উঠোনের নৈঋতকোণে একটানা বিচ্ছিরিভাবে ডেকে চলেছে দাঁড়কাকটা সকালের নরম রোদটাও যেন চোখে জ্বালা ধরাচ্ছে। বড় আনচান করছে মনটা। একবার ঘরে, একবার বাইরে হানটান করছে পারুলবালা। কোথাও তিষ্ঠোতে পারছে না। কাল রাত থেকে বাড়ি ফেরেনি ছেলেটা। সারারাত ভাত আগলে বসেছিল সে। ভোরবেলায় চোখটা একটু লেগে এসেছিল। ঘুম ভাঙলো হারুনের মায়ের বাজখাঁই আওয়াজে।
- ‘আ মলো যা! অ বৌ তুই ঘরদোর আলগা রেখে অমন চড়বড়ানি বেলায় বসে বসে ঢুলতাছিস ক্যান?’
- ‘দাদাবাবু ও দাদাবাবু দরজাটা খুলবেনি?’
অনেকক্ষণ ধরে দরজা ধাক্কানোর শব্দে চোখ মেলে তাকালো শাক্য। শাক্যজিত বোস। দুর্গাপুর শহরের নামী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্র। ঝিমধরা মাথা নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। ঘরের ছয়-সাতের ডিভানে তখনও ঘুমন্ত ইন্দ্র, অর্ক, আর আদিত্যরা। কাল সারারাত পার্টি করেছে তারা। বিছানার কাছেই সেন্টার টেবিলটাতে আধ খাওয়া প্লেট, ছিপি খোলা স্কচের বোতল, আর অর্ধসমাপ্ত গ্লাস তাদের নৈশ অ্যাডভেঞ্চারের সাক্ষ্য দিচ্ছে।
মাঝগগনের সূর্যটা চোখ রাঙ্গাচ্ছে খুব। কাঠের জালের উনুন থেকে ভাতটা নামিয়ে কড়াই চড়িয়ে দিল পারুলবালা। একটু নুন-হলুদ আর জল দিয়ে মাসকলায়ের ডালটা সেদ্ধ হতে বসিয়ে দিল। এই চৈত্রের খরানীর দিনে আদা- মৌরি ফোড়ন দিয়ে নামানো কলাইয়ের ডাল ‘লাড়’ ঠান্ডা করে; বলতো তার শাউড়ি মা। এর সঙ্গে একটু ঝিরিঝিরি আলু ভাজা হলেই হাসিমুখে একথালা ভাত খেয়ে নিত তার স্বামী-ছেলে-মেয়েরা। আজ ডাল রাঁধতে বসে বড় মনে পড়ছে তাদের মুখগুলো পারুলবালার। মাস তিনেক হলো বাড়ির মানুষটা ভিনরাজ্যে মজদুরের কাজে গিয়েছে। মেয়েটা পাশের গাঁয়ে প্রেমের বিয়ের জোয়াল টানছে। বুকজুড়ে আছে কেবল ছেলেটুকু। সরকারি স্কুলে নাম লেখানো আছে বটে, তবে অল্প বয়স থেকেই তাকে টাকার নেশায় পেয়েছে ।
- ‘দিবাকর!ও দিবাকর! শাক্যকে একবার ডাকো তো !’
লং-ড্রাইভ থেকে ফিরে ফ্রেশ হয়ে লিভিং রুমে এসে বসেছেন মিস্টার এন্ড মিসেস বোস। প্রতিষ্ঠিত ডাক্তার দুজনেই। ক’দিনের ছুটিতে শান্তিনিকেতন গিয়েছিলেন বসন্ত উৎসব দেখতে। ছেলেকেও সঙ্গে নিতে চেয়েছিলেন। তবে রাজি হয়নি সে।
- ‘শাক্যবাবা তো বাড়িতে নেই’-উত্তর দিল গৃহভৃত্য। ‘এইতো বিকেল বিকেল চান খাওয়া সেরে বন্ধুদের নিয়ে বাইরে বেরোলো।‘
- ‘সেকি! এই অবেলায় চান খাওয়া কেন?’
দিবাকরের দিকে প্রশ্নটা ছুড়ে দিলেন মিস্টার বোস। গত দু’দিনে শাক্যর বিশৃংখল জীবনযাপনের কাহিনী আর গোপন রাখলো না দিবাকর। দিনের আলো ফুরিয়ে এসেছে প্রায়। রাস্তার স্ট্রিটলাইটগুলো একে একে জ্বলে উঠলো। অথচ ডাক্তারদম্পতির মুখে তখন কে যেন একপোচ কালি ঢেলে দিয়েছে !
ছ্যাঁক করে শব্দ উঠল কড়াইতে। আদা-মৌরি সম্বর দিয়ে আরো একবার সেদ্ধ ডালটা চড়িয়ে দিল উনুনে পারুলবালা।
- ‘বাড়িতে কে আছেন?একটু বাইরে আসুন।‘
অপরিচিত কন্ঠস্বর শুনে বেরিয়ে এলো পারুলবালা। খাঁকি পোশাক পরা পুলিশবাবু দাওয়ার সামনে এসে দাঁড়ালেন। একটা মানিব্যাগ ও ফটোগ্রাফ বার করে এগিয়ে দিলেন তার দিকে। চমকে উঠলো সে । চোখের তারায় ফুটে উঠলো আতঙ্ক। পুলিশ বাবুটি যেন নিশ্চিন্ত হলেন খানিক।
জিজ্ঞাসা করলেন ‘আপনারই ছেলে তো?’ কোনক্রমে ঘাড় নাড়লো পারুলবালা।
- ‘এখন তবে একবার হাসপাতালে যেতে হবে আপনাকে। জেলা সদর হাসপাতাল। শরীরে অসংখ্য কাচের টুকরো বিঁধে গুরুতর জখম অবস্থায় আজ সকালে আপনার ছেলেকে ভর্তি করানো হয়েছে সেখানে।‘
আতঙ্কে উৎকণ্ঠায় তার তখন মূর্ছা যাওয়ার অবস্থা। হাত পা অবশ হয়ে আসছে। চোখের সামনে ভেসে উঠছে গতকাল দুপুরে দু’মুঠো মুখে দিয়ে সাইকেল চেপে বেরিয়ে যাওয়া ছেলেটার মুখটা।
- ‘আসুন আমার সঙ্গে’, বলে উঠলেন পুলিশ বাবুটি। ‘কাল রাতে পুলিশের তাড়া খেয়ে ছুটে পাঁচিল টপকে পালিয়ে যাওয়ার সময় এই বিপদ নিজেই বাঁধিয়েছে আপনার ছেলে। ওর কাছ থেকে কিছু গাঁজার প্যাকেট ও চোলাই মদের বোতল পাওয়া গেছে। এটা পুলিশ কেস।‘
একনাগাড়ে কথাগুলি বলে গেলেন খাকি বরদি। পুলিশ ভ্যানে চেপে বসল পারুলবালা। নিমজালে বসানো সম্বর দেওয়া ডালটা তখন জল শুকিয়ে পুড়তে লেগেছে। সারা পাড়া ছড়িয়ে পড়ছে সেই তিক্ত কটু গন্ধ।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন