ভগিনী নিবেদিতা সেদিন বেলুড়মঠে গেলেন তাঁর গুরু স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে
সাক্ষাত করতে। বিভিন্ন বিষয়ে কথাবার্তা হচ্ছিল। হঠাৎ স্বামীজী নিবেদিতাকে বললেন,
“আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হচ্ছি। একটা মহা তপস্যা ও ধ্যানের
ভাব আমাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে এবং আমি মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হচ্ছি।”
স্বামীজীর এই কথার সত্যতা সম্পর্কে নিবেদিতার মনে কিছুমাত্র সন্দেহ ছিল না
ঠিকই, তবু তিনি তাঁর স্কুল সম্পর্কে কয়েকটি বিষয় নিয়ে স্বামীজীর
সঙ্গে আলোচনা করতে চাইলেন। এবার স্বামীজী ধীর শান্ত কণ্ঠে বললেন,
“এসব ব্যাপারে আমি আর আলোচনা করতে পারি না। আমি মৃত্যুর দিকে
চলেছি।”
সেদিন ছিল একাদশী। স্বামীজী নিজে উপবাস করেছিলেন। কিন্তু তিনি নিবেদিতাকে
খাওয়াবার জন্য অতিমাত্রায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। নিবেদিতা এতে একটু বিব্রত হলেন।
কিন্তু শিষ্যকে নিজের হাতে খাওয়াতে তাঁর গুরু সেদিন যথার্থই ব্যাকুল। তিনি খাওয়ার
ব্যবস্থা করে নিজেই পরিবেশন করতে শুরু করলেন। খাওয়ার জিনিসের মধ্যে ছিল কাঁঠালের
বিচি সেদ্ধ, আলু সেদ্ধ, ভাত এবং বরফ দিয়ে ঠান্ডা করা
দুধ। নির্বাক ও নিস্পন্দ নিবেদিতা যন্ত্রচালিতের মত সবকিছু খেলেন। এবার তাঁর সামনে
এল আরও বড় বিস্ময়। স্বামীজী নিজেই জল ঢেলে নিবেদিতার হাত ধোয়ালেন এবং তারপর তোয়ালে
দিয়ে হাত মুছিয়ে দিলেন। এই অভাবনীয় ঘটনায়
নিবেদিতা সংকুচিত হয়ে প্রতিবাদ করলেন। বললেন,
“স্বামীজী, এসব তো আমারই করারই কথা।
আপনাকে আমারই সেবা করার কথা। অথচ আপনি আমার জন্য করছেন?”
একথা শুনে হঠাৎই স্বামীজী যেন গম্ভীর হয়ে গেলেন, তারপর একটু
থেমে বললেন,
“যীশু তাঁর শিষ্যদের পা ধুইয়ে দিয়েছিলেন।”
চমকে উঠলেন নিবেদিতা। এক অজানা আশংকায় তাঁর বুকে ঝড় উঠল। তিনি তৎক্ষণাৎ বলতে
যাচ্ছিলেন, “সে তো শেষ সময়!” কিন্তু এই কঠিন কথাগুলো তিনি আর উচ্চারণ
করতে পারলেন না। কে যেন আড়াল থেকে তাঁর গলা চেপে ধরল। তাঁর বারবার মনে হতে লাগল,
যিশুখ্রিস্ট ঠিক তাঁর অন্তিম সময়ে শিষ্যদের পা ধুইয়ে দিয়েছিলেন,
তাহলে কি… আর তিনি ভাবতে পারছিলেন না।
তারপর এল ৪ জুলাই।
ভোরবেলা ঘুম ভাঙল বিবেকানন্দের। তাকালেন ক্যালেন্ডারের দিকে। আজই তো সেইদিন।
আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস। মা ভুবনেশ্বরীর মুখটি মনে পড়ল তাঁর, ধ্যান করলেন সেই দয়াময়, প্রসন্ন মুখটি। বুকের মধ্যে
অনুভব করলেন নিবিড় বেদনা। তারপর সেই বিচ্ছেদবেদনার সব ছায়া সরে গেল। ভারী উত্ফুল্ল
বোধ করলেন বিবেকানন্দ। তাঁর মনে আজ নতুন আনন্দ। তাঁর শরীরে আজ নতুন শক্তি। তিনি
অনুভব করলেন তাঁর সব অসুখ সেরে গেছে, শরীরে আর কোনও কষ্ট
নেই। বিবেকানন্দ ডুবে গেলেন ধ্যানমগ্ন উপাসনায়। উপাসনার পরে গুরুভাইয়ের সঙ্গে
হাসিঠাট্টা করতে-করতে সামান্য ফল আর গরম দুধ খেলেন। বেলা সাড়ে আটটা নাগাদ
প্রেমানন্দকে ডেকে বললেন,
“আমার পূজার আসন কর ঠাকুরের পূজাগৃহে।”
সকাল সাড়ে নটায় স্বামী প্রেমানন্দও সেখানে এলেন পূজা করতে। বিবেকানন্দ একা
থাকতে চান। প্রেমানন্দকে বললেন,
“আমার ধ্যানের আসনটা ঠাকুরের শয়নঘরে পেতে দে। এখন আমি সেখানে
বসেই ধ্যান করব।”
অন্যদিন বিবেকানন্দ পুজোর ঘরে বসেই ধ্যান করেন। আজ ঠাকুরের শয়নঘরে প্রেমানন্দ
পেতে দিলেন তাঁর ধ্যানের আসন। ধ্যানে বসেছেন বিবেকানন্দ। ধ্যানের মধ্যে তাঁর মনে
হল, তিনি ঘরে একা নন। ঘরে এত আলো কেন? এ যে
একেবারে আলোর সমুদ্র, আলোর ঢেউ। সেই আলোরই একটি ঢেউ
শ্রীরামকৃষ্ণের রূপ ধরে সামনে দাঁড়িয়ে। কী অপরূপ সেই রূপ! বিবেকানন্দ ধ্যানের
মধ্যে বলে ওঠেন, “ঠাকুর! তুমি এসেছো!” শ্রীরামকৃষ্ণের মুখে
সেই হাসি, সেই আনন্দ। বিবেকানন্দের বুকের মধ্যে ধ্বনিত হল
শ্রীরামকৃষ্ণের কণ্ঠস্বর,
“নরেন, আমি এসেছি, তোকে
এইটুকু জানাতে, তোর কাজ ফুরিয়েছে।আর কোনও কাজ বাকি নেই নরেন।
আমি জানি, তোর মনে পড়ে গেছে তুই কে, কোথা
থেকে এসেছিস মর্ত্যধামে, কার কাজে তুই পৃথিবীতে এসেছিস,
সব এখন জানিস তুই। তোর সব
মোহ-আবরণ ক্ষয় হয়েছে নরেন। আমিই তো তোকে
ডেকেছিলুম পৃথিবীতে। এবার আমিই তোর
বিদায়ের দরজা খুলে দিলুম। তোর ইচ্ছামৃত্যু
নরেন। আর দেরি করিসনি। এবার ফিরে আয়।
দরজাটুকু পার হলেই দেখবি আমি দাঁড়িয়ে আছি তোর জন্যে।”
বেলা ১১টা পর্যন্ত ধ্যান করলেন বিবেকানন্দ। তারপর মন্দির প্রাঙ্গণে পায়চারি
করছেন আর গাইছেন,
“মা কি আমার কালো?
কালোরূপা এলোকেশী হৃদিপদ্ম করে আলো।”
শিলঙে, ১৯০১ সাল
স্বামীজি গান গাইছেন। একসময় অস্ফুটস্বরে বললেন, “যদি আর একটা বিবেকানন্দ থাকতো তবে বুঝতে পারত, বিবেকানন্দ কি করে গেল। কালে কিন্তু এমন শত শত বিবেকানন্দ জন্মাবে।” পিছনেই প্রেমানন্দ। বিবেকানন্দ হেসে বললেন, “তাড়াতাড়ি আজ খাওয়াদাওয়া সেরে নে। আজ আমি নিজের ঘরে একলা খাচ্ছিনে। সবার সঙ্গে খেতে বসব।”
সকালবেলা বেলুড়ঘাটে জেলের নৌকো ভিড়েছিল, নৌকো ভর্তি
গঙ্গার ইলিশ। বিবেকানন্দ মহা উত্সাহে ইলিশ কিনিয়েছেন। তাঁরই আদেশে রান্না হয়েছে
ইলিশের নানারকম পদ। গুরুভাইদের সঙ্গে মহানন্দে ইলিশভক্ষণে বসলেন বিবেকানন্দ। তিনি
জানেন আর মাত্র কয়েক ঘণ্টার পথ, ডাক্তারের বারণ শুনে চলার আর
প্রয়োজন নেই। তিনি পেটভরে খেলেন ইলিশের ঝোল, ইলিশের অম্বল,
ইলিশ ভাজা। দুপুরে মিনিট পনেরো বিছানায় গড়িয়ে নিলেন বিবেকানন্দ।
তারপর প্রেমানন্দকে বললেন, “সন্ন্যাসীর দিবানিদ্রা পাপ। চল
একটু পড়াশোনা করা যাক।” বিবেকানন্দ শুদ্ধানন্দকে বললেন,
“লাইব্রেরি থেকে শুক্লযজুর্বেদটি নিয়ে আয়। এই বেদের
মহীধরকৃতভাষ্য আমার মনে লাগে না। আমাদের দেহের অভ্যন্তরে মেরুদণ্ডের মধ্যস্থ
শিরাগুচ্ছে, ইড়া ও পিঙ্গলার মধ্যবর্তী যে সুষুন্মা নাড়িটি
রয়েছে, তার বর্ণনা ও ব্যাখ্যা আছে তন্ত্রশাস্ত্রে। আর এই
ব্যাখ্যা ও বর্ণনার প্রাথমিক বীজটি নিহিত আছে বৈদিক মন্ত্রের গভীর সংকেতে। মহীধর
সেটি ধরতে পারেননি।”
বিবেকানন্দ এইটুকু বলেই থামলেন। কেউ ধরতেও পারলেন না, বিবেকানন্দের মন ইতিমধ্যেই ভাবতে শুরু করেছে মেরুদণ্ড-সংলগ্ন কুলকুণ্ডলিনী
- শক্তিকে জাগিয়ে তাকে শরীরের অভ্যন্তরে ষঢ়চক্র ভেদ করিয়ে মস্তিষ্কে পৌঁছে দেবার
কথা! এরপর বিবেকানন্দ প্রায় তিন ঘণ্টা ধরে ব্যাকরণ চর্চা করলেন ব্রহ্মচারীদের
সঙ্গে। তিনি বরদরাজের লঘুকৌমুদীর সূত্রগুলি নানারকম মজার গল্পের সঙ্গে জুড়ে দিতে
লাগলেন। ব্যাকরণশাস্ত্রের ক্লাস হাসি-হুল্লোড়ে পরিণত হল।
বিকেল হয়েছে। প্রেমানন্দকে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছেন বিবেকানন্দ। হাঁটতে-হাঁটতে
একেবারে বেলুড়বাজার পর্যন্ত বেরিয়ে আসলেন। কোনও কষ্টই আজ আর অনুভব করলেন না। বুকে
এতটুকু হাঁফ ধরল না। সন্ধেবেলা মঠে ফিরে এসেছেন বিবেকানন্দ বললেন, “আজ শরীর যেমন সুস্থ, এমন অনেকদিন বোধ করি নে।” গঙ্গাঁর
ধারে আমগাছের তলায় একটি বেঞ্চি পাতা। সেখানে তামাক খেতে খেতে আড্ডায় বসলেন
বিবেকানন্দ। সন্ন্যাসীরা কজনে মিলে চা খাচ্ছেন। স্বামীজিও চা চাইলেন।
সন্ধে সাতটা। শুরু হল সন্ধ্যারতি। আর দেরি নয়। শরীরটাকে এবার জীর্ণবস্ত্রের
মতো ত্যাগ করতে হবে। বিবেকানন্দ প্রস্তুত। তিনি তরুণ ব্রহ্মচারী ব্রজেন্দ্রকে নিয়ে
নিজের ঘরে এলেন। বললেন, “আমাকে দু - ছড়া মালা দিয়ে তুই বাইরে বসে জপ কর্। আমি না
ডাকলে আসবি না।” স্বামীজি ধ্যানে বসলেন। তাঁর দেহের মধ্যে, মেরুদণ্ডের
প্রান্তে, মূলাধার পদ্মে তিনটি বেষ্টনে অধোমুখে বিরাজিত
পরমাশক্তি কুলকুণ্ডলিনী। সেই কুণ্ডলিনীকে জাগ্রত করতে চলেছেন বিবেকানন্দ। সেই
পরমাশক্তিকে প্রথমে ধীরে ধীরে বেষ্টন মুক্ত করলেন তিনি। তারপর তাঁকে করলেন
ঊর্ধ্বমুখ।
বিবেকানন্দের সর্বাঙ্গ ঘামে ভিজে গেছে। তাঁর মধ্যে জাগ্রত হয়েছে এক প্রবল
শক্তি। সেই সদ্যোজাগ্রত বেষ্টনমুক্ত ঊর্ধ্বমুখ ভয়ংকর কুলকুণ্ডলিনীকে মেরুদণ্ড দিয়ে
আরোহী করালেন বিবেকানন্দ। মেরুদণ্ড বেয়ে সাপের মতো উঠতে লাগল কুণ্ডলিনী।
বিবেকানন্দ চাইছেন সেই প্রবল শক্তিকে মস্তিষ্কে পৌঁছে দিতে। বাধা দিচ্ছে তাঁর
শরীরের ষঢ়চক্র। সেই সব বাধা বিবেকানন্দ যোগবলে অতিক্রম করলেন। ভয়ংকর কুলকুণ্ডলিনী
ধীরে ধীরে প্রবিষ্ট হল বিবেকানন্দের মস্তিষ্কে। এরপর আর ফেরার পথ বন্ধ।
শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, “যেদিন নরেন বুঝবে ওর কাজ শেষ হয়েছে, সেদিন
ও যোগবলে নিজের মুক্তির পথ খুঁজে পাবে।”
জাগ্রত কুণ্ডলিনী মেরুদণ্ড দিয়ে সাপের মতো উঠে গিয়ে বিবেকানন্দের মস্তিষ্কে যা
ঘটাবার তাই ঘটিয়ে দিল। বিবেকানন্দ ধ্যানের মধ্যে দেখতে পেলেন, খুলে গেছে তাঁর আলোকময় মহাপ্রস্থানের পথ। বললেন, “দরজা-জানালা
সব খুলে দে।” মেঝেতে বিছানা পাতা, সেখানে শুয়ে পড়লেন
বিবেকানন্দ, হাতে তাঁর জপের মালা। ব্রজেন্দ্র বাতাস করছেন।
বিবেকানন্দ বললেন, “আর বাতাস করিসনি। একটু পা টিপে দে।”
রাত ঠিক নটা। বাঁ পাশ ফিরলেন বিবেকানন্দ। তাঁর ডান হাতটা থরথর করে কেঁপে উঠল।
শিশুর কান্নার মতো অস্ফুট শব্দ করলেন বিবেকানন্দ। তারপর একটি গভীর দীর্ঘশ্বাস।
মাথাটা বালিশ থেকে পড়ে গেল। চোখের দুটি তারা চলে এল ভুরুর মাঝখানে। তার পর সব যেন
স্থির হয়ে গেল— ক্লান্ত শিশু যেন মার ক্রোড়ে ঘুমিয়ে পড়লেন। ব্রজেন্দ্র কিছু বুঝতে
না পেরে প্রথমে স্বামী চিন্ময়ানন্দকে ডাকলেন। স্বামী চিন্ময়ানন্দ বিবেকানন্দের নাড়ী পরীক্ষা করলেন।
নাড়ীর গতি অনুভূত না হওয়ায় তিনি স্বামী প্রেমানন্দকে ডাকলেন। প্রেমানন্দ বললেন, “বোধহয় সমাধি হয়েছে।” উচ্চৈস্বরে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের নামকীর্তন করা হল,
কিন্তু স্বামীজির সমাধিভঙ্গ হল না। স্বামী অদ্বৈতানন্দ এবার
বোধানন্দ স্বামীকে ভালো করে নাড়ি পরীক্ষা করতে বললেন। তিনি কিছুক্ষণ নাড়ী ধরে
দাঁড়ালেন, তারপর উচ্চৈস্বরে কেঁদে উঠলেন। তখন অদ্বৈতানন্দ
নির্ভয়ানন্দকে বললেন, “হায়! হায়! আর কি দেখছ? শীঘ্র মহেন্দ্র ডাক্তারকে ডেকে আন।”
স্বামী ব্রহ্মানন্দ ও স্বামী সারদানন্দ সে দিন বেলুড়ে ছিলেন না। খবর পেয়ে
প্রথমে ডঃ মহেন্দ্রনাথ মজুমদার এলেন, তারপরে এলেন
বৈকুণ্ঠনাথ সান্যাল। আর একজন ছুটলেন কলকাতায় স্বামী ব্রহ্মানন্দ ও স্বামী
সারদানন্দকে ডেকে আনতে। রাত সাড়ে দশটায় তাঁরা এসে উপস্থিত হলেন। কৃত্রিম উপায়ে
চৈতন্য সন্ধানের নানা প্রচেষ্টা হল। তার পর রাত বারোটায় ডাক্তার বললেন, প্রাণবায়ু নির্গত হয়েছে। বিবেকানন্দ বলেছিলেন তাঁর মৃত্যুদিন ৪ঠা
জুলাই। বলতেন, “আমি
চল্লিশ পেরুচ্ছি না।”, বলতেন, “আমার
কাজ হয়ে গেছে, এখন তোরা সব দ্যাখ শোন, আমায়
ছুটি দে।” মাত্র ঊনচল্লিশ বছর, পাঁচ মাস, চব্বিশ দিন বয়সে হৃদরোগে চিরকালের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলেন সন্ন্যাসী।
শিলং, ১৯০১ সাল
জুলাইয়ের এই চতুর্থ দিনে দেহাবসানের কয়েক বছর আগে সন্ন্যাসী বিবেকানন্দ কাশ্মীরে বসে আমেরিকান ভক্তদের সামনে পাঠ করেছিলেন ৪ জুলাই আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস উদ্দেশ্যে তাঁর বিখ্যাত কবিতা-
‘চল প্রভু চল তব বাধাহীন পথে ততদিন—
যতদিন ঐ তব মাধ্যান্দিন প্রখর প্রভায়
প্লাবিত না হয় বিশ্ব, যতদিন নরনারী—
তুলি ঊর্ধ্বশির—নাহি দেখে ছুটেছে শৃঙ্খলভার—
না জানে শিহরানন্দে তাহাদের জীবন নূতন।’
তখন কে জানত, এই ৪ জুলাইয়েই তাঁর দেহাবসান ঘটবে!
সেদিনই রাত্রে নিবেদিতা স্বপ্ন দেখলেন, শ্রীরামকৃষ্ণ
যেন সেই রাত্রে দ্বিতীয়বার দেহত্যাগ করছেন। পরদিন খুব সকালেই তাঁর ঘুম ভেঙে গেল।
কে যেন তাঁর দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে। দরজা খুলেই তিনি দেখলেন, বেলুড়মঠ
থেকে একজন লোক এসেছেন। তিনি চিত্রার্পিতের মত দরজায় দাঁড়িয়ে আছেন। শুধু হাত বাড়িয়ে
নিবেদিতার হাতে একটা চিঠি তুলে দিলেন, প্রেরক স্বামী
সারদানন্দ। চিঠিতে লেখা, “My Dear Nivedita, the end has come, Swamiji has
slept last night at 9 o’clock. Never to rise again.”
বিশ্বসংসার অন্ধকার হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে তিনি পাগলের মত ছুটে এলেন বেলুড়মঠে।
সর্বস্ব হারিয়ে তিনি যেন আজ পথের ভিখিরি। মঠে এসে ছুটে গেলেন স্বামীজীর ঘরে। এক
অপূর্ব দৃশ্য চোখের সামনে। স্বামীজীর মরদেহ যেন জ্যোতির্ময় রূপ ধারণ করেছে। দেহের
কিছুমাত্র পরিবর্তন বা বিকৃতি ঘটে নি। তিনি যেন পরিপূর্ণ সুস্থ, সবল এবং জীবন্ত, মুখমণ্ডলে তাঁর অপরূপ জ্যোতি। নিবেদিতা গুরুর পাশে গিয়ে বসলেন। তিনি
নির্বাক, নিস্পন্দ। স্বামীজির মাথাটি নিজের কোলে তুলে নিলেন
সযত্নে। ধীরে ধীরে একটি পাখা হাতে তুলে নিলেন। তারপর সেই পাখা দিয়ে গুরুকে হাওয়া
করতে শুরু করলেন। এই মুহুর্তে আর যে তাঁর কিছুই করার ছিল না। মাত্র দুদিন আগেই তো
তিনি এসেছিলেন। তখনও তো বুঝতে পারেননি, সেই চরম সময় এত কাছে,
একেবারে ঘরের দরজায় অপেক্ষমাণ। তিনি এখন কার কাছে যাবেন,কার কাছে গেলে তিনি খুঁজে পাবেন নির্ভয় আশ্রয়? কার
কাছে গেলে তিনি ফিরে পাবেন অনন্ত সাহস? কার কাছে পাবেন তিনি
অনন্ত পথের সন্ধান? নিবেদিতা তাঁর ডায়েরিতে ৪ জুলাই তারিখে
শুধু দুটো শব্দ লিখেছেন, “স্বামী ডায়েড।” স্বামীজী মারা
গিয়েছেন।
কিন্তু শোকে ভেঙে পড়ার অবকাশ কোথায় ? ঘরে বসে কাঁদার
সময় কোথায় ?
মঠের প্রাঙ্গণে একটি সুন্দর গালিচার ওপর শায়িত দিব্যভাবদীপ্ত, বিভূতি-বিভূষিত, বিবেকানন্দ। তাঁর মাথায় ফুলের মুকুট,
পরনে নবরঞ্জিত গৈরিক বসন, প্রসারিত ডান হাতের
আঙুলে জড়িয়ে আছে রুদ্রাক্ষের জপমালাটি, চোখদুটি যেন
ধ্যানমগ্ন শিবের চোখ। দেখে মনে হচ্ছে, যেন তিনি মহাধ্যানে
মগ্ন।
নিবেদিতা ভোরবেলাতেই চলে এসেছেন। স্বামীজির পাশে বসে হাতপাখা দিয়ে অনবরত বাতাস
করছেন। তাঁর দুটি গাল বেয়ে নামছে নীরব অজস্র অশ্রুধারা। স্বামীজির মাথা পশ্চিমদিকে, পা-দুখানি পুবে। গঙ্গার দিকে শায়িত বিবেকানন্দের পাশেই নিবেদিতাকে দেখে
বোঝা যাচ্ছে সেই গুরুগতপ্রাণা, ত্যাগতিতিক্ষানুরাগিণী
বিদেশিনী তপস্বিনীর হৃদয় যেন গলে পড়ছে সহস্রধারে। আজকের ভোরবেলাটি তাঁর কাছে বহন করে এনেছে
বিশুদ্ধ বেদনা। অসীম ব্যথার পবিত্র পাবকে জ্বলছেন, পুড়ছেন
তিনি। এই বেদনার সমুদ্রে তিনি একা, নির্জনবাসিনী নিবেদিতা।
বেলা একটার সময়ে স্বামী সারদানন্দ তরুণদের বললেন, “আমরা
ভেঙে পড়েছি। তোরা সকলে ধরাধরি করে স্বামীজির দেহখানি নীচে নামিয়ে আনতে পারবি?”
নীচে নামার পরে শেষ ফোটো নেওয়ার কথা উঠেছিল, কিন্তু
রাখাল মহারাজ (স্বামী ব্রহ্মানন্দ) বারণ করলেন। এর পর স্বামীজির চরণতল আলতায়
রঞ্জিত করে তাঁর পায়ের ছাপ নেওয়া হল। নিবেদিতাও অশ্রুসিক্ত নয়নে স্বামীজীর পা
দুটি ধুয়ে একটি পরিষ্কার রেশমি রুমালে তাঁর গুরুর পদচিহ্ন গ্রহণ করলেন।
বৃষ্টিভেজা পিচ্ছিল পথ ছিল চোরকাঁটায় ভরা, তারই মধ্যে
বিবেকানন্দের দেহ স্থাপন করা হল চন্দন কাঠের চিতায়। স্থানটি বিবেকানন্দ নিজেই
চিহ্নিত করে গেছিলেন মহাপ্রয়াণের কিছুদিন আগে, তাঁর প্রিয়
বেলগাছের কাছে। আর তখুনি সেখানে এসে পৌঁছলেন জননী ভুবনেশ্বরী, ছোটো ভাই ভূপেন্দ্রনাথ এবং ব্রজমোহন ঘোষ। চিত্কার করে কাঁদতে কাঁদতে
ভুবনেশ্বরী দেবী লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে, “কী হল আমার নরেনের?
হঠাত্ চলে গেল কেন? ফিরে আয় নরেন, ফিরে আয়। আমাকে ছেড়ে যাসনি বাবা। আমি কী নিয়ে থাকব নরেন? ফিরে আয়। ফিরে আয়।”
সন্ন্যাসীরা তাঁকে কী যেন বোঝালেন, তারপর তাঁকে
তুলে দিলেন নৌকায়। জ্বলে উঠল বিবেকানন্দের চিতা। সেই চিতার আগুন ক্রমে ক্রমে
লেলিহ্যমান জিহ্বা বিস্তার সহ ধূ-ধূ করে জ্বলতে লাগল। মাঝগঙ্গা থেকে তখনো ভেসে
আসছে ভুবনেশ্বরীর বুকফাটা কান্না। ভুবনেশ্বরীর নৌকো ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল, তাঁর কান্না, ‘ফিরে আয় নরেন, ফিরে
আয়’ ভেসে থাকল গঙ্গার বুকে। চিতাগ্নির সামনে বিবেকানন্দের প্রিয় ‘জি.সি’ অর্থাৎ
নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষ বিলাপ করে বলে উঠলেন,
“নরেন, তুমি তো ঠাকুরের ছেলে, ঠাকুরের কোলে গিয়ে উঠলে। আর আমি বুড়ো মানুষ, কোথায়
তোমার আগে যাব, তা না হয়ে আজ আমাকে দেখতে হচ্ছে তোমার এই
দৃশ্য!”
এ কথা শোনামাত্র শোকোচ্ছ্বাস চাপতে না পেরে নিবেদিতা জ্বলন্ত চিতার চারপাশে
পরিক্রমণ করতে লাগলেন। পাছে তাঁর গাউনে আগুন ধরে যায়, এই ভয়ে কানাই মহারাজ স্বামী ব্রহ্মানন্দের নির্দেশে তাঁর হাত ধরে গঙ্গার
ধারে নিয়ে বসালেন। নিবেদিতা মনে মনে ভাবলেন, “স্বামীজীর ওই
জ্বলন্ত বস্ত্রখণ্ডের এক টুকরো যদি পেতাম!”
সন্ধে ছটা। দাহকার্য সম্পন্ন হল। নিবেদিতা অনুভব করলেন, কে যেন তাঁর জামার হাতায় টান দিল। তিনি চোখ নামিয়ে দেখলেন, অগ্নি ও অঙ্গার থেকে অনেক দূরে, ঠিক যেখানে দাঁড়িয়ে তিনি, সেখানেই উড়ে এসে পড়ল ততটুকু জ্বলন্ত বস্ত্রখণ্ড যতটুকু তিনি প্রার্থনা করেছিলেন। নিবেদিতার মনে হল, মহাসমাধির ওপার থেকে উড়ে-আসা এই বহ্নিমান পবিত্র বস্ত্রখণ্ড তাঁর প্রভুর, তাঁর প্রাণসখার শেষ চিঠি। বহু পরে একবার ভগিনী নিবেদিতাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দের মধ্যে তফাত কি? নিবেদিতার স্মরণীয় উত্তর,
“অতীত পাঁচ হাজার বছরে ভারতবর্ষ যা কিছু ভেবেছে, তারই প্রতীক শ্রীরামকৃষ্ণ। আর আগামী দেড় হাজার বছর ভারত যা কিছু ভাববে, তারই অগ্রিম প্রতিনিধি স্বামী বিবেকানন্দ।”
তথ্যসূত্রঃ-
1. যুগনায়ক
বিবেকানন্দ(৩য় খণ্ড) - স্বামী গম্ভীরানন্দ
2. নিবেদিতা
লোকমাতা - শঙ্করীপ্রসাদ বসু
3. https://www.anandabazar.com/patrika/there-are-still-some-speculations-on-last-few-days-of-swami-vivekananda-1.1171155
4. https://www.prohor.in/did-vivekananda-feel-death-in-advance
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন