চৈত্রের পড়ন্ত বিকেলগুলোয় সূর্য যখন অস্ত যাওয়ার আগে আকাশের লালকে কৃষ্ণচূড়ার লালের সাথে মিশিয়ে দিত, বাতাস যখন আমের বোলের গন্ধ মেখে ঝিরঝির করে শরীর ছুঁয়ে বেরিয়ে যেতো, তেমন বিকেল গুলোয় তুমি আর আমি,একসাথে বসে থাকতাম কৃষ্ণচূড়া গাছটার নীচে।
দুজনে হাতে হাত রেখে একে অন্যের শরীরের তাপ শুষে
নিতাম।তোমার টিউশনি আর আমার ছোট্ট আয়ের সংমিশ্রণে কিসুন্দর করে হিসেব মিলিয়ে
দিতে গোটা একটা মাসের, আমাদের ভবিষ্যৎ সংসারের। কি করে
যে তার মাঝেও কাছে পিঠে বেড়াতে যাওয়ার খরচও কুলিয়ে নিতে তা ভেবেই অবাক হতাম। আরও কতো বিকেল ফুরিয়ে সন্ধ্যে নামতো,তুমি আর আমি দুজনে হাতে হাত রেখে পা বাড়াতাম বাড়ির পথে।
পার্কের কোনায় এই কৃষ্ণচূড়া গাছটা আমাদের প্রায় প্রতিটা বিকেলের সঙ্গী গত ছয় বছর ধরে। বাবা মায়ের এক ছেলে আমি। বাবা আমার পাঁচ বছর বয়সেই আমাদের একা করে চলে যান না-ফেরার দেশে। মা আর আমি,এই ছোট্ট গন্ডির মধ্যেই বড়ো হয়ে ওঠা আমার। এই বছর দু’য়েক মাকেও হারিয়েছি। তাও আমি একা নই এই এতো বড়ো পৃথিবীতে শুধু তুমি আছো বলে।
বেশ কিছু টিউশনি আর একটা বেসরকারি স্কুলে আঁকা
শেখানোর কাজে চলে যায় নিজের কোনমতে। তাই চাইলেও তোমায় নিজের করে নিয়ে আসার সাহস
করে উঠতে পারিনি। বৈশাখের এক শেষ বিকালের কনে
দেখা আলোয় তুমি দাঁড়িয়ে ছিলেকৃষ্ণচূড়া গাছের নীচে সেই পরিচিত ভঙ্গিমায়। আমি এক
পা এক পা করে এগিয়ে যাচ্ছি তোমার কাছে, কৃষ্ণচূড়ার লাল
মিশেছে তোমার চোখে, পিঠে এলোমেলো ছড়িয়ে আছে একরাশ কালো মেঘের ঢল, বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে তোমার কপালে, চিবুকে। কেন
জানিনা আজ বিকেলটায় কেমন বিষন্ন আর উদাস চোখে চেয়ে ছিলে তুমি আমার দিকে, হঠাৎ কেমন একটা অসহায় হাসি ফুটে উঠলো তোমার ঠোঁটে যা কাঁপন ধরিয়ে দিল আমার বুকে। একবারও আমার
হাতে হাত রাখলে না আজ। কেমন একটা ভাঙ্গা ভাঙ্গা অস্ফুট স্বরে বললে 'বুঝলে রবি আর আমাদের এক সাথে থাকা হলো না!' আমার পায়ের তলার
মাটি সরে গেল হঠাৎ! পুরো পৃথিবীটা যেন নড়ে উঠল। মুখ থেকে বেরিয়ে এল কেন???????
হঠাৎ কেমন উন্মাদ হয়ে গেলাম আমি। তাহলে তুমিও সেই একই!! গতানুগতিক সুখী,নিশ্চিত জীবনের লোভ সামলাতে পারলে না। যে সম্বন্ধটা এসেছিল পয়সাওয়ালা ব্যবসায়ীর একমাত্র
ছেলে!! বুঝেছি বুঝেছি। যাও চলে যাও। আরও কতো কি আবোল তাবোল বলে গেলাম আমি। কিন্তু তুমি নির্বিকার। কোনো কথা বেরোলো না তোমার মুখ দিয়ে।
হঠাৎ তুমি উঠে আস্তে আস্তে চলে গেলে। আমি আহত বাঘের মতো ফুঁসছিলাম যেন। তুমি চলে যাচ্ছ দেখেও আটকানোর কোনো চেষ্টাও করলাম না।
হঠাৎ ফোন বেজে উঠল দেখলাম প্রকাশ। অনিচ্ছা সত্বেও ধরলাম, বিরক্ত গলায় বললাম, হ্যালো! কি???? কি করে সম্ভব! কখন? কিন্তু...
ফোনটা হাত থেকে ছিটকে নিচে পড়ে গেল। হঠাৎ যেন বুকের খাঁচায় শ্বাস আটকে গেছে, বেরিয়ে আসার পথ পাচ্ছে না। হাজারটা ঢেউ আছড়ে পড়ার শব্দ হচ্ছে মাথার ভেতর। সব গুলিয়ে যাচ্ছে আমার। এ কি করে সম্ভব !!!
আজ প্রায় বিকেল চারটের সময় কৃষ্ণা রাস্তা পার হতে গিয়ে বাসে চাপা পড়ে স্পটেই মারা গেছে? কিন্তু এতক্ষণ আমার পাশে যে বসেছিল! হঠাৎ পাশে তাকিয়ে দেখি একটা টকটকে লাল কৃষ্ণচূড়া ঠিক যেখানটায় কৃষ্ণা বসে ছিল ওখানে চুপটি করে ঝড়ে পড়ে আছে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন