প্রথম বাঙালি মহিলা সাংবাদিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর সহকারী, নারীশিক্ষা প্রসারের সুযোগ্য কান্ডারী, বিনা বিচারে আটক হওয়া ভারতের প্রথম নারী রাজবন্দী – যেকোনো খেতাব, বিশেষণ বা প্রশংসাসূচক শব্দ কম পড়ে যায় তাঁর দেশপ্রেমকে, আত্মবলিদানকে যথাযথভাবে বর্ণনা করতে। ২রা অক্টোবর মহাত্মা গান্ধীর জন্মদিবসকে আমরা সবাই মনে রেখেছি। এই বীরাঙ্গনার জন্মদিনও যে একই দিনে, তা আমাদের মনে নেই। অনেকে হয়তো জানিও না এই ব্যাপারে।
বর্তমান
দিনে প্রায় সবক্ষেত্রেই নারীশিক্ষা ও নারীর অধিকার নিয়ে সচেতনতা উল্লেখযোগ্যভাবে
লক্ষ্য করা যায়। মেয়েদের পদচারণা সবখানে। শিক্ষিকা, চিকিৎসক, সাংবাদিক, বিজ্ঞানী, মহাকাশচারী ইত্যাদি বিভিন্ন
রূপে মেয়েদের আমরা দেখতে পাই। যুগটা আধুনিক হলেও অধিকাংশ মেয়েদেরই কমবেশি
নানারকম সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। আগেকার দিনে এই লড়াইটা ছিল অত্যন্ত কঠিন।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে ইংরেজ অধীনস্থ পুলিশের ঘেরাটোপে বহু পরিশ্রমের দ্বারা
বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ের চৌকাঠ পেরোতে পারলেও নির্দিষ্ট কোনো পেশায় নিযুক্ত
হওয়া এবং আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া ছিল অতীব কষ্টকর। তার উপর যদি সেইসব
কাজকর্মের যোগাযোগ থাকে দেশের স্বাধীনতা লাভের উদ্দেশ্যে, লড়াইটা তখন হয়ে যায় বহুগুণ কঠিন। তবুও দুঃসাধ্য সেই সংগ্রাম দমাতে পারেনি
বাংলার হাজার হাজার মেয়েদের, যাঁদের মধ্যে অন্যান্য মহীয়সী
নারীদের সঙ্গে সমানভাবে উজ্জ্বল হয়ে রয়েছেন ভারতমাতার সুযোগ্য এক সন্তান লীলা
নাগ।
জন্ম ও
শিক্ষাজীবন :
নারী
জাগরণের পথিকৃৎ লীলা নাগ আসামের গোয়ালপাড়ায় ১৯০০ সালের ২রা অক্টোবর জন্মগ্রহণ
করেন। জন্মগত নাম শ্রীমতি লীলাবতী নাগ। মা-বাবা আদর করে ডাকতেন ‘বুড়ি’। পিতা
গিরীশচন্দ্র নাগ ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট। মা কুঞ্জলতা দেবী গৃহিনী।
তাঁদের বাড়ি মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলা সদর থেকে ৫ কিলোমিটার উত্তরে পাঁচগাঁওতে।
মৌলভীবাজারের অন্যতম শিক্ষিত ও সংস্কৃতমনা একটি পরিবার হিসাবে খ্যাত ছিল তাঁদের
পরিবার।
১৯০৫ সালে আসামের দেওগড় বিদ্যালয়ে লীলার শিক্ষাজীবন শুরু হয়। সেখানে দু’বছর অধ্যয়নের পর ভর্তি হন কলকাতার ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়ে। ১৯১১ সালে তিনি এসে ভর্তি হন ঢাকার ইডেন হাইস্কুলে। ইতিমধ্যে ১৯১৬ সালে গিরীশবাবু অবসরগ্রহণ করার পর তাঁরা ঢাকায় স্থায়ীভাবে বাস করা শুরু করেন। ১৯১৭ সালে লীলা ইডেন হাইস্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে রেকর্ড নম্বর পেয়ে উচ্চশিক্ষার জন্যে কলকাতার বেথুন কলেজে ভর্তি হন।
লীলা
ছিলেন বহুমুখী প্রতিভার অধিকারিনী। পড়াশোনায় তো মেধাবী ছাত্রী ছিলেনই, সাথে নিয়মিত কবাডি ও ব্যাডমিন্টন খেলতেন। গান ও আঁকাতেও চৌখশ ছিলেন তিনি।
লীলা ছিলেন শিক্ষিকাদের প্রিয় ছাত্রী। সাথে ছিল নজরকাড়া ব্যক্তিত্ব এবং
প্রতিবাদী চরিত্র। কলেজে পড়াকালীন বড়লাটের পত্নীকে নতজানু হয়ে অভিবাদন জানানোর
প্রথা বাতিলের আন্দোলনে তিনিই নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৯১৯ সালে ২০ টাকা বৃত্তি পেয়ে
আই.এ. পাশ করেন। ১৯২১ সালে বেথুন কলেজ থেকে মেয়েদের মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করে
বি.এ. পাশ করেন। লাভ করেন ‘পদ্মাবতী’ স্বর্ণপদক। ওই বছরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে
ইংরেজিতে এম.এ. করার জন্যে দরখাস্ত করেন।
পূর্বেই
উল্লিখিত, সেসময় মেয়েদের উচ্চশিক্ষার পথ মোটেও মসৃণ ছিল না।
তার অন্যথা হয়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও। বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা মেয়েদের জন্য ছিল
বন্ধ। বললেই বা শুনছে কে! লীলা দরখাস্ত নিয়ে সটান দেখা করলেন আচার্য তথা বাংলার
বড়লাটের সাথে। তাঁর আগের পরীক্ষার ফলাফল এবং জেদ দেখে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার বিশেষ
অনুমতি দিতে আচার্য বাধ্য হলেন। সেই প্রথম মেয়েদের জন্য খুলে গেল
বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা। ১৯২৩ সালে লীলা ইংরেজিতে প্রথম বিভাগে মাস্টার্স ডিগ্রি
অর্জন করেন। তিনিই ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম এম.এ. ডিগ্রিধারী।
অবশ্য
লীলা একাই সেইসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিলেন না। সেই শিক্ষাবর্ষে
(১৯২১-২২) অর্থনীতি বিভাগে বি.এ. প্রথম বর্ষে ভর্তি হন সুষমা সেনগুপ্ত নামে আরেকজন
ছাত্রী। সুষমা ছিলেন সেই সময় ঢাবির আইনের অধ্যাপক ও জগন্নাথ হলের প্রথম প্রাধ্যক্ষ
নরেশচন্দ্র সেনগুপ্তের মেয়ে। সুষমা সেনগুপ্তের নিজস্ব স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায় –
"আই.এ. পড়তে পড়তে আমার বিয়ে হয়ে গেলো। ঢাকায় ইউনিভার্সিটি হলো। বি.এ. পড়তে
ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হলাম। সে বছর লীলাও এম.এ. ক্লাসে ভর্তি হলো। ঢাকা
ইউনিভার্সিটিতে আমরা দু'জন প্রথম ছাত্রী। এক কমন রুমে
বসতাম দু'জন। ক্লাসে যাবার সময় অধ্যাপক আমাদের ডেকে নিয়ে
যেতেন।”
বিবাহ ও
কর্মজীবন :
শিক্ষাজীবন
শেষ করে লীলা নারীশিক্ষার প্রসারে নিজেকে নিযুক্ত করেন। নারীদের অশিক্ষার অন্ধকার
থেকে মুক্ত করার জন্য কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিবারের এনা রায়, সিলেট মুরারীচাঁদ কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ অপূর্ব চন্দ্র দত্তের মেয়ে বীণা
দত্ত ও সরোজ বসু, ব্যারিস্টার পি কে বসুর মেয়ে
কমলা বসু, তাঁর বোন মনোরমা বসু, ব্রাহ্ম সমাজের ডাক্তার নেপাল রায়ের মেয়ে লতিকা রায়, তাঁর বোন লীলা রায়সহ ১২ জন সংগ্রামী সাথী নিয়ে গড়ে তোলেন ‘দীপালি সংঘ’। এই
সংঘের মাধ্যমে তিনি দীপালি স্কুল ও আরও ১২টি অবৈতনিক প্রাইমারি স্কুল প্রতিষ্ঠা
করেন। নারীশিক্ষা মন্দির ও শিক্ষাভবন নামেও দু’টি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।
পরবর্তীতে ঢাকায় তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্কুল দীপালি-১ নাম বদলে হয় কামরুন্নেসা গার্লস
হাই স্কুল এবং নারীশিক্ষা মন্দিরের নাম হয় শেরে বাংলা বালিকা মহাবিদ্যালয়। ঢাকার
আরমানিটোলা বালিকা বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাও তিনি।
শিক্ষাজীবন
শেষ করার পর লীলা মেয়েদের উন্নতিসাধনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও শুরুটা কিন্তু ছিল ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীনই। তাঁর একক্লাস উপরের ছাত্র ছিলেন সাহিত্যিক কাজী
মোতাহার হোসেন। লীলা নাগ সম্পর্কে তিনি তাঁর স্মৃতিকথা নামক প্রবন্ধ সংকলনে লেখেন, "এঁর মত সমাজ-সেবিকা ও মর্যাদাময়ী নারী আর দেখি নাই। এঁর থিওরী হল, নারীদেরও উপার্জনশীলা হতে হবে, নইলে কখনো
তারা পুরুষের কাছে মর্যাদা পাবে না। তাই তিনি মেয়েদের রুমাল, টেবলক্লথ প্রভৃতির উপর সুন্দর নক্সা এঁকে বিক্রয়ের ব্যবস্থা করেছিলেন। এই সব
বিক্রি করে তিনি মেয়েদের একটা উপার্জনের পন্থা উন্মুক্ত করে দেন।”
শুধুমাত্র
নারীশিক্ষার প্রসারই নয়, দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে
মুক্ত করতেও লীলা ব্রতী হন। দীপালি সংঘ তৈরির আগে থেকেই বিপ্লবীদের সাথে তাঁর
যোগাযোগ ছিল। দীপালি ছাত্রী সংঘ ও মহিলা আত্মরক্ষা কেন্দ্রও গড়ে তুলেছিলেন তিনি।
বিপ্লবী পুলিন দাসের নেতৃত্বে মেয়েরা এখানে অস্ত্র চালনা ও লাঠিখেলা শিখতো। ১৯২৮
সালে কলকাতা কংগ্রেস ও বাংলার অন্যান্য বিপ্লবী দলগুলি সুভাষচন্দ্র বসুর চারপাশে
সমবেত হতে থাকে। লীলাও উপস্থিত হন সেখানে। নিখিল ভারত মহিলা সম্মেলনে বাংলার নারী
আন্দোলনের ইতিহাস বলার সময় মঞ্চে ওঠেন তিনি। এর মাধ্যমে তাঁর বিপ্লবী জীবনের পথ
প্রশস্ত হয়।
পরবর্তী
কয়েক বছরের মধ্যে দীপালি সংঘের দ্রুত বিস্তার লাভ হতে থাকে। দলে দলে মেয়েরা সংঘে
এসে যোগ দেয়। আসাম ও বাংলার বিভিন্ন স্থানে এর শাখা বিস্তৃত হতে থাকে। নারী
সমাজের মুখপাত্র হিসেবে ‘জয়শ্রী’ নামে একটি পত্রিকাও বের করেন লীলা। ছাত্রীদের
সুবিধার জন্যে কলকাতায় তিনি একটি মহিলা হোস্টেল তৈরি করান। বিপ্লবী নেত্রী লীলা
নাগের কাছে দলের ছেলেরাও আসতো নানা আলোচনার উন্মুখতা নিয়ে। প্রীতিলতার মতো
সুপরিচিত নারী বিপ্লবীরাও এই দীপালি সংঘের মাধ্যমেই বিপ্লবের পাঠ নিয়েছিলেন লীলা
নাগের কাছ থেকে। দীপালি সংঘ ছাড়াও বিপ্লবী অনিল রায়ের শ্রীসংঘের সাথেও যুক্ত ছিলেন
তিনি। ১৯৩০ সালের ১৮ই এপ্রিল মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে বিপ্লবীরা চট্টগ্রাম
অস্ত্রাগার দখল করেন। এরপর ইংরেজ সরকার সব বিপ্লবী দলের নেতৃত্বস্থানীয়দের একযোগে
গ্রেফতার করা শুরু করলে অনিল রায়ও গ্রেফতার হন। ফলে শ্রীসংঘের দায়িত্ব পুরোটাই এসে
পড়ে লীলার উপর। সূর্যসেনের পরামর্শে এসময় অবিভক্ত ভারতের প্রথম নারীবিপ্লবী
প্রীতিলতা বিপ্লবী জীবনের পাঠ বা প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন লীলা নাগের কাছে।
শ্রীসংঘের
সদস্যরা সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনার জন্যে অস্ত্র সংগ্রহ ও বোমা তৈরির কাজ করতেন।
বোমার ফর্মুলা নিয়ে কাজ করতেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের ছাত্র অনিল দাস
ও শৈলেশ রায়। ১৯৩১ সালে বিপ্লবীদের কার্যকলাপ আরও জোরদার হয়। ঢাকার গুলিবর্ষণের
অভিযোগে ৩৩টি বাড়িতে পুলিশ অভিযান চালায়। লীলা নাগের বাড়ি আগুনে ভস্মীভূত করে
দেওয়া হয়। ওই বছরের এপ্রিলে বিপ্লবীদের গুলিতে তিন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, আলিপুরের জেলা জজ ও কুমিল্লার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট নিহত হন। এর মধ্যে কুমিল্লার
জেলা জজ স্টিভেন্সের হত্যার সাথে দু’জন তরুণী জড়িত থাকার সন্দেহে পুলিশ তৎপর হয়ে
ওঠে। ১৯৩১ সালের ২০শে ডিসেম্বর দীপালি সংঘের কাজ সেরে বাড়ি ফেরার পথে লীলাকে
গ্রেপ্তার করা হয়। তারপর থেকে তিনি ১৯৩৭ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ঢাকা, রাজশাহী, সিউড়ী, মেদিনীপুর জেল ও হিজলী বন্দিশালায় আটক ছিলেন। ভারতবর্ষে বিনা বিচারে আটক হওয়া
প্রথম নারী রাজবন্দী লীলা নাগ। ১৯৩৬ সালে তিনি কংগ্রেসের প্রার্থীরূপে সাধারণ
নির্বাচনে মনোনয়নও পেয়েছিলেন। কিন্তু ভোটার তালিকায় নাম না থাকায়
প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেননি।
বিপ্লবী
অনিল রায়ের সঙ্গে লীলার অনেক আগে থেকেই যোগাযোগ ছিল। অনিল রায়ের অনুপস্থিতিতে
তাঁর শ্রীসংঘের দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন লীলা। ১৯৩৯ সালে সেই অনিল
রায়ের সাথে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। ওই বছরই অনিল রায় ও লীলা নাগ প্রতিষ্ঠাতা সদস্য
হিসেবে ফরোয়ার্ড ব্লকে যোগদান করেন। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকা, মানিকগঞ্জ সফর করেন তাঁরা। ১৯৪০ সালে নেতাজির সম্পাদনায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক
‘ফরোয়ার্ড ব্লক’ পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব নেন লীলা। ১৯৪১ সালের ১১ই ডিসেম্বর
ভারতরক্ষা আইনে গ্রেফতার হন শরৎচন্দ্র বসু। তাঁর গ্রেফতারের তীব্র নিন্দা জানিয়ে
হাজরা পার্কে জনসভায় বক্তব্য দেন লীলা নাগ ও অনিল রায়। এই অপরাধে তাঁদের গ্রেফতার
করা হয় এবং দীর্ঘ প্রায় পাঁচ বছর কারাভোগের পর ১৯৪৬ সালের জুন মাসে তাঁরা
কারামুক্তি লাভ করেন।
ওই বছরই
হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গাকালে উভয় সম্প্রদায়ের বিপন্ন মানুষকে উদ্ধার ও নিরাপত্তা
দেওয়ার কাজে স্বামীর যোগ্য সহকারী হন লীলা। ১৯৪৬ সালের অক্টোবর মাসে নোয়াখালীর
দাঙ্গার পর সেখানকার রামগঞ্জে ‘ন্যাশনাল সার্ভিস ইনস্টিটিউট’ খুলে ১৭টি ক্যাম্পের
মাধ্যমে তিনি দীর্ঘদিন সেবা ও সহায়তা প্রদান করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর লীলা নাগ
ও অনিল রায় পূর্ববঙ্গে বসবাস করার উদ্যোগ নেন। কিন্তু তৎকালীন মুসলিম লীগ শাসকরা
জোরপূর্বক তাঁদের দেশত্যাগে বাধ্য করেন। ১৯৫১ সালে তৎকালীন ভারত সরকার উদ্বাস্তু
উচ্ছেদের বিল আনে। এই বিলের প্রতিবাদ করায় গ্রেফতার হন লীলা।
মৃত্যু
:
বহুকালের
আন্দোলনসঙ্গীর সঙ্গে লীলা ঘর বেঁধেছিলেন। কিন্তু সংসারসুখ বেশিদিনের জন্য স্থায়ী
হলো না। ১৯৫২ সালে স্বামী অনিল রায় ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। বিয়ের মাত্র
১৩ বছরের মাথায় জীবনসঙ্গীকে হারিয়ে লীলা শারীরিক ও মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে
পড়েছিলেন। কিন্তু তাঁর মনের জোর ছিল প্রস্তরকঠিন। কম সময়ের মধ্যে শোক কাটিয়ে লীলা
স্বদেশের বৃহত্তর স্বার্থে পুনরায় মনোনিবেশ করেন। ১৯৫৩ সালে জয়প্রকাশ নারায়ণের
সমাজবাদী শিবিরে যোগ দেন।
কেটে
যায় অনেকগুলো বছর। তবে লীলা নাগের পদচারণা থামার নয়। ১৯৬৪ সালে পূর্ববাংলা
বাঁচাও কমিটির আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে। ১৯৬৬ সালে
ছাড়া পাওয়ার পর তিনি শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। ১৯৬৮ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি
সকালে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়লে তাঁকে কলকাতার পিজি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তেইশ দিন পর
সংজ্ঞা ফিরে এলেও তাঁর বাকশক্তি বন্ধ হয়ে যায় এবং শরীরের ডান অংশ সম্পূর্ণরূপে অচল
হয়ে যায়। ৪ঠা আগস্ট সেরিব্রাল আক্রমণে তিনি কোমায় চলে যান। প্রায় আড়াই বছর কোমায়
সংজ্ঞাহীন অবস্থায় থাকার পর ১৯৭০ সালের ১১ই জুন তিনি অমৃতলোকে যাত্রা করেন।
হ্যাঁ, এই জুন মাসেই আমরা হারিয়েছি মহীয়সী এই নারীকে। আমাদের দেশ হারিয়েছে তার
সুযোগ্য এক সন্তানকে যিনি আত্মসুখের কথা বিন্দুমাত্র চিন্তা না করে নিজের গোটা
জীবনটাকেই দেশের স্বার্থে বিলিয়ে দিয়েছিলেন। আমৃত্যু সংগ্রাম করে আগামী
প্রজন্মকে উপহার দিয়েছেন পরাধীনতার শৃঙ্খলমুক্ত এক ভোর। লীলা নাগের
মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর উদ্দেশ্যে সশ্রদ্ধ প্রণাম জানিয়ে এই আশাই রাখি, আমাদের দেশের প্রতিটি মেয়ের চিত্ত যেন তাঁরই মতো সদা ভয়শূন্য এবং
আত্মবিশ্বাসে পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন