কিষানগঞ্জ রেল স্টেশন পার করে ট্রেনটা বেশ ভালো স্পীডে চলছিল।হঠাৎ কিছুদুর গিয়ে থেমে গেল। ট্রেনের কামরার জানলা দিয়ে বাইরে অরূপ দেখল, একটা ছোট জনমানবহীন রেল স্টেশনে ট্রেনটা দাঁড়িয়ে আছে। একটা ইলেকট্রিক পোল থেকে এই স্টেশনের মাঝ বরাবর একটা কম পাওয়ারের বাল্ব টিমটিমিয়ে জ্বলছে। ট্রেনের কামরার ভিতরেও যে আলো ছিল, সেটা কোন অজ্ঞাত কারনে এখন নিভে গিয়েছে। এক কথায় ট্রেনের এই গোটা কামড়াটাতেই ঘুটঘুটে অন্ধকার।
অরূপ সেই
জনমানবহীন রেল স্টেশনে যে আলো জ্বলছিল, সেই আলোতেই হাতের ঘড়ি দেখার চেষ্টা করলো। অন্ধকারে চোখে প্রায় কিছু দেখাই যাচ্ছে না। তবুও দুরের ল্যাম্পপোস্টের
আলোতে অরূপ দেখতে পেল, ঘড়িতে দেড়টা বেজে গিয়েছে।
কলকাতা থেকে
অফিসের কাজে নিউ জলপাইগুড়ি যাচ্ছে অরূপ। শিয়ালদা স্টেশন থেকে যখন ট্রেনটা চলা শুরু
করেছিল, সেসময় কামরাতে বেশ
ভিড় ছিল। তবে রিজার্ভেশন না করলেও জেনারেল কম্পার্টমেন্টের এই কামরায় বসার সিট
পেতে তেমন বেগ পেতে হয়নি। কামরাতে অন্য যে প্যাসেঞ্জাররা ছিলেন, তাঁরা মাঝ পথে বিভিন্ন স্টেশনে নেমে গিয়েছেন। আসলে করোনার পরে সব
স্বাভাবিক হলেও, এখনও মানুষ করোনার আতঙ্ক থেকে সম্পূর্ন বের
হয়ে আসতে পারেননি। অনেকেই সাবধানতা মেনে স্যোসাল ডিসটান্সিং মেনে চলছেন। মুখে
মাক্স এবং খুব প্রয়োজন ছাড়া দুরে কোথাও সফর করছেন না।
অরূপ যে
বেসরকারি কোম্পানীর সেলস্ ডিপার্টমেন্টে চাকরি করে, সেখানকার কাজ নিয়েই খুব দরকারে
উত্তরবঙ্গে যেতে হচ্ছে, আর সেটা অফিস কর্তৃপক্ষ এমন সময়ে
তাঁকে জানিয়েছে, যে বাড়ি গিয়ে ভালোভাবে তৈরি এসে হয়ে ট্রেন
ধরার সময় সে পায়নি। অফিস থেকেই শিয়ালদা এসে নিউজলপাইগুড়ি যাওয়ার ট্রেনে চেপে বসেছে।
কামরাতে যে যাত্রীরা ছিলেন, তারা মালদা আসতে না আসতেই নেমে পড়েছেন। এখন কামরাতে অরূপ
একাই চলেছে। অগাস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে উত্তরবঙ্গে কলকাতার
থেকে যতটা গরম কম হবে বলে মনে করেছিল, ফারাক্কা পার হয়ে আসার পরেও গরমের কোন কমতি নেই। এরমধ্যে ট্রেন যখন বিহারের বারসই রেল
স্টেশনে সামান্য সময়ের জন্য দাঁড়িয়েছিল, তখন থেকেই শুরু হয়েছে মুশলধারে বৃষ্টি। এই বৃষ্টি
এখনও থামেনি।
হঠাৎ
ট্রেনটা চলতে চলতে এই রকম জনমানবহীন একটা স্টেশনে কেন থেমে গেল, সেটা বুঝতে পারছে না অরূপ। গভীর রাতে
একা একা কামরায় জেগে থেকে সে কি করবে,
সেদিকে মাথা না ঘামিয়ে সঙ্গে যে গামছাটা এনেছিল, সেটাকেই চাদরের মত গায়ের উপরে দিয়ে ঘুমিয়ে গেল।
হঠাৎ প্রচণ্ড
শব্দ কানে এল অরূপের। সঙ্গে প্রচুর লোকের চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজ। কামরার জানলা
দিয়ে বাইরে কৌতুহল বশে তাকিয়ে দেখল, পাশে বিভৎস উঁচু হয়ে আগুন জ্বলছে। প্রচণ্ড শব্দ করে
বিস্ফোরনের আওয়াজও শুনতে পেল সে। প্রচুর মানুষ একসঙ্গে
চিৎকার করে বলছে, ‘বাঁচাও, বাঁচাও!’
ঘুম থেকে
উঠে ট্রেনের কামরার দরজায় দাঁড়িয়ে অরূপ যা দেখল, তা এক কথায় বিভৎস দৃশ্য। আগুনের
আলোতে দেখল পাশের লাইনে দাঁড়ানো ট্রেনটি জ্বলছে। সেখান থেকেই মানুষের আর্ত
চিৎকারের আওয়াজ আসছে! এই দৃশ্য দেখে এতটাই ঘাবড়ে গিয়েছিল
অরূপ, নিজের ট্রেনের কামরা থেকে নেমে ঘটনার দিকে এগিয়ে
যাওয়ার কথা মনে এল না। সে নিজের সিটে ফিরে এসে বাইরে তাকিয়ে দেখতে পেল, বেশ কিছু লোক এসে ওই দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেন থেকে
আহতদের নীচে নামানোর চেষ্টা করছে! এরপরেই অরূপের চোখে পড়ল, একটা
ট্রেনে আগুন নয়, দুটো ট্রেন মুখোমুখি ধাক্কা লাগায় এই দুর্ঘটনা
ঘটেছে।
যেহেতু
জেনারেল কম্পার্টমেন্টের প্যাসেঞ্জার সে, তাই ট্রেনের অন্য কামড়াগুলিতে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। নিজের কামরার
জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েও অন্য কোন কামরার
যাত্রীদের সে দেখতে পেল না। বৃষ্টি
তখনও হয়েই চলেছে। চোখের সামনে দেখল,
অনেক মানুষের কাটা হাত পায়ের টুকরো এসে পড়েছে
সে নিজে যে ট্রেনে রয়েছে, সেই কামরার কাছে।
অরূপের হাত পা কাঁপছিল এই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে।
চোখের সামনে
এই দৃশ্যের ভয়াবহতার সঙ্গে সারাদিনের ক্লান্তিতে এতটা রাস্তায় ট্রেন জার্নি করার
ধকল সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারাল অরূপ। এরপরে তাঁর আর কিছু মনে নেই!
যখন জ্ঞান
ফিরল দেখল সকাল হয়ে গিয়েছে। বৃষ্টির লেশ মাত্র নেই। আকাশ ঝকঝকে নীল। রোদে ভেসে
যাচ্ছে চারদিক। গত রাতের ট্রেন দূর্ঘটনার কথা
মনে হতেই জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল অরূপ। কোথায় আগুন জ্বলেছিল! কোন ট্রেন দূর্ঘটনা তো হয়নি! দুরে সকালের আলোতে দেখা যাচ্ছে ছোট্ট রেল স্টেশনের
বিল্ডিংটাকে। অরূপ ট্রেনের কামরার দরজায় এসে দাঁড়ালো। সেই একই জায়গাতে থেমে রয়েছ
ট্রেনটি। এই সময় তাঁর নিউজলপাইগুড়ি পৌঁছে যাওয়ার কথা। পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের
করে দেখল, সেটিও কাল সারাদিন চার্জ না দেওয়ায় কখন যেন বন্ধ
হয়ে গিয়েছে। সিগনালের দিকে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলো অরূপ। সেটি এখনও লাল হয়েই
রয়েছে। পাশের রেল লাইনে কাজ করছেন কয়েকজন রেলকর্মী। তাঁদের উদ্দেশ্য করে অরূপ
জানতে চাইলো, “ট্রেনটা প্রায় সারারাত এখানেই থেমে আছে কেন?”
রেলকর্মীদের
মধ্যে থেকে জবাব এলো, ‘সামনের এক জায়গায় লাইনচ্যুত হয়েছে একটি মালগাড়ি। তাই গতকাল মাঝরাত থেকে ট্রেন চলাচল বন্ধ। কখন লাইন ঠিক হবে সঠিক বলতে পারছি না।’
অরূপের
বিরক্ত লাগছিল। সে এবার নিজেই নেমে এসে রেল স্টেশনে থাকা চায়ের স্টলে গিয়ে চায়ের অর্ডার দিয়ে বললো, “গত রাতে
কি এখানে কোন ট্রেন অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছিল?”
চা দোকানী
অবাক হয়ে অরূপের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে আবার নিজের কাজ শুরু করে দিলেন।
অরূপ আবার
একই প্রশ্ন করলে চায়ের ছোট গ্লাস অরূপের হাতে ধরিয়ে কিছু উত্তর দেওয়ার আগে জানতে চাইলেন,
“আপনার এই ট্রেন কত রাতে এখানে এসে থেমেছিল?”
“তা তখন রাত
প্রায় দেড়টা হবে!”
নিজের চা
স্টলের মধ্যে ফিরতে ফিরতে সে শুধু বললো, ‘হুম, বুঝলাম!’
অরূপের আরও
অবাক লাগছিল। সে বললো, “কি বুঝলেন? আমি তখন পরিস্কার কামরা থেকে এখানে দুটো
ট্রেনের মুখোমুখি অ্যাক্সিডেন্ট হতে দেখলাম। দুটো ট্রেনেই আগুন ধরে গিয়েছিল।
প্রচুর মানুষের চিৎকার শুনলাম! বিভৎস দৃশ্য দেখে আমি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু
এখন তো দেখছি সেসব কিছুই নেই! এত তাড়াতাড়ি সব পরিস্কার করে দিয়েছে রেল
ডিপার্টমেন্ট?”
চা দোকানী
অরূপকে জিজ্ঞাসা করলেন, “বলুন তো বাবু, আজ ইংরাজি মাসে কত তারিখ?”
অরূপ জানালো, “কেন, আজ আগষ্ট
মাসের তিন তারিখ। আমি গতকাল আগষ্ট মাসের ২ তারিখে কলকাতা থেকে অফিসের কাজ নিয়ে নিউ
জলপাইগুড়ি রওনা হয়েছিলাম!”
“বাবু এত
তাড়াতাড়ি ভুলে গেলেন গত শতাব্দির সেই বড় রেল অ্যাক্সিডেন্টের কথা! এখানেই তো
ঘটেছিল ব্রহ্মপুত্র মেল আর অবধ আসাম ট্রেন দুটোর মুখোমুখি অ্যাক্সিডেন্ট! যেটাতে
প্রচুর মানুষ মারা গিয়েছিল। সেই দিন আর সময়টা ছিল ১৯৯৯ সালের ২ আগষ্ট রাত একটা।
এখনো আমরা এখানকার মানুষের এই রাতে রেল স্টেশনের আশেপাশে থাকি না। শুনেছি, প্রতি বছর রাত একটায় এই রেল স্টেশনে
যদি কোন মানুষ থাকেন, তিনি সেই অ্যাক্সিডেন্ট দেখতে পান।
আসলে ওতগুলো মানুষের প্রাণ তো এই জায়গাতেই চলে গিয়েছিল!
তাদের অতৃপ্ত আত্মা এখনও ওই রাতে এখানে দেখা যায়!”
“কি নাম এই
গ্রামের? এই স্টেশনের?”
অবাক হয়ে অরূপ প্রশ্ন করে!
‘কেন
স্টেশনের নাম লেখে বোর্ড দেখেননি। এই রেল স্টেশনের নাম গাইসাল!’
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন