রহস্যসন্ধানী পুলিশের “ফাঁদ” - পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়

 




বই – ফাঁদ

লেখক – অনিরুদ্ধ সাউ

প্রকাশক – বিভা পাবলিকেশন

প্রথম প্রকাশকাল – ফেব্রুয়ারি ২০২২

প্রচ্ছদ – কৃষ্ণেন্দু মণ্ডল

অলংকরণ – তমোজিৎ দেব

পৃষ্ঠা – ২৫০

মুদ্রিত মূল্য – ২২২/-

 


এই বইয়ের নাম হওয়া উচিত ছিল “পুলিশ যখন খুনি” বা “খুনি পুলিশ” বা “ষড়যন্ত্রকারী পুলিশ” গোত্রীয় কিছু। কারণ …। থাক কারণগুলো নাহয় পাঠক বই পড়েই জেনে নেবেন। এই বই পড়ার পর ভারতীয় আইন শৃঙ্খলা ব্যবস্থার ওপর ভরসা নষ্ট হতে বাধ্য। সাথে সাথেই চিন্তার জগতে গভীরভাবে যেসব প্রশ্নগুলি গেঁথে যায় তা হল - খুনের মত ভয়ঙ্কর অপরাধ করার পরেও খুনী কি এত সহজে রেহাই পেয়ে যায়? কিংবা রেহাই দেওয়া উচিত? খুনের নেপথ্য কারণ অর্থাৎ মোটিভ যাই হোক না কেন! খুন করে সব কিছু পরিকল্পনা মাফিক ধামাচাপা দিয়ে স্বাভাবিক জীবন কাটানো  কি খুব সহজ কাজ?? অথবা পুলিশ কি আইন ব্যবস্থার ঊর্ধ্বে হয়? অপরাধ করার পরেও কি তাঁদের শাস্তি পাওয়া বাধ্যতামূলক হয় না? এই রকম বহুবিধ প্রশ্নগুলিই বইয়ের গল্পগুলির যুক্তিগ্রাহ্যতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলতে বাধ্য!!  বিগত বছর কয়েক ধরে বাংলা সাহিত্যে রহস্য ও ভৌতিক ঘরানার গল্প উপন্যাসের ভিড়ে পাঠকদের প্রায় নাভিশ্বাস দশা। প্রায় প্রতিটি বইয়ের আগমনের খবরে একটি গালভরা বিজ্ঞপ্তি দেখতে পাওয়া যায় – ‘এই প্রকারের কাহিনী এর পূর্বে পাঠক পড়েন নি’। অতঃপর বই প্রকাশিত হয় এবং সুবিখ্যাত কোনও পাঠক সামাজিক মাধ্যমে ধন্য ধন্য করে একটি পাঠ প্রতিক্রিয়া লিখে দেন। সাধারণ পাঠক  সেই প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বাসী হয়ে বইটি কিনে ফেলেন। পরবর্তী সময়ে ‘না পড়া প্রকারের’ গল্প-কাহিনী পড়তে গিয়ে অধিকাংশ সময়েই পাঠকের বিজ্ঞপ্তি তথা পাঠ প্রতিক্রিয়া ঠকে গিয়ে দুর্মূল্যের বাজারে কষ্টার্জিত অর্থের জলাঞ্জলী যাওয়ার দুঃখে  মুখ -গলা – মন – মস্তিস্ক তেতো হয়ে যায়। এই বইয়ের বেশ কিছু ক্ষেত্রে এই কথাগুলো উপলব্ধি করা যায়।

ভাবনার ফাঁদে পাঠক বই পড়ে জড়িয়ে যাবার আগে বইয়ের বিষয়ে অল্প করে বলে ফেলি। বইয়ের ভূমিকা থেকে রহস্য উপন্যাস ঘরানা সহ বইয়ের বেশ কিছু বিষয় সম্পর্কে লেখক আমাদের জানিয়েছেন। ভূমিকা থেকেই জানা যায় যে এই বইটি সাধারণ ধরণের “অপরাধী কে?” ( হু ডান ইট) ভিত্তিক নয়। বরং গল্পগুলি কি করে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে অর্থাৎ “হাউ ডান ইট” গোত্রীয়। অনিরুদ্ধ সাউ লিখিত বইটি ছোট বড় উপন্যাসিকা মিলিয়ে মোট চারটি গল্পের সমাহারে রচিত।

১. ফাঁদ

২. দেবলীনা কি ভূত হয়ে গেছে ?

৩. দাগ

৪. দাগ -২ (যদিও শেষের দুটি গল্প দুটি মিলিতভাবে একটি উপন্যাস ।)


গল্পগুলির পটভূমিকা রচিত হয়েছে মুর্শিদাবাদে। বাংলা সাহিত্যের রহস্য দুনিয়ায় এই বইয়ের মাধ্যমে আবির্ভূত হয়েছেন বহরমপুর থানার এ.এস.আই, জিশান আলী। যার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ও বুদ্ধিদীপ্ত অনুসন্ধিৎসু মন যে শুধু যাবতীয় কেসগুলিকে সমাধানের মুখ দেখায় তাই নয়, তাঁর অভাবনীয় কূটকৌশল আইন শৃঙ্খলা ব্যবস্থাকেও হার মানিয়ে দেয়। খুনিও সম্ভবত ভাবতে শুরু করে কি করে খুনটা হল ?!?     

বইয়ের প্রথম “ফাঁদ” গল্পে পরপর চারজন শিক্ষিত তরুণের মৃত্যুতে সিরিয়াল কিলারের আগমন ভেবে পুলিশ মহল যখন বিপর্যস্ত, তখনই পুলিশ অফিসার পৃথ্বীরাজ সেন তুখোড় বুদ্ধি দিয়ে সেই সমস্যার সমাধান করেন। এই কেসেই তরুণ অফিসার জিশান আলী তাঁর গুরু বলে ভেবে নেওয়া পৃথ্বীরাজকে সহযোগী হিসাবে সাহায্য করেন। কিন্তু রহস্য উন্মোচনে নিজেই যেন নতুন করে এক রহস্যের ফাঁদে জড়িয়ে পড়েন। যা তাঁর গুরু প্রতি শ্রদ্ধার আসন নাড়িয়ে দিয়ে যায়। গল্পের কিছু জায়গার কাহিনী বিন্যাস বেশ অগোছালো লাগলেও স্বল্প দৈর্ঘ্যের গল্প হিসাবে খারাপ লাগবে না।

দ্বিতীয় গল্প “দেবলীনা কি ভূত হয়ে গেছে?” রহস্য গল্পের নাম এমন অদ্ভুত ও হাস্যকর সাধারণত হয়না। সম্ভবত লেখক ভূতের গল্প লিখতে গিয়ে মোট বদল করে রহস্য গল্পে পরিণত করেছিলেন। ফলে এক দ্বিধা ধন্দের মধ্যে পুলিশ – খুনিসহ পাঠকও ভাবনার ফাঁদে পড়ে গিয়েছেন। অত্যন্ত দুর্বল বুনটে লেখা গল্পটি নামকরণের মতই যুগপৎ বিরক্তি ও হাসির উদ্রেক করে।

বিরক্তি ও অর্থ জলাঞ্জলী দেওয়ার দুঃখে কাতর পাঠক পরবর্তী গল্প পড়তে শুরু করলে তৃতীয় “দাগ” গল্পটির জমাট রহস্য শুরুর দিকে বেশ মন কেড়ে নেবে। এই উপন্যাসে বহরমপুর থানায় এক তরুণী তাঁর বাবার রিভলভার হারানোর রিপোর্ট লেখাতে আসেন। রাজনৈতিক নেতার পরিবারের কন্যার নিজের স্বামীকে গুলি করে হত্যা। কলেজ জীবনে ফেলে আসা এক পুরনো প্রেম ও হত্যার ঘটনার পুনরায় লোকচক্ষুতে উন্মোচিত হয়ে যাওয়া। শেষে খুনি কে খুনের কারণ কি সব প্রায় ধোঁয়াশায় ঢেকে গিয়ে গল্প শেষ হয়ে যাওয়া। কৌতূহল জিইয়ে রাখার তাগিদে লেখক প্রচুর প্লট, সাবপ্লট লিখে ফেলেছেন এবং আবারও গল্পটি শেষের দিকে জোলো হয়ে গিয়েছে।

অতঃপর শেষোক্ত গল্প “দাগ – ২”। ভিকটিমের জামায় প্রাপ্ত একটি দাগ। যাকে নিয়ে দু দুটি বড় গল্প লেখা হয়ে যায়, অথচ সেটি পুলিশ মহলের একমাত্র জিশান আলী ছাড়া বাকিদের নজর এড়িয়ে যায়। বা ওই আরকি ঠিকভাবে “ধরা পড়িয়াও পড়িল না ধরা” গোছের কিছু একটা হয়ে বাকি রয়ে যায়। এই গল্পে রহস্যের সাথে সাথে আরও বহুবিধ রসের সমাহার দেখা যাবে। রাজনৈতিক শক্তিতে বলীয়ান দুর্নীতিপরায়ন নেতা, ধনী বনেদী পরিবারের উচ্ছৃঙ্খল কন্যা, অতীত প্রেম, প্রেমে ব্যর্থতা, ভদ্র মুখোশের আড়ালে অন্ধকারাচ্ছন্ন প্রতিশোধ স্পৃহায় মত্ত কুটিল চেহারা, জটিল ও বিকৃত মানসিকতায় মোড়া মন, সম্পর্কের জটিলতা অসহায়তার সুযোগ নিয়ে নিজেদের কুকীর্তির বলি দেওয়া প্রিয়জন প্রভৃতি। এককথায় পরতে পরতে সামাজিক অবক্ষয় ও লোভ ঘৃণা ঈর্ষা প্রভৃতি মানসিক জটিলতার কাহিনী। কিন্তু সবশেষে বহু ঘটনা দুর্ঘটনার সমাহারে গল্পের সমাপ্তি ঘটে। পাঠক নতুন ভাবনার ফাঁদে পড়ে যান এই ভেবে যে রক্ষকই যদি ভক্ষক হয় তাহলে সমাজে বিশ্বাস ভরসা করার কে রইল?


যাইহোক জিশান ‘সলিউশন’ আলীর আবির্ভাব যথেষ্ট পরিমাণে জমকালো হলেও একজন সুবুদ্ধি সম্পন্ন পাঠকের কতটা ভালোবাসা অর্জন করতে পারবেন সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ থেকে যায়। বরং তাঁর কার্যকলাপ তাঁর প্রতি অশ্রদ্ধাই তৈরি করে। ফলত পরবর্তী সময়ে তাঁকে নিয়ে লেখা গল্পও একজন পাঠক হিসাবে পড়ার আগ্রহ আর বোধ করিনা। কারণ কর্তব্য তথা আদর্শহীনতা ও অনৈতিকতার কখনই কোনও যুক্তিগ্রাহ্যতা হয় না। বিশেষ করে একজন পুলিশ অফিসারের ক্ষেত্রে নৈতিকতা ও কর্তব্যে অবিচল থাকা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলেই তাঁরা চাকরি জীবনের সূত্রপাতে এই বিষয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকেন। দোষে গুণে ভরা মানবিক চরিত্র বলে এড়িয়ে যাওয়াই যায়, কিন্তু তাকে নায়কের আসনে বসানো যায়না। এমনকি সাধারণ মানুষ বলে ভক্তি শ্রদ্ধা করাও অসম্ভব হয়ে পড়ে।

এই বইয়ের লেখা শুধুই পড়া যায়, নাতো তা আত্মস্থ করতে মন চায় নাই তা অনুভব করা যায়। বরং বই সমাপ্তিতে অতৃপ্তি ও অন্ধকারে মন ভারাক্রান্ত হয়। বইয়ের প্রচ্ছদ অত্যন্ত সাধারণ মানের। খুব একটা পৃথক ভাবনার ছোঁয়া না থাকায় তা নজর কাড়ে না। বরং গল্পের অলংকরণ বেশ ভালো লাগে। গল্পের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আঁকা ছবিগুলি পাঠকের গল্প পড়ায় কিছুটা গতি প্রদান করে। নতুন লেখকের বই হিসাবে একবার অন্তত পড়ে দেখাই যায় এই বই।   

 



কলমে - পারমিতা বন্দ্যোপাধ্যায় 

Post a Comment

নবীনতর পূর্বতন