ডাক্তারবাবু দের নিয়ে নানা ব্যাঙ্গাত্মক মন্তব্য, অরুচিকর উপাধি প্রদান এবং ক্ষেত্র বিশেষে নানা প্রকার হামলা এখন নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। ডাক্তারদের পক্ষে উমেদারী নয়, নিরপেক্ষ দৃষ্টি ভঙ্গী নিয়ে বলতে গেলেও মনে হয়, এ ধরনের নেতিবাচক মন্তব্যই শুধু নয়, আচরণ ও সংযত করা প্রয়োজন। ভুলে গেলে চলবেনা, এনারাও আমাদের মত মানুষ। প্রত্যেকেরই ঘর সংসার পূত্রকন্যা রয়েছে। তাই তাঁরাও নির্দয় নন। পুনর্জীবন ফিরে পেতেও সেই ডাক্তারবাবুই ভরসা। শুধু কী তাই ? গ্রামীণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলো এমনকি মহকুমা ও সদর হাসপাতালগুলোর যে পরিকাঠামোর মধ্যে ডাক্তারবাবুদের কাজ করতে হয়, তা এককথায় অমানুষিক এবং অমানবিক। কিন্তু শুধু রোগী দেখাই নয়, উপযুক্ত চিকিৎসাও দিতে হবে ডাক্তারবাবুদের।
কিন্তু পাবলিক কিছু বুঝতে নারাজ। হল্লা বাজি,হামলাবাজি যেন জনতার একচেটিয়া অধিকার। যাইহোক আমার এক
পরিচিত ডাক্তারবাবুর জবানিতেই শোনা যাক,একখানা মজার গল্প।
কিন্তু এটা গল্প হলেও সত্যি!
রোগীর সাথে যারা আসেন চিকিৎসালয়ে তাদের আমরা বলি ‘পেসেন্ট পার্টি'। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই
পেসেন্ট পার্টি র সংখ্যা দুই থেকে পাঁচের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। তবে মাঝে মধ্যে তার ব্যতিক্রম হয়েই থাকে। আর পেসেন্ট পার্টির
সংখ্যাধিক্য মানেই চিকিৎসা বিভ্রাট। পারলে ডাক্তারবাবুকে সরিয়ে দিয়ে তারা
নিজেরাই চিকিৎসার ভার নিয়ে নেয়।
" ইনজেকশন দিন, অক্সিজেন দিন, স্যালাইন দিন”, এসব তো আছেই।
এরসাথে আছে নানা কুরুচিকর মন্তব্য, "এখনকার ডাক্তাররা নাড়ি টিপতে জানেনা, জানে রোগীর গলা
টিপতে।" অবশ্য এতেও মাথা গরম করা
যাবেনা। সব নীরবে সহ্য করে নিজের কাজ করতে হয়। আর নিতে হয় কিছু উপস্থিত বুদ্ধির
সহায়তা।
কখনো কখনো পেসেন্ট পার্টি আসত ট্রাক বোঝাই করে। এদেরকে
স্বাস্থ্যকর্মীরা বলতাম , "বৌদি
কেস" ।
পাড়ার জনপ্রিয় কোন বৌদি অসুস্থ হলে হই হই রই রই করে
‘দুপুরবেলার
ঠাকুরপো’রা আসত পাড়া ঝেঁটিয়ে। আর বৌদি একটু বেশি সুন্দরী
এবং সবার সাথে গায়ে পড়া হলে তো আর কথাই নেই। মানে সেসময়
পাড়ায় কোন কারণে যদি অগ্নিকাণ্ড ঘটে যায়, তাহলে এক মগ জল নিয়ে ছোটার মত একটিও প্রাণী অবশিষ্ট থাকত না। যাহোক ট্রাক থেকে নেমেই সেই পেয়ারের ঠাকুরপোদের
শুরু হত চিল চিৎকার, "কোথায় ডাক্তার ! কোথায় ডাক্তার !” আর নিরীহ টেবিলের উপর পড়ত অবিরাম চড় চাপড় ।
এসব ওই ডাক্তারী পড়ার সময় ছাত্রজীবনে হয়ে গিয়েছিল গা সওয়া। ঠাকুরপোবাহিনীকে
বিন্দাস হ্যান্ডেল করে, গম্ভীর মুখে রুগী দেখতাম আমরা। নিতে হত বিশেষ ব্যবস্থা। একদল ঠাকুরপোকে অমুক ওষুধ আনতে দিতাম তো অন্য দলকে তমুক। এইসব করেই মাঠ ক্রমশঃ ফাঁকা হত।
এগুলো হল আমাদের চিকিৎসা
বিজ্ঞানের প্রধান পাঠ এবং এই প্রধান পাঠের পরীক্ষাটিতে ডিস্টিংসন সহ পাশ করেছিলেন আমাদের
এক সিনিয়র। তাঁকে অবশ্য আমরা চোখে দেখিনি। কিন্তু তাঁর পেসেন্ট পার্টি হ্যান্ডেল পৌঁছেছিল
এক কিংবদন্তী পর্যায়ে। তাঁর নাম ধরা যাক পিন্টুদা। সেই
পিন্টুদারই গল্প বলব এখন।
একবার এক "বৌদি কেস" এসেছে। বৌদি গায়ে আগুন দিয়েছেন স্বামীর সাথে ঝগড়া করে। ভগবানের অসীম করুণা, একাধিক ঠাকুরপো তাঁর উপর
ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই আগুন নিভিয়েছেন। আগুন জাস্ট চুম্বন করে গেছে ডান পায়ের
পাতাতে। কিচ্ছুটি হয়নি।
আমাদের ডাক্তারী পরিভাষায় পেটিকেস। কিন্তু ঠাকুরপোদের বোঝায় কার সাধ্য!
বৌদির কাছে একটা প্রমাণ দিতে হবে। কার প্রেম কত গভীর! তাই চলল হুংকার।
"এই
শাল্লা, ডাক্তারের বাচ্চা, দ্যাখ ভালো করে
" - এর সাথে বরাহ,সারমেয় প্রভৃতির বাচ্চার সাথে ডাক্তারের তুলনা। এসব আমরা এখন আর গায়ে মাখিনা। এসব উক্তি করা
পেসেন্ট পার্টির জন্মগত অধিকার। তাছাড়া আমি মনে করি, ডাক্তার আর শুয়োরের বাচ্চার মধ্যে বিশেষ তফাৎ নেই। দু’দলই চারপাশে ভরে যাওয়া পাঁকের প্রতি উদাসীন
থেকে কাজকর্ম করে।
তা সে যাক। খানিকবাদে
দেখা গেল আজকের ঠাকুরপোরা বেশ একটু মরিয়া। কিছু একটা ভাঙচুর হবেই,যদি না এই মুহূর্তে বাহিনীকে ছত্রভঙ্গ
করা যায়।
ইতিমধ্যেই ওষুধের স্লিপ ধরানোর ট্যাকটি্স ফেল মেরে গেছে। প্রহরারত
পুলিশ নিয়মমাফিক প্রাণের ভয়ে মাথার টুপি আর হাতের লাঠি লুকিয়ে বাহিনীর মধ্যে
মিশে গিয়ে "আমি তোমাদের লোক" সেজে
দাঁড়িয়ে আছে।
ঠিক এরকম একটা এভারেস্ট অভিযান মার্কা সময়ে আবির্ভূত হন
পিন্টুদা। এসেই প্রথমে ঠাকুরপোদের নেতাকে ডেকে বলেন, " শুনুন কেস খুব সিরিয়াস। পা নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আপনারা এক কাজ করুন, এক এক করে আসুন পাশের ঘরে।"
গুরুগম্ভীর গলায় পিন্টুদার আদেশ শুনে
সবাই একটু থমকালো। নেতা বললো, “কেন?
কি দরকার?”
"না
আসলে পুড়ে যাওয়া চামড়া পাল্টাতে হবে। আসুন আপনাদের এক এক করে, চামড়ার স্যাম্পেল নিয়ে দেখি
কারটা ম্যাচ করে।"
ঠাকুরপোরা এরকম কথা আগে শোনেনি, বুঝতেও পারছেনা সত্যি নাকি গাঁজা! পিন্টুদাও একেবারে নিক্তি মেপে চেঁচিয়ে
উঠলেন, "কই আসুন। পেসেন্ট খারাপ আছে যে।"
মিনিট খানেকের মধ্যেই ময়দান পুরো ফাঁকা। ট্রাক এবং
সাধের বৌদিকে ফেলে রেখেই প্রাণপ্রিয়
ঠাকুরপোরা উধাও!
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন