ণিমাতেও কিংশুক ও অন্যান্য ফুলের সুগন্ধ জল ও যবচূর্ণ ও লাক্ষা নির্মিত কুমকুম পরস্পরের গায়ে দিয়ে উৎসব হত। এই প্রেক্ষিতে মদনোৎসবসম্পর্কে সামান্য আলোচনা না করলেই নয়। সংস্কৃত সাহিত্যে এর উল্লেখ পাওয়া যায়। বসন্তকালে অনুষ্ঠিত এই উৎসবে আমোদ-আহ্লাদ এবং নারী পুরুষের উচ্ছল মেলামেশাটাই প্রাধান্য পেত। ধারণা করা হয়, পরবর্তীকালে দোল উৎসবের সাথে এই মদনোৎসবও একাকার হয়ে গেছে।

 

রোমান সভ্যতার শুরুর দিকে এবং ওই সভ্যতার মধ্যযুগ অব্দি একটা একইরকম উৎসবের কথা আমরা পাই সান্দ্রা বত্তিচেল্লির আঁকায় যার নাম প্রিমেভেরাবা Primeveraএই প্রিমেভেরার আক্ষরিক অনুবাদ হলো মদনোৎসব বা বসন্তোৎসব। বসন্তকালের আগমনে মানুষ মেতে উঠতেন একদিনের অর্গলহীন, লোকলজ্জাহীন মেলামেশায়। কুমকুম, ফাগ মেখে মনের মতো সঙ্গী খুঁজে একটি দিন অতিবাহিত করত তারা। সাধারণত নারীরাই বেছে নিতে পারতেন তার সঙ্গীকে। এই উৎসবের কথা আছে পেত্রার্কের ডেকামেরন কাব্যগ্রন্থে। পরে দান্তের Divine Comedy-Inferno অংশেও পাওয়া গেছে। টেনিসনের কবিতাতেও এই উৎসবের উল্লেখ আছে। মদনোৎসবের সাথে রোমান প্রিমেভেরা উৎসবের মিল পাওয়া যায়।

 

এই মদনোৎসব মুলত কামদেবের উপাসনার সাথে যুক্ত ছিল। প্রাচীন ভারতে কামদেব রীতিমতো পূজিত হতেন। গুপ্তযুগে নগরে নগরে তাঁর মন্দির ছিল। প্রাচীন সাহিত্যগুলি থেকে জানা যায়, সেই মন্দিরগুলি ছিল সেকালের প্রেমিক-প্রেমিকাদের নিয়মিত বিহারের স্থান। তৃতীয়-চতুর্থ শতক থেকে ষোড়শ শতক পর্যন্ত উত্তর-ভারতের সর্বত্রই কামমহোৎসব নামে মদনোৎসবের প্রচলন ছিল। প্রাচীন কাব্যগুলিতে যেমন বাণভট্টের রত্নাবলীনাটকে রাজা উদয়নের সাথে সিংহলকুমারী রত্নাবলীর প্রথম দেখা হয় মদনোৎসবে অর্থাৎ কামদেবের পূজায়। বাৎসায়নের ‘কামসূত্র’ যা রচিত হয়েছিলো তৃতীয়-চতুর্থ শতকে, তাতে এই উৎসবের উল্লেখ আছে। ‘কামসূত্রে’ দোলায় বসে তরুণ-তরুণীদের উন্মুক্ত আমোদ-প্রমোদের কথা আমরা জানতে পারি।

 

এছাড়াও এই উৎসবের উল্লেখ মালতীমাধবকাব্যে, বাৎস্যায়নের কামসূত্র (তৃতীয়-চতুর্থ শতক), মালতীমাধব নাটক (অষ্টম শতক), অল্-বেরুণী (একাদশ শতক), জীমূতবাহনের কালবিবেক (দ্বাদশ শতক) এবং রঘুনন্দন (ষোড়শ শতক) সকলের লেখাতেই অল্প বিস্তার জানা যায়। মালবরাজ ভোজের শৃঙ্গারমঞ্জরীকথা কাব্যে বসন্তোৎসবকে মদনযাত্রামহোৎসব বলে উল্লেখ করা হয়েছে, নীলমাতা পুরাণে মদনত্রয়োদশী এবং ভবিষ্যপুরাণ ও রত্নাবলী কাব্যে মদনোৎসবের উল্লেখ পাওয়া যায়। মিরাটের শারদাতনয় বলে একজন নাট্যশাস্ত্রকার ভাবপ্রকাশবলে একখানি বই লিখেছিলেন, তাতেও বসন্তোৎসবকে মদনোৎসব বলেই উল্লেখ করা হয়েছে। প্রচুর নৃত্যগীতবাদ্য, জুগুপ্সিত উক্তি, যৌন অঙ্গভঙ্গি এবং ব্যঞ্জনা প্রভৃতি ছিল এই উৎসবের অঙ্গ। প্রাচীন বঙ্গদেশে এই উৎসবের কথা জীমূতবাহন ও স্মার্ত রঘুনন্দন বলে গিয়েছেন। শরদিন্দুর ঐতিহাসিক কাহিনীতেও এর পরিষ্কার উল্লেখ আছে। বিশেষত সেতুগল্পটিতে -

 

একবার মাত্র তাহাকে দেখিয়াছি মদনোৎসবের কুম্কুম-অরুণিত সায়াহ্নে। উজ্জয়িনীর নগর উদ্যানে মদনোৎসবে যোগ দিয়েছিলাম। একদিনের জন্য প্রবীণতার শাসন শিথিল হইয়া গিয়াছে। অবরোধ নাই, অবগুণ্ঠন নাই - লজ্জা নাই। যৌবনের মহোৎসব।”

 

মনে হয়, ষোড়শ শতকের পর কোনও সময় মদন বা কামোৎসব ফাল্গুনী দোল, হোলী বা হোলক উৎসবের সঙ্গে এক হয়ে এবং কামমহোৎসব অপ্রচলিত হয়ে পড়ে। বস্তুত, ষোড়শ শতকের পর কামমহোৎসবের কোনও উল্লেখ বা প্রচলন কোথাও আর দেখা যায় না।

 



দোলের সঙ্গে রাধাকৃষ্ণের ঝুলন এবং আবীর-কুমকুম খেলার ইতিহাসের যোগ আবার অন্য পথে। রামগড় গুহার এক লিপিতে (খ্রীষ্টপূর্ব দ্বিতীয়-তৃতীয় শতক) এক ঝুলন উৎসবের কথাই আমরা প্রথম শুনি। কিন্তু সে-ঝুলন কোনও দেবদেবীর নয়, বোধ হয় নেহাৎই মানুষের ঝুলন। দোলনায় মানুষেরা, নরনারী উভয়ই দোল খেতেন, বিশেষ করে শিশুদেরকে দোল দেওয়া হত তাদের আন্দন্দ দেওয়ার জন্যই। হয়তো তারই প্রকাশ পরবর্তী সাহিত্যে। বালকৃষ্ণ বা বালগোপালকে দোলও দিতেন মা যশোদা। তারপরের পর্বে আর শুধু বালগোপাল নন, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের যৌবনলীলার সহচরী রাধাও উঠে এলেন সেই দোলনায় এবং একাদশ শতকের আগেই রাধাকৃষ্ণের ঝুলনলীলা ভারতবর্ষের অন্যতম ধর্মোৎসবে পরিগণিত হইয়া গেল।  অল্-বেরুণীর সাক্ষ্যে মনে হয়, এই উৎসব অনুষ্ঠিত হত চৈত্রমাসে; গরুড়-পুরাণ এবং পদ্ম-পুরাণের সাক্ষ্যও তাই। পরবর্তী কোনও সময়ে এই উৎসব ফাল্গুনী পূর্ণিমাতে এগিয়ে আসে(পদ্ম-পুরাণ, পাতালখণ্ড এবং স্কন্দপুরাণ, উৎকলখণ্ড দ্রষ্টব্য) এবং হোলির সঙ্গে একাকার হয়ে যায়। দোলনায় রাধাকৃষ্ণকে দুলিয়ে তাদের উপর ফুল, কুমকুম এবং আবীরগোলা জল ছড়ানো হত এবং তাঁহরাও সহচরীদের উপর ফুল, কুমকুম ইত্যাদি ছুঁড়ে মারতেন। হোলীর সঙ্গে পিচ্কারী খেলার যোগাযোগ এইভাবেই।

 

দোলের সাথে রাধাকৃষ্ণের সম্পৃক্তকরনের পিছনেও এই ধারণাই প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে। বৈষ্ণব ধর্মের ব্যাপক প্রসারের ফলশ্রুতিতে রাধা ও কৃষ্ণের বসন্তলীলা এবং দোল এখানে সমন্বিত হয়ে গেছে। বাঙ্গালীর যেহেতু কানু বিনে গীত নাইতাই তরুণতরুণীদের মদনোৎসবস্বভাবতই রাধাকৃষ্ণের দোলের ব্যঞ্জনায় বাঙ্গালী সমাজমনে প্রতিভাসিত। এই বৈষ্ণব ভাবানুসঙ্গের কারণেই মদন জনমানসে প্রতিস্থাপিত হয়েছেন স্বয়ং মদনমোহনের দ্বারা। এখানে বলে রাখা ভালো বেশিরভাগ পুরাণে কৃষ্ণের দোলযাত্রার কথা পাওয়া যায় না। অপেক্ষাকৃত অর্বাচীন পদ্মপুরাণে যদিও বা দোলের উল্লেখ পাওয়া যায় তাতে রাধাকৃষ্ণের যুগলমুর্তিতে দোল খাওয়ার কথা অনুপস্থিত। এছাড়াও, বৃহদ্ধর্মপুরাণ নামক উপপুরাণে পুষ্পপরাগ নিক্ষেপ দ্বারা দোলযাত্রা বর্ণিত আছে। কৃষ্ণের এই দোললীলার লোককথার সাথেই সৃষ্টি হোলিকা দানবীর অগ্নিদাহনের পুরাণবৃত্ত; প্রহ্লাদকে কোলে নিয়ে অগ্নিতে প্রবেশ করে তাকে পুড়িয়ে মারতে গিয়ে নিজেই পুড়ে মরেছিল। চাঁচরের সঙ্গে এই লোককথা খাপ খাইয়ে বৈষ্ণব  মাহাত্ম্য প্রচার করা হয়েছে অবশ্যই  রাধাকৃষ্ণের দোললীলার প্রসারের পরিপ্রেক্ষিতে।

 

মদনোৎসবের যে ভাবানুষঙ্গ দোলের মধ্যে সুষ্পষ্ট, ভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যতে তাঁর মধ্যে শিব পার্বতীড় মিলনও অভিব্যঞ্জিত। একই সঙ্গে বৈষ্ণব, শৈব ও শাক্ত- তিনটি প্রধান ধর্মধারা বা কাল্ট এই উৎসবের মধে বিমিশ্রিত হয়েছে। নতুন বছরের আবাহন, ফসল প্রত্যাশা, বাসন্তিক যৌবনোৎসব- কালের নিয়মে এই সব কিছুই দোলও মহোৎসবের মধ্যে লীন হয়ে পরেছে।

 

বস্তুত, ‘দোলযাত্রা বা হোলি'র উৎসব-মুখরতার আবেদন এতোটাই তীব্র যে এঁর অন্তর্নিহিত ধর্মানুষঙ্গটি কালক্রমে গৌণ হয়ে পড়েছে। সম্ভবত, এই উৎসবের সার্থকতা এখানেই যে, ধর্ম-বর্ণ-জাতি-সম্প্রদায়ের বিভেদগুলি সুচারু ভাবে আবীরের রঙে ঢাকা পড়ে। নানান নামে এই উৎসবের বিস্তার গোটা ভারত জুড়েই- বাংলায় যা দোলযাত্রা’, ওড়িশাতে তাই দোলোৎসব’, উত্তর ও মধ্য ভারতে তারই নাম আবার হোলিবা হোরি’, কোঙ্কণ অঞ্চলে শিমাগা’, আবার দক্ষিণ ভারতে তা পরিচিত হয়েছে মদন দহনবা কামায়ননামে। ভিন্নভিন্ন নাম, কিন্তু উৎসবের মুলসুরটি একই- আগুন জ্বালিয়ে কিছু পোড়ানো, রঙ মাখানো, নাচ-গান-আমোদ-প্রমোদ; সঙ্গে নারী-পুরুষের মধ্যে কিছুটা বাধাহীন ঘনিষ্ঠতা। হোলি পার্বণের এই কামায়ন(কামের যাত্রা), শিমাগা(যৌবনোৎসব), মদন দহন, দোল যাত্রা(দোলায় গমনবা মিলন) নামগুলিই এই উৎসবের মুল চরিত্রের নির্দেশক। এই সমস্ত দিকগুলি বিশ্লেষণ করলে আদিম কাল থেকে এই ধরনের বিভিন্ন যেসব উৎসবের প্রচলন পৃথিবীর সর্বত্রই দেখা যায়।

 

ধর্মের ভাবনার কথা সরিয়ে রেখে সমাজ বিজ্ঞানের চোখে দেখলে একে বসন্ত ঋতুর উপলক্ষে আয়োজিত উৎসব বলেই গণ্য করতে হবে। দোল বা হোলির সূচনা একাধারে যেমন কামোৎসবের, তেমনই শষ্যোৎসবের সাথেও সম্পৃক্ত। হোলির আগে অগ্ন্যুৎসব তথা চাঁচর(ন্যাড়াপোড়া, মেড়াপোড়া, হোলিকা দহন ইত্যাদি নামেও পরিচিত) সম্ভবত ফসল উৎসবের দ্যোতক। জীবন্ত মেড়া(ভেড়া) পোড়ানোর রেওয়াজ বর্তমানে লুপ্ত হলেও  মেড়ার প্রতীকী হিসেবে কলাগাছ কিংবা ভেরেণ্ডা গাছ পোড়ানো এখন উত্তর ভারতে প্রচলিত। বঙ্গদেশে চাঁচাড়ি এবং বাঁশের ঘর পোড়ানো, খড়ের ভেড়ার মুর্তি পোড়ানো, মানুষের কুশপুত্তলিকা জ্বালানোর রীতিও কমবেশি দেখা যায়।  এই অগ্নি দাহনের তাৎপর্য কি? মানুষ এবং ভেড়ার প্রতীকী দাহন সম্ভবত শষ্যদেবতার উদ্দেশ্যে বলি নিবেদনের আদিম প্রথার ধারাবাহী। চাঁচরের ছাই শস্যক্ষেত্রে ছড়ালে বা ওই ছাইয়ের কিছুটা ঘরে এনে যত্ন করে রাখলে সারা বছর অন্নাভাব হয়না, এরকম একটি সংস্কার প্রচলিত আছে। সম্ভবত, বন-জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে তা সাফ করে চাষযোগ্য ভুমি তৈরীর প্রাচীন প্রথার উত্তরসুরী হিসেবে এই সংস্কারটি আজও মানুষের মনে রয়ে গিয়েছে।

 

আবার চন্দ্রের মঘা নক্ষত্র থেকে মাঘ মাসের নাম, যেমন ফাল্গুনী থেকে ফাল্গুন। মঘা নক্ষত্র থেকে পূর্ণচন্দ্র ফাল্গুনী নক্ষত্রে গমন করলে চান্দ্র ফাল্গুন মাস শুরু হয়। আর জ্যোতিষে কথিত আছে, মঘা নক্ষত্র সপ্তবিংশতি নক্ষত্রের মধ্যে উজ্জ্বলতম এবং পিতৃগণের দ্যোতক বলে ধরা হয়। উজ্জ্বলতম মঘা থেকে চন্দ্রের এই সংক্রমণের উপলক্ষ্যেই কি এই বহ্নি-উৎসবের আয়োজন? নাকি এটি পিতৃপুরুষদের বাসন্তী আলো দেখানোর উৎসব, কারণ এই অগ্নিকে স্মৃতির একস্থানে দক্ষিণাগ্নি নামে অভিহিত করা হয়েছে। মঘার আকৃতির সঙ্গে মেষের আকৃতির সাযুজ্য আছে। সেজন্য স্মৃতিশাস্ত্রে বহ্ন্যুৎসবের স্তূপে বা ঘরে একটি ক্ষীরময় বা জীবন্ত মেষ রাখার বিধি দৃষ্ট হয়, এই গৃহকে মেষমন্দিরও বলা হয়েছে, মেষ থেকে মেড়াপোড়া শব্দটি এসেছে।

 



কৃষিকেন্দ্রিত সংস্কারের সঙ্গে উর্বরতাকেন্দ্রিক পক্ষান্তরে প্রজননকেন্দ্রিক ধর্মসংস্কারের অন্যতম দিকটিও বিদ্যমান। হোলি উপলক্ষে নারী-পুরুষের হাতে যে ধরনের সামাজিক ছাড়পত্র তুলে দিতে দেখা যায়, তাতে মনে করবার কারণ আছে যে, বসন্ত উৎসব উপলক্ষে নারী-পুরুষের অবাধ যে মেলামেশার রীতি সারা পৃথিবীতেই প্রচলিত, সেই সুপ্রাচীন ঐতিহ্য এখানেও টিকে আছে। হোলির প্রধান দুই রঙ হল লাল ও সবুজ; যা মুলত রক্ত ও সবুজ বাসন্তিকা পাতার বর্ণপ্রতীক। স্পষ্টতই তারূণ্যের এবং যৌবনোৎসবের দ্যোতনা বহন করছে এঁরা। মনোবিজ্ঞানীরা এই দুই রঙকে যথাক্রমে কামনার ব্যঞ্জনাবাহী ও যৌবনের অনুভূতিসঞ্চারী বলে ব্যাখ্যা করেন। রঙ মাখানোও এক ধরণের প্রচ্ছন্ন যৌনাচার হিসেবেই এজন্যে গণ্য করা হয়। ফলত হোলি যে আদিতে প্রাচীন জাতিগোষ্ঠীর  প্রথাসিদ্ধ যৌনাচারভিত্তিক উৎসব, তথা মদনোৎসব এবং উর্বরতা-কেন্দ্রিত ধর্মধারায় সমন্বিত বিবর্তন, তাতে বোধ হয় সন্দেহের কোনো কারণ থাকেনা।




কোকিলের ডাক যেমন বসন্তের আগমনী বার্তা বয়ে আনে, তেমনি লাল পলাশের রঙিন দোলায় নির্ঘণ্ট বাজে বসন্তোৎসবের। ঋতুরাজ বসন্ত। এসময় যেন গাছেদের ইশারার ভাষা বদলে যায়, আগুন ঝরে প্রতিটা দুপুরের ঝাঁ ঝাঁ রোডে, বিকেলে কোন দূর থেকে ভেসে আসে হাওয়া, সন্ধে হলেই কুহুতান বন্ধ করে ঘরে ফেরে কোকিলের দল। তাঁর সাথে একগুচ্ছ মানুষের জীবনে ঢুকে পড়ে অবাধ্য রঙ। বসন্ত আর রঙ- একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। আর বসন্তের রঙ বলতে আমরা বুঝি দোলযাত্রা, যেখানে রাজনীতির বাইরে গিয়ে সমস্ত রঙ শোভা পায় মানুষের শরীরে। মনেও কি রঙ লাগে না? নিশ্চয়ই লাগে। এই মনের রঙকে প্রকৃতির সাথে মিলিয়ে দেখাই হলো দোল উৎসবের সারকথা। এই উৎসব রঙের, এই উৎসব আনন্দের, মানুষের জীবনবোধ থেকে হারিয়ে যাওয়া নবরসের ধারাকে রঙখেলার ফিরিয়ে আনাই এই উৎসবের উপজীব্য।

 



চিত্র সৌজন্যঃ আন্তরজাল থেকে সংগৃহীত 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন