প্রথমেই
বলি সমস্ত জাগতিক জিনিসের প্রাণ আছে। প্রাণ না থাকলে তার অস্তিত্বই থাকত না। তাই প্রত্যেক
পদার্থের যে অস্তিত্ব আছে, এটা বলাই বাহুল্য। কিন্তু প্রাণ কি? প্রাণ সেটাই যার মধ্যে
স্পন্দন আছে। এর একটা উদাহরণ হল কেউ অজ্ঞান হয়ে গেলে বা নড়াচড়া না করলে, আমরা কি করি?
তার বুকে হাত দিয়ে দেখি হৃদয়যন্ত্রটি কাঁপছে কিনা? তার মানে বাঁচার জন্য একটা কম্পন
চাই। এই কম্পনই হল জীবনের মূলমন্ত্র, যার পরিমাপ হল হার্টজ (প্রতীক: Hz)। SI এককে যাকে
একটি পর্যায়ক্রমিক ঘটনার প্রতি সেকেন্ডে চক্রের সংখ্যা হিসাবে বলা হয়ে থাকে। এই হার্টজ নামকরণ ইন্টারন্যাশনাল ইলেকট্রোটেকনিক্যাল
কমিশন 1930 সালে বিখ্যাত জার্মান বিজ্ঞানী হেনরিচ রুডলফ হার্জের নামে করেছিল। সে যাইহোক, মানুষ বা জীবজন্তুর বেলায় কম্পনের প্রভাব তো বুঝে গেলাম।
কিন্তু ছোট প্রাণী পিঁপড়ে বা তার চেয়েও ছোট আণুবীক্ষণিক জীবের ক্ষেত্রে কি করব? তখনই
যন্ত্রের প্রয়োজন হবে। কিন্তু যন্ত্র না হয় বলে দিল কাঁপছে। কিন্তু কতটা কাঁপছে জানতে
গেলে সময়ের সঙ্গে তুলনায় আসতে হবে। তাই এই কম্পনকে মাপতে গেলে লাগে সময়, যার ইউনিট
হচ্ছে সেকেন্ড। এটাকে কখনও কখনও স্পেস জিওমেট্রিতে ফোর্থ ডাইমেনশনও বলা হয়ে থাকে।
প্রায়
1871 বছর আগে সেকেন্ডের কথা প্রথম বলেছিলেন বিখ্যাত গ্রেকো ইজিপ্সিয়ান গণিতজ্ঞ ক্লডিয়াস
টলেমি। পরের দিকে বিজ্ঞানীরা দেখেছিলেন এটা হল সিজিয়ামের কম্পন। সিজিয়াম 133 এ্যাটমের
হাইপারফাইন ট্রাঞ্জিশন ফ্রিকোয়েন্সি হল 9192631770 Hz, যেটা
হতে সময় লাগে এক সেকেন্ড। তার মানে সিজিয়াম এ্যাটমের দুটো সবচেয়ে নিচের অরবাইটালের
মধ্যে যখন ইলেক্ট্র্ন জায়গা পালটায় তখন যে রেডিয়েশন হয় তার কম্পন। আর অন্য ভাবে বললে
এটা থেকেই এভারেজ সৌর দিনের মাপ করা যায়। একটি গড় সৌর দিনের মাপ হল 86,400 সেকেন্ড।
পরের
দিকে বিজ্ঞানীরা এই সেকেন্ডকে আরও ছোট ইউনিটে ভাগ করেছিলেন। এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে ছোট
ইউনিট হল যেপ্টো সেকেন্ড। এটা সেকেন্ডের একের একলক্ষ কোটি কোটির এক ভাগ। মানে দশমিকের
পর কুড়িটা শুন্য বসিয়ে এক বসাতে হবে। তাই এর সাহায্যে যত ছোট কম্পাঙ্কই হোক তাকে ঠিক
মাপা যাবে।
এই
বিশ্বব্রম্ভান্ডে কেউ স্থির নেই। সব কিছুই কাঁপছে। এমনকি বিশ্বব্রম্ভান্ড নিজেই কাঁপছে।
এই কারণেই আমাদের বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বোস বলেছিলেন সবার মধ্যেই প্রাণ
আছে। প্রাণ মানে কি, একটা অনুভুতি। আর অনুভুতি মানেই কম্পাঙ্ক। যেমন কেউ বেঁচে আছে
কিনা দেখতে গেলে তার বুকে কান পেতে শোনার চেষ্টা করি হার্ট চলছে কিনা, অর্থাৎ এককথায়
হার্টটা কাঁপছে কিনা। সেরকমই যন্ত্র দিয়ে মাপলে বোঝা যাবে, শরীরের সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গই
সারাক্ষণ কাঁপছে। কিন্তু প্রত্যেকের কম্পাঙ্ক আলাদা।
মানুষের
শোনার ক্ষমতা মাত্র 20 Hz থেকে 20000 Hz। এর মানে হল যে এই রেঞ্জের মধ্যে যা কিছু কাঁপবে
তার বিচার আমাদের মাথা করতে পারবে। যদিও বয়সের সাথে ওপরের দিকটা কমতে কমতে 8000 হার্জের
কাছাকাছি চলে আসে। কিন্তু এর বাইরে যা আছে সেগুলোর কি হবে? শরীর কি নিতে পারবে না!
সাধারণ জ্ঞান অনুযায়ী আমরা বলি 'না'। কিন্তু তা নয়। অবশ্যই পারবে। এর অর্থ হল, মস্তিষ্ক
বিচার করতে পারবে না কিন্তু অনুভব করতে পারবে। যেমন একটা ছোট্ট উদাহরণ হল, আমাদের চোখ।
যদি কোন কম্পাঙ্ক 18 Hz এর খুব কাছাকাছি হয় তাহলে চোখে ব্যথা হতে শুরু করবে। এখানে
মস্তিষ্ক শুধু ব্যাথাটাই বুঝতে পারবে। এবার কথা হচ্ছে কেন ব্যাথা হবে। এর উত্তর হল
অনুরণন বা রেজোন্যান্স। প্রত্যেক কম্পনের দুটো দিক আছে, একটা ওপর নিচ করে আরেকটা সমতলের
দিকে চলে। তবে আমাদের পক্ষে খারাপটা হল কম্পনের ওপর নিচ করাটা। এবার একই মাপের কম্পন
যদি ওপর-নিচের কম্পনের সঙ্গে মেশে তাহলে দ্বিগুণ হয়ে যাবে। আর এর ফলে চোখের কম্পাঙ্কও
দ্বিগুণ হয়ে যাবে। চোখ যদি এত জোরে ওপর নিচ করে তাহলে শুধু ব্যাথাই হবে না, চোখে অনেক
রকমের ছায়াও দেখতে পাওয়া যাবে। মনে হবে আশপাশে ছায়ার মত কেউ ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই ছায়ার
বিচার করতে না পেরেই লোকে ভূত বা ভগবানের কথা বলে ওঠে। তবে যদিও এই আলোচনায় নেই তাও
বলছি ভগবানেরও আলাদা কম্পাংক আছে।
এবার
ভুতের বাড়ী সম্বন্ধে কিছু আলোচনা করা যাক। ধরা যাক কেউ একটা পুরনো দিনের বাড়ীতে গেল,
যেখানে বহু পুরনো সিলিং ফ্যান, পাম্প চলছে যেগুলো থেকে ইনফ্রাসাউন্ড বা 20 হার্জের
নিচের কম্পাংক বেরোচ্ছে। তাহলে যে কেউই ওখানে থাকবে সে চোখের চারপাশে ছায়া ছায়া মত
জিনিস দেখতে পাবে। ব্যস, ওখানেই ভুতের জন্ম হয়ে গেল। কত ভুতের গল্প যে তৈরী হয়ে যাবে
তার ঠিক নেই।
অনেকে
ভুত দেখে মারা গেছে শোনা গেছে। এটা হয়ত মস্তিষ্কের ওপর একটা মানসিক প্রভাবের জন্য হতে
পারে। কিন্তু বৈজ্ঞানিক দিক থেকেও এটা প্রমান করা যেতে পারে যে এটা ইনফ্রাসাউন্ডের
কাজ। দেখা গেছে আমাদের শরীরের অনেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যেমন মস্তিষ্ক, হৃদয় এসব 7 Hz এর
কাছাকাছি এলেই অনুরণন শুরু হয়ে যায়। আর তখন মনে হবে কে যেন চারিদিক থেকে চেপে ধরছে।
এইবার যদি কোন পুরনো বাড়ীতে রাতে ফ্যান থেকে ঐরকম কম্পাঙ্ক বার হয়, তাহলে যে কেউ ভাবতে
পারে ভুতে এসে গলা টিপে ধরেছে। তারপর আর কিছু করতে হবে না। ওতেই মারা যাবে।
এই
ইনফ্রাসাউন্ড এতটাই ভয়ঙ্কর যে কেউ যদি কোন যন্ত্রের সাহায্যে খুব জোরে ইনফ্রাসাউন্ড
তৈরী করতে পারে তাহলে একটা সৈন্য বাহিনীকেও মেরে ফেলতে পারবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের
সময়ে জার্মানী এটার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু সেরকম কিছু লাভ হয় নি। তবে পরীক্ষা এখনও
চলছে।
আমাদের
শরীরটাও একটা সুর, যেখানে অনেক কম্পাঙ্ক নিজের মত করে চলছে। শরীরে মস্তিষ্কের কম্পাঙ্ক
হল 72-90 Hz। এরকমই হার্ট চলে 67 থেকে 70 Hz কম্পাঙ্কে, লিভার চলে 55থেকে 60 Hz কম্পাঙ্কে
আর অগ্ন্যাশয়ের কম্পাঙ্ক হল 60 থেকে 80 Hz।
আর যেহেতু শরীরের রক্ত এদের সবাইকে মানিয়ে নিয়ে চলছে, তাই এর কম্পাঙ্ক এদের মাঝামাঝি।
এবার এদের কারুর কম্পাঙ্ক যদি কমে যায়, তাহলেই শরীর খারাপ হতে শুরু করে। মানুষের শরীরের
কম্পাঙ্ক হল 62-78 Hz। এটা দেখা গেছে 58 Hz এর নিচে যখন শরীরের কম্পাঙ্ক নেমে যায় তখনই
শরীর অসুস্থ হয়। অনেক বিজ্ঞানীরা শরীরের জন্য মিউজিক থেরাপির কথা বলেন। এটা আর কিছুই
নয়, শরীরকে মিউজিকের কম্পাঙ্ক দিয়ে সুস্থ শরীরের কম্পাঙ্কে নিয়ে আসা। এই যে সুখ, দুঃখ,
রাগ, ভয়, অবাক হওয়া, লজ্জা এসব হয়, এসবই এই বিভিন্ন কম্পাঙ্কের খেলা। যখন এটা ওপরের
দিকে থাকে তখন সুখ থাকে আর যখন কমের দিকে থাকে তখন মনে দুঃখ আসে।
মানুষের
শরীরের ওপর গানের প্রভাব তো সবাই জানে। যদি কোন সুর নিচের কম্পাঙ্কে বাজানো বা গাওয়া
হয় তাহলে মনের ওপর দুঃখের প্রভাব পড়বে। আবার ওপরের দিকের কম্পাঙ্কে শরীরে শক্তির সঞ্চার
হবে। দেখা গেছে 540 Hz কম্পাঙ্কের ওপরে হলে আনন্দের অনুভুতি আসে আর সেটা যদি 700
Hz পৌঁছে যায় তাহলে তো কথাই নেই। এটা দেখা গেছে 852 Hz ফ্রিকোয়েন্সি নেতিবাচক চিন্তাকে
ইতিবাচক ধারণাতে পাল্টে দিতে সাহায্য করে, অর্থাৎ কাজ করার ইচ্ছা জাগায়। আবার যে কম্পাঙ্কে
স্নায়বিকতা বা উদ্বেগ কমাতে সাহায্য করে সে কম্পাঙ্ক মানুষকে একজন আদর্শ ব্যক্তি করে
তোলে। শুধু তাই নয়, এর প্রভাব অন্তর্দৃষ্টি এবং অভ্যন্তরীণ শক্তি জাগাতেও সাহায্য করে।
ভারতীয় যোগসাধনা এই কম্পাঙ্ককে নিয়ন্ত্রন করে বলেই উচ্চমার্গের সাধুর জন্ম হয়। উলটো
দিকে কম্পাঙ্ক যদি 150 Hz এ নেমে আসে তাহলে মনে রাগ বা ক্রোধের জন্ম নেয়। তবে খুব নিচে
হলে মানে 4 hertz এ চলে
এলে মনে ভয়ের সঞ্চার হবে। আরেকটা কথা না বললে কিছু যেন অসম্পুর্ন থেকে যায়, সেটা হল
প্রেম। দেখা গেছে 639 Hz এ শরীরে মনে প্রেমের অনুভুতি আসে। অবশ্য এই কম্পাঙ্কে মানুষের
মধ্যে একটা সুস্থ সম্পর্কও তৈরী হয়। আর প্রকৃত প্রেম তো কবিরাই বলে গেছেন শুদ্ধ।
আগেকার দিনে সাধুরা মানুষের মন পড়ে নিতে পারতেন। লোকে ভাবত, ওরা ভগবানের কাছাকাছি চলে গেছেন, তাই মানুষের মনের কথা বলে দিতে পারেন। কিন্তু ব্যাপারটা তা নয়। কেউ যদি অন্য কারোর শরীরের কম্পাঙ্কের সঙ্গে নিজের শরীরের কম্পাঙ্ক এক জায়গায় আনতে পারে তাহলেই সে তার মনের কথা জানতে পারবে। সাধুরা বিভিন্ন যোগ ব্যায়ামের সাহায্যে শরীরের কম্পাঙ্ককেও নিজের নিয়ন্ত্রনে আনতে পারতেন। এখনতো যন্ত্রের সাহায্যেই এগুলো করা যাচ্ছে। কিছু জনমাধ্যম তো এটা ব্যবহার করে আমরা কি ভাবছি, সেটা লেখা দেখেই বুঝে নিচ্ছে। এমনকি, এর পরে কি ভাবব সেটাও কম্পিউটারে বলে দিচ্ছে। তাই টেলিপ্যাথিও এখন বৈজ্ঞানিক ভাবে প্রমানিত। ফেসবুক তো এর এক উজ্জ্বল উদাহরণ। লেখার সময় আমরা কি ভাবছি, সেটা ওদের সিস্টেম বুঝে যায়। অবশ্য এর জন্য দীর্ঘদিন ধরে লেখার ওপরে মনের প্রভাব বা চিন্তার সাথে মুখের অভিব্যক্তির পরিবর্তনের ওপর বহু রিসার্চ করা হয়েছে। সেসবের মধ্যে আর গেলাম না।
যাই
হোক সব শেষে বলি যদি আমরা টাকটা ফল শব্জি খাই, নিয়মিত শরীর চর্চা করি, যোগাসন করি তাহলে
শরীরের কম্পাঙ্ককে বাড়াতে পারব। আর এটাই হবে সুস্থ থাকার উপায়।
প্রাথমিক
ভাবে সংকেতের মাধ্যমে আমাদের অনুভুতিগুলো প্রকাশের জন্য কিছু সাংকেতিক বর্ণের ব্যবহার
করা হয়েছিল, যেগুলো অবশ্য পরে বদলে গিয়েছে। নিচের চিহ্নগুলো মনের ভাব প্রকাশের জন্য
তৈরী হয়েছিল।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন