বিখ্যাত ব্যঞ্জনের জন্মকথা - পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

যে কোনও স্বাদু খাবার খাওয়া পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষেরই অন্যতম প্রিয় বিষয়। এঁদের মধ্যে আবার অনেকেরই রান্না করাও একটি প্রিয় কাজের মধ্যে পড়ে। রান্না করা এবং খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে যদি আমরা সেই সমস্ত সুস্বাদু ও জনপ্রিয় খাবারের উৎপত্তি বা সৃষ্টির নেপথ্য কাহিনী জানতে পারি তাহলে তা পেটের সাথে সাথে মনেরও পুষ্টি জুগিয়ে থাকে।

পৃথিবীর মানচিত্রে ভারতের নাম তার বৈচিত্রের জন্য সুবিখ্যাত। তা সে বৈচিত্র ভারতের আবহাওয়া, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ধর্ম, বর্ণ, পোশাক, আচার- বিচার, ভাষা, সাহিত্য, শিল্প , সংস্কৃতিসহ অন্যান্য প্রতিটি ক্ষেত্রেই পরিলক্ষিত হয়। এই সব কিছুর সাথে সাথেই ভারতীয় খাবার এবং বৈচিত্রময় অফুরন্ত প্রকারের মশলার ব্যাবহারে রন্ধন প্রণালীর বৈচিত্রও পৃথিবীতে বিশেষভাবে খ্যাতিলাভ করে আছে। ভারতীয় খাদ্যের ইতিহাস হল ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতির মেলবন্ধনে তৈরী প্রজন্মের পর প্রজন্ম জুড়ে ধারাবাহিকতার ইতিহাস। কিছু ক্ষেত্রে যেমন সাধারণের প্রয়োজন থেকে নতুন খাবার সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি আবার কিছু ক্ষেত্রে ভিন্ন দেশ থেকে আগতদের মাধ্যমে খাদ্যের আমদানী হয়ে ধীরে ধীরে তা ভারতীয় খাবারের তালিকাভুক্ত হয়ে গেছে। আজ তাই পঞ্চব্যঞ্জনে রইল এরকমই কিছু জনপ্রিয় ভারতীয় খাবার সৃষ্টির চমকপ্রদ ইতিহাস

 

পেঠাঃ




প্রেমের কীর্তিভূমি আগ্রার নাম উচ্চারণের সাথে সাথে যে খাবারের নাম প্রত্যেকের মুখে উচ্চারিত হয় ও জিভে রসস্বাদন ঘটায়, সেটি হল “পেঠা”। তাজমহল দর্শনে মুগ্ধ দর্শনার্থীদের মধ্যে এমন খুব কম মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে যিনি পেঠা না খেয়ে ফিরে এসেছেন। সম্ভবত পেঠা সৃষ্টি ও তাজমহল সৃষ্টির ইতিহাস ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকাই এর কারণ।


তাজমহল নির্মাণাধীন থাকাকালীন প্রায় ২১০০০ শ্রমিক প্রতিদিন শুধুমাত্র ডাল ও রুটি দিয়ে ক্ষুধা নিবারণ করতেন। দীর্ঘদিন একই খাবার খেতে খেতে তিতিবিরক্ত শ্রমিকরা কাজে অনীহা দেখাতে শুরু করেন। উদ্বিগ্ন শাহজাহান তাজমহলের প্রধান স্থপতি ঈশা এফেন্দীকে এই বিষয়ে সমাধান করার দায়িত্ব দেন। ঈশা এফেন্দী উপায়ের খোঁজে পীর নাকশাবন্দী সাহেবের কাছে উপায়ের জন্য গেলে তিনি পেঠা বানানোর পদ্ধতি জানান। লোকশ্রুতি অনুযায়ী পীর সাহেব সমাধির মাধ্যমে স্বয়ং স্রষ্টার থেকে এই মিষ্টি তৈরির পদ্ধতি জানতে পারেন। পরবর্তী সময়ে প্রায় ৫০০ বাবুর্চি পেঠা বানিয়ে সমস্ত শ্রমিকদের প্রতিনিয়ত খাবারের সাথে পরিবেশন করেন এবং তাঁদের অসন্তোষ দুর করেন।

 

পনীরঃ


যুগ যুগ ধরে ভারতের বিখ্যাত ও অন্যতম খাবারের প্রধান উপকরণ রূপে পনীর জনপ্রিয়তম স্থান দখল করে আছে। বর্তমানে শুধু ভারতীয় উপমহাদেশেই নয় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই পনীর অত্যন্ত জনপ্রিয় নিরামিষ খাবার রূপে বহুল প্রচলিত। মূলত খাবারের প্রধান উপকরণ হিসাবে পরিচিত পৃথিবীর প্রাচীনতম খাবার পনীরের জন্মবৃত্তান্ত বেশ চমকপ্রদ। যদিও ঋগ্বেদ, চরক সংহিতা সহ বহু প্রাচীন পুথিতে “দুধের টক আবরণ” রূপে বর্ণিত এক প্রকারের খাবারের উল্লেখ থেকে ঐতিহাসিকরা এটি ‘পনীর’ বলে বিবেচনা করে থাকেন, কিন্তু অনেক গবেষকই তা ‘দই’ বলে গণ্য করেন। বহুল প্রচলিত কিংবদন্তী হল যে এক দুর্ঘটনার ফলে পনীরের সৃষ্টি হয়েছিল।প্রায় ষষ্ঠদশ শতকে একদল মঙ্গোল ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বের হলে মরুভূমিতে এসে পড়েন। ভ্রমণার্থীরা তাঁদের সাথে রাস্তায় পান করার জন্য ‘মুশকি’ ভর্তি দুধ নিয়ে আসেন। দীর্ঘ সময় মরুভূমির অত্যধিক শুষ্ক ও উষ্ণ আবহাওয়ায় দুধ নষ্ট হয়ে ছানা হয়ে যায়। মুশকি বন্দী ছানার জল মুশকির কাঁচা চামড়ায় শোষিত হয়ে ছানাকে শক্ত পিণ্ডে পরিণত করে। মঙ্গোল ভ্রমণকারীরা কৌতূহল বশত সেই পিণ্ড ভক্ষন করেন এবং অত্যন্ত উপাদেয় হিসাবে বিবেচনা করে তা খাবার রূপে গ্রহণ করতে শুরু করেন। জন্ম নেয় ‘পনীর’। পরবর্তীকালে মুঘলরা পনীর ভারতে নিয়ে আসে এবং ধীরে ধীরে তা ভারতীয় সমাজের মূলস্রোতে মিশে বর্তমানে অন্যতম প্রধান খাবারের স্থান দখল করে নেয়।  

  

সাম্বার ডালঃ

 

দক্ষিণভারতীয় প্রায় সমস্ত প্রকারের খাবারই আসমুদ্র হিমাচল ভারত তথা সারা পৃথিবীতেই সমানভাবে জনপ্রিয়। ইডলি, ধোসা, উত্থাপাম, আপ্পাম, মেদুবড়া প্রভৃতির নাম ও স্বাদ জানেন না এমন ভারতীয় খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এই সমস্ত খাবারের সাথেই এক বাক্যে উচ্চারিত হয় সাম্বার ডালের নামও। সাম্বার ডাল ব্যাতীত অন্যান্য কোনও খাবারই সম্পূর্ণ হয় না। সাম্বার ডাল আবিষ্কারের প্রচলিত কাহিনী হিসাবে বলা হয় ছত্রপতি শিবাজি মহারাজের প্রথম পুত্র সাম্বাজি একবার থাঞ্জাভুর ভ্রমণে গেলে, মহারাষ্ট্রের মহারাজা শাহজির রাজপাকশালের প্রধান রাঁধুনি সাম্বাজির সন্মানে নতুন ধরণের ডাল রান্না করে পরিবেশন করেন। সাম্বাজি ডাল খেয়ে পরিতৃপ্ত হয়ে নাম জিজ্ঞাসা করলে পাচক মহারাজ সাম্বাজির নামে নামকরণ করেন ‘সাম্বার ডাল” বলে।


তবে এই কাহিনী ছাড়াও আরও একটি কাহিনী প্রচলিত আছে। বলা হয় একবার সাম্বাজি তাঁর ঠাকুরদা শাহজি মহারাজের সাথে দেখা করতে থাঞ্জাভুর যান। শাহজি মহারাজ নিজে একজন দক্ষ রাঁধুনি ছিলেন। নাতিকে নিজের হাতে রান্না করে খাওয়ানোর ইচ্ছা হওয়ায় তিনি ঐতিহ্যবাহী টকডাল রান্না করতে যান। কিন্তু টকডালের প্রয়োজনীয় উপকরণ কোকুমের অভাবে তেঁতুল দিয়ে ডাল রান্না করেন। নাতি শাহজিকে একই সাথে কিছু সব্জি খাওয়ানোর উদ্দেশ্যে তিনি এই ডালে সব্জির টুকরো ও স্বাদ বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন মশলা মিশিয়ে দেন। সাম্বাজিকে ডাল পরিবেশন করলে সাম্বাজি খুব খুশি হন। শাহজি নাতির নামানুসারে ডালের নাম দেন “সাম্বার ডাল”। যদিও অনেকে মনে করেন সাম্বাজি স্বয়ং এই ডালের আবিষ্কর্তা।

 




কলমে -  পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়


Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন