মেট্রোর আগন্তুক - সুকন্যা মজুমদার

  


মেট্রোতে দু-দুটো কাঁচের ব্যবধান ভেদ করে দরজার ওপাশের সিটে বসে থাকা যাত্রীটিকে ভালো করে চাক্ষুষ পর্যবেক্ষণ করে নিলাম । তার পরনে আবছা নীল রঙের শার্ট, কাঁধে কালো ব্যাগ । কিছুটা অবিন্যস্ত, রুক্ষ, বাদামি চুল তার, চুলের বেড়াজাল ভেদ করে তার মুখ স্পষ্টভাবে দেখাই যাচ্ছে না। হয়তো সে আমার মতোই অন্তর্মুখী স্বভাবের, তাই একমাথা চুলের আড়ালে নিজেকে ঢেকে রাখতে পছন্দ করে । রাসবিহারী মোড়ে নেমে আমি কালীঘাট স্টেশনে মেট্রোতে উঠেছি - আমার গন্তব্য কবি সুভাষ মেট্রো স্টেশন । যাচ্ছি এক বিশেষ কাজে । দেখতে দেখতে এক একটা স্টেশন পেরিয়ে যাচ্ছে - ট্রেন খালি হচ্ছে ধীরে ধীরে । আমার আবার মনে পড়লো দরজার ওপাশের সিটে বসা সহযাত্রীর কথা - সে কি এখনো আছে নাকি নেমে গেছে ? হয়তো বা সে আমার মতোই নীরবে, নিভৃতে থাকতে চাওয়া মানুষ - একথা ভেবেই আমি আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম, সে এখনো তার অবস্থানেই রয়েছেভারি অবাক লাগলো । গীতাঞ্জলি স্টেশন পেরিয়ে এখন ট্রেন প্রায় ফাঁকা হয়ে এসেছে, তবুও সে নিবিড় মনোযোগ সহকারে স্বস্থানে বসে - ট্রেনের বাকি কয়েকজনের প্রতি তার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই । বর্তমান যুগে মোবাইল ফোন এসে মানুষের ধ্যান-জ্ঞ্যান সমস্ত কিছু গ্ৰাস করেছে - কিন্তু নাহ ! তার হাতে মোবাইল ফোনও নেই । তবে কীসের ধ্যানে এতো নিমগ্ন সে? আপন মনে, আপন চিন্তায় একাকী ! 

আবার আমার সহযাত্রীর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দেখলাম । কাঁধে ঝোলানো কালো ব্যাগটা সে তার হাতে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে । সামনে আর কয়েকটা মাত্র স্টেশন - সে কোন স্টেশনে নামবে কে জানে ! নাকি যোগনিদ্রারত যোগীর মতো মেট্রো ট্রেনের কামরায় বসে থাকবে নিশ্চল, নীরব ! 

অন্যান্য সময়ে আমি সচরাচর আমার মেট্রোর সহযাত্রীদের প্রতি দৃকপাত করি । নিজের আপন‌ খেয়ালে থাকি অথবা ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি । কিন্তু আজ মেট্রোর এই আগন্তুক আমার কাছে বিশেষ কৌতুহলের । এমন শান্ত, নিশ্চল, রহস্যময় সহযাত্রী আমার প্রথম দেখা । তাই তাকে ভালোভাবে দেখতে প্রাণ যেন আরও উদগ্ৰীব হয়ে উঠেছে । 

শহীদ ক্ষুদিরাম মেট্রো স্টেশন পেরিয়ে গেলো, আসছে কবি সুভাষ । দু'জোড়া মোটা কাঁচ আর একটা দরজার ব্যবধানে আমার সহযাত্রী এখনো ঠায় বসে । এবার আর এদিক-সেদিক না ভেবে সটান ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম তার দিকে । আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, সে-ও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আমার দিকে ! আমি তার দিকে তাকানোতে সে কোনো অস্বস্তি বোধ করছে না, বরং তার দৃষ্টি স্থায়ী আমার মুখের ওপর । এবং তার পরনে সেই একই নীল শার্ট, যা আমি পরে আছি ! হাতে আমারই কালো ব্যাগ ! বিস্ফারিত চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলাম । 

কবি সুভাষ আসছে । নামবো বলে উঠে দাঁড়ালাম । পিছন ফিরে দেখলাম, আমার সহযাত্রীর অস্তিত্বের চিহ্নমাত্র নেই ! 



চিত্র সৌজন্যঃ আন্তর্জাল

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন