বড়াল নদ। পদ্মার একমাত্র শাখা নদী। বাড়ীর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে। দুপুর হতেই আমরা কিশোর ছেলেপেলেদের দল নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ি। প্রায় দুই কিলোমিটার উজানে গিয়ে ঝাঁপ দেই, লুঙ্গিতে বাতাস ভরে ভাসতে ভাসতে উঠে পড়ি সুবল চাচার খেয়া নৌকায়। তারপর নৌকা থেকে দেই লাফ। সে আমাদের গালিগালাজ করে চিৎকার শুরু করে দেয়। সুবলের খেয়া নৌকা আমাদের ৮ থেকে ১০ গ্রামের নদী পারাপারের সম্বল।
খেয়া পারাপারে কোন টাকা লাগে না। বাংলা বছর শেষে আমরা তাকে ধান দেই। এই ধানের পরিমান নির্ধারিত হয় সামর্থ্যের উপর। আমার বাবা ধনীদের কাতারে পড়ে, ধানের পরিমান ৩০ সের। বছর শেষে সুবলের গোলা ধানে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। সূখী
সুবলকে দেখতে তখন অন্যরকম লাগে।
সুবল আমাকে খুবই সমীহ করে। গ্রীষ্মকালে নদী শুকিয়ে চৌচির হয়ে যায়, তটে হাঁটুসম পানি থাকে। তখন নৌকা চলে না, সাঁকো দিতে হয়। সাঁকো দিতে প্রচুর বাঁশ লাগে। আমাদের অনেক বাঁশঝাড় আছে। আমরা সুবলকে বাঁশ দিয়ে সহায়তা করি। তাই নৌকার উপর থেকে লাফ দেবার “অত্যাচার” সুবলকে সহ্যই করতে হয়।
কৈশোর শেষে যৌবনে
পা দিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় গ্রীষ্মকালীন ছুটির জন্য বন্ধ। গ্রামে ফিরে দেখি নদীর তীরে মহা হুলুস্থুল পড়ে গেছে। বড় বড় পাইপ গেঁথে নদীতে পাইলিং হচ্ছে। ব্রীজ হবে!
“সুবল
চাচা, ব্রীজ হতে আর কত দিন লাগবে?” আমি
জিজ্ঞাসা করি।
“আমি কীভাবে বলব? অফিসে গিয়ে খোঁজ নাও। ব্রীজের দরকারই বা কী? আমি কোন দিন, কোন সময় নৌকা বন্ধ রাখি? তুমি একদিন রাত একটার সময় এসে আমাকে ডেকেছিলে, আমি পার করি নাই? পুজোর দিনেও তো খেয়া বন্ধ রাখি না। আমি ঠিক বলছি কি না?” সুবল প্রচন্ড রেগে যায়!
“আমরা চৌদ্দগুষ্ঠি এই নদীতে খেয়া বইছি, আমাদের বিরুদ্ধে কেউ কোন অভিযোগ দিতে পারবে না”, সে বলতেই থাকে!
ব্রীজ বানানো উপলক্ষে গ্রামে মহা ধুমধাম পড়ে গেছে। খেয়াঘাটের রাস্তায় যারা অবৈধ দখল করে বাড়ি কিংবা দোকান গড়েছিল, গ্রামের যুবক ছেলেরা সেগুলো ভেঙ্গে দিয়েছে। ব্রীজের সঙ্গে প্রশস্ত রাস্তা হবে। কেউ কেউ সিএনজি অটো রিক্সা কিনবে। কেউ টেম্পু কিনবে। একজন চাতাল দিবে। দুটো ইটভাটা হবে। মানুষের কোন গরিবী থাকেবে না। সবার দাবি, ব্রীজ তাড়াতাড়ি হোক।
ব্রীজ চালু হল। সবার মাঝে সেকি আনন্দ! নদীর মধ্যে চমৎকার বাতাস! বিকেলে সবাই এসে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে নদীর পানির সৌন্দর্য উপভোগ করে। ঝালমুড়িওয়ালারা এসে ঝালমুড়ি বিক্রয় করে। রিক্সা-ভ্যানওয়ালারা আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করে, আগে যেখানে কোন ইনকাম ছিল না, এখন অনেক প্যাসেঞ্জার হয়।
কয়েক বছর হয়ে গেছে। একদিন বাড়ি ফিরতে হঠাৎ দেখি, সুবল ব্রীজের সামনে লাঠি ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখেই আ.. আ.. স্বরে কথা বলে এগিয়ে এল!
“চাচা ভাল?” জিজ্ঞেসা করতেই দেখলাম তার চোখ দিয়ে অশ্রু বের হয়ে এল।
খেয়া বন্ধ হয়ে যাবার পর কোন কর্মসংস্থান নাই, দারিদ্র, অপুষ্টিতে জরাজীর্ণ অবস্থা। নৌকা ভর্তি লোক নিয়ে শক্ত হাতে যাকে ভরা নদীতে প্রবল স্রোতে নৌকা বাইতে দেখেছি, তার এই দৃশ্য দেখে আমার বুকটাও দীর্ঘশ্বাসে ভরে গেল।অনেকটা ঘুষ দেবার মত হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে বিদায় নিলাম।
আমার স্কুল শিক্ষক বাবা ছিলেন তার প্রথম শ্রেনীর ক্লায়েন্ট। প্রতিদিন স্কুলে যেতে-আসতে দুবার তার সঙ্গে দেখা হত। একদিন বাবার সঙ্গে ফোনে কথা বলতে তিনি জানালেন, সুবল মাঝি মারা গেছে।
অনেক বছর চলে গেছে। বর্তমান প্রজন্ম হয়ত জানেই না এখানে একসময় খেয়াঘাট ছিল। কী চমৎকার দোকানপাট সব হয়েছে।
স্বপরিবারে ঈদের ছুটিতে বাড়িতে এসেছি। বউয়ের নির্দেশক্রমে বাচ্চাকে নিয়ে গেলাম চুল কাটাতে। ব্রীজের পাড়ে সেলুন।
“দাদা, আসেন, আসেন”,
নরসুন্দর খুবই বিনয়ী হয়ে এগিয়ে এল।
“তোমার পরিচয় বল, বাড়ি
কোথায়?” আমি জানতে চাইলাম।
“আমাকে চেনেন না? আমি
সুবল মাঝির ছেলে।”
“ওহ! অনেকদিন এলাকায়
থাকি না। চেনা মুষ্কিল”, জবাব দিলাম।
“কিন্তু আমি আপনাকে
চিনি।”
ব্রীজের দিকে তাকিয়ে আছি। সোলার লাইট বসানো হয়েছে। হঠাৎ ওকে বললাম “এই ব্রীজ হওয়াতে তো তোমার বাবার কর্মসংস্থান চলে যায়। তোমাদের তো অনেক কষ্ট করতে হয়েছিল?”
“কী যে বলেন! কষ্ট হলেও
সেটা সাময়িক।“
“কেন?”
“এই ব্রীজ না হলে আমাদের বাপ-দাদাদের মত আজীবন খেয়া মাঝি হয়েই থাকতে হত। এখন আমরা কয়েক ভাই নানাবিধ কর্মে জড়িত। বিভিন্ন পেশায় থাকায় ইনকামও বেশ ভালো। অনেক অনেক ভালো আছি!”
আমি শুনছি এবং ভাবছি… ব্রীজ…. আহ…. জনগণের ব্রীজ! চকচকে ব্রীজ!
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন