বর্ষার আগমন মানে গ্রীষ্মকালের হাঁসফাঁস করা গরম থেকে মুক্তির আস্বাদ। গ্রীষ্মের প্রখর দাবদাহে যখন সকলের প্রাণান্তকর অবস্থা, এমন সময় শান্তির একপশলা বৃষ্টিও মনকে হাঁফ ছেড়ে বাঁচায়। তাপমাত্রা কমে যায় বেশ কয়েক ডিগ্রী। কিন্তু মুশকিলটা হলো, সবকিছুরই সুবিধার সাথে অসুবিধাও রয়েছে। বর্ষার স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া, অতি আর্দ্রতায় ঘরের ইন্টেরিয়র-এক্সটেরিয়রের ক্ষতি, মশা, ঘরে মোল্ড পড়া, সঙ্গে ভ্যাপসা সোঁদা গন্ধ, পোকামাকড়সহ বিভিন্ন সমস্যা লেগেই থাকে। সেইসব সমস্যার সমাধানের উদ্দেশ্যে রইল কিছু প্রয়োজনীয় পরামর্শ।
১)
বৃষ্টির সময় খোলা জানলা দিয়ে জলের ছাঁট আসতে বাধ্য। সেই কারণে জানলা থেকে একটু
দূরে আসবাব রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। কোনোভাবে আসবাবের গায়ে জল লেগে গেলে শুকনো
কাপড় দিয়ে ভালো করে আসবাবটি মুছে ফেলতে হবে। বর্ষায় অনেকের বাড়ির দেওয়ালে ফাঙ্গাস
পড়ে। এমন দেওয়াল থেকে দূরত্ব বজায় রেখে আসবাব সাজানো উচিত। ঘর ছোটো হওয়ার কারণে
অথবা অন্য কোনো কারণে দেওয়াল ঘেঁষে আসবাব রাখতে হলে আসবাবের পেছনে পলিথিন দিয়ে
ঢেকে রাখতে হবে। বর্ষার দিনে আর্দ্রতা জমে কাঠ ফুলে যায় বলে দরজা-জানলাগুলো অনেক
সময় ঠিকমতো লাগতে চায় না। তাই বৃষ্টির আগেই ল্যাকার পলিশ কিংবা ক্লিয়ার বার্নিশ
করা গেলে এই অতিরিক্ত আর্দ্রতার জন্য কাঠের আকার বদলায় না।
২) এই সময় আলমারির মধ্যে ভ্যাপসা গন্ধ হয়। সেক্ষেত্রে ন্যাপথলিন ও এয়ার ফ্রেশনার ব্যবহার করলে এরকম সমস্যা থেকে মুক্তি মেলে। ঘরোয়া টোটকা হিসেবে লবঙ্গ ও নিমপাতা ভেজে কাগজে মুড়িয়ে আলমারির যেকোনো একটি ধারে রেখে দিলে গন্ধ দূর হয়ে যাবে। বর্ষাকালে কাঠের আসবাবে পোকার আক্রমণ বেশি হয়। আলমারিতে ন্যাপথলিন অথবা নিমপাতা রাখার ফলে পোকামাকড়ের উপদ্রব থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। দামি আসবাবের নীচে একটি ছোট টিনের বা কাঁচের পাত্রে এক টুকরো সালফার বা গন্ধক রেখে দিলে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ থেকে আসবাব মুক্ত থাকবে।
৩) বর্ষার স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া ঘরের দেওয়ালের সাথে সাথে পোশাকেও ফাঙ্গাস ফেলে। অনেকদিন আলমারিতে পড়ে থাকা পোশাক বের করে পরার আগে অবশ্যই একবার রোদে দিতে হবে। বৃষ্টি তো আর সবসময় হবে না। এতে ফাঙ্গাস চলে যায়, গন্ধটাও কাটে। আলমারিতে জামাকাপড়ের ফাঁকে কর্পূর রাখলে জামাকাপড় ঠিকঠাক থাকে। এসময়ের একটি সাধারণ সমস্যা হলো, ধোয়া কাপড় শুকালেও একটা সোঁদা গন্ধ থেকেই যায়। কাপড় ধোয়ার সময় একটু বেকিং সোডা ব্যবহার করলেই এই সমস্যায় আর পড়তে হবে না।
৪) পোকার আনাগোনা কোথায় নেই! পোশাক থেকে শুরু করে চাল, ডাল, আটাও ছাড় পায় না। এক্ষেত্রে এসবের মধ্যে কয়েকটা শুকনো নিমপাতা রেখে দিলে পোকার উপদ্রব অনেকখানি কমবে।
৫) বর্ষাকালে আসবাবপত্রের খেয়াল রাখার পাশাপাশি ঘরের পর্দার কথাটিও মাথায় রাখতে হবে। এরকম সময়ে এমনিতেই আকাশ মেঘলা করে থাকে। বাইরের আলো সেভাবে ঘরে ঢোকে না। তার উপর জানলা দরজায় মোটা ও ভারী ধরণের পর্দা থাকলে ঘরটা আরো অন্ধকারাচ্ছন্ন দেখায়। সেই কারণে এমন পর্দা এড়িয়ে চলা বাঞ্ছনীয় এবং হালকা কাপড়ের পর্দা নির্বাচন করাই শ্রেয়। এর ফলে বাইরের প্রাকৃতিক আলো ঘরের মধ্যে প্রবেশ করতে পারবে এবং ঘরটি স্বাভাবিকভাবে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে। এছাড়াও মোটা কাপড় বাতাস থেকে আর্দ্রতা বেশি শোষণ করে। ফলস্বরূপ, পুরো ঘরের আবহাওয়া জুড়ে স্যাঁতসেঁতে ভাব পরিলক্ষিত হয়। এর সাথে বৃষ্টিতে পর্দা ভিজে গেলে শুকাতে দীর্ঘসময় প্রয়োজন হবে যদি ভারী কাপড়ের পর্দা হয়।
৬) মেঝের কথা তো না বললেই নয়। প্রতিদিন জল দিয়ে মোছার পাশাপাশি সপ্তাহে অন্তত একদিন লিকুইড ক্লিনার দিয়ে মেঝে পরিষ্কার করতে হবে। রান্নাঘরের মেঝে বেশি ময়লা হয় এবং তেলচিটে পড়ে। সপ্তাহে একদিন গরম জলে লেবুর রস মিশিয়ে মেঝে পরিষ্কার করলে মেঝের তেল চিটচিটে ভাব দূর হয়ে যাবে। অন্যান্য ঘরের মেঝেতে কার্পেট বিছানো থাকলে বর্ষাকালের জন্য সেটিকে অবশ্যই গুটিয়ে তুলে রাখতে হবে। মোটা বুননের কার্পেট অনেকখানি আর্দ্রতা শোষণ করে এবং তার ভেজা ভাবের জন্য ঘরে একটা স্যাঁতসেঁতে ভাব তৈরি হয়।
৭) যাঁদের বাড়ির ছাদে বা ব্যালকনিতে ফুলের টব রাখা থাকে, তাঁদের এসময় অতিরিক্ত সজাগ থাকতে হবে। প্রচণ্ড বাতাসে বারান্দায় ঝুলে থাকা বা ছাদের রেলিংয়ে রাখা টবগুলো ভেঙে কিংবা ওপর থেকে পড়ে যেকোনো দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই টবগুলোকে এমনভাবে রাখতে হবে যাতে আলো-বাতাস নিশ্চিত করার পাশাপাশি দুর্ঘটনা এড়ানো যায়। টবে জল জমে মশা এবং পোকার আক্রমণ হতে পারে। তাই সেগুলিকে জলমুক্ত রাখা দরকার। বাড়ির আশপাশে ভাঙা টব, গাড়ির টায়ার, পুরনো ভাঙা জিনিসপত্র জলমুক্ত আছে কিনা তার খেয়াল রাখা অবশ্যই প্রয়োজন। বর্ষায় যেহেতু পোকামাকড়ের উপদ্রব বাড়ে, তাই বাড়ির চারদিকে কার্বলিক অ্যাসিড দিয়ে রাখলে ভালো হয়। অনেক বাড়ির বারান্দায় শুধুই রেলিং থাকে, যেটাকে ওপেন বারান্দা বলা হয়। সেখানে বৃষ্টির ছাঁটে জল জমে কাদার সৃষ্টি হয়। তাই ভালো ড্রেনেজ ব্যবস্থা রাখা একান্তভাবে দরকার।
৮) শুধু ঘরবাড়ি সুন্দর রাখার প্রতি দৃষ্টি দিলে চলবে না। এর সঙ্গে খেয়াল রাখতে হবে সুরক্ষার দিকটিও। বাড়ির চারদিকে কিংবা যেকোনো খোলা জায়গায় লাইনে সংযুক্ত কাটা কিংবা খোলা তার আছে কিনা তা দেখতে হবে। মেইন সুইচবোর্ডের অবস্থান খেয়াল করে কোথাও কোনো ড্যাম্প আছে কিনা তাও নজরে রাখা প্রয়োজন। কারণ, বৃষ্টির মধ্যে এই খোলা তারের গুচ্ছ থেকেই শর্টসার্কিট হয়ে থাকে। ইলেকট্রিক্যাল ওয়্যারিং সিস্টেমও দেখিয়ে নিতে হবে। এতে অনেক দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব।
পরিশেষে
বলি, ছোটো ছোটো এই বিষয়গুলির দিকে দৃষ্টি দেওয়া খুব বেশি
পরিশ্রমসাধ্য একেবারেই নয়। ঘরের ভেতরের ও বাইরের পরিবেশ সুস্থ ও সুন্দর থাকলে তা
মনের উপরেও ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। বর্ষারাণীর রিমঝিম নূপুরের ছন্দে ছন্দে প্রাকৃতিক
সৌন্দর্য্য উপভোগ করার সাথেই খিচুড়ি ও ইলিশ মাছ ভাজা সহযোগে পেটপুজো সেরে ছুটির
দিনের দুপুরে লম্বা একটা ঘুম দিয়ে দেওয়াই যায়। বর্ষায় ঘরের যত্নের সঙ্গে
নিজেরও যত্ন বৈকি!
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন