সৃষ্টিকর্তা তাঁর অসামান্য দক্ষতার সাথে আমাদের অঙ্গ - প্রত্যঙ্গ এতটাই সুনিপুণ এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ ভাবে বিন্যস্ত করে রেখেছেন যে তাদের গুরুত্ব স্বাভাবিক অবস্থায় আমরা উপলব্ধি করে উঠতে পারি না। অথচ এই বিপুল শিল্প কর্মের সামান্য ভুলচুকই সময়ে সময়ে হয়ে ওঠে প্রাণঘাতী। এমনই এক বিরল অস্বাভাবিকতার পোশাকি নাম "ইউটেরাইন ডাইডেলফিস" (uterine didelphys) ।
আমাদের দেহের আভ্যন্তরীণ গঠন লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে নারীদেহের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অঙ্গ হল জরায়ু বা ইউটেরাস (Uterus)। যার মধ্যে গর্ভাবস্থায় নতুন ভ্রূণ স্থাপিত হয় এবং সেই ভ্রূণ থেকে যদি কন্যা সন্তান জন্ম নেয় তাহলে মাতৃগর্ভে থাকাকালীনই গর্ভাবস্থার ৬ থেকে ২২ সপ্তাহের মধ্যে তার ইউটেরাসের বা জরায়ুর গঠন সম্পূর্ন হয়ে যায়, যা পরবর্তী কালে হয়ে উঠবে আবার নতুন একটি প্রাণের নিশ্চিন্ত আশ্রয়। অথচ এই জরায়ু গঠনের ক্ষেত্রে সামান্য উনিশ বিশ হলেই সৃষ্টি হয় ইউটেরাইন ডাইডেলফিসের মত অস্বাভাবিকতা।
একের পরিবর্তে দুই
ভ্রূণ বিকাশের সময় থেকেই ভ্রূণের দেহে ‘মুলেরিয়ান টিউব’ নামে দুটি নালি মিলিত হয়ে তৈরি হয় সম্পূর্ণ জরায়ু। কিন্তু কোনো কারণে যদি এই দুটি টিউব একত্রে মিলিত না হয়ে দুটি পৃথক পৃথক জরায়ু সৃষ্টি করে, তখন তাকে বলা হয় ইউটেরাইন ডাইডেলফিস। অর্থাৎ একটি জরায়ুর পরিবর্তে দুটি জরায়ুর উপস্থিতিই হল এই অস্বাভাবিকতার প্রধান লক্ষণ। দুটি জরায়ু থাকার ফলে এই অস্বাভাবিকতায় আক্রান্ত নারীদের সাধারণত দুটি জরায়ু মুখ বা সার্ভিক্স অর্থাৎ দুটি যোনি উপস্থিত থাকে। এক্ষেত্রে ভ্যাজাইনার মাঝে পাতলা একটি টিস্যুর স্তর ভ্যাজাইনাকে দুভাগে বিভক্ত করে রাখে। প্রতিটা জরায়ুর আবার পৃথক ফ্যালোপিয়ান ডাক্টও উপস্থিত থাকে।
তবে আশার কথা একটাই যে, এই অস্বাভাবিকতা সমগ্র জনসংখ্যার মাত্র ০.৩% নারীকে প্রভাবিত করে।
উপসর্গ
ইউটেরাইন ডাইডেলফিসের উপসর্গের প্রসঙ্গে আসার আগে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেওয়া খুবই প্রয়োজনীয় যে এই অস্বাভাবিকতা কোনো নারী দেহে আছে কি নেই সেই সম্পর্কে বহু নারীরা সচেতনই নন। যেহেতু এই অবস্থায় সেরকম উল্লেখযোগ্য কোনো উপসর্গ দেখা যায় না তাই অনেক মহিলা বহুদিন পর্যন্ত জানতেই পারেন না যে তাঁর দেহে একটির পরিবর্তে দুটি জরায়ু উপস্থিত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্রমাগত গর্ভপাত ঘটলে অথবা ঋতুস্রাবের সময় তীব্র ব্যাথা অনুভূত হলে চিকিৎসকেরা পেলভিক এক্সাম এবং আলট্রাসোনোগ্রাফি অথবা এমআরআই করার পরামর্শ দেন। এবং ইউটেরাইন ডাইডেলফিসের মতো কোনো অবস্থা এই উপসর্গের জন্য দায়ী কি না তা নির্ণয় করেন। গর্ভাবস্থার ৮ সপ্তাহের মধ্যে ইউএসজি করানো হলে সেক্ষত্রে দুটি জরায়ুর উপস্থিতি স্পষ্ট ভাবে লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু গর্ভাবস্থার ২০ সপ্তাহ অতিক্রম করে গেলে গর্ভস্থ ভ্রূণ এতটাই বৃদ্ধি পেয়ে যায় যে তার প্রভাবে একটি জরায়ু (যাতে ভ্রূণ স্থাপিত হয়েছে) আকার ও আয়তনে প্রসারিত হয়ে অপর ছোট এবং সংকুচিত জরায়ুটিকে ঢেকে দেয়। ফলে এই সময় ইউএসজি দুটি জরায়ুর স্পষ্ট উপস্থিতি বোঝাতে সক্ষম নাও হতে পারে।
এছাড়াও,
১. সহবাসের সময় ব্যথা
২. ঋতুস্রাবের সময় অথবা তার পরে তীব্র ক্র্যাম্পিং, পেলভিক অংশে চাপ এবং ক্র্যাম্প
৩. দুটি পৃথক জরায়ু এবং ভ্যাজাইনার উপস্থিতির দরুন অধিক রক্তপাত
৪. একাধিক গর্ভপাত
৫. নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই প্রসব বেদনা বা লেবার পেইনের সূচনা
৬. সিজারের সময় এবং পরবর্তীতে অনভিপ্রেত জটিলতা
৭. সদ্যজাত শিশুর স্বাভাবিকের তুলনায় কম ওজন এবং শিশুর বৃদ্ধি এবং বিকাশ ব্যাহত হওয়া প্রভৃতি উপসর্গও ইউটেরাইন ডাইডেলফিসের ফলশ্রুতিতে আত্মপ্রকাশ করতে পারে।
যেহেতু ইউটেরাইন ডাইডেলফিসের মতো অস্বাভাবিকতার পরেও একজন নারী কোনো জটিলতা ছাড়াই গর্ভধারণে সক্ষম হয়, তাই এই গঠনগত ত্রুটি সংশোধনের জন্য সেরকম ভাবে কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন হয় না এবং চিকিৎসকেরাও সাধারণত সার্জারির পরামর্শ দেন না। কিন্তু গর্ভাবস্থার অন্তিম পর্যায় পৌঁছিয়ে গর্ভপাতের মতো ঘটনা ক্রমাগত ভাবে ঘটতে থাকলে অথবা ঋতুস্রাবের সময় পেলভিক ক্র্যাম্পিং তীব্র হয়ে উঠলে অপেরেশনের মাধ্যমে দুটি জরায়ুকে সংযোজিত করে দেওয়া হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আবার ইউটেরাইন ডাইডেলফিসের প্রভাবে জরায়ুর আভ্যন্তরীন টিস্যুর যে স্তর বা আবরণী থাকে তা সম্পূর্ণ ভাবে গঠিত হয় না। ফলে গর্ভস্থ ভ্রূণ প্লাসেন্টার মাধ্যমে পর্যাপ্ত অক্সিজেন বা খাবার কোনটাই পায় না। অথবা ক্ষেত্র বিশেষে দুটি জরায়ু উপস্থিত থাকার দরুন গর্ভস্থ ভ্রূণের বিকাশের সাথে সাথে জরায়ু সঠিক ভাবে প্রসারিত হতেও বাধাপ্রাপ্ত হতে পারে। অন্যদিকে, দুটি জরায়ু যদি দুটি পৃথক যোনি বা ভ্যাজাইনাতে উন্মুক্ত হয়, সেক্ষেত্রে দুটি যোনির অন্তর্বর্তী অনুদৈর্ঘ্যের সেপ্টামকে অপেরেশনের মাধ্যমে বাদ দিয়ে এই ত্রুটি সংশোধন করা যেতে পারে। বলাই বাহুল্য, যেহেতু এই সার্জারির ক্ষেত্রে বিভিন্ন রিস্ক ফ্যাক্টর থেকেই যায় তাই খুব প্রয়োজন না হলে বা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া সার্জারির পথে না হাঁটাই শ্রেয়।
অনেক সময় দুটি জরায়ুর উপস্থিতির জন্য মাতৃগর্ভে দুটি ভ্রূণ একসাথে স্থাপিত হয়, যার ফলে জন্ম নিতে পারে যমজ সন্তান। কিন্তু সাম্প্রতিক বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা গেছে যে ইউটেরাইন ডাইডেলফিসের প্রভাবে জন্ম নেওয়া যমজ সদ্যোজাতদের মধ্যে প্রায় ৬০% নবজাতক প্রিম্যাচিওর অর্থাৎ নির্দিষ্ট সময়ের আগেই তারা ভূমিষ্ঠ হয়েছে। এর কারণ হিসাবে বলা যায় যে একটি জরায়ুতে ভ্রূণ থাকাকালীন যতটা প্রসারিত হতে পারে, সেই একই জায়গায় দুটি জরায়ু পাশাপাশি থাকার ফলে কোনো জরায়ুর পক্ষেই সম্পূর্ণ প্রসারণ সম্ভব হয় না যার ফলে ব্যাহত হয় মাতৃগর্ভে থাকা শিশুর বিকাশ, বৃদ্ধি এবং সঠিক অবস্থান। তবে প্রসঙ্গত এটাও উল্লেখ করা প্রয়োজন যে একবার গর্ভবতী হয়ে পড়লে অর্থাৎ একটি জরায়ুর মধ্যে সঠিক ভাবে ভ্রূণ স্থাপিত হয়ে
গেলে অন্য একটি জরায়ুর মাধ্যমে একই সময়কালে দ্বিতীয় বার গর্ভবতী হওয়া সম্ভব নয়।
অন্যান্য সমস্যা
আপাতভাবে সমস্যা সৃষ্টি না করলেও এই জন্মগত অস্বাভাবিকতা কখনও কখনও অন্য কোনও গঠনগত ত্রুটির সাথে সংযুক্ত থাকে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই আক্রান্ত সদ্যোজাত শিশুটির প্রাণঘাতি কোনও পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়া বিচিত্র নয়।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য Anorectal
Malformation অথবা impeforate anus, যার ফলে সদ্যোজাত শিশুর রেকটাম এবং পায়ুছিদ্রের গঠন সম্পূর্ণ হয় না। এছাড়া কিডনির অনুপস্থিতি ও এন্ডোমেট্রিওসিসের মত রোগের প্রাদুর্ভাব হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
পরিশেষে একটা কথাই বলা যায় যে, যেহেতু ইউটেরাইন ডাইডেলফিস একটি জন্মগত ত্রুটি তাই এই অস্বাভাবিকতার জন্য আমাদের প্রায় কিছুই করার থাকে না। তবে পাশাপাশি এ কথাও সত্যি যে সচেতনতা এবং চিকিৎসকের সুপরামর্শের মাধ্যমে এই অবস্থাতেও যে কোনো নারীর পক্ষে একটি সুস্থ স্বাভাবিক সন্তান জন্ম সম্ভব।
তথ্যসূত্রঃ my.clevelandclinic.org
www.nationwidechildrens.org
www.scientificamerican.com
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন