মানুষ
থেকে শুরু করে পশুপাখি নির্বিশেষে প্রত্যেকটি প্রাণীর দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডের ফাঁকে
বিশ্রাম নেওয়ার একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হলো ঘুম। ঘুমন্ত
অবস্থায় আমাদের সচেতন ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া স্তিমিত থাকে। এই সময়ে মস্তিষ্ক তথ্য
বিন্যাস করার সুযোগ পায়। তাই পর্যাপ্ত ঘুম একটি শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশের জন্য
কতখানি প্রয়োজনীয় তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
শিশুদের জন্য ঘুমের প্রয়োজনীয়তা :
পুষ্টিকর খাদ্য, পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, আরামদায়ক জামাকাপড় এবং দৈনন্দিন যত্নআত্তির সঙ্গে পর্যাপ্ত ঘুম দেওয়াটাও একটি শিশুর ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত জরুরী। ঠিকঠাক ঘুম না হলে একটি শিশুকে নানাবিধ সমস্যার মুখোমুখি পড়তে হতে পারে।
১) শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশ রোধ হতে পারে।
২) ঘুমের সময় শিশুর বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় হরমোনের ক্ষরণ হয়, যার ফলে দিনের পর দিন পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়ায় শিশুর বৃদ্ধির হারও কমে যায়।
৩) কম ঘুমোলে শিশুর শরীরে কোর্টিসল বা স্ট্রেস হরমোনের ক্ষরণ বাড়ে। এতে শিশু মানসিক চাপে থাকে এবং নতুন কিছু শেখার প্রতি তার আগ্রহ কমে যায়।
৪) শিশুদের ঘুম কম হলে তাদের শরীরে লেপটিন হরমোনের ক্ষরণ কমে যায়। এই হরমোনের কাজ হল খিদে নিয়ন্ত্রণ করা। এর ক্ষরণ কমে যাওয়ায় মস্তিষ্ক শরীরকে খিদে নিয়ন্ত্রণ করার সিগন্যাল পাঠাতে পারে না এবং বাচ্চারা প্রয়োজনের তুলনায় বেশি খেতে থাকে। তার ফলে সৃষ্টি হয় বাচ্চাদের পেটের গন্ডগোল ও পেট ব্যথার মতো সমস্যা এবং বেশিদিন এমন চলতে থাকলে বাচ্চার মধ্যে ওবেসিটির লক্ষণও দেখা যেতে পারে।
৫) কম ঘুমোলে শিশুর শরীর ক্লান্ত থাকার কারণে রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায় এবং তার মধ্যে ঘন ঘন অসুস্থ হয়ে পড়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
কিন্তু কোন কোন অনুঘটক শিশুর ঘুমের সমস্যার কারণ হতে পারে? এই প্রসঙ্গে অস্থিরতা, খুব ঘন ঘন রাতে ঘুম ভেঙে যাওয়া, ঘুমের ব্যাঘাতযুক্ত শ্বাস-প্রশ্বাস এবং কিছু অসুখকে দায়ী করা যায়। এসব অসুখের মধ্যে জিইআরডি (খাদ্যনালির রোগ) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। কিন্ডারগার্টেনের প্রি-স্কুলারদের একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, যে বাচ্চারা কম ঘুমায় তাদের নেতিবাচক ব্যবহার গ্রহণ করার ক্ষমতা কম হয়। তুলনামূলকভাবে তাদের কোনো কিছু শেখার আগ্রহ এবং ধৈর্য্যও কম হয়। এমন শিশুদের সামাজিক দক্ষতা এবং ভোকাবুলারি ও স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়। সেই কারণে একটি শিশুর পর্যাপ্ত ঘুমের প্রয়োজনীয়তা কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না।
২) মোবাইল, টিভি, কম্পিউটার এবং অন্যান্য গ্যাজেট থেকে যতটা পারা যায় শিশুকে দূরে রাখতে হবে। ঘুমোনোর আগে কোনোভাবেই তাকে স্ক্রিন টাইম দেওয়া চলবে না।
৩) ঘুমোতে যাওয়ার আগে শিশুকে টয়লেট থেকে ঘুরিয়ে আনার অভ্যাস তৈরি করতে হবে। এর ফলে মাঝপথে ঘুম ভাঙার আশঙ্কা কমবে।
৪) শিশুর ঘুমের জন্য প্রয়োজন নরম বিছানার। তার উপযোগী সঠিক গদি এবং বালিশ বাছতে হবে।
মনে
রাখা দরকার, সব শিশু সমান নয় এবং সেই কারণে
সব শিশুর ঘুমের প্যাটার্নও সমান হওয়া সম্ভব নয়। তাই ঘুমের চার্ট হিসেবে
পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে না মিললে অস্থির হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। শুধু লক্ষ্য রাখতে
হবে, শিশু নিয়মিত কম ঘুমোলে তার মধ্যে অতিক্লান্তির লক্ষণ
রয়েছে কিনা এবং মানুষ, খেলা ও পরিবেশের প্রতি অনাগ্রহ
দেখা যাচ্ছে কিনা। তার আচার ব্যবহারের প্রতি বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে – শিশুর
হাত ও মুখের অঙ্গভঙ্গি, কান টানছে কিনা, বারবার চোখ ঘষছে কিনা, চোখের পাতা বারবার বন্ধ করছে ও
খুলছে কিনা, এক বছরের বেশি বয়সের শিশুর
ক্ষেত্রে হাঁপানি বা শ্বাস নিতে অসুবিধা হচ্ছে কিনা ইত্যাদি। কোনো কোনো শিশু রাত
বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও সক্রিয় ও দুষ্টু হয়ে ওঠে। রাগ ও জেদের মত বিভিন্ন
নেতিবাচক আবেগ দেখাতে থাকে। শান্ত হতে অনেকখানি সময় নেয়, খাবারে অনীহা পোষণ করে এবং অল্প ব্যথাতেই বেশি কান্নাকাটি করে। এসব লক্ষণ
থাকলে শিশুর কম ঘুম নিয়ে সচেতন হতে হবে এবং চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন