গলিটাতে ঢোকার সময়, কেমন যেন একটা গা ছমছমে ভাব লাগলো মোহিনীর, যদিও সে এযুগের আধুনিকতাকে খুব
ভালো ভাবেই রপ্ত করেছে ওসবে, মানে অতীতকে সে একেবারেই
বিশ্বাস করে না। তবুও আজ নিমতলা স্ট্রিটের এই সরু
গলিটাতে ঢুকতে গিয়ে, একটু যেন পিছিয়ে এসেছিল প্রথমে
মোহিনী।
এখনকার এক নামি পত্রিকার সফল রিপোর্টার সে, তার কখনও অসময় বলে কোনও সময় নেই, তাই রাত দশটায় যখন অফিসের সব কাজ শেষে উঠতে যাবে, হঠাৎই সেই সময়েই আসে ফোনটায় !! প্রথমে একটু অবাক হলেও, কথা শেষে ফোনের ওপ্রান্তের অদেখা লোকটি যখন বলল, খবর আছে ম্যাম, চলে আসুন। তখন আর কোনও দ্বিধা করেনি মোহিনী।
- 'ঠিক বেরনোর মুখে শান্তনু বলল, আমি যাবো নাকি তোর সাথে মোহিনীদি?'
- 'আরে না রে শানু।'
- 'অনেকটা রাত হয়ে গেছে রে মোহিনীদি, আর যা ঠিকানা দিয়েছেন ভদ্রলোক!! ঠিক মতো খুঁজে পাবি তো? আমি না হলে তোর - '
শান্তনুর কথা শেষ হওয়ার আগেই, মোহিনী একটু হেসে বলল, 'আরে দূর, আমরা যেই প্রফেশনের, আমাদের কী আর রাতদিন আছে ভাই ! চলে যাবো রে আমি ঠিক মতো, তুই চিন্তা করিস না, তাছাড়া মাসিমার শরীরটাও তো –'
কথাটা শেষ না করেই, 'মাসিমার শরীর কেমন আছে রে শানু?' বলল মোহিনী।
- 'কী যে হচ্ছে, কিছুই তো বুঝতে পারছি না মোহিনীদি, দিন দিন তো খারাপের দিকেই যাচ্ছে সবকিছু। কে জানে, কোন দিন খারাপ খবর শুনে অফিস থেকে ছুটতে হবে আমাকে।' বলল শান্তনু।
- 'একদিন যাবো তোর বাড়ি, অনেক দিন মাসিমাকে দেখতে যাওয়া হয়নি, আমরা তো আর মানুষ নেই রে শানু, যন্ত্র হয়ে গেছি কেমন যেন সবাই!! এই প্রফেশনে এসে, না করতে পারি ঠিক মতো সংসার, না আত্মীয়স্বজনদের খোঁজ খবর, না মানবতা !! সবই হারিয়ে গেছে আমাদের। মাঝে মাঝে কি মনে হয় জানিস শানু, ছেড়ে দিয়ে নিজের মতো চলি এবার,' বলল মোহিনী। কথা বলতে বলতে হাতের সব কিছু গুছিয়ে রেখে, দুজনে একই সাথে বেরিয়ে এলো অফিস থেকে।
হাত ঘড়িটার দিকে তাকালো একবার মোহিনী, দেখলো রাত প্রায় এগারোটা বাজতে চলেছে। সেটা দেখে শান্তনু বলল, আজ না হয় বাড়ি চলে যা, কাল একটু সকাল সকাল বেড়িয়ে ওখানে চলে যাস মোহিনীদি।
- 'না রে শানু, আজই যেতে বলেছে, খবরটা যদি ভালো হয়, তবে অনিমেষদা আমার প্রমোশনটা আর আটকে রাখতে পারবেন না। দেখছিস তো, এতো করেও কত কথা শুনিয়ে দেন অনিমেষদা আজকাল। আসলে মেয়েদের বাড়িতেও কথা শুনতে হয়, আবার বাইরেও কথা শুনতে হয় রে শানু, তুই বুঝবি না ভাই।' তারপর শানুর দিকে তাকিয়ে বলল, 'আরে তুই আমার সাথে হাঁটছিস কেন? বাড়ি যা শিগগিরি, মাসিমার জন্য মনটা কেমন যেন করছে রে আজ শানু, দেখি কাল অফিস ফেরত তোর সাথে চলে যাবো একবার মাসিমার কাছে - '
এরই মধ্যে শান্তনুর বাস এসে গেলে, বাসে ওঠার মুখে মোহিনীর দিকে তাকিয়ে বলল, 'সাবধানে যাস, বাস না পেলে উবের করে নিস মোহিনীদি। অনেকটা দূর কিন্তু এখান থেকে, আর অসুবিধা হলে ফোন করতে ভুলিস না, সেটা যত রাতই হোক।'
শান্তনু চলে যাবার পর, একা একা স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ মোহিনী। অনেকক্ষণ কোনও বাস আসার নাম গন্ধ নেই। একে তো এবার জমিয়ে শীত পড়েছে, তার উপর কুয়াশার কারণে কিছুই ঠিকঠাক দেখা যাচ্ছে না। আর দাঁড়িয়ে থাকা ঠিক হবে না ভেবে, উবের ডেকে উঠে বসলো মোহিনী। উবেরের চালক ছেলেটির অনেক কম বয়স, 'বলল দিদি ওখানে কেন যাবেন, কেউ মারা গেছেন? '
- 'কেন?' বলল মোহিনী।
খানিক চুপ করে থেকে বলল, 'আসলে ঐ রাস্তার অনেক বদনাম দিদি, কেউ একা যায় না, তাই বললাম।'
- 'এই শতাব্দীতে বাস করে, এখনও কুসংস্কার ছাড়তে পারছো না ভাই!! তুমি বিশ্বাস করো এসব?' তারপর বলল, 'আমি বিশ্বাস করি না এতটুকুও। মানুষ মারা গেলে আর কিছু থাকে না ভাই, এটা আজ থেকে জেনে রেখো', বলল মোহিনী।
সারা রাস্তা আর কোনও কথা বলল না ছেলেটি মোহিনীর ধমক খেয়ে। মোহিনীকে ঠিকানা মতো নামিয়ে দিয়ে, ছেলেটি বলল, 'ওই যে সামনে বাঁ পাশে গলিটা দেখা যাচ্ছে ওটাই।'
গাড়ি থেকে নেমে এল মোহিনী। একটু খিদে খিদে পাচ্ছিল কিন্তু এত রাতে সব বন্ধ হয়ে গেছে, গলির ভিতরে ঢোকার মুখে একবার তাকালো মোহিনী বাঁদিকে, দেখলো উবেরটা এখনও দাড়িয়ে আছে। একটু অবাক হলো মোহিনী!! ওই দিক থেকে চোখ সরিয়ে গলিটাতে পা দিতেই, সারা শরীরটা কেমন যেন একটা ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো মোহিনীর।
কিন্তু এই শতকের মেয়ে সে, ব্যপারটাকে আমল না দিয়ে হাঁটতে থাকলো আধো অন্ধকারে, একটা কুয়াশা ঘেরা জায়গার মধ্য দিয়ে। সামনের কিছুই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। মোহিনী তার ছোট্ট হাত ব্যাগটা থেকে টর্চটা বার করে জ্বালতে যাওয়ার মুহূর্তে; হঠাৎই ঠিক কানের পাশে সেই টেলিফোনে শোনা ফ্যাসফ্যাসে গলার আওয়াজটা বলে উঠলো, 'টর্চ জ্বালাবার দরকার নেই ম্যাডাম, আমি আপনার সাথেই আছি।'
পাশে তাকাতেই অবাক হলো মোহিনী লোকটিকে যেন চেনে সে, কোথাও দেখেছে সে লোকটিকে? ভাবছিল মনে মনে মোহিনী, কিন্তু মনে করতে পারলো না কিছুতেই এই মূহূর্তে !
- 'কেন মনে করতে চাইছেন ম্যাডাম?' পাশ থেকে বলা কথাটা শুনে একটু চমকালো মোহিনী!! ওর ভাবনাগুলো কীভাবে পড়তে পারছেন পাশের লোকটি? ভেবে অবাকও হলো একটু মোহিনী! কিন্তু মুখে বলল, 'আমাকে ডেকেছেন যে খবর দেবার জন্য এবার সেটাতে আসি, কী বলেন? রাতও অনেক হলো বাড়িও ফিরতে হবে। বাড়ির সকলে চিন্তা করতে শুরু করেছে বোধহয় এতক্ষণে,' বলল মোহিনী।
হঠাৎ পাশ থেকে লোকটি বলে উঠলো, ' আমারও খুব তাড়া ম্যাডাম। কতদিন ধরে অপেক্ষা করে আছি এই দিনটার জন্য - ।'
- 'কেন?' বলল মোহিনী হাঁটতে হাঁটতেই।
- 'আপনি ভুলে গেছেন ম্যাডাম কিন্তু আমি যে আপনাকে এখনও মনে রেখেছি,' বলল লোকটি।
- 'আপনি কি আবোলতাবোল বলছেন তখন থেকে ? আমার কাছে তো কিছুই স্পষ্ট নয়!'
- 'আপনি মনে করুন ম্যাডাম, আজ থেকে দশ বছর আগে আপনি তখন সবে মাত্র এমবিএ করতে ব্যাঙ্গালোরে চান্স পেয়েছেন।'
- 'আপনি কি করে জানলেন আমি দশ বছর আগে এমবিএ করতে ব্যাঙ্গালোর গেছি?' বলল মোহিনী।
- 'কী করে ভুলি ম্যাডাম, আপনার ভুলের জন্য আজ আমি কোথাও যে নেই।'
- 'মানে?' বলল মোহিনী।
হঠাৎ হেসে উঠলো লোকটি। বলল, 'আপনি আমাকে সত্যিই চিনতে পারেননি ম্যাডাম ?'
হঠাৎ এই হাসির শব্দে মনে পড়তে লাগলো মোহিনীর সব কিছু স্পষ্ট ভাবে। হায়ার সেকেন্ডারিতে খুব ভালো রেজাল্ট করেছিল মোহিনী। বাড়ির সকলে বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে বললেও মোহিনী ভর্তি হলো সাংবাদিকতা নিয়ে। সেখানেই কলেজের প্রথম দিনে আলাপ হয়েছিল শুভ্রর সাথে। গ্রাম থেকে পড়তে আসা একটা সোজা সরল ছেলে শুভ্র। সকলেই তাকে নিতে মজা করছিল আর হাসাহাসি করছিল খুব। কুঁকড়ে যাচ্ছিল ছেলেটি এদের মানসিকতা দেখে। হয়তো মনে মনে ভাবছিল এরা এতো কঠোর কেন !!
এসব দেখে হঠাৎ মোহিনী বলে উঠেছিল, 'কী হচ্ছে এসব? আমি কিন্তু সকলের নামে রিপোর্ট করবো প্রিন্সিপ্যালকে।' মোহিনীর কথায় সকলে একটা বাজে মন্তব্য ছুঁড়ে, সরে গেল শুভ্রকে ছেড়ে দিয়ে। চোখে জল এসেগেছিল শুভ্রর। ধন্যবাদ জানিয়ে সরে এসেছিল মোহিনীর দিক থেকে সেও। তারপর বেড়িয়ে গেছিল কলেজ থেকে। একটা সময় কালের নিয়মে বন্ধুত্ব হয়ে গেল কীভাবে যেন দুজনের। লেখাপড়ায় প্রচন্ড ভালো ছিল শুভ্র, মোহিনীকেও অনেক হেল্প করতে লাগলো পড়াশোনায় এই বন্ধুত্বের কারণে। মাঝে মাঝে কলেজ পালিয়ে সিনেমা, কফি হাউসের আড্ডা যোগ হতে থাকলো তারপর। এই ভাবেই কেটে গেল কয়েকটি বছর, শুভ্র তো রেজাল্ট ভালো করলই, মোহিনী ও খুব ভালো রেজাল্ট করলো। তারপর মোহিনীর রেজাল্ট দেখে, মেয়েকে মাস্টার ডিগ্রি করাবার জন্য বাইরে পাঠানোর মনস্থ করলেন মোহিনীর বাবা।
মোহিনীর বাইরে যাওয়ার কথা শুনে শুভ্র বলেছিল, 'তুমি বাইরে চলে গেলে আমি কী নিয়ে থাকবো মোহিনী?'
কথাটা শুনে "মানে?" বলে অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল শুভ্রর দিকে মোহিনী। সেই তাকানোর মাঝে কোনও ভালোবাসা দেখতে পেল না শুভ্র সেদিন মোহিনীর চোখে। গ্রাম থেকে পড়তে আসা ছেলেরা বোধহয় ভবিষ্যতের কথা চিন্তা না করেই মোহিনীর মতো শহুরে মেয়েদের প্রেমে পরে। আর নিজেদের ভবিষ্যত নষ্ট করে ফেলে !!
এক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়েছিল বন্ধুত্বকে ভালোবাসা মনে
করে শুভ্রর জীবন শুভ্র নিজের হাতেই শেষ করলো। আসলে শুভ্র
গ্রাম আর শহরকে যেমন আলাদা করতে পারেনি, তেমনই পারেনি
ভালোবাসা আর বন্ধুত্বকেও। সেদিন মাথা নিচু করে সরে এসেছিল
মোহিনীর কাছ থেকে শুভ্র, আর কিছু না বলে। হারিয়েও
গেল মোহিনীর জীবন থেকে অন্ধকারের দুনিয়াতে।
মোহিনী চলে গেল বাইরে পড়তে। পড়া শেষে ফিরে এলো যখন, তখন তার ভালোবাসা খুঁজে পেয়ে গেছে মোহিনী। আলাপ হয়েছিল অর্কর সাথে এক কনফারেন্স রুমে, তারপর কেমন করে যেন অনুভব করা এই ভালোবাসা ! কোলকাতায় ফিরে এক নামকরা দৈনিকে চাকরি ও বিয়ে। মোহিনীর ভাবনার মাঝেই পাশ থেকে প্রশ্ন, 'মনে পড়লো তাহলে ম্যাডাম?'
- 'হ্যাঁ মনে পরেছে।
তাই তোমাকে চেনা চেনা লাগছিল আবছা অন্ধকারেও। কিন্তু গলার
আওয়াজ এমন হলো কেমন করে শুভ্র? আর এতো রাতে
এখানে না ডেকে আমাকে দিনেই তো ডাকতে পারতে তুমি,' বলল মোহিনী। 'আমরা তো এক সময় ভালো বন্ধু ছিলাম, তাই না শুভ্র?' বলল মোহিনী।
হঠাৎই চিৎকার করে পাশে দাঁড়ানো শুভ্র বলে উঠলো, 'না, বন্ধুত্ব নয়। তুমি শুধু ভালোবাসা ছিলে আমার, শুধু ভালোবাসা। আমি ভালোবেসেছিলাম তোমাকে মোহিনী। কিন্তু তুমি বন্ধুত্ব ভেবেছিলে। তোমাকে ছাড়া যে আমি শূন্য মোহিনী, তাই তো তোমাকে ডেকেছি আমার দুনিয়ায় তোমাকে নেবার জন্য। যেখানে দুজনেই -' শুভ্রর কথা শেষ হওয়ার আগেই, অবাক হয়ে মোহিনী বলল, 'মানে!!'
- 'অন্ধকার দুনিয়াতে আমি আর একা থাকতে পারছি না মোহিনী,' বলল শুভ্র। 'তুমি জিজ্ঞাসা করছিলে না, আমার গলার আওয়াজ কেন এমন হয়ে গেছে। দেখবে মোহিনী, তুমি দেখবে? এখনও খুউউব কষ্ট হয় আমার। যে দিন তুমি আমাকে ছেড়ে চলে গেলে ব্যাঙ্গালোর, আমি সেদিন খুব কেঁদে ছিলাম আমার ভালোবাসা হারিয়ে। তারপর ভাবলাম মোহিনী ছাড়া এই জীবন টেনে নিয়ে চলবো কেমন করে!! সেটা ভেবেই সেই রাতে গলায় ফাঁস লাগিয়ে ঝুলে পড়লাম পাখার সাথে। ভীষণ কষ্ট হয়েছিল মোহিনী। এই দেখ, এখনও দড়িটা গলায় লেগে আছে মোহিনী।'
ফিরে তাকালো মোহিনী শুভ্রর দিকে, আর অবাক হয়ে দেখলো সত্যিই একটা দড়ি আটকে আছে শুভ্রর গলায়। ভয়ে চিৎকার করে উঠলো মোহিনী, আর ঠিক সেই মুহূর্তেই, মোহিনীর অবাক ভয়ার্ত চোখ দেখলো পাল্টে যাচ্ছে শুভ্রর শরীরটা একটা কঙ্কালে ! আর একটা মাংসবিহীন হাত এগিয়ে আসছে মোহিনীর গলা লক্ষ্য করে। সেই কঙ্কালটা মুখে বলে চলেছে, 'আমি একা থাকতে পারছি না মোহিনী। তুমি চলে এসো আমার সাথে, আমি যে বড্ড ভালোবাসি তোমাকে মোহিনী। এসো মোহিনী, এসো আমার কাছে।'
মোহিনী পিছতে থাকলো ভয় পেয়ে। আওয়াজ করতেও ভুলে গেছে সে সেই মুহূর্তে। একটা সময় পিছতে পিছতে একটা দেওয়ালে এসে ঠেকে গেছে মোহিনী। আর পিছনোর রাস্তা নেই, মৃত্যু চোখের সামনে দেখে চোখ বুজলো মোহিনী।
হঠাৎই একটা ঝটাপটির আওয়াজ, যেন আরেকজন ! একটু একটু করে তাকালো মোহিনী। দেখল একটা মানুষ ওই কঙ্কালটাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিচ্ছে। আর মুখে বলছে খবরদার আর কখনও আসিস না এদিকে !
আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে কঙ্কালটা, একটা সময় ঘুরে দাঁড়াল মানুষটি মোহিনীর দিকে। অবাক হলো এত রাতে মাসিমাকে দেখে সেই মুহূর্তে মোহিনী।
- 'তু তুমি এখানে, এতো রাতে তুমি এখানে কি করছো মাসিমা? তোমার তো অনেক শরীর খারাপ ছিল? তোমাকে কে খবর দিল!!' তারপর একটু হেসে মোহিনী বলল, 'বুঝেছি, তোমাকে শানু বলেছে, পাগল ছেলে একটা।'
মোহিনীর কথাটা শেষ হতেই মাসিমা বলে উঠলেন, 'সাবধানে বাড়ি যা মোহিনী, আর কোনোদিন এমন ফোন পেলে, এখানে আসিস না। কী হতো বলতো ? আমি যদি ঠিক সময়ে না আসতাম।'
ঘাড় কাত করে হ্যাঁ বলে মোহিনী বলল, 'চলো, তোমাকে নামিয়ে দিয়ে তারপর বাড়ি ফিরি মাসিমা।' ঠিক সেই সময় হঠাৎ মোহিনীর ফোনটা বেজে উঠলো ব্যাগের মধ্যে। এইরে অর্কর ফোন বোধহয়!
মোহিনী ফোনটা বার করে বলল, 'দাঁড়াও মাসিমা অর্ককে একবার বলে দিই আমার ফিরতে দেরি হবে। ও
যেন খেয়ে শুয়ে পড়ে।' বলতে বলতে ফোনটা বার করে অবাক হয়ে দেখলো!
শান্তনু ফোন করছে।
একবার মাসিমার দিকে তাকিয়ে ফোনটা ধরে মোহিনী বলল, 'হ্যাঁ শানু বল। কি বলছিস!! মাসিমা তো আমার, আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। একদম সুস্থ।' নিজের বলা কথা আর ফোনের পেছন থেকে বলা কথাগুলো কেমন যেন জড়িয়ে যেতে থাকলো মোহিনীর কাছে। সামনে তাকিয়ে দেখলো হাওয়ায় মিশে যাচ্ছে মাসিমা কুয়াশার চাদরে ঢেকে।
- 'মাসিমা আ আ আ ----- '
চিৎকার করে পড়ে যাবার মুহূর্তে মোহিনী অনুভব করলো কেউ যেন তার দুটো হাত ধরে ফেলল শক্ত করে। হাসপাতালের বেডে বসে আছে মোহিনী। হাতে অনিমেষদার দেওয়া প্রমোশন লেটারটা। কিন্তু খুশি হতে পারছে না মোহিনী। বারবার ফিরে আসছিল চোখের সামনে শুভ্র আর মাসিমার মুখটা আজ। সে হয়তো সত্যিই অপরাধী একটা প্রাণের কাছে। কিন্তু সত্যিই সে ভালোবাসেনি কখনও শুভ্রকে। আর পরেরদিন ভোরে পড়তে চলে যাওয়ার কারণে সে জানতেও পারেনি এসব। ভালো বন্ধু মনে করতো সব সময় শুভ্রকে মোহিনী। কখনও স্বপ্নেও ভাবেনি শুভ্র তাকে ভালোবাসে। আর তার চলে যাওয়ার কারণে এমন কিছু করত পারে! আর মাসিমা!! উনি কীভাবে জানতে পারলেন মোহিনী বিপদে পড়েছে! বাড়ি ফিরে আগে যাবে সে শানুর সাথে দেখা করতে। আর সেদিনের উবেরের ছেলেটা ! ওদের সকলের কাছে আজ অনেক ঋণী সে। ভাবতে গিয়ে চোখে জল চলে এসেছিল মোহিনীর। বা'হাতের পাতায় চোখ মুছে সামনে তাকানোর মুহূর্তে অবাক হয়ে দেখলো উবেরের ছেলেটাকে।
- 'আপনি এখন ভালো আছেন তো দিদি?' বলল ছেলেটি।
- 'হ্যাঁ ভাই, সেদিন তুমি না থাকলে - ।'
কথাটা শেষ করার আগেই দেখলো অর্ক এসেছে তাকে ডিসচার্জ করে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। সাথে মোহিনীর মা এসেছেন। মা বলে উঠলো, 'ও না থাকলে আজ তোকে পেতাম না খুকু।' সবাইকে দেখে খুশি হলেও সব থেকে খুশি হয়েছে আজ মোহিনী উবেরের সেই ছেলেটিকে দেখে। যাকে কুসংস্কারী বলে কথা শুনিয়েছিল সে রাতে মোহিনী। ও সেদিন না থাকলে হয়তো পড়ে থাকতো ওই রাস্তাতে, সেই ঠান্ডাতে। পরে বলেছিল ছেলেটি, কেন জানি ফিরতে চেয়েও ফিরতে পারেনি সেদিন সে। তবে গলিটাতে ঢুকতেও ভয় পেয়েছিল। অনেক পরে ‘ মাসি মা মা মা মা’ আওয়াজটা কানে যেতেই ছুটে গেছিল গলির ভেতরে ছেলেটি। তখন মোহিনী মাটিতে পড়ে ছিল। তারপর অনেক কষ্টে উবেরে বসিয়ে সোজা এই নার্সিংহোম।
মা আর অর্ক দুজনকেই খুব খুশি দেখাচ্ছে আজ বোধহয় সব খুশির দিন এক সাথে জুড়ে যাচ্ছে মোহিনীর জীবনে! অর্কর হাতে একগুচ্ছ গোলাপ ফুলের তোড়া ! অবাক হয়ে তাকালো মোহিনী অর্কর দিকে। অর্ক একটু হেসে বাড়িয়ে দিল মোহিনীর হাতে একটা খাম। একটু হেসে খামটা খুলে চোখের সামনে নিয়ে এলো মোহিনী, চশমাটা চোখে না থাকায়।
দেখলো কনসিভ করেছে সে।।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন