।।এক।।
রমজান আলির
বয়স হয়ে গেলেও, এখনো তার গানের গলাটা চমৎকার। প্রত্যেক দিনের মত আজও
সে বড় দিঘির পাড়ে বসে নিজের মনে গান গাইছে,
"আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে,
বসন্তের বাতাসটুকুর
মত...."।
কোনো দিন কোথাও গানের তালিম না নিলেও, তার গলায় আছে সুরের যাদু। সুরের মুর্চনায় সে মোহিত করে দেয় শ্রোতাদের। সে গেয়ে চলেছে,
"...সে চলে গেল, বলে গেল না।
সে কোথায় গেল, ফিরে এল না..."
লোকে বলে
রমজানের মাথাটা একেবারে বিগড়েছে। কিন্তু এই গানের মধ্যে লুকিয়ে থাকা হাহাকার যেন
বলে ওঠে, এই গান কোনো
পাগলের নয়। এই গান বড় দুঃখের, বড় কষ্টের, বড় বেদনার!
গেয়ে চলেছে
রমজান আলি। মাঝে মাঝে গান থামিয়ে বুক ফাটা আর্তনাদ করে উঠছে, "জাভেদ কোথায় গেলি? ফিরে আয়, ফিরে আয়।" তখন মনে হয় তার
হৃদয় চিরে বেরিয়ে আসা রুধির ধারা যেন অশ্রু ধারা হয়ে তার দুই কপোল বেয়ে নেমে এসে
ভিজিয়ে দিচ্ছে তার শ্বেত শুভ্র শ্মশ্রুকে।
সে আকুল ভাবে
ডাকছে জাভেদকে। ফিরে আসতে বলছে। জাভেদ কি ফিরবে? যারা চলে যায়, তারা কি আর ফিরে আসে?
।। দুই ।।
ফজরের নামাজের পর একটু ঘুমিয়ে নেওয়া জাভেদের বরাবরের অভ্যাস। আজও সবে মসজিদ থেকে ফিরে এসে শুয়েছে। বেজে উঠলো বালিশের পাশে রাখা মোবাইল ফোনটা। হাতে নিয়ে দেখলো তবসুম আপার নামটা ভেসে উঠেছে। এত ভোরে আপা ফোন করছে কেন? কিছুটা অবাক হল। কিছুটা ভয় পেল জাভেদ।
- "জাভেদ আব্বার শরীর খুব খারাপ। আমি, তোর জিজা আট দিন হল এখানে এসেছি। দিন রাত হাসপাতালে এসে দৌড়াদৌড়ি করছি। ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছে। হয়তো আজকালের মধ্যেই ..."। কথা শেষ করতে পারে না তবসুম। ডুকরে কেঁদে ওঠে।
- "আপা, আপা, শান্ত হও আপা। শান্ত হও আপা, কান্না থামাও। পরিষ্কার করে বলো কি হয়েছে আব্বার?" উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করে জাভেদ।
- "তুই অতদুরে থাকিস। এই লক ডাউনে গাড়ি ঘোড়া সব বন্ধ। তাই তোকে কিছু বলা হয়নি। আমরা চাইনি তোকে টেনশনে ফেলতে। আব্বা পনেরো দিন ধরে করোনাতে ভুগছে। হাসপাতালে ভর্তি আছে। সেখানেও হাজার রকম নিয়ম কানুন। আম্মা একা হিমশিম খাচ্ছিলো। তাই আমি আর তোর জিজা আট দিন হল এখানে আছি। দিন রাত হাসপাতাল ঘর করছি। কিন্তু ডাক্তাররা সব সময়ে কথা বলছে না। কাছে ঘেঁষতেই দিচ্ছে না। ঠিকঠাক কোনো খবর পাচ্ছি না। কাল ডাক্তার ডেকে বললো, আর কোনো আশা নেই। ভেন্টিলেশনে দিতে পারলে আরো কিছুদিন রাখা যেত। কিন্তু এখানে ওসব কিছুর ব্যবস্থা নেই।"
- "কি বলছো আপা! হায় আল্লাহ! তুমি কিছু দিন আগে যদি জানাতে, তখন কিছু লরি উড়িষ্যার দিকে যাচ্ছিল। কাশিম, বরকত, হালিম, ইমতিয়াজ আল্লাহর নাম নিয়ে একটা লরিতে উঠে পড়লো। বাড়ি পৌঁছাতে পেরেছে কিনা জানিনা। তবে একসঙ্গে অনেকজন আছে। কিছু না কিছু ব্যবস্থা হয়তো করে নিয়েছে। তখন যদি জানতাম, আমি বেরিয়ে পড়তাম। ওরা আমাকে ফিরতে বলেছিল। আমি ভাবলাম চারিদিকে এক অবস্থা, বাড়ি ফিরেই বা কি হবে! হাজার হাজার টাকা গাড়ি ভাড়া দিতে বেরিয়ে যাবে। এখানেও সব বন্ধ। মাঝে মাঝে দু এক ঘন্টা করে দোকান খুলছে, কিন্তু সবকিছু পাওয়া যাচ্ছে না। দাম খুব চড়া। হাতের টাকা শেষ হয়ে আসছে। চা নাস্তা বন্ধ। কেবল একবেলা ফুটিয়ে দু’বেলা চালাচ্ছি। এরপর যে কি হবে আল্লাহ্ জানে!"
-"দেখ ভাই আমি বলতে পারছি না। আমার বলতে খুব কষ্ট হচ্ছে। তবুও বলছি, তুই আব্বার একমাত্র ছেলে। তোকে মাটি দিতে হবে। তোকে আসতেই হবে। লরি হোক, বাস হোক, যেমন করে পারিস আয়।"
- "ঠিক আছে আপা, দেখছি কি করা যায়। তবে আমাদের এদিকে করোনার খুব বাড়াবাড়ি হয়েছে। হু হু করে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। প্রচুর মানুষ মারা যাচ্ছে। পুলিশ রাস্তায় বেরোতে দিচ্ছে না। ঠিক আছে আল্লাহ কশম আমি ফিরবো মাটির জন্য।"
মুর্শিদাবাদের
ছেলে জাভেদ দু’বছর হল বেঙ্গালুরুতে এসেছে ইমতিয়াজের সঙ্গে।
রাজ মিস্ত্রির কাজ করে সে। কিছুটা পড়াশোনা করেছে, তাই মাপজোকটা সে ভালো বোঝে। ফলে
অনেক কন্ট্রাক্টর, প্রমোটার তাকে বেশ পছন্দ করে। মুর্শিদাবাদ থেকে
বেঙ্গালুরুতে কাজ অনেক বেশি। রোজগারও অনেক বেশি। গত দুবছরে কাজ করে সে অনেক টাকা
উর্পাজন করেছে। প্রতি মাসেই সে বাড়িতে টাকা পাঠায় আব্বা, আম্মার জন্য। বেশ ভালো ভাবেই
দিন কাটছিল। হঠাৎ অতিমারি এসে সব এলোমেলো করে দিল। কাজকর্ম সব বন্ধ। দিন রাত ঘরে
বসে থাকা। ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে দিন কাটছে। সব সময়ে ঠিক মত টাকা পাওয়াও যায় না।
চারিদিকে হাজারো সমস্যা।
ইমতিয়াজ, কাশিম, জাভেদ, বরকত, হালিম মোট পাঁচজন একটা ঘর ভাড়া করে থাকে সহরতলীতে। ছোট ঘর, অ্যাডবেস্টারের ছাদ। আলাদা কোনো বাথরুম নেই। জলের অবস্থা ভালো নয়। কিন্তু ভাড়া তিন হাজার টাকা! পাঁচজনে ভাগ করে দেয়।
লকডাউনে
প্রথম প্রথম খারাপ লাগছিল না। সবাই ভেবেছিল কাজ থেকে কয়েক দিনের ছুটি। ইয়ার দোস্ত
মিলে আড্ডা মেরে, গল্প করে খারাপ কাটছিল না। কিন্তু দেখতে দেখতে প্রায়
চার মাস কেটে গেল। ক্রমশ করোনা বাড়ছে। পরিস্থিতি জটিল হচ্ছে। বেশির ভাগ প্রবাসী
লকডাউনের শুরুতে বাড়ি ফিরে গেছে। যারা ভেবেছিল সাময়িক ব্যাপার, কিছু দিনের মধ্যেই আবার
পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে যাবে, তারা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে দেরিতে হলেও বাড়ি ফেরার
চেষ্টা করছে।
বরকত একদিন খবর আনলো, একটা লরি যাবে ভুবনেশ্বরে। ড্রাইভারের সঙ্গে সে কথা বলে নিয়েছে, কিছু টাকা দিলে সে পৌছে দেবে ভুবনেশ্বরে। তারপর তার চেনা কোনো লরি ড্রাইভারের সঙ্গে যোগাযোগ করে দেবে। যদিও সেই যোগাযোগ করে দেওয়াটা নিশ্চিত নয়। তবে সে চেষ্টা করবে। বরকত, কাশিম, হালিম, ইমতিয়াজরা ব্যাগ গুছিয়ে নিলো। জাভেদকেও বললো। কিন্তু অনিশ্চিতের পথে পা বাড়াতে জাভেদের মন চাইলো না। সে থেকে গেল। যাওয়ার আগে যুক্তি করে, বাড়িওয়ালা মহসিনকে কিছু টাকা দিয়ে গেল। বলে গেল যেন ঘরটা তাদের জন্য রাখা থাকে। কিছু দিন পর তারা ফিরে আসবে। জাভেদ একা রয়ে গেল।
সারাদিন ঘরে থাকে জাভেদ। নিজে রান্না করে খায়। কেবল নামাজের সময় ঘর থেকে বেরিয়ে মসজিদে যায়। একা থাকতে তার মোটেই ভালো লাগে না। কথা বলার কেউ নেই। সময় যেন কাটতে চায় না। মাঝে মাঝে মহসিনের সাথে গল্প করে সময় কাটায়। এলাকাটা প্রায় ফাঁকা হয়ে গেছে। বেশির ভাগ প্রবাসী মজদুর যে যার বাড়ি ফিরে গেছে। কয়েক ঘর স্থানীয় মানুষ অবশ্য রয়েছে। তবে তারা কেউ বাড়ি থেকে বের হয় না।
সারাদিন ঘরে বসে থাকতে থাকতে কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়ছে জাভেদ। কয়েক দিন হল শরীরটাও ভালো যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে জ্বর আসছে। কিন্তু জাভেদ ভয়ে কোনো ওষুধের দোকানে যাচ্ছে না। জ্বর হয়েছে শুনলেই হৈচৈ শুরু হয়ে যাবে। ধরে বেঁধে হাসপাতাল নামক জেল খানায় ঢুকিয়ে দেবে। সেখান থেকে কবে ছাড়বে না ছাড়বে কোনো ঠিক নেই! কিন্তু ওষুধ ছাড়াতো থাকা যাবে না। সে শুনেছে ব্যাথার ওষুধে জ্বর সেরে যায়। জাভেদ একটা ওষুধের দোকানের সামনে গেল। কিছুটা ইতস্তত করে সে ঢুকল দোকানে। ডান হাতে ডান গালটা চেপে, দাঁতের ব্যাথার অভিনয় করতে করতে সে ওষুধ চাইলো। ট্যাবলেটটা খেতে সত্যিই জ্বর ছাড়লো। বেশ ঝরঝরে লাগছে এখন।
- "শক্ত হও বেটা, শক্ত হও। জীবন মৃত্যু সব তার ইচ্ছা। আমরা কেউ চিরদিন থাকবো না। কেউ আগে যাব, কেউ পরে। কিন্তু সবাইকে যেতে হবে। এটাই চিরন্তন সত্য। এটাই তার অমোঘ বার্তা।" জাভেদকে শান্ত করার চেষ্টা করতে থাকে মহসিন। এবং তাকে আশ্বাস দেয় যে তার বাড়ি ফেরার কিছু না কিছু ব্যবস্থা করে দেবে। তারপর মহসিন বিভিন্ন জায়গায় ফোন করতে থাকে।
- "ব্যবস্থা হয়ে গেছে জাভেদ। আমার এক দোস্তের একটা লরি কাল ছাড়বে। যাবে রাউরকেলা। ওটা বিজনেস সিটি। ওখান থেকে কিছু না কিছু পেয়ে যাবে ভুবনেশ্বর বা কটকে যাওয়ার। তারপর আল্লাহ জানে।" মহসিন খবর দেয় জাভেদকে।
- "সুক্রিয়া চাচা। ভুবনেশ্বরে যেতে পারলে কিছু না কিছু পেয়ে যাব।"
- "কিন্তু বেটা, এখান দেখে দশ কিলোমিটার দূরে তোমাকে যেতে হবে লরি ধরতে।"
- "দশ কিলোমিটার দূরে যেতে হবে!"
- "ঠিক আছে, আমার মোটর বাইকে কাল তোমাকে
পৌছে দেব। লাগেজ গুছিয়ে রাখো। খুব ভোরে বের হতে হবে। বেলা হলে পুলিশের ঝামেলা হতে
পারে।"
ভোরের নামাজের পর জাভেদকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে মহসিন। ফাঁকা রাস্তায় ঝড়ের গতিতে মোটর বাইক চালিয়ে কিছুক্ষণের মধ্যে পৌছে যায় গন্তব্য স্থলে। লরি ড্রাইভার চিন্নাকে মহসিন আগে থেকেই চিনতো। ফলে খুঁজতে কোনো অসুবিধা হল না। জাভেদকে তুলে দিল নির্দিষ্ট লরিতে। ড্রাইভার চিন্না জাভেদের সমবয়সী। জাভেদকে লরিতে তুলে নিয়ে চিন্না সময় মত লরি ছেড়ে দিল। জাভেদের সঙ্গে হালকা কথাবার্তা বলতে বলতে সে জেনে নিলো কেন জাভেদ রাউরকেলা যাচ্ছে।
- "এই পরিস্থিতিতে তোমার বের হওয়া ঠিক হয় নি। দুতিন মাস আগে তবুও কিছু গাড়ি রাস্তা ঘাটে দেখা যেত। এখন পরিস্থিতি খুব খারাপ। রাস্তাঘাট পুরো ফাঁকা। কেবল জরুরি পণ্যের গাড়ি রাস্তায় দেখা যায়।" জাভেদকে বললো চিন্না।
- "কি করবো চিন্না! আব্বার অবস্থা খুব খারাপ। হয়তো আজ রাতেই ..."। কথা শেষ না করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে জাভেদ।
- "সেটা ঠিকই বলেছো। ভগবান বলো আর আল্লাহ বলো, উপরওয়ালা যা চাইবে তাই হবে। আব্বার যদি আমার হাত থেকে মাটি নেওয়ার থাকে নেবে। আর উপর ওয়ালা যদি অন্য কিছু ঠিক করে রাখে, তাই হবে। কিন্তু আমারতো বসে থাকলে চলবে না। আমাকে চেষ্টা করতে হবে। আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে।"
- "কিন্তু তোমাকে তো অনেক দুর যেতে হবে। রাউরকেলা থেকে ভুবনেশ্বর বা কটক। যেখানেই যাও সেখানে গাড়ি খুঁজতে হবে। তোমার অচেনা জায়গা, খুব সমস্যা হবে। ঐসব জায়গার পরিস্থিতিও খুব একটা ভালো নয়। সেখান থেকে হাওড়া। তারপর আরো প্রায় দুশো কিলোমিটার। আমি বুঝতে পারছি না তুমি কি শেষ অবধি পৌছতে পারবে? নাকি আমার সঙ্গে ফিরে যাবে? ঠিক আছে আমি তিন চার দিন রাউরকেলাতে থাকবো, তার মধ্যে যদি কোনো ব্যবস্থা করতে পারো তাহলে যেও। না হলে আমার সঙ্গে ফিরে যেও।"
- "কিন্তু আমাকে তো বাড়ি যেতে হবে। আব্বাকে একবার শেষ দেখা দেখব না?"
- "তোমার কষ্টটা বুঝতে পারছি জাভেদ। কিন্তু বাস্তবকে তো মেনে নিতে হবে। তাছাড়া করোনা রোগীর ডেড বডিতো রোগীর বাড়ির লোকের হাতে দেয় না। প্রশাসন শেষ কাজ করে। তাই ভাবছি তুমি বাড়ি ফিরেও তোমার আব্বাকে শেষ দেখা দেখতে পাবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।"
লরি পৌছায় রাউরকেলায়। চিন্না ব্যস্ত হয়ে পড়ে তার কাজে। মাল খালাস, হিসেব মেলানো, পেমেন্ট নেওয়া, বেশ জটিল ব্যাপার। এখন লোকজন কম। ফলে অনেক বেশি সময় লাগছে। জাভেদ এদিকে ওদিকে ঘোরাঘুরি করছে। খোঁজ খবর নিচ্ছে যদি কোনো গাড়ি পাওয়া যায়! বাড়িতে এরমধ্যে ফোন করে খবর নিয়েছে। ভালো কোনো খবর নেই। আব্বার অবস্থা একই রকম। একটাই ভালো খবর, এখনো বেঁচে আছে। জাভেদ গাড়ি খুঁজছে কিন্তু কোনো গাড়ির খবর পাচ্ছে না। ভীষণ হতাশ হয়ে পড়েছে সে। হয়তো চিন্নার সঙ্গে বেঙ্গালুরুতে ফিরে যেতে হবে! কি আর করা যাবে, এ জীবনে হয়তো সে আর কোনো দিন তার আব্বাকে দেখতে পাবে না! আল্লাহর যা মর্জি তাই হবে।
।। তিন ।।
রমজান উত্তর দেয়, "জ্বরের বড়ি খেলে জ্বর সেরে যায়। তাই রক্ত পরীক্ষা করানো হয় নি। ঠিক আছে আবদুল, কাল সকালেই আমি রক্ত পরীক্ষা করাবো।"
কয়েক দিন ধরেই জ্বরে ভুগছে রমজান আলি। রোজ আবদুলের কাছে যায় ওষুধ আনতে। আবদুল বারে বারে রমজানকে সতর্ক করে, সাবধান করে। রক্ত পরীক্ষা করাতে বলে। কিন্তু রমজান গুরুত্ব দেয় না। এবারে আবদুল বেশ কড়া ভাবে ধমক দিয়েছে। বাধ্য হয়ে রমজান পরের দিন হাসপাতালে যায় রক্ত পরীক্ষা করাতে। ভীষণ ভিড় হাসপাতাল চত্বরে।হাজার হাজার মানুষ ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে।রক্ত পরীক্ষার লম্বা লাইন। শেখ পাড়া, মোল্লা পাড়া থেকে কাতারে কাতারে লোক এসে ভিড় জমিয়েছে হাসপাতালে। বড় দিঘির ওপারে দাস পাড়া, মিত্তির পাড়া থেকেও প্রচুর লোক এসেছে। রমজান প্রথমে ভাবে বাড়ি ফিরে যাবে। আবার আবদুলের ধমকের কথা মনে পড়তে লাইনে দাঁড়িয়ে যায়। রক্ত পরীক্ষা হলো। রোগ ধরা পড়েছে। কোভিড পজিটিভ এসেছে রমজানের। ভর্তি হতে হল হাসপাতালে ।
তবসুম, সাত্তার রোজ নিয়ম মাফিক সকালে বিকালে হাসপাতালে যায়। দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু কোনো খবর পায় না। কালে ভদ্রে ডাক্তারের সঙ্গে দেখা হয়। কিন্তু পরিষ্কার করে কিছু বলে না। কেবল জানায় অবস্থা ভালো নয়। ক্রমশ অবনতি হচ্ছে। দিন রাত অক্সিজেন দিতে হচ্ছে। আই সি ইউ, ভেন্টিলেটর কিছুই এই হাসপাতালে নেই। খুব সাধারন মানের চিকিৎসা হচ্ছে। তবে অনেকেই সেরে উঠে বাড়ি ফিরে যাচ্ছে। সাত্তার অবশ্য এক সাফাই কর্মীকে কিছু টাকা দিয়ে ম্যানেজ করেছে। সে প্রত্যেক দিন ভেতরকার খবর দেয়। আজও সকালে সাত্তার, তবসুম এসেছে হাসপাতালে। আজও তারা অপেক্ষা করছে যদি ডাক্তারের সঙ্গে দেখা হয়। কিছু কথা হয়। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে তারা। হঠাৎ হাসপাতালের মাইকে শুনতে পেল, "রমজান আলির বাড়ির লোক দেখা করবেন।"
দুজনেই ঘাবড়ে যায়। তবে কি...? সাফাই কর্মীটার সঙ্গে তো দেখা হল। তেমন কিছুতো বললো না! পড়িমরি করে দৌড়ায় সাত্তার। পেছনে পেছনে তবসুম।
সাত্তারকে দেখে ডাক্তারবাবু বললেন, " আপনার জন্য একটা ভালো খবর আছে। রমজান আলির রক্ত পরীক্ষায় কোভিড নেগেটিভ এসেছে। শ্বাসকষ্ট নেই। অক্সিজেন দিতে হচ্ছে না। কাল ছুটি দেওয়া হবে।"
"অনেক ধন্যবাদ ডাক্তার বাবু। তাহলে কাল আমরা আব্বাকে বাড়ি নিয়ে যেতে পারবো?" কথা বলতে গিয়ে চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ে তবসুমের।
পরের দিন বাড়ি ফিরলো রমজান আলি। মেয়ে তবসুম, জামাই সাত্তারের সেবা যত্নে কিছু দিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠলো।
।। চার ।।
লরি থেকে কলকাতায় নেমে জাভেদ সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়লো। এর আগে কখনো মহসিন, কখনো চিন্না তার সঙ্গে ছিল। তারাই সব ব্যবস্থা করে দিয়েছিল। এবার যা করার তাকে নিজেকে করতে হবে। কিন্তু কি করবে সে? এটা কি সেই কলকাতা? যে কলকাতাকে দেখতে সে অভ্যস্ত। উদভ্রান্তের মত ঘুরে বেড়াচ্ছে জাভেদ। মোবাইল ফোনটা অনেকক্ষণ আগে অফ হয়ে গেছে। বাড়িতেও যোগাযোগ করতে পারছে না। শরীর একদম ভালো নেই। বারে বারে জ্বর আসছে। দুপাতা ব্যাথার ট্যাবলেট সে কিনেছিল, সেটাও প্রায় শেষ। নিজের মনে হেঁটে চলেছে। কোথায় যাচ্ছে, কোন দিকে যাচ্ছে, কিছুই জানেনা সে। পায়ে পায়ে সে এসে পড়েছে কলেজ স্কোয়ারে। দোকানগুলো সব বন্ধ। তার চোখে পড়লো কলকাতা ইউনিভার্সিটি। চোখ ভরে দেখলো ঐতিহ্য মন্ডিত বিশ্ব বিদ্যালয়কে। চলার শক্তি আর নেই। শরীরে নেমে এসেছে ক্লান্তি। চোখে নেমে আসছে ঘুম। মনে হচ্ছে শেষ নিঃশ্বাস এখানেই বেরিয়ে যাবে। কিন্তু নিঃশ্বাস ফেলতেও তার কষ্ট হচ্ছে। রাস্তার ধারে শুয়ে পড়ে সে। আবার জ্বর আসছে। খুব খিদে পেয়েছে। কিন্তু এক ফোঁটা খাবার জল আসে পাশে কোথাও নেই। এখন সে কোথায় যাবে? যাওয়াতো দুরের কথা, উঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেছে সে। কিন্তু উঠতে তাকে হবেই। তাকে যেতে হবে আব্বার কাছে।
হাঁটতে হাঁটতে সে পৌছে যায় শ্যামবাজারে। অশ্বারোহী নেতাজিকে সালাম জানায়। এতগুলো রাস্তা বিভিন্ন দিকে গেছে! এবার সে কোন দিকে যাবে? কিছুই ঠিক করতে পারছে না। একটা ফাঁকা জায়গায় বসে পড়ে।
- "বাবু আপনি গাড়ি খুঁজছেন?" একটা ছেলে জাভেদকে জিজ্ঞাসা করে।
- "হ্যাঁ, হ্যাঁ খুঁজছিতো। মুর্শিদাবাদ যাবো।" আগ্রহের সঙ্গে উত্তর দেয় জাভেদ।
- "হ্যাঁ যাবো। তিন হাজার টাকা লাগবে।"
- "তিন হাজার!"
- "হ্যাঁ এতটা যাবো আসবো। জানেন তো তেলের দাম কত বেড়ে গেছে!"
- "ঠিক আছে, তাই দেব চলো।"
- "ঐ যে গাড়ির মালিক দাঁড়িয়ে আছে, আগে ভাড়াটা দিয়ে দিন।"
- "আগে ভাড়া!"
- " অনেক টাকার তেল ভরতে হবে। আমার খাওয়া খরচ আছে।"
গুনে গুনে তিন হাজার টাকা মিটিয়ে দিয়ে গাড়িতে উঠলো জাভেদ। গাড়িতে মাত্র দুজন আছে। জাভেদ আর ড্রাইভার। মসৃণ গতিতে গাড়ি চলতে লাগলো। পেছনের সীটে চোখ বন্ধ করে বসে আছে জাভেদ। বেশ কিছুক্ষণ চলার পর হঠাৎ গাড়িটা দাঁড়িয়ে পড়লো। চোখ খুললো জাভেদ।
- " কি হল ড্রাইভার ভাই?"
- "ইঞ্জিনে একটু সমস্যা হচ্ছে। দেখছি কি করা যায়।"
গাড়ির বনেট খুলে ড্রাইভার ইঞ্জিন পরীক্ষা করতে লাগলো। জাভেদ গাড়ি থেকে নেমে এসে এদিকে ওদিকে দেখছে। ভীষণ পিপাসা পেয়েছে তার। ড্রাইভারের থেকেও কিছুক্ষণ আগে সে জল চেয়েছিল। কিন্তু তার কাছেও খাবার জল নেই। জাভেদকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে ড্রাইভার বললো, "একটু এগিয়ে দেখুন না যদি কোথাও পানি পাওয়া যায়। ততক্ষণে আমি গাড়িটা ঠিক করছি।"
মাত্র কয়েক পা জাভেদ এগিয়েছে। তৃষ্ণার্ত চাতকের মত তার চোখদুটো জল খুঁজছে। হঠাৎ ইঞ্জিনের শব্দ। সে ঘুরে দেখলো তীব্র গতিতে গাড়িটা চলতে শুরু করেছে! অসুস্থ দুর্বল শরীর নিয়ে জাভেদ গাড়িটার পেছনে দৌড়ানোর অক্ষম চেষ্টা করলো। ততক্ষণে গাড়িটা অনেক দুরে চলে গেছে। বিভিন্ন বন্ধ দোকানের সাইন বোর্ড দেখে বুঝতে পারলো সে এখন ব্যারাকপুরে দাঁড়িয়ে আছে।
দু’চার পা দৌড়াতে গিয়ে জাভেদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। দম বন্ধ হয়ে আসছে। গায়ে ভীষণ জ্বর। দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে রাস্তার ধারে শুয়ে পড়ে। মাঝ রাতে উঠে আবার হাঁটতে শুরু করলো। কতক্ষণ হাঁটতে হবে, কত দিন হাঁটতে হবে, কিছুই জানে না সে। কেবল উত্তর দিক ধরে হেঁটে চলেছে। পা চলছে না, শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে, তবুও হেঁটে চলেছে সে। না, সে হাঁটছে না, কোনো রকমে তার অর্দ্ধমৃত শরীরটাকে টেনে নিয়ে চলেছে। মাঝে মাঝে বসে পড়ছে, রাস্তার ধারে শুয়ে পড়ছে, ঘুম ভাঙলে আবার হাঁটছে। কতদিন ধরে হাঁটছে তার মনে নেই। কখন সকাল হচ্ছে, কখন রাত হচ্ছে তার মনে থাকছে না। কেবল হেঁটে চলেছে। হাঁটছে, হাঁটছে আর হাঁটছে। যেন এক অনন্ত যাত্রা! যার শুরু আছে শেষ নেই। সহরাঞ্চল ছেড়ে এবার সে গ্রামের পথে এসে পড়েছে। আসে পাশে নেই কোনো বসতি। নেই কোনো দোকান বাজারের চিহ্ন।দুদিকে ধু ধু জলা। মাঝে ফাঁকা রাস্তা।
আর একটা রাত কাটলো। আর একটা ভোর হল। রাস্তার ধারেই নামাজ পড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে জাভেদ। তখনো মাথার টুপিটা খোলেনি। একটা লরি এসে দাঁড়ালো তার সামনে। একজন নামাজিকে দেখে লরির ড্রাইভার জিজ্ঞাসা করলো, "সালাম আলেইকুম। আসে পাশে কোনো চা নাস্তার দোকান আছে?"
- "আলেইকুম
সালাম। আমি জানি না ভাইজান। আমি বেঙ্গালুরু থেকে আসছি। যাবো মুর্শিদাবাদে।"
নতুন আলাপ হওয়া ড্রাইভারকে সবকিছু খুলে বললো জাভেদ। লরিটি যাচ্ছে মুর্শিদাবাদে। জাভেদকে লরিতে তুলে নিলো ড্রাইভার। কিন্তু ততক্ষণে তার জীবনীশক্তি প্রায় শূণ্যতে এসে দাঁড়িয়েছে।
কয়েক ঘন্টার মধ্যে লরিটা পৌছালো মুর্শিদাবাদে। লরি থেকে নেমেই চেতনা হারালো জাভেদ। রাস্তার ধারে পড়ে রইলো কিছুক্ষণ। জ্ঞান ফিরতে আবার সে হাঁটতে শুরু করলো। এটা তার চেনা জায়গা। কাঁপতে কাঁপতে হাঁটছে সে। কিছুটা গিয়ে বড় রাস্তায় উঠলো। দু একটা অটো, সাইকেল, ভ্যান রিক্সা এখানে চলাচল করছে। একটা ভ্যানে সে উঠলো। এখন সে অনেকটা নিশ্চিত যে সে এবার বাড়ি যেতে পারবে। মাটি দিতে পারবে তার আব্বাকে। ভ্যানে উঠেই সে চিৎকার করে বলে উঠলো, "আব্বাজান আমি আসছি।" ভ্যান চালক তাকে সতর্ক করে, "হল্লা গুল্লা কোরো না সাহেব। পুলিশ এসে গেলে যেতে দেবে না।" ভ্যান চালকের কথা শুনে চুপ করে যায় জাভেদ। শুয়ে পড়ে ভ্যানেতে। আর কোনো শব্দ শোনা গেল না তার মুখ থেকে।
অবশেষে বাড়ি পৌছালো জাভেদ। তবে তার আব্বাকে মাটি দিতে নয়। আব্বার হাত থেকে মাটি নিতে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন