স্বজন - পুষ্প সাঁতরা


যাঃ!! ঘাটশিলা-হাওড়া ট্রেনটা চোখের সামনেই বিজয়গর্বে বাই বাই করে চলে গেল! কি হবে এখন, ভাবনার ভীমরুলগুলো চারপাশে কামড়াতে থাকে; ট্রেন সেই ভোর ছ'টাএখন বিকেল পাঁচটা থেকে কাল ভোর! ভাবতেই কেমন গায়ে কাঁটা দিচ্ছে। দুষ্কৃতীদের ভয়ে পুলিশ প্রহরায় জঙ্গলের মধ্যেই গাড়ি যায়, তাও পাঁচটার পর বন্ধ। ভয় আর দুশ্চিন্তায় কাঁপা পা নিয়ে হাঁটা দিই, তারপর যা আছে কপালে! ঘরমুখো গরুর গলায় কাঠের শব্দ নিশানা ঠ-- র-র- র যেন নিঃশব্দ ভেঙে চলছে পালক আর তার পোষ্যরা

- 'কি ম্যসটর বাবু, সাবধানে যা বিপ্যদ বটে' একথা বলে রাখাল মাহাতো ক্রমশ সরু হতে হতে পথ আর জঙ্গলের মধ্যে সেঁধিয়ে গেল।

নিজেকে দুষতে লাগলাম আর একটু আগে বেরোলেই হত লাষ্ট পিরিয়ডে অঙ্ক বোঝাতে গিয়ে সময় দেখিনি যা হবার হয়ে গেছে উন্নয়নের জোয়ারে কালো পিচ রাস্তা একলা শুয়ে হাঁটায় জোর দিলাম। ঘাটশিলায় নেমে রোজ যাওয়া আসাটা বন্ধুর বাইকে স্কুলে পৌঁছই ও আজ ব্যাঙ্কে আসেনিআসার সময় বাসটা কোনরকম পেয়েছিলামএখন হাঁটছিস্টেশনে তো পৌঁছই।

হঠাৎ দেখি, খুব দ্রুতগতিতে আসা একটা বাইক সামনে এসে বল, 'স্যার উঠে পড়ুন কথা না বলে, খুব খারাপ অবস্থা!' কে, কি, কেন প্রশ্নগুলোকে চুপ রেখে বাইকে চড়লাম

'কি খুব অবাক হচ্ছেন তো? আপনি প্রথম যেদিন স্কুলে জয়েন করলেন সে বছরই আমি উচ্চমাধ্যমিক দিয়ে স্কুল ছেড়েছি'

 ও তুই লখিন্দর মাহাতো?’

 'চুপ! চারদিকে কাঁকড়া বিছে', হিসহিস করে লখিন্দর বলল। একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। মা’,  ডাকতেই সারা শরীরে উল্কি আঁকা মহিলাটি বেরিয়ে এসে বললে, 'আয় বাপ'

মাটির ঘরে দেওয়াল জুড়ে আলপনা, গাছের ছায়া ঘেরা বাড়ি! নরম সুরে বললেন, 'আমার ঐ এক বেটাবৌটা সাপ কাটানে ম্যরল, আর বিহা করেক নাইপায়ে জল দে বাপ, আমি খাবারটুকুন করি।‘

ভাবনার ঘোরে চোখ একটু এঁটেছিল। 'ও খোকা ম্যসটর আমার রাঁধ্যা হইয়্যে গ্যেছে, এখানে কাঁকড়া বিছার ভয়, অচেনা মানুষ দেখল্যে মেরে পুত্যে দ্যেয়, মারাং বুরুর দয়ায় ব্যেঁচে গ্যেছিস'

শুনে আমার লোম খাঁড়া। 'ম্যসটর ফ্যসটর মানে না, তবে এলে আমিই তীরকাঁড় ছুঁড়তাম, খ্যে লে বাপ' শালপাতার থালায় বোয়াল ছাতুর তরকারি শুঁটকি মাছের চচ্চড়ি, ডান হাত পাখা ঘোরাচ্ছে বাঁ হাত পিঠে আদর মাখছেএরমধ্যে লখিন্দর এসে বলল, ‘একটা লাশ দেখে এলাম দুধ কুসুমের রাস্তায়!

নির্ঘুম চোখে শুনতে পাচ্ছি, 'একট্যো লোক ঢুক্যেছিল, তবে উ তো লখিন্দরের লোক, লিশ্চয়ই ভাল বট্যে! শুনে শুকনো জিভটা কিছুতেই নাড়াতে পারছিলাম নাভোরের পাখির ডাক ঢুকে পড়ল ঘরেলখিন্দর তুমি আমার স্বজন সন্তান!

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন