মরা জীবন আর স্বপ্ন প্রেম - প্রদীপ দে



পুকুরটি বহুদিন ধরে পরিস্কার করা হয় নি। তিনধারের বিস্তীর্ণ বাঁশ জঙ্গলে চতুর্দিক অন্ধকারে। গাছের পাতা জলে পড়ে পচে মরে, আর গভীরে নাব্যতা কমিয়ে দিয়েছে। জলের রঙ একেবারে কালছে সবুজ। পানা আর শ্যাওলা আঁকড়ে ধরেছে ওকে আষ্টেপৃষ্টে

বকাই একপাড়ে বসে থাকে। দেখে আর ভাবে, তার বুড়ি মা ও ঠিক এইভাবে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে রেখেছে। জীবন তার দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে অথচ কিছু করার নেই। ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়েছিল। মাই ছিল জীবনের জ্যান্ত পিলার বা থা; যাকে জড়িয়ে ধরেই তার তরতর করে না হলেও ধীরগতিতে বেড়ে ওঠা

পরিণত যুব বয়সে প্রেম শুরু হয়েছিল। জোয়ারের ঢেউ লাগার আগেই ভাটার টানে তা ফিরে গিয়েছে।  ভালোবাসা মরে গেছে। প্রেমিকা সুবি বকাইয়ের জীবন থেকে সরে গিয়ে ভিনদেশি অন্য কোন যুবকের বুকে গিয়ে উঠেছে। সবই ভবিতব্য। সব প্রেমের পরিণতি হয় না। বকাই আর সুবিরও হয় নি

বাপের যেটুকু জমি অবশিষ্ট ছিল তাতেই লাঙল টানা, তবে বাপ ঠাকুর্দার রেখে যাওয়া চাষের জমিজমা খুব কম ছিল না। এরকম ভাবেই মা আর পুত্রের সংসার চলছিল। চলতে চলতে বয়সও তার থেমে থাকে নি। মা চলে গেলে কি হত জানা নেই, কিন্ত এই ব্যবস্থায় তার আর বিয়ে করা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। তারপর থেকে জীবন নদী প্রতিকূল স্রোতে বয়ে চলে তার

গ্রাম বীরভূমের সিউড়ি। ময়ুরাক্ষী নদীর ধারে। এখানের তিলপাড়া বাঁধের জন্য সেচের কাজে জল পাওয়া যায়। বকাই তার জমিতে অন্য চাষের সঙ্গে সঙ্গে তুলো আর রেশমের চাষও করে। কিছু লোকও তার সঙ্গে কাজ করে

বকাই কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিল। গ্রীষ্ম বর্ষা শীত … এই এইরকম করে ছয়টি ঋতু শেষ হয়ে বছর কাটে বকাইয়ের। নিজের পানে চেয়ে দেখা হয় না তার। তা হোক নিজের নিয়েই কেটে যাচ্ছিল হঠাৎই সমস্যা বেড়ে গেল মায়ের অসুস্থতা। রাতে বাথরুমে যেতে গিয়ে সেই যে পড়ে গেল,  আর উঠে দাঁড়াতে পারলো না, ডান দিক পক্ষাঘাত হয়ে বিছানায় পড়ে গেল। এ খুবই বেদনাদায়ক। ডাক্তার বেদনাহত হয়ে তখনি বলেছিল বয়স্ক মানুষ, বিছানা নিয়ে নিলেই বিপদ। যারা কাছের লোক থাকে তাদেরই বড় বিপদ। শুনতে বা বলতে খারাপ লাগলেও ঘটনা যেটা সত্যি তা হল মরণ। এক্ষেত্রে মৃত্যুই বেশি কাম্য। কিন্তু সেটাতো মানুষের হাতের মধ্যে নেই। তাই এই বিধাতার এই অভিশাপ মেনে নিতেই হবে

শুরু হলো বকাইয়ের জীবনে অন্য আর এক পথ চলা এবার আর সে একা নয় অন্যজনকে টেনে নিয়ে চলা যে প্রথমে প্রথমে মায়ার কারণ হয়েও কিছুদিনের মধ্যেই জ্বালা যন্ত্রনার কারণ হয়ে উঠলো। সব সময় মাকে দেওয়া। সেই ভোর থেকে মাকে প্রাত্যহিক সব কাজ করিয়ে দেওয়ার থেকে রাত্রিকালীন দেখভাল পর্যন্ত।  এদের আবার ঘুমও যেন অনেক হ্রাস পেয়ে পেয়ে বাঁচার ইচ্ছা দ্বিগুণ হয়ে যায়। আর সেই যন্ত্রনার মধ্যে থেকে বাঁচিয়ে রাখার সব দায়িত্ব গিয়ে বর্তায় তার এক ছেলে বকাইয়ের উপর। মাও যে কেমন বদলে যায়। চাওয়াগুলো জেদে পরিণত হয়ে ওঠে। ছেলে কে করবে না তার জবাবদিহি চায় যেন। রাগ অভিমান বেড়ে যায়। ছেলে বকাইয়ের কষ্টের কথা বেমালুম ভুলে যায়। এটাই এই রোগের প্রধান উপসর্গ

এরকম ভাবে কেটে যায় দিন তারিখ। দিন আসে রাতের তাড়ায়। তাড়াহুড়া করে রাতও চলে যায়। বকাই বসে থাকে একই তিমিরে। এগোনোর জন্য নয় বেঁচে থাকার জন্য এ এমন ভাবে বেঁচে থাকা - যাকে বলে মরে গিয়েও না মরা

বকাই শুধু পুরোনো স্মৃতি ভাবে আর স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন দেখতে সে ভালোবাসে এটাই তার কাছে জীবন আর ভাল করে বাঁচার এক রসদ!

সুবি গ্রামে ফিরে এসেছে সবেমাত্র কদিন হয়েছে

এবারে একেবারে সব মিটিয়ে সব চুকিয়ে। স্বামী মরে যেতেই লম্পট দেওর মেরেধরে বার করে দিয়েছে। গ্রামের পঞ্চায়েত যে ওর হাতেই ধরা। ক্ষমতা নিয়ম বানায় আবার ভাঙ্গে। তবে তার আগে কায়দা করে সুবিকে কাজে লাগিয়ে ওর মাথায় কলঙ্কের টিকা পরিয়ে দেয়। সুবির পিতামাতা আত্মীয় কেউ না থাকায় প্রতিবাদও জমেনি। একা বেঁচে থাকাই বড় লড়াই এক্ষেত্রে

বকাই সুবিকে দেখে ফেলে। সুবি নিজেকে লুকাতে চায়। পারে না ধরা পড়ে যায় বকাইয়ের হাতে

-  লুকাস কেনে? 

সুবি আঁচল দিয়ে মুখ লুকায়, সরম লাগে

বকাই অবাক! সে কিরে ক্যানে?

সুবির মুখ কালো, আমি যে বেধবা

বকাই বোঝায়, মরণ কার হাতে রে?

সুবি মুখের আঁচল সরায়, বুঝি নাই

বকাই খপ করে সুবির হাতটা ধরে ফেলে। আকাশে তখন সাদা মেঘমালা তুলোর কারবার সাজিয়ে বসেছে

- একিরে? কেউ যদি দেইখে ল্যায় সুবির মুখ লাল

বকাইয়ের মুখে হাসি - আমার লাজ লাই। আমি তুকে নিয়ে ভালোবাসবে -ঘর বাঁধবে - অনেক আদর দিবে চল মোর সাথ

- তা হয় লারে রে। মুই পরের ছিলেম

- ক্যানে হইবেক না। আমি বাসি জিনিসই ঘরে লিবো - দেখি ক্যামনে লাগে

-  এ ক্যামন লাগবে? বেধবা তার উপরি পুরা রদ্দি

 - ছাড় অই সব চল মোর ঘর

 বকাই সুবিকে হাত ধরে টান মারে। সুবির বয়স বত্রিশ। সে ভাবে, আধ খাওয়া যৌবনের বাকীটুকু বকাই লিতে চায়। সুবি বাঁধ দিতে সাহস লারে। বাকি সোয়াধ তারই বা কিসের?

বকাইয়ের সাথে চলে। মাথার আঁচল খুলে বুক ঘুরিয়ে টাইট করে কোমড়ে বাঁধে। মাথার চুল খুলে দেয়। বকাইয়ের চোখে লাগে। পুরুষোচিত বুক ফুলে ওঠে

মাঠ ঘাঠ পেরিয়ে তার ঘরে ঢোকে। তারপরই সোহাগে জড়িয়ে ধরে সুবিকে। আদরে ভাসিয়ে দেয়। সুবি বাঁধা দেয় না। সেও চায় বকাই তার পুরোনো ভালোবাসার লোক, তাকে সোহাগ দিক। সে পুরোটাই নিতে প্রস্তুত

পাশের ঘরে মায়ের কাছ থেকে অস্ফুট গোঙানি ভেসে আসে। সুবিকে সরিয়ে বকাই ঘরের দিকে এগোয়, সুবি পিছু নেয়। অসাড় দেহে, নিস্পৃহ দৃষ্টি  ওদের জরিপ করে ভাষাহীন ঠোঁটে

বকাই মায়ের মাথায় হাত রাখে - চোখ বুঁজে নেয় নিশ্চল প্রান। সুবি অনায়াসে পাশে এস দাঁড়ায়।  কিছু বোঝানোর নেই অবুঝ হৃদয় অনেক আগেই হৃদয়হীন হয়ে গেছে যে

সুবি বহুদিন বাদ বকাইয়ের মাকে দেখে ডুকরে কেঁদে ওঠে। সেই ক্রন্দন আকাশ বাতাস মুখরিত হয়তো করে না কিন্ত নিষ্প্রাণ দেহে সামান্য বিচ্ছুরিত হয় যেন। বকাইয়ের মা যেন নড়ে ওঠে তারপর নিস্তেজতার চাদরে নিজেকে  মুড়ে নেয়

বকাই চিৎকার করে কাঁদতে চায় কিন্তু পারে না

বহুদিন বাদে আজ মরে যাওয়া ভালোবাসা জন্ম নেয় আর এক জন্মের শেষ হয়!

পুরোনো কথা মনে পড়ে…। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে…। স্বপ্ন ভেঙে যায়……। ঘোর কাটে…। এঁদো পুকুরে পানার শিকড়ে আবার সে জড়িয়ে পড়ে। 

পুকুরটি বহুদিন ধরে পরিষ্কার করা হয় নি। তিনধারের বিস্তীর্ণ বাঁশ জঙ্গলে চতুর্দিক অন্ধকারে। গাছের পাতা জলে পড়ে পচে মরে, আর গভীরে নাব্যতা কমিয়ে দিয়েছে। জলের রঙ একেবারে কালছে সবুজ। পানা আর শ্যাওলা আঁকড়ে ধরেছে ওকে আষ্টেপৃষ্টে

বকাই একপাড়ে বসে থাকে। দেখে আর ভাবে তার বুড়ি মা ও ঠিক এইভাবে তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরে রেখেছে। জীবন তার দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে অথচ কিছু করার নেই

স্বপ্ন আসে আবার ফিরে যায়। সে শুধু বসে থাকে

জীবন একইভাবে প্রবাহিত। তার জীবনও মরা পুকুরের মত, পানা আর শ্যাওলা আবর্তিত। বেড়োনোর সব পথ রুদ্ধ !

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন