ভারতীয় ঐতিহ্য ও আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকার : স্বামী বিবেকানন্দ - মিঠুন মুখার্জী

 



'বীর সন্ন্যাসী বিবেকের বাণী ছুটিছে জগৎময়'-- বিশ্বজয়ী বিবেকানন্দ ভারত মায়ের এমন এক সন্তান যার কথা যতই বলা যায় ততই বলতে ইচ্ছা করে। মনে হয়--"সাধ মিটিলো না"। ভারতীয় সনাতন ধর্মের ঐতিহ্যকে সারাবিশ্বে ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন এই মহান পুরুষ। জাত-পাত,ধনী-দরিদ্রের নিরিখে নয়, মানুষকে দেখেছিলেন সবকিছুর ঊর্ধ্বে। তাইতো তিনি বলতে পেরেছিলেন--"হে বীর সাহস অবলম্বন করো, সদর্পে বল- আমি ভারতবাসী,ভারতবাসী আমার ভাই।বলো-- মূর্খ ভারতবাসী, দরিদ্র ভারতবাসী, ব্রাহ্মণ ভারতবাসী, চন্ডাল ভারতবাসী আমার ভাই।....... বল ভাই-- ভারতের মৃত্তিকা আমার স্বর্গ,ভারতের কল্যাণ আমার কল্যাণ।"( বর্তমান ভারত)। এই দৃঢ় ধারণাই তার ঈশ্বর উপলব্ধির সারকথা

               ঊনিশ শতকের রেনেসাঁস বা নবজাগরণের শীর্ষস্থানীয়দের মধ্যে স্বামী বিবেকানন্দ অন্যতম ছিলেন। অনেক মনীষীই বিবেকানন্দকে আধুনিক ভারতের স্রষ্টা বলেছেন। সত্যই ভারতবর্ষের নবজাগরণের প্রতিটি ক্ষেত্রকে স্বামীজি বিরাট ভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। চক্রবর্তী রাজা গোপালাচারী লিখেছেন --"আমাদের আধুনিক ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে যে-কেউ স্পষ্ট দেখতে পাবেন-স্বামী বিবেকানন্দের কাছে আমরা কত ঋণী! ভারতের আত্মমহিমার দিকে ভারতের নয়ন তিনি উন্মীলিত করে দিয়েছিলেন। তিনি রাজনীতির আধ্যাত্মিক ভিত্তি নির্মাণ করেছিলেন।আমরা অন্ধ ছিলাম, তিনি আমাদের দৃষ্টি দিয়েছেন। তিনি ভারতীয় স্বাধীনতার জনক-- আমাদের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও আধ্যাত্মিক স্বাধীনতার তিনি পিতা।"

                 মানুষকে ঈশ্বর জ্ঞানী এই মহাপুরুষ ১৮৬৩ সালের ১২ ই জানুয়ারি (১২৬৯ বঙ্গাব্দের ২৯ শে পৌষ) সূর্যোদয়ের ন্যায় এই পৃথিবীতে আবির্ভূত হয়েছিলেন তার আলোয় বিশ্বময় অন্ধকারকে দূর করার জন্য। পিতা বিশ্বনাথ দত্ত অসম্ভব প্রতিভাবান মানুষ ছিলেন। হিন্দু-মুসলিম মিশ্রসংস্কৃতিতে অনুরাগী ছিলেন। মা ভুবনেশ্বরী দেবী ছিলেন অত্যন্ত তেজস্বিনী ও দরাজ মনের মানুষ। কাশির বিশ্বেশ্বর শিবের অনুগ্রহে পুত্রের জন্ম এই বিশ্বাসে তার মা তার নাম রেখেছিলেন বীরেশ্বর। এই থেকে সংক্ষেপে 'বিলে'তে এসে দাঁড়িয়েছিল। ছেলেবেলা থেকেই বিবেকানন্দের মধ্যে অপূর্ব মেধা, তেজস্বিতা, স্বাধীনচেতা মনোভাব,বন্ধুপ্রীতি আর খেলাধুলার প্রতি আকর্ষণ লক্ষ করা যেত। সেই সঙ্গে গভীর আধ্যাত্মিক তৃষ্ণারও পরিচয় পাওয়া যায় বন্ধুদের সঙ্গে রাম- সীতার ও শিবের পূজা করার মধ্যে। সঙ্গীতের প্রতি তার গভীর অনুরাগ লক্ষ করা যেত শৈশব থেকেই।এছাড়া অসহায় মানুষদের দুঃখ যন্ত্রণা দেখে এগিয়ে গিয়ে সমবেদনা জানানো বা সহযোগিতার প্রচেষ্টা ছোট থেকেই স্বামীজীর মধ্যে লক্ষ করা যায়

                স্বামী বিবেকানন্দের সংগীত প্রীতি ও তার সঙ্গীত প্রতিভা নিয়ে যথেষ্ট বই লেখা হয়েছে। শ্রী অমিত্রসূদন ভট্টাচার্যের কিছু কিছু সশ্রদ্ধ অভিব্যক্তি যথা: "গানের তাল ও বিভিন্ন রাগ রাগিনী সম্বন্ধে স্বামী বিবেকানন্দ যেভাবে সহজ কথাভঙ্গিতে তার আলোচনা উপস্থাপিত করেছেন তা যেকোনো সংগীত শিক্ষার্থীর পক্ষেই এক পরম প্রাপ্তি।"...." শুধু আধ্যাত্ম প্রেরণায় নয় নানা সময়ে ঠাকুরকে গান শুনিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ অন্তরে যে আবেগ ও প্রেরণা  অনুভব করতেন তা বিস্মৃত হবার নয়।".... "স্বামী বিবেকানন্দের জীবনে গান ছিল তার চিরকালের সঙ্গী। শ্রীরামকৃষ্ণের প্রয়ানের  পূর্বে বা পরে এবং স্বদেশে অথবা বিদেশে যেখানেই স্বামী বিবেকানন্দ অবস্থান করুন --গান কখনো তাকে পরিত্যাগ করেনি।"

             পড়াশুনায় অসম্ভব মেধাবী নরেন্দ্রনাথের পড়ার বিষয়বস্তু ছিল অত্যন্ত বিস্তৃত। গবন ও গ্রিনের ইতিহাস বই থেকে শুরু করে জেভন্সের ডিডাক্টিভ লজিক, কান্ট- স্পেন্সার- মিলের দর্শনের পাশাপাশি গডফ্রের অ্যাস্ট্রোনমি, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য কাব্যচর্চার সঙ্গে সঙ্গে অ্যাপ্লাইড ম্যাথমেটিক্স-- বিভিন্ন বিষয় তখন থেকেই তার গভীর আগ্রহ ও আগাধ পড়াশুনো। শৈশবের শেষ অবস্থা থেকে বিবেকানন্দের মধ্যে আধ্যাত্মিকতার জোয়ার উঠেছিল। এই জন্য তিনি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতেন, মনের তৃপ্তি পূরণের জন্য তিনি ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষ দর্শন করতে চেয়েছেন। অনুমান নয়, প্রত্যক্ষ উপস্থিতির উপরেই বিশ্বাস করতেন তিনি। ধর্ম,ঈশ্বর, আত্মা যদি সত্য বস্তু, তবে তার বাস্তব রুপ কি--- এই প্রশ্নে তাঁর মন সর্বদা ব্যাকুল থাকতো। তিনিই ঈশ্বরের প্রকৃত উপস্থিতি জীবের মধ্যে উপলব্ধি করেছিলেন। জীবনের একটা পর্যায়ে এসে তিনি উপলব্ধি করেছেন--" জীবে প্রেম করে যেই জন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর"। আধ্যাত্মিকতার উৎস প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন--" প্রত্যেক মানবের যেমন একটা বিশেষ ব্যক্তিত্ব আছে, প্রত্যেক জাতিরও একটা নিজস্ব ব্যক্তিত্ব আছে। প্রত্যেক মানব যেমন অপর সকল মানব থেকে কতক বিষয়ে একেবারে পৃথক, তেমনি প্রত্যেক মানবগোষ্ঠী অপর সকল মানবগোষ্ঠী থেকে কতক বিষয়ে একেবারে ভিন্ন। প্রকৃতি যেমন তার আপন রাজ্যে প্রত্যেক মানবকে দিয়ে নিজের একটা বিশেষ উদ্দেশ্য পূরণ করিয়ে নেয়, প্রত্যেক মানবের প্রাক্তন কর্ম যেমন তার জীবনকে একটা বিশেষ গতিপথে চালিত করে ,প্রত্যেক নেশনের বেলায় ঠিক তদ্রুপ"

              আধ্যাত্মিকতায় স্বামীজীর মন যখন নিমগ্ন তখনই তাঁর জীবনে পথপ্রদর্শক শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ দেবের আবির্ভাব ঘটে। সম্ভবত ১৮৮১ খিস্টাব্দের ৬ই  নভেম্বর কলকাতার সুরেন্ মিত্রের বাড়িতে তার দর্শন পান নরেন্দ্রনাথশ্রী রামকৃষ্ণদেব বুঝেছিলেন-- এই যুবক নরঋষির অবতার, মানুষের কল্যাণার্থে পৃথিবীতে নেমে এসেছেন। নরেন্দ্রনাথ সেদিন রামকৃষ্ণকে প্রশ্ন করেছিলেন--' আপনি কি ঈশ্বর দর্শন করেছেন?' এই প্রশ্নের উত্তরে স্বামীজি যা উত্তর পেয়েছিলেন তাতেই রামকৃষ্ণ সম্পর্কে ধারণা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল তাঁর। কিন্তু খুব সহজেই যে রামকৃষ্ণকে স্বামীজি মেনে নিয়েছিলেন তা নয়, বারংবার তাঁর ত্যাগ, পবিত্রতার ও আধ্যাত্মিকতার পরীক্ষাও নিয়েছিলেন। রামকৃষ্ণের দেখানো পথে পা বাড়িয়েছিলেন। মানুষকে ঈশ্বর জ্ঞানে সেবা করার জন্য সংসার ছেরে  সন্ন্যাস গ্রহণ করেন তিনি। শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে মাত্র ছয় বছর অতিবাহিত করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ ।এই সময়ে আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জন করেছেন তিনি।  দক্ষিণেশ্বরের মন্দিরে বারংবার রামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে ধর্মজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকজ্ঞান অর্জন করেছেন। নরেন্দ্রনাথকে আধ্যাত্মিক পথে এগিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শ্রী রামকৃষ্ণদেব তাকে ভাবি লোকশিক্ষক রূপে তৈরি করেছিলেন। জনমানসে যে আধ্যাত্মিক ধ্যান-ধারণার স্থাপন করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণদেব, পরবর্তীতে সেই চেতনাকে আরও এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ

                ১৮৮৬তে রামকৃষ্ণের তিরোধানের পর তিনি গুরুভ্রাতাদের নিয়ে বরাহনগর মঠ স্থাপন করেন ও স্বয়ং সন্ন্যাস নাম গ্রহণ করে হন স্বামী বিবেকানন্দ। ১৮৯১ সালে বিবেকানন্দ ভারত পরিক্রমায় বেরিয়েছিলেন। শুরু হয় তাঁর দেশকে জানার, মানুষকে জানার এবং ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ ও তা বাস্তবায়নের কাজ। ১৮৯২ সালে বড়দিনের সময় বিবেকানন্দ ভারত মহাসাগরে কন্যাকুমারিকার দক্ষিণে শেষ শিলাখণ্ডটির উপর দাঁড়িয়ে যেন দর্শন করলেন তাঁর ধ্যান ধারণার পূর্ণরূপটি

                রামকৃষ্ণের মানবপ্রেম সুলভ মানসিকতা, উদারতা এবং কর্মধারার মধ্যেই লুকিয়ে ছিল বিবেকানন্দের ভবিষ্যৎ কর্মকাণ্ডের বীজ। রাজনীতি পছন্দ করতেন না বলেই সর্বদায় গুরুভাইদের রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতেন। জীবনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সর্বদা অবগত করাতেন তিনি, যা রামকৃষ্ণের কাছ থেকে পাওয়া

                ১৮৯৭ সালে আমেরিকার শিকাগো শহরে ধর্ম মহাসভায় ভারতের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করে সনাতন হিন্দু ধর্মের ঐতিহ্যকে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। এই সম্মেলনে ভারতের সনাতন হিন্দু ধর্ম ও বেদান্তের অদ্বৈতবাদ প্রচার করাই ছিল স্বামীজীর প্রধান উদ্দেশ্য। তিনি বলেছিলেন--'ত্যাগ ও সেবায় ভারতের মূল মন্ত্র--আধ্যাত্মিকতায় মানবের স্থায়ী কল্যাণের নিদান। তাই ভারত বহু উত্থান-পতন, বহু রাজনৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয়ের মধ্যেও সমুন্নত শির-- সঞ্জীবিত। তাই আবহমানকাল থেকে ভারতই বিশ্বমানবকে দেখায় প্রকৃত শান্তির পথ।' তার বক্তৃতায় বিশ্বের মহাপন্ডিতকুল অভিভূত হয়েছিলেন। এই বক্তৃতার ফলপ্রসূতে বিশ্বের বহু বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব স্বামীজীর শিষ্যত্ব গ্রহণে ব্যাকুলতা প্রকাশ করেন। ভগিনী নিবেদিতা স্বেচ্ছায় স্বামীজীর সান্নিধ্যে আসেন। আমেরিকা ও ইংল্যান্ডে গেলে সেখানেও আশাতীত সাড়া পড়ে যায় এবং সেখানকার সুধীসমাজে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়

               আমেরিকা ও ইংল্যান্ড থেকে ১৮৯৩ সালে ফিরে বিবেকানন্দ ভারতবর্ষে পেয়েছিলেন বীরের সম্মান। প্রস্তুত হলো তার ভবিষ্যতের কাজের ক্ষেত্র। এই বছরই কলকাতায় ফিরে বিবেকানন্দ তৎপর হলেন তাঁর সংকল্পিত মঠ ও মিশনের একটি স্থায়ী রূপ দেয়ার জন্য। বিশিষ্ট কয়েকজন রামকৃষ্ণ ভক্ত ও অনুরাগীদের নিয়ে তিনি ১৮৯৭ সালের পয়লা মে গঠন করেন রামকৃষ্ণ মিশন অ্যাসোসিয়েশন। এই সংস্থার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ঠিক হয়-- সেখানে প্রথমেই বলা হয়েছে, মানবকল্যাণে শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর নিজ উপলব্ধ যে সত্যের প্রচার করেছেন, নিজের জীবনচর্যায় যা অনুসরণ করেছেন, অন্যদের ঐহিক, আত্মিক ও আধ্যাত্মিক অগ্রগতির জন্য যে সত্যকে প্রতিফলিত করতে সাহায্য করেছেন-- এই সংঘ সেই সত্যকেই প্রচার করবে। ঘোষণায় স্পষ্টভাবে বলা হয়, মিশনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হবে পুরোপুরি আধ্যাত্মিক ও মানবিক। রাজনীতির সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক থাকবে না। এরপর ১৮৯৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন প্রতিষ্ঠা করেন স্বামী বিবেকানন্দ।বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজই এর উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়ায়। জীবের মধ্যে শিবের উপস্থিতি অনুভব করে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দান করেন স্বামী বিবেকানন্দ

                জীবনে এগিয়ে চলার জন্য একজন আদর্শ মানুষের প্রয়োজন, যে পথ দেখাবেন গুরু হিসেবে। সেই আদর্শ পুরুষ স্বামী বিবেকানন্দের গুনমুগ্ধ হয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যারা তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন বা তাঁর ভক্ত হয়ে উঠেছিলেন তাদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য--- ১) ভগিনী নিবেদিতা : স্বামীজীর শিষ্যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন মিস মার্গারেট নোবল্। ভারতের নারীদের উন্নতিতে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন। স্বামীজীর ভাবাদর্শকে গ্রহণ করে স্ত্রী শিক্ষা বিস্তারের  কাজে ও স্বাধীনতা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন ২)মিস্টার স্টাডি :মিঃ.ই.টি স্টাডি ইংল্যান্ডে বেদান্ত প্রচারে স্বামীজীকে সহযোগিতা করেন। ৩) মিস হেনরিয়েটা মুলার : ১৮৯৬ সালে স্বামীজি তাঁর অতিথি ছিলেন। বেলুরমঠ স্থাপনের কাজে ইনি অর্থসাহায্য করেছিলেন। ৪) মিসেস সেভিয়ার : বেদান্ত প্রচারের কাজে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। স্বামীজীর ইচ্ছা ও অনুপ্রেরণায় 'মায়াবতী অদ্বৈত আশ্রম' প্রতিষ্ঠা করেন। ৫) মিস ম্যাকলাউড: সম্পূর্ণ নাম মিস জোসেফাইন ম্যাকলাউড। স্বামী বিবেকানন্দের পাশ্চাত্য দেশীয় প্রধান অনুরাগী ভক্তদের মধ্যে অন্যতমা। তিনি সবসময় স্বামীজীকে তার কাজে সহযোগিতা করেছিলেন। তিনি বহুবার বেলুড়মঠে এসেছেন। ৬) সারা বুল : স্বামী বিবেকানন্দ ইনাকে ' মা' বা 'ধীরামাতা' বলে সম্বোধন করতেন। বিখ্যাত নরওয়েবাসী বেহালাবাদক মিস্টার ওলি বুলের স্ত্রী। স্বামীজীকে এদেশে ও পাশ্চাত্যে অনেক ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছিলেন। বেলুড় মঠ স্থাপনে অর্থ দান করেছিলেন

                ক্ষণজীবনের অধিকারী স্বামী বিবেকানন্দের বাস্তবিক জীবনের প্রভাব ও উপলব্ধি তার সাহিত্যগুলির মধ্যে ফুটে উঠেছে। 'ভাববার কথা' (১৩০৫ বঙ্গাব্দ), 'বর্তমান ভারত' (১৩০৬-০৭ বঙ্গাব্দ), ' পরিব্রাজক' (১৩০৬-১৩০৭ বঙ্গাব্দ),' প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য'(১৩০৭-০৮ বঙ্গাব্দ)। তার লেখা গদ্যগ্রন্থ 'বর্তমান ভারত'-এর বিভিন্ন গদ্যে তৎকালীন ভারতের অবস্থাকে তুলে ধরেছেন। এই গ্রন্থের 'শূদ্র জাগরণ' গদ্যে শূদ্রদের জাগরণের কথা বর্ণিত। শ্রেণীবিভক্ত সমাজে সর্বনিম্নে শূদ্রদের অবস্থান হলেও, তাদের উপরই এই সমাজ নির্ভরশীল তা স্বামীজি দেখাতে চেয়েছেন। এই সমস্ত শ্রমজীবী মানুষের শূদ্রত্ব থেকে প্রতিভা বলে উচ্চ স্তরে উঠে আসার কথাও বর্ণিত হয়েছে। যেখানে শূদ্রদের মধ্যেই স্বামীজীর ঈশ্বর চেতনা ক্রিয়াশীল হয়েছে।' পরিব্রাজক' গ্রন্থে স্বামীজীর পরিব্রাজক হিসেবে যে পরিক্রমা তার উপলব্ধি ফুটে উঠেছে। এই গ্রন্থের 'সুয়েজ খালে: হাঙ্গর শিকার' গদ্যে সুয়েজখাল খননের ইতিহাস যেমন বর্ণিত, তেমনি সুয়েজ-এর মধ্য দিয়ে ভারত ও ইংল্যান্ডের জলপথে বাণিজ্যের কথাও তুলে ধরেছেন। শ্রমজীবী মেহেনতি মানুষদের দুরবস্থা ও বঞ্চনার কথাও তুলে ধরেছেন। যাদের মধ্যে ঈশ্বরকে খুঁজে পেয়েছেন স্বামী বিবেকানন্দ।' প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য' গ্রন্থের রচনাগুলিতে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য দেশগুলোর আচার-আচরণ, পোশাক-পরিচ্ছদ, রীতিনীতি, আহার, পরিছন্নতা, ধর্ম ও মোক্ষ,সংস্কৃতিগত তুলনামূলক আলোচনা করেছেন স্বামীজি। পাশ্চাত্য ও প্রাচ্য নারীদের মধ্যেও তুলনা করেছেন স্বামীজি তাঁর বিভিন্ন রচনায়। এদেশের নারীরা পাশ্চাত্য নারীদের থেকে সুশিক্ষা নিক তিনি তা চাইতেন। নারী দুর্বল নয়, সবল হোক; নারীরা পুরুষের সমান অধিকার ও সম্মান অর্জন করুক তা স্বামীজীর বিভিন্ন বক্তৃতায় ফুটে উঠেছে। নারীদের শিক্ষা দেওয়ার কথা তিনি বারংবার বলেছেন। স্বামীজি সন্ন্যাসীদের শুধু ধর্ম প্রচার না করে ঘরে ঘরে শিক্ষা পৌঁছে দেওয়ার কথা বলেছেন

             ভারতবর্ষের ঐতিহ্য স্বরূপ স্বামী বিবেকানন্দ হিন্দু সনাতন ধর্মের প্রতিষ্ঠা করে সমগ্র বিশ্বের দরবারে যেমন ভারতবর্ষকে সমৃদ্ধ করেছেন, তেমনি ভারতবাসী তাকে পেয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে। রামকৃষ্ণের আধ্যাত্মিক চিন্তা-চেতনাকে উত্তরাধিকার হিসেবে স্বামী বিবেকানন্দ বহন করে নিয়ে গেছেন। যার ফলস্বরুপ রামকৃষ্ণ মিশন ও বেলুড় মঠ প্রতিষ্ঠিত হতে দেখা যায়। তাঁর মত করে ভারত তথা বিশ্বের মানুষের প্রতি সহৃদয় মনোভাব এবং সকল মানুষের মধ্যে আধ্যাত্মিক চেতনার জাগরণ ঘটানোর মতো ত্যাগী মানবপ্রেমী কমই পৃথিবীর বুকে জন্মেছে। কোন মূর্তি নয়, মানুষের মধ্যেই ভগবান প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি। স্বামী বিবেকানন্দ সারা জীবন তপস্যা করে বুঝেছেন যে, জীবের মধ্যেই ঈশ্বর অধিষ্ঠান হয়েছেন। তাছাড়া ঈশ্বর ফিশ্বর কিছুই আর নেই। স্বামীজি সম্পর্কে পৃথিবীর বহু মনীষীর বহু মত প্রকাশ পেয়েছে। রাশিয়ান দার্শনিক ও সাহিত্যিক লিও টলস্টয় বিবেকানন্দ সম্পর্কে বলেছেন- "ঈশ্বর, আত্মা,মানুষ, ধর্মীয় ঐক্য ইত্যাদি তত্ত্ব সম্পর্কে আলোচনায় স্বামী বিবেকানন্দ বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী।" ১৯০৮ সালের ১৭ই আগস্ট তারিখে সমাপ্ত 'ধর্ম ও বিজ্ঞান' নামক একটি প্রবন্ধে টলস্টয় বিবেকানন্দের মূল্যায়ন করেছিলেন। উল্লিখিত প্রবন্ধে তিনি লেখেন-- "প্রজ্ঞা ও তত্ত্বজ্ঞানলাভের অনিবার্যতা ও প্রয়োজনীয়তার বিষয়ে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করাই বর্তমানকালে মানবজাতির অগ্রণী চিন্তাবিদগণের প্রধান দায়িত্ব। তাদের কর্তব্য মানুষের কাছে তুলে ধরা যে, বহু পূর্বে এই প্রজ্ঞা বা তত্ত্বজ্ঞান মানবজাতি অর্জন করেছিল এবং তা ধর্মের উপদেশ ও ঋষিদের বানীর মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। মানুষকে দেখানো, এটা শুধুমাত্র ভারতীয়, মিশরীয়, গ্রীক এবং রোমান মহান ব্যক্তিদের মাধ্যমেই নয়, পরবর্তীকালে কান্ট, শোপেনহাওয়ার, বিবেকানন্দ প্রভৃতি মনীষীদের মাধ্যমেও প্রকাশিত হয়েছিল। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিবেকানন্দ সম্পর্কে বলেছেন-- "যদি তুমি ভারতকে জানতে চাও, তবে বিবেকানন্দকে জানো। তার মধ্যে সবকিছুই ইতিবাচক, নেতিবাচক কিছুই নেই।"রোঁমা রোলাঁ বলেছেন-- "বিবেকানন্দকে দ্বিতীয় স্থানে কল্পনা করা অসম্ভব, যেখানেই গিয়েছেন, সেখানেই তিনি প্রথম স্থানে আসীন।... তাকে দেখা মাত্রই প্রত্যেকে বুঝতে পারত: ইনি একজন নেতা, একজন ঈশ্বর প্রেরিত পুরুষ; এমন এক চিহ্নিত ব্যক্তি যার মধ্যে সুস্পষ্ট প্রকাশিত অপরকে পরিচালিত করার শক্তি।একবার হিমালয়ে এক পর্যটক তাকে না চিনলেও বিস্ময়ে থমকে দাঁড়িয়ে ছিল-- বলে উঠেছিলঃ'শিব!' বিনোবা ভাবে বিবেকানন্দ সম্পর্কে বলেছেন--" তিনি আমাদের শিখিয়েছিলেন একই আত্মা সকলের মধ্যে বিরাজ করছেন। যদি তুমি এটা বুঝতে পারো তাহলে তোমার কর্তব্য সবাইকে তোমার ভাই মনে করা এবং মানবজাতির সেবা করা।" সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণন স্বামী বিবেকানন্দ সম্পর্কে পৃথিবীর মহাসংকটের  সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলেছেন--"যদি বিবেকানন্দের কোন বাণী এখন আমাদের স্মরণ করতে হয় তা হলো আমাদের আধ্যাত্মিক মহিমার প্রতি নির্ভরতার জন্য তার সেই আহ্বান। ...মানুষের মধ্যে অফুরন্ত আধ্যাত্মিক সম্পদ নিহিত আছে। মানুষের আত্মাই সর্বোচ্চ, মানুষ অদ্বিতীয়, অপূর্ব। জগতে কোন সমস্যা বা বিপদই অবশ্যম্ভাবী কিংবা অনিবার্য নয়। মানুষ আমরা চরম বিপদ এবং অক্ষমতার সম্মুখীন হলেও তাকে কাটিয়ে আসতে পারি। শুধু লক্ষ্য রাখতে হবে, আমরা যেন আশা না হারাই। বিবেকানন্দ আমাদের যন্ত্রণার মধ্যে আশ্রয় দিয়েছেন, দুঃখের মধ্যে দিয়েছেন আশা, হতাশার মধ্যে সাহস।"

          উপরের মনীষীদের বিবেকানন্দ সম্পর্কে মহামূল্যবান মন্তব্যগুলি থেকে সর্বশেষে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, ভারতের হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যকে পুনর্জীবন দান করেছেন স্বামী বিবেকানন্দ। ভারতের মতো দেশের সনাতন ধর্মকে, ঐতিহ্যকে, কৃষ্টি-সংস্কৃতি, মানবিকতাকে সমগ্র পৃথিবীর মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়ে আমাদেরকে ঋণী করে রেখেছেন স্বামীজি। নিজের ইতিবাচক চিন্তা ভাবনার মাধ্যমে ভারতীয় ঐতিহ্যকে তুলে ধরেছেন তিনি। অন্যদিকে বেদান্ত প্রচার ও রামকৃষ্ণদেবের পরম ভক্ত হয়ে আধ্যাত্মিকতার পরিচয় দান করেছেন। রামকৃষ্ণদেবের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান করে তিনি রামকৃষ্ণদেবের উত্তরাধিকার রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তার দেখানো পথে পরবর্তীতে বহু মানুষ তাকে আদর্শ মেনে এগিয়ে চলেছেন। বর্তমান সময়ে বিবেকানন্দ ছাড়া এগিয়ে যাওয়ার কথা ভাবাই যায় না। তাই এই মহাপুরুষ সম্পর্কে বলা যায়-- " দাও হে সুমতি দীনে, দীনবন্ধু ভগবান।/ তব নামামৃত পানে যেন প্রভু যায় প্রাণ।।/ পরলোকেতে সদ্গতি,/যেন হয় করি স্তুতি/ বিবেক বৈরাগ্য মুক্তি দিয়ে করো পরিত্রান।।" 

 

 


 

 

।।ঋণ স্বীকার।

১)" বিশ্বজয়ী বিবেকানন্দ"; নৃপেন্দ্র কৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায; প্রকাশন-- দেব সাহিত্যকুটির

২) "নবদর্শনে সংগীত ও বাদ্য স্বামী বিবেকানন্দ " ; সংকলক-- অমিত্রসূদন ভট্টাচার্য ; প্রকাশন--দীপ প্রকাশন

৩) "স্বামী বিবেকানন্দের উত্তিষ্ঠত জাগ্রত";সংকলক-- শ্রী একনাথ রানাডে;প্রকাশন- বিবেকানন্দ কেন্দ্র কলকাতা

৪)" মাতৃশক্তি" (দ্বিমাসিক পত্রিকা); সম্পাদক-- কুশল চৌধুরী

৫) "আমার ভারত অমর ভারত" স্বামী বিবেকানন্দ ; প্রকাশক-- স্বামী সর্বভুতানন্দ

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন