[দ্বিতীয় পর্বের পর…]
৫. চান্দেমা ফতেমা
প্রায় একশো বছর আগের কথা। আলিপুরদুয়ারের এক ছোট্ট গ্রাম ময়রাডাঙ্গা। জনবসতি খুবই কম, হাতে গোনা কয়েকটা মোটে বাড়িঘর। চারপাশে ঘনজঙ্গল, ঝোপঝাড়; লম্বা বিল। সেই জঙ্গলে আবার বাঘের উপদ্রব; তাঁর সাথে আনুষাঙ্গিক ভাবে অন্যান্য হিংস্র জন্তু-জানোয়ার আর সাপখোপ তো আছেই। মোটকথা, বসবাসের একেবারেই অনুপযুক্ত এই ময়রাডাঙ্গা গ্রাম। একদিন এই ময়রাডাঙ্গা গ্রামেই এসে বসতি গড়লেন জনৈক মনমোহন দাস। কিছুটা জঙ্গল পরিষ্কার করে একটা বাসযোগ্য কুঁড়ে বানালেন বটে, কিন্তু সমস্যা হল অন্য জায়গায়। এইরকম একটা ‘পাণ্ডববর্জিত’ গ্রামে তিনি থাকবেন কি করে? এতো দূরে এসে বসতি গড়ে শেষে বাঘের পেটে প্রাণ দিতে হবে? এদিকে এসে যখন পড়েছেন, তখন আর উপায়ও নেই। কি আর করা যাবে, ভয়-আশঙ্কাকে সঙ্গী করেই তাঁর দিন কাটতে লাগলো।
এমনই একদিন রাতে তিনি এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলেন। উনি দেখলেন, ওঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছেম দুটি নারী মূর্তি। তাঁরা যেন যমজ, দুজনেই একইরকম দেখতে, পরনে শাড়ি, আলুলায়িত কেশরাজি, দুজনেই চতুর্ভুজা, ত্রিনয়না এবং দুজনেই সিংহবাহিনী, এক পায়ের উপর আরেক পা তোলা। শুধু পার্থক্যটা তাঁদের গায়ের রঙে, একজন নীলবর্ণা; অপরজন শ্বেতশুভ্রা। মনমোহ দাস বুঝলেন যে, এঁরা কোনো সামান্যা মানবি নন, নিশ্চয় কোনো দেবী। দেবীরা তখন মনমোহন দাসকে আদেশ করলেন,
“আমরা চান্দেমা আর ফতেমা, দুই বোন। তুই আমাদের মূর্তি বানিয় পূজা শুরু কর এই গ্রামে, আমাদের পূজা করলে গ্রামে শান্তি আসবে। হিংস্র জন্তু-জানোয়ারের প্রকোপ থেকে আমরা তোদের রক্ষা করবো। রোগ-ব্যাধী-প্রতিকুলতা, সবই নির্মুল করবো আমরা।”
অতঃপর, স্বপ্নাদেশ শিরোধার্য করে মনমোহন দাস চান্দেমা দেবী আর ফতেমা দেবীর মুর্তি বানিয়ে পূজা শুরু করলেন। সেই থেকেই আলিপুরদুয়ার জেলার ফালাকাটার ময়রাডাঙ্গা গ্রাম পঞ্চায়েতের পশ্চিম যোগেন্দ্রপুরে পূজা পেয়ে আসছেন চান্দেমা আর ফতেমা দেবী। আদ্যন্ত লৌকিক এই দেবীগণ মুলত সেখানকার হিন্দু নমঃশূদ্রদের দ্বারা পূজিত হন, কিন্তু পুজারী ব্রাহ্মণ। ব্যতিক্রমী ভাবে, চান্দেমা হিন্দু এবং ফতেমা মুসলিম।
উপরের গল্প থেকেই জানা যায়, চান্দেমা আর ফতেমা দুই বোন। ফতেমা দেবীর রঙ নীল আর চান্দেমা দেবীর সাদা। তাঁদের মূর্তি দুটিও মোটামুটি একই। অর্থাৎ, ত্রিনয়না, চতুর্ভুজা, সিংহোপরে আসীনা, কিরীটশোভিতা। দেবীর ফতেমার পরনে নীল আর চান্দেমার পরনে লাল শাড়ি। চান্দেমা দেবীর একহাতে জবাফুল, অন্যদিকে ফতেমা কমলা ও হলুদ রঙের একটি ফুল ধরে থাকেন। চান্দেমা আর ফতেমা দেবীর খ্যাতি এতোটাই যে, পশ্চিম যোগেন্দ্রপুরের যে অঞ্চলে তাঁদের পূজা হয় তার নাম চান্দেমা দেবীর নামে চান্দামারী। আর তার ঠিক পাশের অঞ্চলটির নাম ফতেমা দেবীর নামে হয়েছে ফতেমারী।
চান্দেমা আর ফতেমার মন্দির বা থান বলতে একটি টিনের চালের ঘর। ঘরের মধ্যেই মাটির দাওয়াতে মুর্তি স্থাপন করে পূজা করা হয়। প্রতিবছর ভাদ্রমাসের প্রথম অমাবস্যার পরপরই যে নতুন চাঁদ ওঠে পুর্ণিমার আগে, সেই সময়ই দেবী চান্দেমা ও ফতেমার পূজা হয়ে থাকে। বছরে একদিনই এই পূজা হয়, পূজার আগে গ্রামে ঘুরেঘুরে মাগন সংগ্রহ করা হয়। কেউ চাল দেয়, কেউ দেয় ফলমূল, কেউবা সবজি কিংবা টাকা-পয়সাও দান করেন। অসুখবিসুখ, প্রতিকূলতা দেখা দিলে গ্রামবাসীরা পায়রা, পাঁঠা, সোনার টিপ ইত্যাদি দেবীদের কাছে মানত করেন।
ফতেমা ও চান্দেমা
প্রতিবছর নতুন মূর্তি গড়িয়ে দেবীদের পূজা করা হয়। দুই মূর্তির সামনে চারটে করে খুঁটি পুঁতে তার উপর লাল শালু বিছানো হয়। শালুর নীচে করা হয় ঘটস্থাপন। পূজার উপকরণ বলতে আতপচাল, ছোলা, আপেল, আনারস, কলা বা অন্যান্য ফলমূল। এছাড়া ঢাকি লাগে, লাগে কুলো, আলতা, শাঁখা, চুড়ি। আর লাগে এক কল্কে গাঁজা আর দেশি মদ। এই পুজায় রান্না করা ভোগ উৎসর্গের প্রথা নেই, বরং পূজার পরে নৈবেদ্যের শাকসব্জি, চাল, ডাল ইত্যাদি দিয়ে খিঁচুড়ি রান্না করে ভক্তদের দেওয়া হয়। পূজায় উৎসর্গীকৃত দেশি মদও অনেকে প্রসাদ হিসেবে গ্রহণ করেন। এই পূজার মন্ত্র লৌকিক, কোনোরূপ বৈদিক মন্ত্র পাঠ করা হয় না। থানের পূরোহিতরা বংশ পরম্পরায় এই দেবীদের পূজা করে আসছেন। জনশ্রুতি মতে, এই পূজার মন্ত্রও স্বপ্নাদেশপ্রাপ্ত। পূজায় পশুবলি দেওয়া হয়না, কেউ পাঁঠা বা পায়রা মানত করলে সেগুলোকে পূজার সময় দেবীদের উৎসর্গ করে ছেড়ে দেওয়া হয়।
চান্দেমা আর ফতেমা নামে হিন্দু-মুসলিম দুই দেবীর একসাথে পূজা দেখে মনে হয় হিন্দু-মুসলিম সম্ন্বয়ের নজির হিসেবেই এই পূজাটা হয়ে আসছে বহু বছর ধরে। অথবা এটাও ধারণা করা যায়, আদিতে এই অঞ্চলের হিন্দু-মুসলিমদের মিলিত প্রচেষ্টার দ্বারাই এই পূজা প্রাথমিক ভাবে চালু হয়েছিল। তবে বর্তমানে এই অঞ্চলে কোনো মুসলিম পরিবার বসবাস করেননা। সেক্ষেত্রে কিভাবে চান্দেমা এবং ফতেমা নামের হিন্দু আর মুসলিম দুজন দেবী দুই বোন হিসেবে পূজা পেয়ে আসছে, সে ব্যাপারে কোনো তথ্য পাওয়া যায়না। তবে স্বীকার করতে আপত্তি নেই যে, এই পূজা অবশ্যই বহু যুগ ধরে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি আর সমন্বয় বহন করে আসছে।
৬. লোহাসুর
লোহাসুর ( চিত্র সৌজন্যঃ মৃগাঙ্ক চক্রবর্তী)
দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা। স্বর্গ বা মর্ত্য, সর্বত্রই তিনি নির্মাণের দেবতা হিসেবে পরিচিত। জটিল থেকে জটিলতর নির্মানকার্য তাঁর কাছে যেন কোনো ব্যাপারই না। এহেন নির্মাণের দেবতা বিশ্বকর্মার একবার ভীষণ অহঙ্কার হল। দম্ভে যেন মাটিতে পা পড়েনা তাঁর। নিজেই সগর্বে নিজের প্রশংসা করে ঘোষণা করলেন, “এই গোটা ত্রিভুবনে আমার থেকে শ্রেষ্ঠ নির্মাণশিল্পী আর কে আছে?” বিশ্বকর্মার এই আত্মতুষ্টি ক্রমেই বাড়লো বই কমলো না। অহঙ্কার আর শ্রেষ্ঠত্বের মোহে অন্ধ দেবশিল্পী সমস্ত নির্মাণকার্য বন্ধ করে দিলেন। স্বাভাবিক ভাবেই, দেবতাদের মাথায় হাত, নির্মাণ বন্ধ হলে সৃষ্টিকার্য চলবে কি করে! সৃষ্টি বন্ধ হওয়ায় সভ্যতার গতিপথ রুদ্ধ হল, চরাচর ধ্বংসের আশঙ্কা দেখা দিল। দেবগণ বিশ্বকর্মাকে বোঝালেন, কিন্তু আত্মতুষ্ট বিশ্বকর্মা অনড় রইলেন। “আমিই শ্রেষ্ঠ”- এরকম একটা দম্ভ যেন ওনাকে গ্রাস করেছে।
দেবগণের মাথায় চিন্তার ভাঁজ পরলো। এদিকে একটা উপায় না বের করলেই নয়। তাঁরা জরুরী ভিত্তিতে একটি বৈঠক করলেন। অনেক আলাপ-আলোচনার পর তাঁরা এক কঠোর সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন। তাঁরা ঠিক করলেন যে, দাম্ভিক বিশ্বকর্মা যদি কাজ না করতে চান, তাহলে তাঁকে পদচ্যুত করা হবে এবং তাঁর স্থলে অন্য কোনো যোগ্য ব্যক্তিকে দেবশিল্পীর দায়িত্ব দেওয়া হবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। গোটা ত্রিলোকে বিশ্বকর্মার সমান দক্ষ ও ক্ষমতাধর শিল্পীর খোঁজ চালু হল। স্বর্গে খোঁজা হল, মর্ত্যেও খোঁজা হল। শেষে দেবতারা উপস্থিত হলেন পাতাললোকে। পাতালে এসে দেবগণ অবাক হয়ে গেলেন, পাতালনগরীর সৌন্দর্য যেন স্বর্গের অমরাবতীকেও হার মানায়। ঘর, বাড়ি, অট্টালিকা, তোরণ, প্রাচীর এমনকি সামান্য রাস্তাঘাটও যেন শৈল্পিক দিক থেকে নিখুঁত। কেউ যেন হাতের নিপুন আঁচড়ে পাতালনগরীকে ছবির মতো সুন্দর করে গড়ে তুলেছে।
অবশেষে, দেবগণের সাথে সাক্ষাৎ হল সেই শিল্পীর সাথে। সুদর্শন যুবকটির শিল্পনৈপুন্যে দেবগণ মুগ্ধ। তাঁরা যুবকটিকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কী পরিচয় তোমার?”
যুবকটি বললে, “আমি লোহাসুর। পাতাললোকের সমস্ত নির্মাণের দায়দায়িত্ব আমারই কাঁধে। আমিই এখানে সমস্ত নির্মাণ সামলাই।”
দেবগণের সোনায় সোহাগা, এতোদিন ধরে যাকে খুঁজছিলেন, অবশেষে তাঁকে পাওয়া গেছে। লোহাসুরকে তাঁরা দেবশিল্পী হতে অনুরোধ করলেন। তাঁরা বললেন, “শোনো বাপু, যতোদিন না বিশ্বকর্মার অহঙ্কার কমছে, ততোদিন অবধি তোমাকে বিশ্বকর্মার অসম্পূর্ণ নির্মাণ কাজগুলি চালিয়ে যেতে হবে। শুধু তাই নয়, এখন থেকে সমস্ত নির্মাণ কাজের দেখভাল তোমাকেই করতে হবেম যতোদিন না ওই বিশ্বকর্মা ফিরছেন, ততদিন।”
লোহাসুরেরও নিজের প্রতি অহঙ্কার কম ছিলো না। কিন্তু বিশ্বকর্মার পরিণতি দেখে লোহাসুর উপলব্ধি করেন, “আজ বিশ্বকর্মার অহঙ্কারের কারণে, দেবতারা বিশ্বকর্মাকে ত্যাগ করেছেম, এবার যদি আমারও এরকম দম্ভ থাকে, তাহলে অদূর ভবিষ্যতে দেবগণ যে আমাকে ত্যাগ করবেন না, এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই।” লোহাসুর দেবগণকে কথা দেন, “আপনারা চিন্তা করবেন না, আপনারা আমাকে যে গুরুদায়িত্ব দিয়েছেন, আমি আপ্রাণ চেষ্টা করবো তা পালন করার। আমার তরফ থেকে কোনো ত্রুটি হবে না, কথা দিলাম।” অতঃপর লোহাসুর নিষ্ঠাভরে, একাগ্র চিত্তে দেবশিল্পীর দায়িত্ব পালন করে চললেন।
এরই মধ্যে বিশ্বকর্মা নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। নিজের দম্ভের জন্য তিনি দেবগণের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী হলেন। তিনি নিজে আবার দেবশিল্পীর পদে আসীন হতে চাইলে দেবগণ লোহাসুরকে তাঁর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেন। কিন্তু, লোহাসুরের নিষ্ঠা ও কর্মদক্ষতায় দেবগণ মুগ্ধ। প্রসন্ন দেবগণ লোহাসুরকে বরপ্রদান করলেন, “আজ থেকে তুমি মর্ত্যলোকে অন্যান্য দেবতাদের মতোই পূজা পাবে।”
সেই থেকে লোহাসুরের পূজার সূচনা হয়। বর্তমান আলিপুরদুয়ারের কামাখ্যাগুড়ি গ্রামের আদি মা কামাখ্যাধামে তিনি পূজিত হন। মূলত উত্তর বঙ্গের রাভা জনজাতির লোকেরাই এই লোকদেবতার পূজা করেন। লোহাসুরের মুর্তি সুদর্শন, লম্বা চুল, ফর্সা গায়ের রঙ, দ্বিভুজ, দুইহাতেই অস্ত্র ধরা, খালি গা, পড়নে ধুতি। প্রতিবছর নতুন মূর্তি গড়ে তাঁর পূজা হয়। পূজার আগে লাল শালুতে মোড়ানো বাঁশ মন্ত্র পড়ে জাগিয়ে তুলে, সেগুলোকে লোহাসুরের থানের সামনে পুঁতে রাখা হয়। তারপর পূজার আগে পাঁচদিন ওই বাঁশ নিয়ে বাড়ি-বাড়ি, বাজার, হাটে বাজনা বাজিয়ে নাচতে নাচতে মাগন বাঁ পূজার সামগ্রী সংগ্রহ করা হয়। প্রতি বছর ১১ই আষাঢ় আমাতির সময় লোহাসুরের বাৎসরিক পূজা হয়। এছাড়া, নিত্যপূজারও চল আছে, সন্ধ্যেবেলা আরতিও হয়। পূজার পুরোহিতও রাভা সম্প্রদায়ের লোক, তাঁকে বলা হয় ‘দেউসী’।
লোহাসুর কারো উপর অসন্তুষ্ট হলে, ওই ব্যক্তিকে আক্রমণ করে। আক্রান্ত ব্যক্তির সারা শরীরে ফোসকা পড়ে, এছাড়া প্রচণ্ড ব্যাথা হয়, শরীর অবশ হয়ে যায়। কখনো কখনো শরীর লোহার মতো শীতল হয়ে যায়। তখন আক্রান্ত ব্যক্তি সমেত লোহাসুরের থানে হাসির হয়ে লোহাসুরের কাছে মাওনত করতে হয়। লোহাসুরকে পূজা দিতে গেলে দই, চিঁড়ে, গুঁড় আর বীজকলা দেওয়া আবশ্যক। কলাটাকে শীষসমেত গোটা ছুলে দিতে হয় ঠাকুরের সামনে। এছাড়া পূজায় একোটা লাল নিশান লাগে। পূজায় বলির প্রচলন নেই। আক্রান্ত ব্যক্তিকে পূজারী বিষ ঢেকিয়া, নিমপাতা দিয়ে মন্ত্র পড়ে ঝাড়ফুঁক করেন এতেই নাকি লোহাসুরের প্রকোপ থেকে আক্রান্ত ব্যক্তি নিস্তার পায়।
তবে, লোহাসুরের কিংবদন্তি শুধু বঙ্গদেশেই প্রচলিত নয়। মধ্যপ্রদেশের লোহাপুরের লোককথাতেও আমরা লোহাসুরের খোঁজ পাই। জনশ্রুতি আছে, লোহাসুরের নামানুসারেই অঞ্চলটির নাম হয়েছে লোহাপুর। সেই লোককথা অনুসারে, স্বয়ং বিশ্বকর্মা লোহার টুকরো থেকে এক শিশুমূর্তি প্রস্তুত করেন। বিশ্বকর্মার অনুরোধে দেবতা ঝুলেলাল মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন। এদিকে, লোহাসুরের অনুনয়ে ঝুলেলাল তাঁকে অমরত্ব প্রদান করতে গেলে, দেবরাজ ইন্দ্র তাঁতে বাধা দেন। লোহাসুর শেষে দেবী নর্মদার শরণ নিলে, দেবীর বরে তিনি অমরত্ব পান। অতঃপর, বিশ্বকর্মা মনুষ্যজাতীকে লোহার ব্যবহার শেখানোর দায়িত্ব দেন লোহাসুরকে। লোহাসুর তখন মধ্যপ্রদেশের অন্নুপুর গ্রামের মানুষদের লোহার ব্যবহার শেখান। এই অন্নুপুরের নামই পরবর্তিতে লোহাপুরে পরিবর্তিত হয়।
হিমাচল প্রদেশের লোককথাতেও আমরা এই লোহাসুরের উল্লেখ পাই। তবে, এই লোককথায় লোহাসুর অত্যাচারী হিসেবে আমাদের কাছে ধরা দেন। নন্দাদেবী এই লোহাসুরকে বধ করেন। কথিত আছে, যুদ্ধরত লোহাসুরের শরীরে নন্দাদেবী অলকানন্দার জল ছিঁটিয়ে দিলে, তাতে লোহাসুরের লোহার শরীরে মরচে বা ‘জং’ ধরে তাঁর মৃত্যু ঘটে। হিমাচলপ্রদেশের যেখানে লোহাসুরকে দেবী বধ করেন, সেই স্থানের নাম হয় ‘লোহাজং’।
লোহাসুর যেই হোক না কেন, একই লৌকিক দেবতাকে ঘিরে তিনটি পৃথক স্থানে তিনটি মিথ। অথচ প্রত্যকেটিই লৌকিক উপাদানে পুষ্ট। তবে একথা অনস্বীকার্য যে, লোহাসুরের বেশিরভাগ লোককথার সাথেই কোনো না কোনো ভাবে বিশ্বকর্মা জড়িত। এর থেকে ধারণা করা যেতেই পারে, অতীতে প্রান্তিক সম্প্রদায়ের মানুষদের কাছে কোনো সময় দেবতা বিশ্বকর্মার সমপারদর্শিতা সম্পন্ন, সমক্ষমতাযুক্ত বিকল্প দেবতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন এই লোহাসুর।
৭. সুন্দরমালা
এই গল্পের ঘটনা সত্যযুগের। মহাদেব শিব প্রায়ই দেবী পার্বতীর অজান্তেই বোরোদের ঘরে ভাঙ খেতে আসতেন। বোরো জনজাতির মহিলারা পরম যত্নে মহাদেবকে ভাঙ তৈরি করে দিত। তা একসময় এইখবর দেবী পার্বতীর কানে পৌঁছায়। নিজের স্বামী অন্য মহিলার ঘরে ভাঙ খেতে যায়, এই কথা শুনে রেগে আগুন হয়ে যান পার্বতী। ক্রুদ্ধ পার্বতী সটান ভলে যান বোরোদের গ্রামে। মহাদেব হাতেনাতে ধরা পরলেন। কিন্তু মহাদেবকে পার্বতী নিয়ে যেতে চাইলে বোরো মহিলাদের সাথে তাঁর তুমুল ঝগড়া লাগে। ক্রুদ্ধা পার্বতী তখন রেগে গিয়ে তাঁদের অভিশাপ দিলেন, “এতো বড়ো স্পর্ধা তোমাদের! তোমরা নিজেদের সৌন্দর্য নিয়ে গর্ব করো! আমার স্বামীকে রূপের মোহে ভুলিয়ে ভালিয়ে ভাঙ খেতে নিয়ে আসো! তোমাদের এই রূপ, এই সৌন্দর্য আমি নষ্ট করে দেব।” এই বলে পার্বতী রাগের মাথায় পদাঘাত করে বোরো মহিলাদের নাক ভোঁতা করে দেন।
এদিকে পার্বতী মহাদেবকে নিয়ে কৈলাসে ফিরলেন বটে, কিন্তু নিজের স্বামীর অন্য মহিলার হাতে ভাঙ খাওয়ার ব্যাপারটা কিছুতেই মন থেকে মানতে পারলেন না। দেবী পার্বতীর এই হিংসা থেকেই তাঁর ভেতর থেকে জন্ম হয় এক দেবীর। এই দেবীই হলেন সুন্দরমালা।
উত্তরবঙ্গের কোচবিহারের রাভা সম্প্রদায়ের লোকেদের মধে সুন্দরমালার পূজার চল আছে। দেবীর মূর্তি গড়িয়ে পূজা হয়না। পূজার সময় একটা কলাপাতায় সুন্দরমালার মুখ আঁকতে হয়। মুখ বলতে একটা অপরূপ সুন্দরী মুখাবয়ব, নাকে নোলক, গলায় মালা। এই আঁকা ছবিকেই দেবী সুন্দরমালা হিসেবে পূজা করা হয়। দেবীকে সধবা হিসেবে কল্পনা করা হয়। পূজার উপকরণ হিসেবে কলার ঝুঁকি, ঘট, সুপারি, পান, আমে পল্লব, লাল শালু আর ডাব। এছাড়া লাগে পাঁচরকম ফল, দুধ, কলা, চিনি, দুটো বাতি, ধুপধুনো, একটা কাঁচি আর একটা কালো কচু। তান্ত্রিক ওঝা পূজা করেন, সমগ্র পূজাই তান্ত্রিক মতে সম্পন্ন হয়।
সুন্দরমালার কোনোরকম নিত্যপূজা হয়না, আলাদা করে কোনো থান বা মূর্তিও নেই। কেবল প্রায়শ্চিত্ত করতেই তাঁর পূজা করা হয়। বাড়ির বাইরে তাঁর পূজা করা হয়। সুন্দরমালার গলার মালাটি হল আসলে ফাঁস। কেউ যদি ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করতে যায়, কিংবা গলায় দড়ি দেয়, অথচ আত্মহত্যা করতে বিফল হয়, এক্ষেত্রে সেই ব্যক্তির উপর সুন্দরমালার ভর হয়। সুন্দরমালা তখনো সেই ব্যক্তির সামনে অপরূপ নারীবেশে আসে। এসে মিষ্টি গলায় বলে, “আয়… তোকে মালা পড়িয়ে দেই…”। খবরদার। এই মালাই আসলে গলার ফাঁস। সুন্দরমালার মিষ্টি কথায় ভুলে কেউ যদি তাঁর ফাঁদে পা দেয়, তাহলে সেই ব্যক্তির তৎক্ষণাৎ মৃত্যু ঘটে। ফাঁসি দিয়েও যদি তাঁর মৃত্যু না হয়, সেক্ষেত্রে সুন্দরমালা তাঁকে ক্রমাগত আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেয়। সেই ব্যক্তির চেনাপরিচিত কোনো মানুষ। যেমন তাঁর প্রেমিকা, স্ত্রী, বান্ধবী বাঁ অন্য কোনো দেনা মুষের ছদ্মবেশে ওই ব্যক্তির সামনে ভুলিয়ে ভালিয়ে বলবে, “আয়… বরং একসাথে মরি…কীরে…মরবি না আমার সাথে?”
অনেকেই তখন চেনা মানুষের মুখ দেখে ফাঁদে পা দেয়। ব্যাস, তারপরেই ঘটে সর্বনাশ। কিন্তু কেউ যদি ফাঁদ বুঝে না এগিয়ে, সুন্দরমালার উদ্দেশ্যে প্রণাম করে, তাহলে সুন্দরমালা সেই ব্যক্তিকে তখনকার মতো রেহাই দেয়। এমনকি কোনো ব্যক্তি যদি মনে মনে অবসাদে ভোগে, তাহলেও সে সুন্দরমালার কবলে পড়ে। তবে সুন্দরমালা কখনই পুরুষের বেশে আসেনা, সবসময় নারীবেশেই আক্রান্ত ব্যক্তির সামনে দেখা দেয়।
রাভাদের সমাজে তাই কেউ মজাচ্ছলেও যদি গলায় কাপড় প্যাঁচায়, তাহলে বাড়ির বড়োরা তাঁকে বকাঝকা করে। স্থানীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, কারো উপর সুন্দরমালা ভর করলে, তখনো সেই ব্যক্তিকে ওঝা দিয়ে সুন্দরমালার পূজা করে প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। এই প্রায়শ্চিত্তের উদ্দেশ্য হলো সুন্দরমালার সাথে ওই ব্যক্তির যাবতীয় সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা। পূজার সময় আক্রান্ত ব্যক্তির দুই পায়ের মাঝে একটা কালো কচু চাপা দিয়ে রাখতে হয়। তারপর পূজান্তে, তান্ত্রিক কাঁচি দিয়ে কচুটা কেটে ফেলেন। কাঁচি দিয়ে কচু কাটা আসলে সুন্দরমালার সাথে আক্রান্ত ব্যক্তির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার প্রতীকী। পূজায় কোনো বৈদিক মন্ত্র পাঠ হয়না।
তবে যদি বাড়াবাড়ি হয়ে যায় কিংবা প্রায়শ্চিত্তে বিলব হয়ে যায়, সেক্ষেত্রে সুন্দরমালার উদ্দেশ্যে পাঁঠা বাঁ পায়রা বলি দেওয়ার চলও আছে, আদতে জীবের বদলে জীব উৎসর্গ করেই আক্রান্ত ব্যক্তি সুন্দরমালার কবল থেকে রেহাই পায়।
লৌকিক দেবদেবীদের ঘিরে তৈরী হওয়া লোককাহিনি বড়োই অদ্ভুত। লৌজিজ জনশ্রুতি, লোকগাথায় যেমন আমাদের চেনা দেবিদেবীরা একাধারে ভিন্ন রূপ নিয়েছেন, এমনই তাঁদের ঘিরে তৈরী হয়েছে এখাধিক সব ব্যতিক্রমী সব ঘটনা। সেই ঘটনার সাথে আমাদের চিরপরিচিত পুরাণের ঘটনাবলির কোনো মিল নেই, সংযোগ নেই। এগুলো একান্তই অঞ্চলবিশেষে তৈরী হওয়া লোকপুরাণ। এখানে লোকদেবতারা, বিভিন্ন অপদেবতা আর উপদেবতাদের সাথে সহাবস্থান করে, এখানে স্বর্গের দেবদেবীরা আমাদের চেনাপরিচিত রূপের বাইরে গিয়ে আমাদের মটঈ জীবনযাপন করে। আমাদের নিত্যদিনের দারিদ্র, জীবন সংগ্রাম, বেঁচে থাকার লড়াই, প্রেম-ভালোবাসা, পরকীয়া, সাংসারিক জটিলতা দেবদেবীদের নিয়ে তৈরি হওয়া লৌকিক কাহিনীগুলিতে ভালো ভাবেই দেখা যায়। তাঁরা যেন এখানে আমাদের ঘরের পাশের মানুষ। লোক কাহিনীতে দেবতা আর মানুষের সহাবস্থানের ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য সত্যিই দৃষ্টিনন্দন হয়ে ধরা দেয়।
[অলমিতি]
তথ্যসূত্রঃ-
বাংলার দেবতা, অপদেবতা ও লোকদেবতা – মৃগাঙ্ক চক্রবর্তী
বাংলার বিচিত্র দেবদেবী – মৃগাঙ্ক চক্রবর্তী
বাংলার লৌকিক দেবতা – গোপেন্দ্রকৃষ্ণ বসু
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন