ভাংড়িওয়ালার আবাদ - আবদুস সাত্তার বিশ্বাস


 

।। এক ।।


পশ্চিম আকাশে সূর্য অস্ত গেছে। আকাশ তবু আলোকিত হয়ে রয়েছে। সেই আলোয় পাখিরা নীড়ে ফিরছে। আর গরুর দল ধুলো উড়িয়ে ঘরে ফিরছে হাম্বা হাম্বা ডাক ছেড়ে। আকাশ বোধহয় এদের জন্যই আলো জ্বেলে রেখেছে। না হলে আলো নিভে গেলে এরা যে পথ হারাবে। আকাশ এদের এতটা বিপদে ফেলতে চায়নি


ছিদ্দিক এইসময় বাড়ি ফিরলে তার সাথে টুকটুকি নেই দেখে মনোরা বিবি শুধালো, 'টুকটুকি কই গো? টুকটুকি দেকচি ন্যা!'

মনোরা বিবি ছিদ্দিকের ঘরনি। বক্সিপুরের মেয়ে। ছিদ্দিক তাদের পাড়ার কাওসারের বিয়ের বরযাত্রী গিয়ে তাকে দেখে বিয়ে করে আনে। গরিব ঘরের মেয়ে হলে কী হবে? তার রূপ কিন্তু বড়লোকদের পাতে দেওয়ার মতো। যেকারণেই ছিদ্দিক তাকে...

ছিদ্দিক বলল, 'মোড়ে থুয়ে আসনু। টুকটুকির এ্যাকচিন কাজ করাতে হবে। দিনের বেলায় সুমায় হয় না বুলে এ্যাখুন থুয়ে আসনু। মিস্ত্রি রাতে কাজ করবে। আমি তাহিলে সকালবেলায় টুকটুকি লিয়ে ফের গাঁ ঘুরতে যাতে পারবো।'

শুনে মনোরা বিবি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, 'যাক, সে-ও ভালো। আমি আবার ভেবেচিনু...' বলে সে ছিদ্দিককে লুঙ্গি ও গামছা খানা ঘর থেকে বের করে দিয়ে বলল, 'প্যান্ট ছাড়ো। ছেড়ে কল থেকে গা ধুয়ে আসো। আমি ত্যাতক্ষণে পাটি পেড়ে ভাত, তরকারি বেড়ে থুই। তুমি এসে খাতে বসো...'


।। দুই ।।

 

ছিদ্দিকের বাড়িতে কোনো কল নেই। বাড়ির বাইরে সরানের ধারে বটতলায় একটা খাসকল রয়েছে। ছিদ্দিকের বাড়ির ও আরও কয়েক খানা বাড়ির লোক এ কলে জল খায়। কল নষ্ট হয়ে গেলে তারাই সারে। সরকারের কোনো লোক এসে সারে না। ছিদ্দিক ওই কল থেকে গা ধুয়ে এসে পাটির ওপর বসে মুখে 'বিসমিল্লাহ' উচ্চারণ করে খেতে বসল

মনোরা বিবি সেসময় ছিদ্দিকের সামনে বসে বলল, 'আমাধের ভুঁইড্যা ম্যালা দিন হলো ভাগে দ্যাওয়া আছে, তাই না!'

ছিদ্দিকের একটা নিয়ম আছে, খাওয়ার সময় মুখে কথা বলে না। খাওয়ার সময় মুখে কথা বলতে নেই। চুপচাপ দাঁতে চিবিয়ে খাবার খেতে হয়। তাহলে সে খাবার খেয়ে গায়ে লাগে। সহজে হজম হয়। পেট খারাপ হয় না। যে কারণে সে খাওয়ার সময় যতটা সম্ভব কথা না বলে চুপচাপ খাবার খেয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এছাড়া সে খাবার শেষে থালা চেটে খায়। থালা চেটে খাওয়া হুকুম আছে, নবিজির সুন্নত। নবিজি এভাবে খেতেন। আলেমদের মুখে তার শোনা আছে। সুতরাং সে এভাবে খাবার খাওয়া শেষ করে একটা ঢেঁকুর তুলে বলল, 'কী বুলচিলি, এব্যার বুল!'

 

মনোরা বিবি কথাটা দ্বিতীয় বার বলল, 'আমাধের ভুঁইড্যা... '


ছিদ্দিক বলল, 'হ্যাঁ। কিন্তুক ক্যানে?'

মনোরা বিবি বলল, 'ভুঁইড্যা লিয়ে ল্যাও!'

'লিয়ে কী করবো?'

'লিজে আবাদ করো। লিজে আবাদ করলে আজকাল আবাদে ভালো লাভ আচে। ভাগে দিয়ে কুনু লাভ আচে?'

'কিন্তুক আবাদ যে কুনুদিন করিনি। করতে পারবো?'

'ক্যানে পারব্যা না? আবাদ করা কি খুব আঁকড়ের কাজ নাকি? যেকোনো মানুষই তো আবাদ করতে পারে। তাহিলে তুমি পারব্যা না ক্যানে!'

'কুনুদিন করিনি তো তাই সাহস পাচি ন্যা।'

'ক্যানে, তুমার বাপের সাথে কুনুদিন মাঠে যাও নি?'

'কই গেলচি! ছেলেবেলাতেই তো বাপ মারা যায়। তারপর আস্তে আস্তে এই লাইনে চলে আসি। সুতরাং মাঠে যাওয়া হয়নি। তবে তুই য্যাখুন বুলচিস, চেষ্টা করে দেকব। না পারলে পরে না হয়  অকেই আবার ভাগে দিব।'

'হ্যাঁ, তাই করো।'

 

।। তিন ।।

মনোরা বিবির সাথে কথা সেরে ছিদ্দিক ভাগারুর বাড়ি এল। ভাগারুকে কথাটা জানানো দরকার আছে। ভাগারু, যে ভুঁই ভাগে করে। ছিদ্দিকের ভাগারুর নাম নিয়াজ সেখ। একই পাড়ায় বাড়ি। তাহলেও তার বাড়ি থেকে ছিদ্দিকের ভুঁইটা কাছে। বাড়ি থেকে তাকালে ভুঁইটা দেখতে পাওয়া যায়। নিয়াজ সেখের নিজস্ব লাঙ্গল, গরু আছে; স্যালো, মেশিন আছে; ভুঁইয়ে গোবরে সার প্রয়োগ করে। যেকারণে ছিদ্দিক ভুঁইটা তাকেই ভাগে দিয়ে রেখেছিল এতদিন

যাইহোক, ছিদ্দিক তার বাড়ি এসেও সরাসরি বাড়ির ভিতর ঢুকল না। কারও বাড়ির ভিতর সরাসরি ঢুকতে নেই। বাড়ির মেয়েছেলে, মেয়েমানুষ কে কোথায় কোন অবস্থায় থাকে বলা তো যায়না। তাই বাইরে থেকে মুখে আওয়াজ করে কারও বাড়ির ভিতর ঢুকতে হয়। পাড়ার মুরুব্বিদের মুখে ছিদ্দিকের শোনা আছে। অতএব ছিদ্দিক মুখে আওয়াজ করল, 'কই গো, নিয়াজ ভাই! বাড়ি আচো নাকি!'

বাড়ির ভিতর থেকে নিয়াজ সেখ উত্তর দিল, 'কে, ছিদ্দিক?'

'হ্যাঁ, ভাই।'

'আচি, আয়।'

ছিদ্দিক বাড়ির ভিতর ঢুকে গেল, 'কী করচ?'

'বলদ দুইট্যা গোহালে তুলে দিয়ে ক্যাবলই বসনু। কী খবর, বুল!'

ছিদ্দিক বলল, 'তুমাকে এ্যাকটা কথা বুলতে আসনু, নিয়াজ ভাই!'

'কী কথা, বুল!'

ছিদ্দিক শুধালো, 'আমার ভুঁইড্যা কি চষ্যাচ?'

'না, ক্যানে?'

'তাহিলে আর চষ্যোনা ভাই। আমি লিজেই আবাদ করবো। এই কথাডাই তুমাকে বুলতে আসনু।'

কথাটা শুনে নিয়াজ সেখের দুঃখ পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা না পেয়ে সে খুবই খুশি হল। বলল, 'এ্যা তো খুবই ভালো কথা। আমি তো সব সুমায় এড্যাই চাহাই, সবাই লিজে আবাদ করুক; মানুষ সবাই আবাদ মুখি হোক; তাহিলে দ্যাশের উন্নতি হবে। কুনু মানুষের খাবারের অভাব থাকবে না। কিনে খাতে হবে না। কিনা চালের ভাত, কিনা গমের আটার উটি আর কিনা ত্যালের তরকারি খাইয়্যাই মানুষের য্যাতো রোগ। সুগার ও আরও ক্যাতো রকমের অসুখ। আগে যুগের মানুষের এ্যাতো রোগ বালাই ছিল? রোগ কী জিনিস আগে যুগের মানুষ এ্যাতো বুঝতোক না। কারণ, আগে যুগের মানুষ মাঠে খাটতোক, পরিছ্রম করতোক আর ঘরের চালের ভাত খাতোক...'

ছিদ্দিকের এই ভুঁইটার নাম বাবুর ভুঁই। ভুঁইটা মাঝারি মাঠে। ছিদ্দিকের দাদো আমির হামজা বাবুদের হালসানা ছিল। বাবুদের বাড়িতে কাজ কাম করত। বঙ্কুবাবু নামে এক বাবু খুশি মনে তাকে ভুঁইটা দিয়েছিল। তাই ভুঁইটার নাম বাবুর ভুঁই। ছিদ্দিকের সেই দাদো মারা যাওয়ার পর ভুঁইটা তার বাপের ভাগে পড়েছিল। তার বাপ মারা যাওয়ার পর তার ভাগে পড়েছে। ছিদ্দিকের এই একটাই ভুঁই। আর কোনো ভুঁই নেই। কিন্তু ছিদ্দিক ভুঁইটায় কোনোদিন আবাদ করেনি। নিয়াজ সেখের কাছে ভাগে রেখেছে। তিন ভাগের ভাগে। অর্থাৎ জমিতে উৎপন্ন ফসলের তিন ভাগ করে দু-ভাগ পায় নিয়াজ সেখ আর এক ভাগ পায় ছিদ্দিক। কারণ, খরচাপাতি ছিদ্দিক কোনোদিন সমান সমান দেয়নি। সমান সমান দিলে আধা আধি ভাগ পেতো


।। চার ।।


পরের দিন ছিদ্দিক মাঠে ভুঁই দেখতে এসে ভুঁইয়ের চারপাশ ঘুরে দেখল। ভুঁইয়ে পাট ছিল। পাট কেটে নেওয়ার পর ভুঁই এখন আচষ পড়ে রয়েছে। পাটের খোঁচ কেমন খাড়া খাড়া হয়ে আছে। অসতর্ক হয়ে ভুঁইয়ে হাঁটলে পায়ে খোঁচ লেগে যাবে। আর ভুঁইয়ে ঘাস রয়েছে। লোকের গরু, ছাগল চরছে। দেখতে দেখতে ছিদ্দিক লক্ষ্য করল, খানিক দূরে একটা ট্রাক্টর চলছে। লোকের ভুঁই চাষ করছে। ছিদ্দিক এক পা এক পা করে ট্রাক্টরের কাছে গেল। গিয়ে দেখল, বাবলা গাছতলায় নমাজি, সেরালি, খাইরুল, বাশার, খোশ মহাম্মদ, হায়দর ও ইমরান এরা কয়েকজন লোক বসে রয়েছে। ফুকফুক করে বিড়ি টানছে। কারও গায়ে জামা নেই। সবাই খালি গায়ে আছে। তবে গামছা সব জনার ঘাড়ে আছে। জামা থাকা বলতে শুধু সেরালির গায়ে আছে। আর সেই জামার বুক পকেটে খাতা, কলম দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। তা দেখে ছিদ্দিক বুঝতে পারল, মাঠে ট্রাক্টর এই-ই নামালছে। ট্রাক্টর কার কতটুকু ভুঁই  চাষ করছে ওই নোটবুকে হিসাব রাখছে। তবু ছিদ্দিক তার পাশে দাঁড়িয়ে শুধালো, 'মাঠে টাক্টার কে নামালচে, ভাই?'

সেরালি বলল, 'আমি। ক্যানে, ভুঁই চষবি?'

'হ্যাঁ।'

'কুন ভুঁই চষবি?'

'আমার তো এ্যাকখানই ভুঁই আচে, বাবুর ভুঁই।'

'ভুঁইখান নিয়াজ সেখের কাছে ছিল না!'

'হ্যাঁ, ছিল; এবছর আমি লিজে আবাদ করবো। চষ্যে দিবা?'

'আজ হবে না, কাল চষ্যে দিব।'

কথামতো সেরালি ভুঁই খানা চষে দিল। শুধু তার খানা নয়, পাশালের সব ভুঁইই চষে দিল। দিলে সবার মতো ছিদ্দিকও তার ভুঁই খানা মাটির ভাঁপ বের করার জন্য কিছুদিন ফেলে রাখল। রাখার পর গম বোনার সময় হলে সবার দেখাদেখি সে-ও ভুঁই খানা ভিজালো এবং ভুঁই জো হয়ে উঠলে একসাথে ভুঁই বোনা শুরু হল। সবাই যে যেমন পারল ভুঁই বুনে সারল। কিন্তু ছিদ্দিক তার ভুঁই বোনার জন্য কোনো লাঙ্গল পেল না। না ট্রাক্টরের লাঙ্গল, না গরুর লাঙ্গল। না পেলে ভুঁইয়ের জো হারিয়ে গেল এবং মাটি টেনে গেল। পরে জো আনার জন্য তাকে দ্বিতীয়বার ভুঁই ভিজাতে হল এবং ভুঁই জো হতে হতে গম বুনতে তার দেরি হয়ে গেল। ফলে গম নামলা হয়ে গেল। সবাই জানে, নামলা ফসল ভালো হয়না। ফসল হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। তারও হল না। শিষ বেরিয়ে দানা পুষ্ট হওয়ার আগেই গম পেকে গেল। ওকে পাকা বলে না। ঝাকাসে শুকিয়ে গেল। ফলে দানা জিরার মতো সরু হয়ে গেল। কেটে মেড়ে দশ কাঠা ভুঁইয়ে মোটে দু-মণ গম হল। যেখানে ছয় থেকে সাত মণ গম হওয়ার কথা ছিল। ফলে ছিদ্দিক গমে লস খেয়ে গেল। সেই লস পূরণ করার জন্য সে দ্বিতীয়বার আবাদ করল, পাট বুনলো


।। পাঁচ ।।

যারা পাকা পাট চাষি হয় পাট বোনার আগে তারা দোকান থেকে পাটের বিচি কিনে সেই বিচি রোদে শুকাতে দেয়। হালকা একটু গরম করে নেয়। নিলে পাটের চারা ভালো বের হয়। তারপর কলা বা মানের ডগা কেটে তাতে গুনে গুনে কিছু বিচি চারাতে দেয়। কেউ কেউ আবার মাটির কাতারিতে মাটি ভরে চারাতে দেয়। চারা কেমন বেরোচ্ছে দেখার জন্য। যদি কুড়িটা বিচির মধ্যে পনেরোটা বিচি বা তার অধিক বিচির চারা বের হয় তাহলে জানতে হবে বিচি ঠিক আছে, বোনা যাবে। তার কম চারা বের হলে বিচি ঠিক নেই, বোনা যাবে না। চাষিরা তখন ওই বিচি ফেরত দিয়ে নতুন বিচি নিয়ে আসে। না হলে যে আবাদ মার যাবে। একটা আবাদ মার যাওয়া মানে বিরাট ক্ষতি। চাষিরা সব ক্ষতি সইতে পারে কিন্তু আবাদের ক্ষতি সইতে পারেনা। বুকে মাটি ঠেকে যায়। কিন্তু ছিদ্দিক এসবের কিছুই করেনা। বিচি কিনে অমনি ভুঁইয়ে বুনে দেয়। দেওয়ার পর ক'দিন বাদে মাঠে গিয়ে দেখে, পাটের চারা সেভাবে বের হয়নি। তারমানে দোকানদার তাকে ভালো বিচি দেয়নি। গতবছরের পুরনো বিচি দিয়েছে। এবছরের টাটকা এবং ভালো বিচি দিলে এত কম পাট বেরোত না। হাউই হয়ে পাট বেরোত। ভুঁইয়ে সব পাটের জায়গা হতো না। পরে ভুঁই নিড়ানোর সময় নিড়ানি দিয়ে কিছু পাট কেটে বাদ দিতে হতো। বৈশাখ মাসে পোকায় কেটে দিলে তা-ও পাটের বাউলি চরুস থাকত। গোটা ভুঁইয়ে কম পক্ষে ষাট থেকে সত্তর আঁটি পাট হতো। গমের লস পাটে উঠে যেত। কিন্তু তা না হয়ে পাটেও লস হল। দশ কাঠা ভুঁইয়ে মোটে বাইশ আঁটি পাট হল। ফলে গমের চাইতে পাটে তার দ্বিগুণ লস হল। কারণ, গমের চাইতে পাটে খরচ বেশি, তাই লসও বেশি।   



।। ছয় ।।

                        
এভাবে পরপর দুটো আবাদে লস খেয়ে ছিদ্দিকের মন ভেঙে গেল। সে আর আবাদ করবেনা ধরে নিয়ে চুপ করে বসে থাকল এবং মনোরা বিবিকে বলল, '...আমার দ্বারা হবেনা রে মনোরা, আমি আর আবাদ করবো না। আমাকে আর আবাদ করতে বুলিস ন্যা। আবাদি লোক ছাড়া আবাদ হবে না।'

কিন্তু মনোরা বিবি শুনল না। সে বলল, 'এব্যারকার গমের আবাদডা করে দ্যাখো! এব্যারও যতি না হয় ত্যাখুন দ্যাখা যাবে...'


মনোরা বিবির কথায় ছিদ্দিক আবার গম বুনল। গ্যালোবার একসাথে ভুঁই ভিজিয়ে বোনার সময় লাঙ্গলের খুব টান বহে গিয়েছিল। যেকারণে সে এবার ভুঁই চাষ করে সবার আগে গম বুনে দিল। গ্যালোবারের মতো যাতে না হয়। তারপর সে মাস খানেক আর ভুঁইয়ে এল না। তার ভাংড়ির ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত থাকল। টুকটুকি করে গাঁয়ে গাঁয়ে মাইকে হাঁক দিয়ে ভাংড়ি কিনে বেড়ালো---'কাহুরির বাড়ি ভাংড়ি আচে গো! যতি থাকে লিয়ে আসো। ভাঙা সাইকেল থাকলে তা-ও আনো। ছোট সাইকেল থাকলেও আনো। বড় সাইকেল থাকলেও আনো। দাম ভালো পাবা, চারশো টাকা। ছোট সাইকেলও চারশো টাকা, বড় সাইকেলও চারশো টাকা। ঠগাব না, এ্যাকই সমান দাম দিব। সাইকেল যতি না থাকে তো ভাঙা লোহা থাকলেও আনতে পারো। ভাঙা লোহা পঁয়ত্রিশ টাকা কেজি পাবা। টিন ভাঙা থাকলেও আনতে পারো। টিন ভাঙা কুড়ি টাকা কেজি পাবা। পুরাতন খাতা থাকলেও আনতে পারো। পুরাতন খাতা কুড়ি টাকা কেজি পাবা। কার্টন থাকলেও আনতে পারো। কার্টন দশ টাকা কেজি পাবা। এ্যাছাড়া মেয়েধের মাথার চুল, হাঁসের পালকও আনতে পারো। মোটরসাইকেলের পুরাতন ব্যাটারি থাকলেও আনতে পারো। এ্যাকশো টাকা দাম পাবা। আমার মুতন বেশি দাম দিয়ে কেহু কুনু ভাংড়ি মাল কিনবে না। তাই কাহুরির বাড়ি যতি কুনু ভাংড়ি মাল থাকে তো চটপট লিয়ে আসো। চলে গেলে বেশি দামে আর কুথুতে বিক্রি করতে পারব্যা না...'


।। সাত ।।

মাস খানেক পর মনোরা বিবি একদিন শুধালো, 'হ্যাঁ গো, গম বুনে আসা থেকে তুমি কুনুদিন মাঠে  গেলচো? গম ক্যামুন বার হলো মাঠে যাইয়্যে এ্যাকদিন দেখে আসা তো দরকার!'
   ছিদ্দিক বলল, 'দেকতে পাস ন্যা, বাড়ি থেকে কখুন বের হই আর কখুন ফিরি! ঝুঁজকি থাকতে বাড়ি থেকে বের হই আর মুখ আন্ধার হয়ে ফিরি। তাহিলে মাঠে কখুন যাবো! আজই ক্যাবল বেলা থাকতে বাড়ি আসনু।'


'
তাহিলে আজই যাও, গম ক্যামুন বার হয়েচে দেখে আসো!' মনোরা বিবি বলল
ছিদ্দিক বলল, 'তুই না বুললেও আজ আমি মাঠে যাবো।' বলে ছিদ্দিক বাড়ি থেকে বের হয়ে হাঁটতে শুরু করল। খানিক হেঁটে যেতেই রুহুল আমিনের আখ ক্ষেতের আলে বিল্লুর সাথে দেখা হল। বিল্লু তখন মাঠ থেকে এক বস্তা ঘাস কেটে বস্তা মাথায় বাড়ি ফিরছিল। ফিরতে ফিরতে ছিদ্দিকের সাথে দেখা হলে বস্তাটা সে মাথা থেকে টপ করে নামিয়ে রেখে শুধালো, 'কী রে, কুতি যাবি? এ্যাকটা বিড়ি দে, খাই! ম্যালাক্ষুণ বিড়ি খাইনি।'


ছিদ্দিক একটা বিড়ি বের করে দিয়ে বলল, 'ভুঁইড্যা এ্যাকচিন দেখে আসি। গম বুনে দেকতে আসা হয়নি। গম ক্যামুন বারালচে দেখে আসি।'


বিল্লু বিড়িটা ধরিয়ে পরপর দুটো টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বলল, 'আবাদ করে কী করবি? গাঁয়ে গাঁয়ে ভাংড়ি কিনে বেড়া গা!'


ছিদ্দিক তাকে শুধালো, 'গম ক্যামুন বারালচে দেকেচিস?'

বিল্লু বলল, 'তো দেকবো না! সারাদিন মাঠে থাকচি।'

'ক্যামুন বারালচে?'

'দারুণ!' বলে বিল্লু বস্তাটা মাথায় তুলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করলে ছিদ্দিক ভুঁইয়ে এসে মাথা ধরে বসে পড়ল

ভুঁইয়ের আলে তখন হামিদুল নামে এক ব্যক্তি ঘাস কাটছিল। কাটতে কাটতে ছিদ্দিককে মাথা ধরে বসে পড়তে দেখে কাছে এসে শুধালো, 'কী রে ছিদ্দিক, মাথা ধরে বসে পড়লি ক্যানে! কী হলো?'

ছিদ্দিক হামিদুলের দিকে তাকিয়ে তখন বলল, 'ভুঁই দেখে আমার মাথা খারাপ হয়ে গ্যালো! কী করবো, আমি কিচু ভেবে পাচি ন্যা। তাই মাথা ধরে বসে পড়নু!'


হামিদুল শুধালো, 'ক্যানে, ভুঁইয়ের কী হয়েচে?'

বিরক্ত হয়ে ছিদ্দিক বলল, 'দেকতে পাচো না, ভুঁইয়ে গম বার হয়নি!'


হামিদুল বলল, 'দেকতে তো আমি রোজই পাই। দেকতে তুই-ই পাস ন্যা, তুই-ই দ্যাখ!' বলে হামিদুল বকুনির সুরে বলতে লাগল, 'আবাদ জানিস ন্যা কিচু না আবাদ করিস কী করতে! যা জানিস তাই কর। আবাদ করার আগে মাটির সাথে কুটুম করতে হয়। মাটির সাথে তোর তো কুনু যোগাযোগই নাই। য্যাতো যোগাযোগ লোহা লক্কড়ের সাথে, ভাংড়ি মালের সাথে। আবাদ করা অতো সহজ জিনিস লয়; তাহিলে সবাই আবাদি লোক হতে পারতোক। আবাদে নামার আগে আবাদ করা শিখতে হয়। কুন সুময় কুন আবাদ করতে হয়, মাটি কীভাবে তৈরি করতে হয়, কুন সুময় কুন বীজ বুনতে হয়, বিঘে প্রতি কুন বীজ কতটা ফেলতে হয়, কীভাবে ফেলতে হয়, সার ক কেজি হারে দিতে হয়, কুন ফসলে কুন সার দিলে ফসল ভালো হয়, সেচ কখুন দিতে হয় সব কিচু নিখুঁত জেনে তবেই আবাদে নামতে হয়। তুই তো এ্যাসবের কিচুই জানিস ন্যা। জানিস কি? যতি জানতিক তাহিলে এ্যাতো আইঘর গম বুনতিক ন্যা। পাশালে কেহু বুনার পর তবেই গম বুনতিক। এ্যাতো আইঘর গম বুনার লাগেই তো গম বার হয়নি। পাখিতে সব খুঁটে...আমিই ক্যাতোদিন পাখি খেদালচি। ঝাঁক ঝাঁক পাখি। আবার তুই যতি ভুঁইয়ে কিচু পুঁতে থুতিক তা-ও হতোক। সাদা-কালো ক্যারি বা লাল ত্যানা। তা-ও পাখি বসতে ভয় পাতোক। আর বসলেও কম বসতোক। না তো তুই গম বুনে দিয়ে গাঁয়ে গাঁয়ে... তাহিলে হবে!'

নিজের ভুল বুঝতে পেরে ছিদ্দিক শুধালো, 'এ্যাখুন কী করবো, তাই বুলো!'

হামিদুল বলল, 'কী করবি! ভুঁই চষ্যে ফেলে কাঁকড়ি করে আবার গম বুনে দে! নাহিলে ভুঁই মখল যাবে। ভুঁই মখল দিয়ে কী হবে?'

'এ্যাখুন গম বুনে গম নামলা হয়ে যাবে না!'

'না, কেহু কেহু এ্যাখনও গম বুনচে

'তাহিলে তাই করবো। কিন্তুক?'

'বুল!'

'কাঁকড়ি করা কী জিনিস বুঝি ন্যা যে!'

হামিদুল তখন বলল, 'কাঁকড়ি করা কী জিনিস বুঝিস ন্যা, তাহিলে ভাব!'

ছিদ্দিক লজ্জা পেয়ে গেল। তার লজ্জা পেয়ে যাওয়া দেখে হামিদুল বলল, 'ভুঁইয়ে গম বুনে দিয়ে পানি ভরে দ্যাওয়াকে কাঁকড়ি করে বোনা বলে। এব্যার বুঝলি! এভাবে গম বুনলে খুব তাড়াতাড়ি গমের গাছ বার হয়। তিন-চার দিনে ছুঁচ হয়ে যায়। আর সাত-আট দিনে বাউলি চরুস হয়ে যায়।'

'কিন্তুক গম যে মাটির ওপর পড়ে থাকবে! পাখিতে আবার খেয়ে ফেলবে না!'

'না, এ্যাখুন পাখিতে আর গম খাবেনা। কারণ, সারা মাঠেই গম বোনা। পাখির প্যাটে এ্যাখুন অতো খিদে নাই।'

হামিদুলের কথা মতো ছিদ্দিক তাই করল। রছেলের লাঙ্গল দিয়ে ভুঁই চষে ফেলে কাঁকড়ি করে গম বুনে দিল। তিন-চার দিনে যেখানে গমের গাছ বেরিয়ে যাওয়ার কথা সেখানে দশ দিনেও গাছ বেরলো না দেখে ছিদ্দিকের ভীষণই মন খারাপ হল। হামিদুলকে সে একদিন ধরে জিজ্ঞেস করল, 'কী হলো গো...'

হামিদুল বলল, 'তাহিলে কি বিছোনের কুনু গণ্ডগোল আচে?'

'বিছোনের কী গণ্ডগোল থাকবে? আমি তো হাট থেকে ভালো গম কিনে এনে... '

হামিদুল অমনি মাথায় হাত দিল, 'এ্যা তুই কী করেচিস রে, ছিদ্দিক!' তারপর ছিদ্দিককে বলতে লাগল, 'বুনার লাগ্যে হাটের গম কেহু কিনে! হাটের  গমে রোদ দ্যাওয়া থাকে না। হাটের গম মানুষ কিনে উটি খাওয়ার লাগ্যে। ভুঁইয়ে বুনার লাগ্যে কেহু কিনে না। বিছোন গমে মাসে মাসে রোদ দিতে হয়। রোদ দ্যাওয়া কম থাকলে গাছ বার হয়না। অর লাগ্যেই গমের গাছ বার হয়নি। যাইহোক, আবাদ তুই আর করিস ন্যা ছিদ্দিক, আবাদ তোর জন্যে লয়। তুই যে কাজ করে খাস সে কাজই কর! আল্লাহ পাকের ইচ্ছায় ওখ্যান থেকেই তোর চলে যাবে...'

হামিদুলের কথা শুনতে শুনতে ছিদ্দিক নিয়াজ সেখের বাড়ির দিকে তাকাল। ওই তো বাড়িটা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে...






শব্দার্থ:

থুয়ে আসনু-রেখে এলাম; এ্যাকচিন-একটু, সামান্য; বেড়ে থুই-বেড়ে রাখি; সরানের ধারে-রাস্তার পাশে; আঁকড়ের কাজ-কঠিন কাজ; আচষ-চষা নেই এমন জায়গা; পাশালের-পাশের; ঝাকাসে-বাতাসে। ফাল্গুন মাসের পনেরো তারিখের পর থেকে বৈশাখ মাসের পনেরো তারিখ পর্যন্ত যে বাতাস প্রবাহিত হয় তাকে ঝাকাস বলে; কাতারি-মাটির মালসা; কুথুতে-কোত্থাও; আইঘর-আগাম; মখল-কোনো আবাদ করার পর সেই আবাদ না হলে ভুঁই ফাঁকা পড়ে থাকাকে ভুঁই মখল বলে

 

 

চিত্র সৌজন্যঃ আন্তরজাল 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন