বুলি তুলিদের বাড়ির গা ঘেঁষেই ঝুনু পিসিদের দোতলা বাড়ি। ঝুনু পিসির বিয়ে ঠিক হবার পর থেকেই ছোট্ট বুলি-তুলি নিজেদের মধ্যে অনেক জল্পনা
কল্পনা করেছিল। আর যখন বিয়েবাড়ির প্যান্ডেলের জন্য বাঁশ বাঁধা শুরু হল তখন দুই বোনের আগ্রহ প্রায় তুঙ্গে
পৌঁছেছিল। ছোটো তুলি দিনের মধ্যে বেশ কয়েকবার তার খুদে দিদিকে জিজ্ঞেস করছে, "ওরা আমাদের নেমন্তন্ন করবে তো দিদি?"
সাত বছরের দিদির উপর ভারি ভরসা তুলির! বুলি তার খুদে মাথা হেলিয়ে বলেছে, " পাশাপাশি বাড়ি, নিশ্চয় করবে। "
নেমন্তন্ন ওরা খুব একটা পায় না। পাড়ার বিয়ে-শাদীতে ওদের পরিবার প্রায় ব্রাত্য! তুলি না বুঝলেও বুলি বোঝে ওরা পাড়ার আর পাঁচটা বাড়ির থেকে বেশ অনেকটাই গরীব।
পাড়ার বেবি, টুনু, মানিদের বাবারা যেমন অফিসে চাকরি করেন, ওদের বাবা তা করেন না, রেশন দোকানে স্লিপ কাটেন। এই বড়লোক পাড়ায় ওরা বেমানান। পাড়ার বাচ্চারা ওদের খেলায় নিতে চায় না। ওরা পড়ে
কর্পোরেশনের ফ্রি প্রাইমারী স্কুলে। পাড়ার অন্য বাচ্চাদের মতো চকচকে ইউনিফর্ম পরে
ভ্যান রিকশায় বসে স্কুলে যায় না।
আসলে এই বাড়িটা
ছিল মামাদাদুর মানে বাবার মামার। তিনি বিয়ে করেন নি তাই মারা যাবার আগে বেকার ভাগ্নেকে বাড়িটা লিখে দিয়ে গেছেন। টাকাপয়সা কিন্তু যে ব্রহ্মচর্য মিশনের সাথে
দাদু আজীবন যুক্ত ছিলেন সেই আশ্রমকে দান করে গেছেন।
ঝুনু পিসির
বিয়ে ঠিক হবার পর থেকেই দুই বোন প্রতীক্ষা করে আছে কবে ঝুনু পিসির বাবা কার্ড নিয়ে ওদের দোর গোড়াতে এসে হাঁক দিয়ে বলবেন, "অমর,সবাইকে নিয়ে আসতে হবে
কিন্তু।“ বিয়ের তিন দিন আগে সরকার দাদু মানে ঝুনু
পিসির বাবা এলেন। তখন বাবা বাড়িতে ছিলেন না, মা অনেক করে ভিতরে আসতে বলায়ও এলেন না, কিছুই না বলে মায়ের হাতে কার্ডটা ধরিয়ে দিয়ে চলে গেলেন। তুলি একগাল হেসে দিদিকে জানালো, “নেমন্তন্ন করেছে রে!”
ওরা দুই বোন বিয়েতে কি কি খাওয়াবে তাই নিয়ে অনেক জল্পনাকল্পনা
করেছিল। মাংস তো করবেই, ফিসফ্রাইও নিশ্চয় হবে, পোলাও তো হবেই, আসলে এইসব সুখাদ্য ওদের কপালে জোটে না। মিষ্টি খেতে তুলি
ভালোবাসে না, সে বলে, “দিদি,আমি কিন্তু দুটো আইসক্রিম খাবো।” বুলি চোখ পাকায়, “তোর তো টনসিল আছে, একটার বেশি খাস না নাহলে জ্বরে পড়বি। “
রাতে শুয়ে বুলি শুনতে পেলো মা বাবাকে বলছে, "চামার, একদম চামার! পয়সা থাকলেই কি বড় মন হয়? দুটো ছোটো বাচ্চার মুখের সামনে এতো ঘটাপটা করছে তবু তাদের বললো না, একা তোমার নামে কার্ড!”
বাবা বলেন, " ভালোই হয়েছে, ফ্যামিলি বললে যেতেই হত! এখন আর যাবই না, মাসের শেষ টাকা কটা বাঁচবে।"
মায়ের করুণ গলা শোনা গেল, “ আহা! ওরা খুব আশা করেছিল গো, কোথাও তো যায় না।"
তুলি দিদির দিকে পাশ
ফিরে ফিসফিস করে বলে, "কার্ড তো দিয়েছে তবে মা কেন বলছে নেমন্তন্ন করে নি?" বুলি বলে, "মনে হয় শুধু বাবাকে
বলেছে।" তুলির চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে দেখে ছোট্ট দিদিরও কান্না পায়, প্রাণপণে
কান্না চেপে বলে, "কাঁদিস না, এই বেস্পতিবার বাবার সাথে আমরা চিড়িয়াখানায় যাব।" ওদের বাবার রেশন অফিস
বৃহস্পতিবার বন্ধ থাকে, তুলি তবুও নিঃশব্দে
ফোঁপাতে থাকে।
বুলি তুলির
শোবার ঘরের জানলার পাশেই দুই বাড়ির বাউন্ডারি ওয়াল। সেখানে অনেকটা খালি জায়গায়
রান্নার উনুন বানানো হয়েছে। রান্নার জায়গায় ত্রিপল দেয়নি, পাতলা কাপড় দিয়ে শুধু ঘিরেছে, মানুষজনের চলাফেরা
হাঁকডাক সবই দেখা যাচ্ছে। তারা দুই বোন জানলার পর্দার পিছনে লুকিয়ে সব দেখছিল, লোভে ততোটা নয়, এতো হৈ চৈ আনন্দ ওরা কাছ থেকে কখনো দেখে নি।
তারপর রান্না যখন শুরু হলো তখন সুগন্ধে ওদের ছোটো বাড়িটা ম ম করতে লাগলো। সেদিন দুপুরে ওরা প্রায়
কিছুই খেলো না, পর্দার পিছন থেকে হাঁ করে রান্না চড়ানো দেখতে লাগলো।
সেদিন বোধহয়
ওদের দেখে ঈশ্বরেরও কষ্ট হয়েছিল! সন্ধ্যে হবার আগেই তুমুল ঝড়বৃষ্টি শুরু হল। নিমন্ত্রিতর চার ভাগের এক ভাগও তখন আসেন নি। রাত দশটায় বৃষ্টি থামার পর হাঁক
ডাক দিয়ে পাড়ার যারা আসেন নি তাদের ডাকাডাকি করে আনার চেষ্টা শুরু হল নইলে খাবার তো সবই প্রায় নষ্ট হবে। ওদের
বাবাকেও ডাকলো, বাবা ঘর থেকে গলার আওয়াজ চিঁচিঁ করে বললেন, “জ্বর, পেটখারাপ যেতে পারবো না।“ তখন সরকার দাদু বললেন, "তোমার বদলে তোমার মেয়েদের পাঠিয়ে দাও।" মা খড়খড়ে গলায় উত্তর দেন, "ওরা খেয়েদেয়ে ঘুমাচ্ছে।“
হঠাৎ বুলি আর
ওদের বাবা মা অবাক হয়ে দেখেন তুলি তার সবচেয়ে ভালো জামাটা পরে, ঠোঁটে মায়ের কালেভদ্রে ব্যবহার করা লিপস্টিক লাগিয়ে সরকার বাড়ি যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে। মায়ের বোঝানো, দুই ঘা থাপ্পড় কোনো কিছুতেই তার গোঁ যায় না, যখন তাদের ডেকেছে তখন যেতে দোষ কি! পাঁচ বছরের মেয়েকে কিছুতেই বোঝাতে না পেরে ওদের মা কাঁদতে শুরু করেছিলেন। মাকে কোনোদিন ওরা কাঁদতে দেখেনি। ওদের দিদা মারা
যাবার খবরেও মা এইভাবে কাঁদেন নি!
আকুল হয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকা মাকে দেখে বুলির
বুকের ভিতরটা কেমন করতে থাকে। সে মায়ের পাশে বসে মায়ের চোখ মুছিয়ে বলে, "কেঁদো না মা, তুলি যাবে
না।" সেইদিন সাত বছরের বাচ্চাটা হঠাৎ বড় হয়ে যায় এক নিমেষে।
এত দিন মা
বললেও পড়াশুনোকে বুলি সিরিয়াসলি নেয়নি। মা বলতেন ভালো করে পড়াশুনা করলে তাকে লোকে সম্মান করে, আদর করে। সেইদিনের সেই অনিমন্ত্রণের অসম্মান আর মায়ের কান্না বুলির জীবনের টার্নিং পয়েন্ট। প্রথম প্রথম পড়তে ভালো লাগত না, পরে মন বসল, তার দেখাদেখি তুলিও পড়ত।
আজ সে জে এন ইউ তে পড়ায়, সমাজ তত্ত্বের উপর তার কিছু লেখা বিদেশেও সমাদর পেয়েছে। তুলি ডাক্তার হয়েছে, সে মীরাট থেকে এম ডি করে আমেরিকায় চলে গেছে। তারা দুজনেই সুপ্রতিষ্ঠিতা, সুখী সংসারের অধিকারিণী। জীবন কত বিচিত্র, কোথা থেকে কখন
যে সে কার হাত ধরে উত্তরণ ঘটায় তা কেউ বলতেই পারে না।
বাবা মা তুলির
কাছে আমেরিকায় থাকেন। তবু বুলি প্রতিবার সরস্বতী পূজার দিন দিল্লী থেকে কলকাতায় আসে শুধু ওর স্কুলের অঙ্কের দিদিমণি মানসীদিকে প্রণাম
করতে। মানসীদি হলেন তার কাছে ঈশ্বরের প্রতিভূ। তার সাফল্যের পিছনে মানসীদির প্রচুর অবদান আছে। মাধ্যমিক পর্যন্ত মানসীদি তাকে প্রচুর
সাহায্য করেছেন। বিনা পয়সায় অঙ্ক দেখিয়ে দেওয়া, বই জোগাড় করে
দেওয়া এমনকি টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য পর্যন্ত করেছেন। মানসীদির সাহায্য ছাড়া সে আজকের সুচরিতা দত্ত কোনোদিন হতে পারতো না। ঈশ্বর তো নিজে আসেন না, তিনি কিছু দেবদূতের মধ্যে তার চরণচিহ্ন রেখে যান।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন