কাউকে বলার নেই তাই ভাবলাম নিজের ভয়টাকে লিপিবদ্ধ করে রাখি। একে আমার জবানবন্দি হিসেবেও ধরে নেওয়া যায়। আমার এই ভয় কাউকে জানানো যায়না। আমাকে পাগল বলেই ভেবে নেবে সবাই। কে বিশ্বাস করবে যে আমার সবচেয়ে কাছের মানুষকে নিয়েই আমার ভয়। কাছের মানুষ তাতে সন্দেহ নেই কিন্তু মানুষ নয়। অথবা মানুষ ছাড়াও আরও কিছু। কিকরে কাউকে বলি যে আমার নিজের ছেলেকে নিয়েই আমার ভয়। কেন? কারণ আমার মৃত্যু শিয়রে। আমায় মানুষের পরিত্রানের জন্য বলে যেতে হবে আমার বৃত্তান্ত যা জুড়ে আছে আমার প্রায় সারা পূর্ণবয়স্ক জীবন। সমস্ত ঘটনা খুলে বলতে আমায় ফিরে যেতে হবে জীবনের এমন এক অধ্যায়ে যার অনেকখানি আমার কাছে ঝাপসা। সেই সময়ে আমার সাথে কি হয়েছিল, কি ঘটেছিলো তা আমার কাছে একটা ধোঁয়াশার মতো। প্রায় পঁচিশ বছর যেন কেটে গিয়েছিলো এক দুঃস্বপ্নের মধ্যে।
শুরুর থেকে শুরু করাই ভালো। আমার পরিচয়টা আগে দেওয়া
দরকার। আমার নাম ডক্টর অনুরাধা রায়। আমি এখন থাকি আমেরিকার, নর্থ ক্যারোলিনাতে, ছোট্ট শহর, কালোহীতে। কালোহীর আরও একটা পরিচয় আছে। ওয়েস্টার্ন ক্যারোলিনা ইউনিভার্সিটি এই
শহরের লাগোয়া। আমার পড়াশোনা এই ইউনিভার্সিটিতেই। এখানে এসেছিলাম সেই মধ্য সত্তরের
দশকে। কলকাতায় তখন বিষম গন্ডগোল, নকশাল আন্দোলন চলছে। মেধাবী
ছাত্রছাত্রীদের যখন তখন বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। আমি লেখাপড়ায় চিরকালই
ভালো ছিলাম। বায়োলজি নিয়ে যখন বি এস সি শেষ করলাম তখন দেখা গেলো কলকাতা
ইউনিভার্সিটিতে প্রথম তিনজনের মধ্যে আমি একজন। বাবা ছিলেন বিখ্যাত উকিল তাই টাকাপয়সার
অভাব ছিল না। বাবা আমাকে পাঠিয়ে দিলেন আমেরিকাতে এম এস করতে। বললেন কলকাতার
পরিস্থিতি থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই মঙ্গল। কিছুদিনের মধ্যেই আমি পারি দিলাম
আমেরিকা। ভর্তির পরীক্ষা মোটামুটি সহজেই উৎরে গেলো। নানা বড়ো শহরের ইউনিভার্সিটি
ঘেটে আমার পছন্দ হলো পাহাড়ে ঘেরা এই ছোট্ট শহরটাকে। ভর্তি হলাম নর্থ ক্যারোলিনা
ইউনিভার্সিটিতে কারণ এদের রিসার্চ পরিকাঠামো সারা পৃথিবীতে বিখ্যাত। পরিবার ছেড়ে
আসার দুঃখ কেটে গেলো নতুন বন্ধু বান্ধব পাওয়াতে। দেখলাম সারা পৃথিবী থেকে মেধাবী
ছাত্র ছাত্রীরা এখানে পড়তে আসে। দেখতে দেখতে এম এসের দুবছর কেটে গেলো। আমি পি এইচ
ডি শুরু করলাম এই ইউনিভার্সিটিতেই। ততদিনে আমার আলাপ হয়েছে সাই চন্দ্রশেখর বলে
অন্ধ্র প্রদেশের এক ছাত্রের সাথে। পি এইচ ডিতে ও আমার সিনিয়র। আলাপ থেকে হলো প্রেম
এবং সেখান থেকে আমরা বাড়িতে কিছু না জানিয়েই একসাথে থাকা শুরু করি। বছর আড়াই পড়ে
হঠাৎ একদিন জানতে পারি আমি অন্তঃসত্ত্বা। তখন বাড়িতে জানাতে বাধ্য হই। বাড়িতে একটা
হুলুস্থুলু কান্ড শুরু হয়। বাবা চলে আসেন আমেরিকাতে। চন্দ্রর সাথে তার আলাপ হয়।
আস্তে আস্তে চন্দ্র ও আমার দুই পরিবারেরই আপত্তি কেটে যায়। বিয়েটা হয় ভারতবর্ষেই।
তারপর আমরা ফিরে আসি আমেরিকাতে। কিছুদিনের মধ্যেই চন্দ্রর পি এইচ ডি শেষ হয়।
চাকরিও পেয়ে যায় সে কাছেই একটি ওষুধের কোম্পানিতে। ভালো পারিশ্রমিক, বাড়ি, গাড়ি কোনোকিছুরই অভাব হয়না। আমার পি এইচ ডি পিছিয়ে
দিই একবছর আমার সন্তানের জন্মের জন্য। ততদিনে আমরা দুজনেই আমেরিকার নাগরিকত্ব পেয়ে
গেছি। সেই সময়ে মেধাবী ছাত্র ছাত্রীদের আমেরিকা লুফে নিতো। ছেলের নাম রাখি অরুণ, আমার দাদুর নামে। পুরো নাম অরুণ সাই। অরুণের জন্মের দেড় বছর পর আমার পি এইচ
ডিও শেষ হয়। আমার ইউনিভার্সিটিতেই জুনিয়র লেকচারার হিসেবে চাকরিজীবন শুরু করি।
জীবন ছিল অতি শান্ত, স্থির, আনন্দের। জঙ্গল ঘেষা আমাদের দুতলা কাঠের বাড়ি। সামনের লন থেকে দেখা যায়
চারপাশের পাহাড়। সারা দিন অরুণ আর আমার কাজ নিয়ে ব্যাস্ততা, অরুনের দেখাশোনা, এই নিয়েই কেটে যায় পাঁচটা বছর।
এর পরেই জীবনে এমন এক ঘটনা ঘটে যা আমার জীবনের মোড়
ঘুরিয়ে দেয় চিরকালের জন্য। অরুণের বয়েস তখন ছয়, সালটা ১৯৮৭।
আমাদের খুব কাছের বন্ধু ছিল জন আর সারা উইলিয়ামস। সারা এম এসএ আমার সহপাঠী ছিল।
তাছাড়া ওরা থাকতও আমাদের বাড়ির খুব কাছে। ছুটিছাটাগুলো কাটতো একসাথে, কখনও কাছের জঙ্গলে চড়ুইভাতি, কখনও পিছনের বাগানে বারবিকিউ
করে। ওরা একবার প্রস্তাব করলো হাতের কাছে ব্লু রিজ মাউন্টেন ফরেস্ট নামক অভয়ারণ্যে
ক্যাম্পিং করতে যাওয়ার জন্য। ক্যাম্পিং আমাদের কাছে একটা নতুন অভিজ্ঞতা যদিও
আমেরিকায় এর প্রচলন খুবই বেশি। অনেক সময়েই পরিবার বা বন্ধু বান্ধব মিলে একসাথে
জঙ্গলে গিয়ে দিন দুয়েক তাবু খাটিয়ে বা কোনো কাঠের কেবিনে গিয়ে থাকা। সেবার গরমটাও
ভালোই পড়েছিল। সবাই মিলে ৪ঠা জুলাইয়ের ছুটিটা ভালোই কাটবে মনে হয়েছিল। কে জানতো
আমাদের জীবনের সব চেয়ে বড়ো বিভীষিকা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলো। শনিবার, ৪ঠা জুলাই সকালে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। ওখানে যখন পৌঁছলাম তখন দুপুরবেলা। গাড়ি
পার্ক করে প্রায় ঘন্টাখানেক জঙ্গলের রাস্তায় হেঁটে আমরা পৌঁছলাম একটা লেকের ধারে।
সেখানেই জনেদের এক আত্মীয়ের কেবিন। সামনে কিছুটা জায়গা সমতল হলেও একটু দূরেই শুরু
হয়েছে পাহাড় আর জঙ্গল। অত্যন্ত মনোরম পরিবেশ। জন আর সারারও এক ছেলে, নাম ড্যানি। ড্যানি অরুণের চেয়ে বয়েসে দুবছরের বড়ো। কেবিনটার বাইরে এলে দূর
থেকে কোনো ছোট নদীর কুল কুল শব্দ শোনা যায়। প্রথম দিন চলে গেলো সব গুছিয়ে নিতে।
খাবার বানাতে বানাতেই সন্ধ্যে নেমে এলো। রাতটা কেটে গেলো গল্প করে আর তাস খেলে।
বাচ্চারা সারাদিন হেঁটে ক্লান্ত ছিল। ওরা ঘুমিয়ে পড়েছিল অনেক আগেই।
পরের দিন ছিল রবিবার। আলো ফোটার সাথে সাথেই আমরা উঠে
পড়েছিলাম লেকের উপর সূর্যোদয় দেখতে। কুয়াশামাখা জঙ্গল, চেনা অচেনা নানা পাখির ডাক, লেকের জলে আলোর খেলা, হালকা ঠান্ডা হাওয়া, মনটা খুশি হয়ে উঠেছিল। কিছুক্ষন
পরে চন্দ্রকে নিয়ে জন গেলো লেকে মাছ ধরতে। আমি আর সারা বাচ্চাদের তুলে প্রাতরাশের
ব্যবস্থা করলাম। খেয়ে ওরা নিজের মনে খেলতে চলে গেলো। আমি আর সারা কেবিনের সামনে
বেঞ্চে বসে গল্প করছিলাম। প্রায় যখন বারোটা বাজে তখন জন আর চন্দ্র ফিরে এলো। এসেই
ওরা বাচ্চাদের খোঁজে বেরোলো। তখনও আমরা বিপদের কোনো আঁচ পাইনি। একটু পরে জন আর চন্দ্র
ফিরে এসে উদ্বিগ্ন মুখে জানালো যে ড্যানি আর অরুণকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছেনা। জন যদিও
শান্ত হয়ে বললো চিন্তার কোনো কারণ নেই, ওরা আশপাশেই
থাকবে। এখানে কোনো বড়ো জানোয়ার নেই, জঙ্গলও খুব ঘন
নয়। হয়তো কাছেই নদীর কাছে গেছে বাচ্চারা। ওরা দুজনে আবার বেরিয়ে গেলো বাচ্চাদের
খুঁজতে। সারা আর আমিও কেবিনের আশপাশে, লেকের কাছে খুঁজে
এলাম কিন্তু ড্যানি আর অরুণকে কোথাও পেলাম না। ঘন্টাখানেক কেটে গেলো কিন্তু না
অরুণরা, না চন্দ্র আর জন ফিরে এলো। ততক্ষণে আমার আর সারার
পাগলপাগল অবস্থা। যখন চন্দ্র আর জন ফিরে এলো তখন ওদের সাথে একজন ফরেস্ট গার্ড। সে
জানালো সে রেডিওতে কাছাকাছি সমস্ত গার্ডদের খবর দিয়ে দিয়েছে। সবাই মিলে খুঁজলে
ওদের পেতে বেশি সময় লাগার কথা নয়। হয়তো জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে একটু বেশি দূরে গিয়ে পড়েছে। আমি আর সারা তখন নিজেদের দুষছি। কেন ওদের
চোখে চোখে রাখলাম না? কি ভেবে এই জঙ্গলে একা ছেড়ে
দিলাম? জন প্রচন্ড উত্তেজিত হলেও চন্দ্র এর মধ্যেও ছিল ধীর, স্থির, শান্ত। সে গার্ডটার সাথে কথা বলে যেতে লাগলো। ৯১১
এমার্জেন্সি নম্বরে ফোন করে পুলিশকেও জানানো হলো। ঘন্টাখানেকের মধ্যে তারাও চলে
এলো। জন, চন্দ্র আর ফরেস্ট গার্ডরা তখন আবার চলে গেছে অরুণ আর
ড্যানিকে খুঁজতে। পুলিশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমাদের সকাল থেকে কি কি হয়েছিল তা
জিজ্ঞাসা করলো। পরনের পোশাক, অরুণের লাল টি শার্ট, নীল শর্টস। ড্যানির ডোরাকাটা সাদা কালো জামা আর কালো শর্টস, সবই জানালাম আমরা। কিছুক্ষণের মধ্যে তাদের সার্চ এন্ড রেস্কিউ দল চলে এলো। জঙ্গল
চষে ফেলতে লাগলো তারা কিন্তু ওদের কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলোনা।
দিন শেষ হয়ে রাত নামলো। এমন বিভীষিকাময় রাত আমাদের
জীবনে আর আসেনি। বিনিদ্র রাতের প্রত্যেকটা শব্দে মনে হতে লাগলো ওই বোধহয় ওদের
পায়ের শব্দ, ওই বোধহয় ওদের নিঃস্বাশের
আওয়াজ। চোখের জল বাঁধ ভেঙেছিল। পুলিশের কয়েকজন আমাদের সাথে কেবিনে ছিল। চন্দ্র আর
জন ছিল সার্চ পার্টির সাথে। রাতের কালো ভেদ করে সূর্য উঠলো আবার। সকালে আমি আর
সারা কেবিনের সামনে বসে ছিলাম। হঠাৎ পুলিশের একজনের কোমরের রেডিওটা কর কর করে
উঠলো। খবর এলো ওদের পাওয়া গেছে। ওদের নিয়ে যাওয়া হবে সোজা হাসপাতালে। প্রায়
ঘন্টাখানেক পরে পুলিশের লোক ড্যানিকে নিয়ে ফিরলো। ড্যানির কপাল কেটে রক্ত জমে
গেছে। সারা রাত বাইরে জঙ্গলে পড়ে থেকে বিদ্ধস্ত দেখাচ্ছে তাকে। ছুটে গিয়ে তাকে
জড়িয়ে ধরলো সারা। আমিও ছুটে গিয়ে অরুণকে খুঁজলাম কিন্তু আমার ছেলেকে কোথাও দেখতে
পেলাম না। ছুটে গেলাম পুলিশের কাছে। ওরা জানালো ড্যানিকে খুঁজে পাওয়া গেলেও অরুণকে
পাওয়া যায়নি। খোঁজ এখনও চলছে।
পুলিশ সারা আর ড্যানিকে নিয়ে হাসপাতালে চলে গেলো।
সেদিনও সারারাত খোঁজ চললো। সার্চের দল এখন হয়েছে আরও অনেক বড়ো। হেলিকপ্টার ব্যবহার
করা হলো যাতে কম সময়ে বেশি জায়গা খোঁজা যায়। পরের দিন গার্ডরা খবর দিলো যে
ড্যানিকে পাওয়া যায় জঙ্গলের মধ্যে এক ধাপ সিঁড়ির কাছে। সিঁড়ি? কিসের সিঁড়ি? তবেকি জঙ্গলের মধ্যে কোনো বাড়ি
আছে? অত্যন্ত আশ্চর্য হলাম একথা শুনে। গার্ডরা ফিশ ফিশ করে
জানালো যে আমেরিকার অনেক জঙ্গলেই নাকি ছড়িয়ে আছে এরকম সিঁড়ি। সিঁড়িগুলো কিছুদূর উঠে শেষ হয়ে যায়। কে বা কারা এই সিঁড়ি বানায় তা কারও জানা
নেই। এই সিঁড়িতে যারা ওঠে তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায়না। এই জঙ্গলের গার্ডরা অনেক
সময়েই কুসঙ্গস্কারাচ্ছন্ন হয়। আমেরিকা উন্নত দেশ হলেও প্রদীপের তলায়েই অন্ধকার
থাকে। আমরা ভেবে নিলাম এ নিশ্চই ঠিকমতো খোঁজ না করার ছুতো।
আমরা পরের দিন ছুটলাম হাসপাতালে ড্যানির কাছে। সে তখন
কিছুটা সুস্থ, কথা বার্তা স্বাভাবিক। পুলিশকে
ড্যানি যা বললো সে কোনো বাচ্চার কল্পনা ছাড়া কিছু হতে পারেনা। সে জানালো অরুণ আর ও
নদীর ধারে খেলতে খেলতে একরকম শীষ শুনতে পায়। শীষটা এমনই যে ওদের আচ্ছন্ন করে ফেলে।
ওরা শীষের আওয়াজ লক্ষ্য করে চলতে আরম্ভ করে। ওরা বুঝতে পারছিলো যে ওরা কেবিন থেকে
দূরে চলে যাচ্ছে কিন্তু ওদের যেন নিজের ইচ্ছায় কিছু করার আর কোনো শক্তি ছিলোনা।
চলতে চলতে ওরা পাহাড়ের কিছুটা উপর দিকে উঠে যায়। সেখানে'গাছগুলো যেন আরও লম্বা আর ঘন। দুপুর গড়িয়ে আলো পড়ে আসে। সন্ধের সময় ওরা পৌঁছায়
এমন এক জায়গায় যেখানে গাছপালা বেশ পরিষ্কার আর সেখানেই তারা দেখতে পায় এক ধাপ
সিঁড়ি। নিজেদের অজান্তেই তারা সেই সিঁড়ি বেয়ে ওঠে। তারপরেই ঝলসে ওঠে একটা নীল রঙের
বৃত্তকায় আলো আর মুহূর্তেই হাওয়ায় মিলিয়ে যায় অরুণ। প্রচন্ড এক ধাক্কায় সিঁড়ির উপর
থেকে ছিটকে পড়ে ড্যানি আর জ্ঞান হারায়। তার জ্ঞান ফেরে তাকে যখন সার্চ পার্টির
একটা দল খুঁজে পায়। অত্যন্ত নিরাশ মনে আমি আর'চন্দ্র ফিরে
এসেছিলাম কেবিনে।
অপেক্ষার সাত দিন কেটে গেলো সময় গুনতে গুনতে। অরুণের
কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া গেলোনা। চষে ফেলা হলো হাজার হাজার বর্গ মাইল। জর্জিয়া, নর্থ ক্যারোলিনা, দুই প্রদেশেই খোঁজা হলো কিন্তু
কোনো লাভ হলোনা। পুলিশ আমাদের বাড়ি ফিরে যেতে বললো কিন্তু কিভাবে ফিরে আসি ছেলেকে
ছেড়ে? পুরো দেড় মাস ধরে খোঁজ চললো কিন্তু অরুণকে আমরা খুঁজে
পেলামনা। ভগ্ন হৃদয়ে একদিন ফিরে এলাম বাড়ি। আরও তিন মাস ধরে খোঁজ করার পর পুলিশ
একদিন জানালো যে এবার অরুণকে জীবিত ফিরে পাওয়ার আর কোনো আশা নেই। কোনো জানোয়ারই
নিশ্চই তাকে মেরে ফেলেছে অথবা সে নদীতে বা কোনো জলাশয়ে ডুবে গেছে। কিন্তু কাছাকাছি
হ্রদে বা নদীতে ডুবুরি নামিয়ে খোঁজ করেও তার দেহ খুঁজে পাওয়া যায়নি। হয়তো বা ভেসে
গেছে বহুদূরে। যেদিন বেড়াতে গেছিলাম সেদিন জানতাম না। পরে জানতে পেরেছিলাম
আপেলেশিয়ান পর্বতমালার, ব্লু রিজ ফরেস্টের মতো জঙ্গলে
প্রত্যেক বছর হারিয়ে যায় অগুনতি মানুষ। তাদের আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়না। কেউ
জানেনা তারা কোথায় যায়। কারা অদৃশ্য করে দেয় তাদের? তাদের অস্তিত্ব হিসেবে শুধু রয়ে যায় প্রিয়জনেদের চোখের জল।
হতাশায় ডুবে যাওয়া দুটো মানুষ কোনোরকমে বেঁচে ছিল।
আমি আর চাকরিতে মন বসাতে পারছিলাম না। ইউনিভার্সিটি থেকে লম্বা ছুটি নিলাম। আমার
প্রতি চন্দ্রর ব্যবহার হয়ে উঠেছিল অত্যন্ত রূঢ়। একদিন সে স্পষ্ট জানিয়ে দিলো যে সে
অরুণের নিখোঁজ হওয়ার জন্য আমাকেই দায়ী মনে করে। আমি কিছু বলতে পারলাম না কারণ
কোথাও আমি নিজেও নিজেকে দায়ী ভাবতাম। আমাদের মধ্যে আর কোনো সম্পর্ক ছিলোনা। একদিন
নিজের জিনিসপত্র নিয়ে চন্দ্র চলে গেলো। জানালো সে চলে যাচ্ছে বোস্টনে, অন্য চাকরি নিয়ে। সে আমার সাথে আর থাকতে চায়না। আমি মা হয়ে অরুণকে ফেলে যাই কি
করে? আমি থেকে গেলাম কালোহী আঁকড়ে। ফিরে গেলাম আবার
চাকরিতে, শুরু করলাম রিসার্চ। একদিন চন্দ্র বিবাহবিচ্ছেদ চেয়ে
কোর্টের সমন পাঠালো। আমিও আপত্তি করলাম না। চন্দ্র মিলিয়ে গেলো অতীতের অন্ধকারে।
আমি বেঁচে রইলাম অরুণের স্মৃতি আর ইউনিভার্সিটির রিসার্চের কাজ নিয়ে। আস্তে আস্তে
একটু নাম ডাক হলো আমার কাজের জন্য। কিন্তু নিজের জীবনে আমি নিঃসঙ্গই রয়ে গেলাম।
একদিন খবর এলো চন্দ্র আর নেই। একটা পথদুর্ঘটনা জীবন কেড়ে নিয়েছে তার। আমি ভাবতাম
আলাদাই হোক চন্দ্র কোথাও তো আছে। সেদিন আরও একা হয়ে গেলাম আমি।
মাঝে মাঝেই ফিরে যেতাম ব্লু রিজ ফরেস্টে, সেই কেবিনে। জন আর সারা কালোহী ছেড়ে পারি দিলো নক্সভিল।চলে যাওয়ার আগে জন তার
আত্মীয়ের অনুমতি নিয়ে কেবিনের একটা চাবি দিয়ে দিয়েছিলো আমাকে। একা একা ঘুরে
বেড়াতাম জঙ্গলে। মনে হতো কোথাও, কোনো পথের বাঁকে আবার দেখতে
পাবো আমার অরুণকে। কখনও বা দরজা খুলে বসে থাকতাম সারা রাত, যদি সে ফিরে আসে? ডাক দেয় "মা" বলে? একদিন হাঁটতে হাঁটতে খুঁজে পেলাম সেই
সিঁড়ি। তারপর থেকে বারবার যেতাম ওই সিঁড়ির কাছে, খুঁজতাম আমার ছেলেকে। কিন্তু অরুণ ফিরে এলোনা। কেবিনে যখন থাকতাম বা জঙ্গলে
হাটতাম, তখন মাঝে মাঝেই মনে হতো কেউ যেন আমায় দেখছে, আমি যেন একা নই কিন্তু কাউকে কখনও দেখতে পেতাম না। নিজের মনের ভুল বলেই ধরে
নিয়েছিলাম ব্যাপারটাকে। সেই সিঁড়ির চারপাশেও অস্বাভাবিক কিছুই চোখে পড়েনি কখনও।
অনেক দিন, রাত কাটিয়ে দিলাম ওই সিঁড়ির আশপাশে, তাঁবু খাটিয়ে থেকে। কিন্তু কিছুই চোখে পড়লো না, অরুণও ফিরে এলোনা।
এভাবেই কেটে গেলো বাইশটা বছর। সময়ের চাকা গড়িয়ে সালটা
তখন ২০০৯। বার বার যেভাবে ফিরে যাই, সেভাবেই ফিরে যাই
আবার সেই সিঁড়িটার কাছে। সেই গরমকাল, সেই জঙ্গল, সেই আর্দ্র আবহাওয়া। দিনটা আমার স্মৃতিতে ঝক ঝকে আজকের দিনের মতো। আমার জীবনের
সব চেয়ে আশ্চর্য্য অথচ সব চেয়ে আনন্দের দিন। সেদিন বিধাতা আমায় ফিরিয়ে দিয়েছিলেন
আমার সবকিছু। আমার জীবনের সব চেয়ে বড়ো পাওনা। না, কোনো ব্যাখ্যা নেই জীবনের সেই মুহূর্তের। আমি চাইও না সেই ব্যাখ্যা। নিজের
সন্তানের বেশি এক মা আর কিই বা চাইতে পারে?
সেদিন হাওয়া ছিলনা। জঙ্গল যেন স্থির হয়ে গিয়েছিলো।
অবিরত ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক সেদিন থেমে গিয়েছিলো। সন্ধের পাখিদের ঘরে ফেরার কলতান ছিল
নিস্তব্ধ। নদীও যেন তার বলিষ্ঠ স্বর হারিয়ে ফেলেছিলো। ঘর্মাক্ত দুপুরে ঘুমিয়ে
পড়েছিলাম আমি তাঁবুর মধ্যে। ঘুম ভাঙলো খুব কাছে বাজ পড়ার মতো একটা প্রচন্ড আওয়াজে।
চমকে উঠে বসে তাঁবুর জিপার খুলে বাইরে বেরিয়ে এসেছিলাম আমি। ঢোলে পড়া সূর্যের
ম্লান আলোয় চারপাশে তাকিয়ে ঠিকমতো কিছু ঠাওর করার আগেই চোখ আটকে গেলো সিঁড়ির
মাথায়। এ কি? এ দাঁড়ানোর ধরণ, এই আদল, এই লাল টি শার্ট, নীল শর্টস যে আমার খুব চেনা। চোখ কচলে আবার তাকালাম আমি। না, কোনো ভুল নেই। সত্যিই সিঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা পাঁচ ছ বছরের ছোট্ট ছেলে।
কিছু উপলব্ধি করার আগেই আমি বুঝতে পারলাম আমি ছুটছি। ছুটে উঠে গেলাম সিঁড়ির মাথায়।
জড়িয়ে ধরলাম বাচ্চা ছেলেটাকে। ও যে আমার অরুণ। ঈশ্বরের কৃপা ছাড়া আর কিছু হতে
পারেনা। আজ এই বাইশ বছর পরে কিভাবে সেই ছ বছরের অরুণ ফিরে আসে তা একবারও মনে হলোনা
আমার। এ ঈশ্বরের কৃপা, এছাড়া আর কিছু নয়। অরুণও
"মা" বলে ডেকে উঠলো। আমি চোখের জল ধরে রাখতে পারছিলাম না। চরাচর ঝাপসা
হয়ে এলো সিক্ত অশ্রুতে।
আমরা ফিরে এলাম কালোহীতে। কিছুদিন বাড়ি থেকে বাইরে
বেরোলাম না। সবাইকে জানিয়ে দিলাম আমি কিছুদিনের ছুটি নিয়ে ব্যক্তিগত কাজে ভারতবর্ষ
যাচ্ছি। কিছুদিন বন্দি অবস্থায় কাটিয়ে তারপর একদিন বেরোলাম বাড়ি থেকে। ততদিনে
জন্মের তারিক বদলে বানিয়ে নিয়েছি নতুন জন্মের প্রমাণপত্র। বানিয়ে নিয়েছি দত্তক
নেওয়ার নথি। আমেরিকা হলেও টাকা ছড়ালে হয়না এমন কোনো কাজ এই পৃথিবীতে নেই। বাঁকা পথ
হলেও তাই করলাম আমি। সবাইকে জানালাম ভারত থেকে এই শিশুকে আমি দত্তক নিয়েছি। আমার
সাথে বড়ো হতে লাগলো অরুণ। ভর্তি করে দিলাম স্কুলে। আর সব বাচ্চাদের মতো খেলা ধুলায়
তার কোনো উৎসাহ নেই। তার উৎসাহ শুধু পড়াশোনায়। কিছুদিনের মধ্যে বোঝা গেলো, অরুণ অত্যন্ত মেধাবী। বিশেষত গণিত, পদার্থবিদ্যা আর
জীববিজ্ঞানে তার জুড়ি মেলা ভার। হাইস্কুলের গন্ডি সে পার হয়ে গেলো পাঁচ বছরের
মধ্যেই, অর্থাৎ এগারো বছর বয়েসে। কলেজ শেষ করলো পরের দুবছরের
মধ্যে আর তারপর সে পড়তে গেলো আমেরিকার নিয়ম অনুযায়ী চার বছরের পৃ মেড কোর্স। চার
বছরের শিক্ষা দুবছরে শেষ করে চিকিৎসাশাস্ত্র নিয়ে ভর্তি হলো হার্ভার্ড মেডিকেল
স্কুলে। ঊনিশের কোঠা পার হওয়ার আগেই সে ফিরে এলো ডাক্তার হয়ে। তারপর সে
নিউরোলজিকাল শল্যচিকিৎসক হতে চলে গেলো বোস্টন। পড়াশোনা শেষ করে ওখানেই মেসাচুসেট্স
জেনারেল হসপিটালে কাজ শুরু করলো সে। মা হিসেবে গর্বে বুক ভরে গিয়েছিলো আমার।
আমার সাথে তার সম্পর্ক শুরু থেকেই ছিল একটু
অস্বাভাবিক। সেরকম কোনো চাহিদা ছিলোনা অরুণের। কখনও কিছু মুখে ভেঙে চাইতও না সে।
মা হিসেবে আমার উপর খুব একটা নির্ভরতাও ছিলোনা। সব দায়িত্ব সে পালন করতো কিন্তু কোনো আদর সোহাগের কোনোদিন বালাই
ছিলোনা। তাকে জড়িয়ে ধরলে সে কোনো প্রতিবাদ না করলেও তার দিক থেকে যেন কোনো সাড়া
পেতাম না আমি। আর একটা অদ্ভুত স্বভাব ছিল অরুণের। পোকা, মাকড়, ছোট ছোট খরগোশ, ব্যাঙ সে ফিরে'আসার পর থেকেই নিয়ে আসতো বাড়িতে। বাড়ির নিচে মাটির তলার ঘরে সে একটা জায়গা করে
নিয়েছিল নিজের। আমি সেখানে মাঝে মাঝেই জানোয়ারের দেহাবশেষ খুঁজে পেতাম। তাদের
মস্তিষ্ক কেটে বার বার কি যেন দেখতো অরুণ। অনেক বার বারণ করা সত্ত্বেও তার এই আজব
খেয়াল সে ছাড়তো না। আমিও ফিরে পাওয়া সবেধন মানিক ছেলেকে বেশি কিছু বলতে পারতাম না।
গা গুলিয়ে উঠতো আমার দেহগুলো দেখে কিন্তু দেখেও অদেখা করতাম আমি। দেহাবশেষগুলো ও
নিজেই ফেলে দিয়ে আসতো বাড়ির পিছনের জঙ্গলে। কাউকে কিছু বোঝার সুযোগ দিতোনা। আরও
একটা কথা আমার মনে কড়া নাড়তো। অরুণকে বাড়ি আনার পর থেকে সব সময় মনে হতো কেউ যেন
আড়াল থেকে আমাদের লক্ষ্য করছে। কখনও মনে হতো ইউনিভার্সিটি থেকে বাড়ি ফেরার পথে
গাড়ির আলোতে হঠাৎ যেন রাস্তার মাঝখান থেকে কাউকে সরে যেতে দেখলাম। কখনও বা মনে হতো
পিছনের জঙ্গলের সীমানায় কে যেন দাঁড়িয়ে আছে। ছায়া ছায়া তাদের শরীর, মুখ চোখ স্পষ্ট বোঝা যায়না। আবার কখনও রাতে মনে হতো জানলার বাইরে এ কার পায়ের
শব্দ? কিন্তু দরজা খুলে বেরিয়ে কাউকে দেখা যেতোনা। এ সবই
একাকীত্বর ফল বলে ধরে নিয়েছিলাম আমি। মনের কুয়াশা ঝেড়ে ফেলে এগিয়ে যাওয়াকেই শ্রেয়
বলে মনে করেছিলাম।
অরুণকে আমি জিজ্ঞাসা করতে চাইনি এতো বছর সে কোথায়
ছিল। যেদিন সে হারিয়ে গিয়েছিলো সেদিন ঠিক কি হয়েছিল? সত্যিই কি নীল আলোর বৃত্ত তাকে নিয়ে চলে গিয়েছিলো অন্য কোথাও? কি তার অজ্ঞাতবাসের রহস্য? কিন্তু কৌতূহল কি কখনও সম্পূর্ণ
দমন করা যায়? কথার ছলে বার কয়েক মুখ দিয়ে
বেরিয়ে গিয়েছিলো,"এতদিন কোথায় ছিলি বাবা?" কিন্তু অরুন চিরকাল বলেছে সে কোথাও যায়নি। সে জানেনা কি করে এতগুলো বছর কেটে
গেছে। সে শুধু জানে সে ড্যানির সাথে শীষের আওয়াজ লক্ষ্য করে এগিয়েছিল। উঠেছিল সেই
সিঁড়ি বেয়ে। কিন্তু তার স্মৃতিতে সে শুধু কয়েক মুহূর্ত ওই সিঁড়ির উপর দাঁড়িয়েছিল
আর তারপরেই আমি তাকে খুঁজে পাই। কোনো নীল আলো বা বাজ পড়ার শব্দ সে শুনতে পায়নি।
তার সম্পূর্ণ বড়ো হওয়ার সময়ের মধ্যে এই কথার কোনো নড়চড় হয়নি। আমিও জীবনের এক
আশ্চর্য্য অধ্যায় হিসেবে ধরে নিয়ে এই নিয়ে আর তাকে কিছু বলিনি। আমার সন্তান ফিরে
এসেছে এর বেশি আর আমার কি চাই? ওকে বড়ো করা ছাড়া কোনো কিছুতে
মন দিতে চাইনি আমি।
মাস ছয়েক আগে একদিন সকালবেলা দরজার ঘন্টা বেজে উঠলো।
দরজা খুলে আমি অবাক,"এ কি অরুণ তুই?" উত্তরে অরুণ শুধু বললো,"আর ভালো লাগছিলো না মা, চলে এলাম। এবার এখানেই কোনো হাসপাতালে কাজ করবো।" বেশি কথা বলার ছেলে
অরুণ নয় তাই আমি আর কিছু জিজ্ঞাসা করলাম না। ও কৃতি ছেলে, তাছাড়া স্নায়ুবিজ্ঞানের শল্যচিকিৎসক। এখানে কোনো হাসপাতাল ওকে পেলে লুফে নেবে।
ওর কাজের অভাব হবেনা। হয়তো আমার কথা খুব মনে পড়ছিলো। মনের কোনায় একটা খটকা থাকলেও
মনকে এই বলে শান্তনা দিলাম।
তারপর থেকে অরুণ বাড়িতেই সময় কাটাতে লাগলো। ওর বাবার
সেই পুরোনো মাটির নিচের ঘরে কি যেন করতো সারাদিন। কিন্তু নিয়ম মতো খাওয়াদাওয়া, ডাকলে সাড়া দেওয়া সবই ছিল সেই চিরকালের মতো। আমিও খুশি ছিলাম অরুণ ফিরে আসায়।
এই সত্তরের কোঠায় এসে কারই বা একা থাকতে ভালো লাগে? সকালে উঠে ওর জন্য খাবার বানানো, সারাদিন ওর খুট
খুট করার আওয়াজ শোনা, সন্ধ্যেতে একসাথে বসে গল্প করা, কখনও বা একসাথে বসে টিভি দেখা, ভালোই লাগতো
আমার। ইউনিভার্সিটি থেকে অবসর নিলেও মাঝে মাঝে যেতাম আমি। একদিন সকালে আমি যখন
ইউনিভার্সিটি যাবো বলে তৈরী হচ্ছি, তখন সকালের দৌড়
শেষ করে ঘরে ঢুকলো অরুণ। টিভিতে কি একটা খবর দেখাচ্ছিল। আমি খেয়াল করিনি আগে
কিন্তু অরুণ খবরটা দেখে দাঁড়িয়ে গেলো। বোস্টনে ম্যাসাচুসেটস জেনেরালে মর্গ থেকে
মৃতদেহ লোপাট হওয়ার ঘটনার এখনও কোনো সুরাহা হয়নি। পুলিশের সন্দেহ গিয়ে পড়েছে কিছু
ডাক্তারের উপরে কিন্তু তারা আগেই হাসপাতাল ছেড়ে চলে গেছে। তাছাড়া পুলিশের হাতে
তাদের বিরুদ্ধে কোনো প্রমাণও নেই। বুঝলাম অরুণ চিন্তা করছে কারণ এ তার সেই ছেড়ে
আসা হাসপাতাল। আসল কারণ যে কি তা বুঝতে পেরেছি অনেক পরে। সে যে কি ভয়ঙ্কর সত্য তা
ছিল আমার কল্পনার অতীত।
আমি আজকে এই ইমেল লিখতে বাদ্ধ হচ্ছি তার কারণ আমার আর
কিছুই করার নেই। নিজের ফিরে পাওয়া সন্তানের কোনো ক্ষতি আমি করতে পারবো না। আমার
হাতে আর বেশি সময় নেই। শেষ করে দেবে ও আমায়। বাঁচবার কোনো ইচ্ছে আমার নেই কিন্তু
অন্তত কেউ জানুক কি ভীষণ বিপদ আমি রেখে যাচ্ছি পৃথিবীর বুকে। মনুষ্যজাতির প্রতি
আমার একটা কর্তব্য আছে। আর আমি জানালেও এখানকার আইনরক্ষকরা এই বুড়ি, কালো চামড়ার মহিলার কথা বিশ্বাস করবে না। ওদের দোষ নেই, কথাটা বিশ্বাসযোগ্যও নয় তাই যারা এ সব নিয়ে অনুসন্ধান করে বলে গুজব, তাদের কাছেই পাঠিয়ে যাবো এই গল্প।
আজ অনেক রাত হয়ে গিয়েছিলো রাতের খাবার দিতে।
সন্ধেবেলা চোখ লেগে গিয়েছিলো। ঘুম থেকে উঠে অরুণকে ডেকে কোনো সাড়া পেলাম না। তন্ময়
হয়ে কি যে করছে ছেলেটা? এই ভেবে বেসমেন্টের দরজা খুলে
সন্তপর্নে সিঁড়ি দিয়ে নামছিলাম আমি। প্রথমেই যেটা লক্ষ করলাম সেটা হলো ঘরের মধ্যে
বড়ো আলোটা নেভানো। বেশ কিছু পরিবর্তন করেছে অরুণ ঘরটাতে। সিঁড়ির পাশে রাখা রয়েছে
একটা বিরাট শীততাপনিয়ন্ত্রিত ফ্রিজার। কি কারণে অরুণের তা দরকার হতে পারে তা আমার
বোধগম্য হলো না। কৌতূহলবশত ফ্রিজারের ডালাটা খুললাম শরীরের সমস্ত শক্তি একত্রিত
করে। জ্বলে উঠলো ফ্রিজারের ভিতরের আলো আর তাতে যা দেখলাম তাতে আমার নিশ্বাস বন্ধ
হয়ে এলো। পচা মাংসের গন্ধ নাকে এসে ঝাপটা মারার সাথে সাথেই দেখতে পেলাম পর পর
সাজানো রয়েছে মানুষের মাথা। একটা খবর কিছুদিন ধরেই সব প্রচারমাধ্যমে ঘুরছিলো। অনেক
মানুষ নিখোঁজ হয়েছে এই ইউনিভার্সিটি অঞ্চলে গত কয়েকদিনে। তবেকি তার জন্য আমার অরুণ
দায়ী? মাথাগুলোর উপরদিকগুলো সব খোলা আর তার মধ্যে দেখা
যাচ্ছে কালো কালো গোল ডিমের মতো কিছু। মস্তিষ্কের মধ্যে রাখা রয়েছে সেই ডিম্।
কিন্তু অরুণ এরকম কেন করবে? তাছাড়া ওর মতো রোগা একটা শরীর
এতো মানুষকে গুমখুন করে কি করে? এ অসম্ভব, এ হতে পারেনা। মাথাটা ঘুরে গেলো আমার, সামলে নিলাম
ফ্রিজারটা ধরে। হাত পা কেমন ঠান্ডা হয়ে গেছে, অবশ লাগছে সারা
শরীরটা। ঘরটার মাঝামাঝি একটা পর্দা টাঙানো, তার পিছনে দেখা
যাচ্ছে একটা উজ্জ্বল আলো। পা টিপে টিপে পর্দাটার দিকে এগিয়ে গেলাম আমি। হালকা ফাঁক
দিয়ে যা দেখলাম তাতে আমার গা গুলিয়ে বমি চলে এলো। একটা শীতল স্রোত নেমে গেলো আমার
শিরদাঁড়া বেয়ে যা ছড়িয়ে পড়লো শরীরের প্রত্যেক স্নায়ুতন্ত্রে। নিজের চোখকে বিশ্বাস
হচ্ছিলো না আমার। এ কোনো দুঃস্বপ্ন, এ সত্যি নয়, এ সত্যি হতে পারেনা। হাসপাতালের স্ট্রেচার পাতা রয়েছে একটা টেবিলের উপরে।
সেখানে শোয়ানো একটা মৃতদেহ। মাথাটা শরীরের থেকে আলাদা আর মস্তিষ্কের উপরটা খোলা।
মাথাটাকে দুহাতে ধরে তার উপরে ঝুঁকে পড়েছে অরুণ। রক্তে রাঙা তার হাত দুটো। তার
নিজের মাথাটা এক অস্বাভাবিক কোন সৃষ্টি করে'ঝুলে রয়েছে পিছন
দিকে আর গলার জায়গা থেকে বেরিয়ে এসেছে ধূসর রঙের আর একটা গলা। সেই গলা থেকে সৃষ্টি
হয়েছে ওই একই ধূসর রঙের মাথা যাতে নাক, চোখ কিছু নেই।
মুখের পুরো সামনেটা জুড়ে একটা গহ্বর যার চারপাশে ধারালো দাঁতের সারি। সেই গহ্বরের
অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এসেছে একটা সবজে রঙের নল জাতীয় কিছু। কালচে সবুজ নলটার ভিতর
থেকে একের পর এক কালো ডিম্ নেমে আসছে আর জড়ো হচ্ছে কাটা মাথাটার মস্তিষ্কের উপরে।
একটা নিঃশব্দ চিৎকার গলা বেয়ে উঠে এলো। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে মুখ বন্ধ করে নিজেকে
আটকানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু শেষরক্ষা করতে পারলাম না। গলা দিয়ে একটা করুণ আওয়াজ বেরিয়ে
এলো আর অরুণের দুটো মাথাই একসঙ্গে ঘুরে তাকালো আমার দিকে। কোনো প্রতিক্রিয়া হলোনা
অরুণের। এক মুহূর্তের জন্য থেমে গিয়েও আবার নিজের কাজে মনোনিবেশ করলো সে।
পর্দাটার কাছ থেকে ছিটকে সরে এলাম আমি। টলোমলো পায়ে, কাঁপতে কাঁপতে উঠে এলাম সিঁড়ি দিয়ে। ফিরে এলাম নিজের ঘরে। ধপ করে বসে পড়লাম
নিজের চেয়ারে। কি করবো, কি ভাববো কিছু বুঝে উঠতে
পারছিলাম না। শরীরে খেলা করছে অকৃত্তিম আতঙ্ক। নিশ্বাস নিতে পারছিলাম না। বেশ
কিছুক্ষণ লাগলো নিজেকে শান্ত করতে। বোঝার চেষ্টা করলাম ঘটনাপ্রবাহ। বুঝতে পারলাম
অরুণের ফিরে আসার পিছনে ঈশ্বরের আশীর্বাদ নয়, আছে শয়তানের
অভিশাপ। অরুণের ফিরে আসাটা স্বাভাবিক বিজ্ঞানের আওতায় পড়েনা এটা আমি জানতাম কিন্তু
ও কি? ও কি জঙ্গল থেকে আসা কোনো পরজীবী? এমন কি হয় এই পৃথিবীতে? আমি জানিনা। কিন্তু এ আমি
নিশ্চিত এর পরে আর আমার বেশি আয়ু বাকি নেই। অরুণের মধ্যে থাকা ওই প্রাণী আমায়
নিস্তার দেবেনা। কি করবো? পুলিশকে জানাবো? কে বিশ্বাস করবে আমার কথা? অরুণকে শেষ করার ক্ষমতা আমার
নেই। ও আমার নিজের সন্তান, ওই পরজীবীকে শেষ করতে হলে অরুণও
আর থাকবে না, পরজীবীর নিয়মই তাই। আমার নিজের
রিসার্চ তাই বলে। তাহলে?
ঠিক করলাম লিখে যাবো সব কথা। পাঠিয়ে দেব এমন জায়গায়
যারা এ নিয়ে কিছু করতে পারে। তাই লিখতে বাধ্য হলাম এই ইমেল। আমার আর সময় নেই।
দরজার বাইরে সিঁড়িতে পায়ের আওয়াজ পাচ্ছি। অরুণ উঠে আসছে সিঁড়ি বেয়ে। ওর কাজ শেষ
হয়েছে, এবার ও শেষ করে দেবে সমস্ত প্রমাণ। নিজেকে শান্ত হতে
হবে, মৃত্যুকে শিকার করতে হবে আমায়। ওই দরজায় প্রথম টোকা
পড়লো, আস্তে আস্তে বাড়ছে দরজায় ধাক্কার জোর...
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
এফ বি আইয়ের ডেপুটি
ডিরেক্টর সাদা এ ফোর কাগজটা ছুঁড়ে ফেললেন টেবিলে। চিন্তান্বিত মুখে জিজ্ঞাসা করলেন,"কোথা থেকে এলো এই ইমেল?" এক্স বিভাগের স্পেশাল এজেন্ট উত্তর দিলেন,"কালোহী থেকে। এক
ভারতীয় মহিলা পাঠিয়েছেন। আমরা গতকালই একটা দল পাঠিয়েছিলাম কিন্তু পুরো বাড়িটা ছাই
হয়ে গেছে, সম্পূর্ণ ধ্বংসস্তূপ। কিছু দেহাবশেষ ছাড়া কিছুই পাওয়া
যায়নি। পুড়ে যাওয়া দেহাবশেষগুলো পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। ওই মহিলা বা তার ছেলে, কারোরই কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি, অনুসন্ধান
চলছে।" ডিরেক্টর আবার বললেন,"এরকম কিছু আগে হয়েছে?" "কিছু গুজব আছে কিন্তু আজ অবধি আমরা কিছু খুঁজে পাইনি।" ডিরেক্টর বললেন,"খুঁজতে থাকো, এর একটা বিহিত হওয়া দরকার।
আপেলেশিয়ান পর্বতমালায় হারিয়ে যাওয়া মানুষের সংখ্যা দিনে দিনে বৃদ্ধি
পাচ্ছে।" হাতের ইঙ্গিতে তিনি বুঝিয়ে দিলেন যে এই সাক্ষাতের সময় শেষ। এক্স
বিভাগের এজেন্ট ফিরে এলেন নিজের কক্ষে। তার রিপোর্টটা সাবধানে রাখলেন মোটা একটা
ফাইলের ভিতর। এক্স বিভাগের সমাধান না হওয়া ঘটনাগুলোর শ্রেণীতে যুক্ত হলো একটা নতুন
পাতা।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন