যেদিন
সে নিজেকে মোটামুটি যোগ্য করে তুলতে পারলো, সেদিনই সে
জানতে পারলো সে সবার পছন্দের ঊর্ধ্বে নয়, বাইরে চলে
গিয়েছে। সে ভেবেছিলো সে পূর্ণতা পেলো, কিন্তু
জানলো সে ফুরিয়ে গিয়েছে, পতনের পথে। সে নিজেকে যোগ্য করে
তোলার পূর্বেও কারও আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে যেতে পারেনি, নিজেকে যোগ্য করে তোলার পরও কারও পছন্দের তালিকায় স্থান পেলো না।
মানুষ হওয়ার জন্য সময় নিই, সফলতা যখন মেলে তখন আর সময় থাকে না। মানুষ হওয়ার চেষ্টাকালে অন্যজ্ঞান থাকে না, মানুষের মতো মানুষ হওয়ার পর বুঝতে পারে অন্যজ্ঞানও জরুরি ছিলো জীবনের জন্য। সময় থাকতে সাধন করার পাশাপাশি জীবনকে উপভোগের উপলক্ষ্যও খুঁজতে হয়; সময় গেলে যেমন সাধন হয় না, সময় কালে সাধন করলেও সফলতা পেতে পেতে সময় চলেই যায়; নতুবা সাধনের মতো সফল লোকটিও কেন কারও পছন্দের হতে পারছে না। সে কেন অপছন্দনীয় হচ্ছে সবার কাছে?
সাধনের কাকাতো ভাই মদন, সাধনের চেয়ে ছোটো; মানে অনেক ছোটো। দুষ্ট, মানে অনেক দুষ্ট। সে পড়াশোনা ঠিকমতো শেষ করেনি, তারও বিবাহ প্রয়োজন। সেও সমত্থ। গোটা মহল্লা ঘুরে ঘুরে বখাটেপনা করে বেড়ায়। পরিবারের বড়ো ছেলেকে বিবাহ না দিয়ে ছোটো ছেলেকে বিবাহ দিতে চাচ্ছেন না মদনের বাবা। সেই কারণে মদন সাধন ও নিজের বাবার উপর ক্ষুব্ধ।
চাকরি পাওয়ার পর থেকেই সাধন বিবাহের চেষ্টা করছে। কিন্তু বিবাহটা হচ্ছে না। নিজের অনেক পছন্দ ছিলো, চাওয়া ছিলো, সব বিসর্জন দিয়েছে; তবুও বিবাহটা হচ্ছে না। কারণ বয়সটা বেড়ে গিয়েছে। বয়স বেড়ে গেলে মানুষ বয়েসী মানুষটার যোগ্যতা, চরিত্র, সৌন্দর্যকে গুরুত্ব দেয় না। প্রতিষ্ঠিত মানুষের বয়স বেড়ে যাওয়াটায় স্বাভাবিক। যার ভবিষ্যৎ ভালো তার বয়সের কারণে তাকে বেশিরভাগ মানুষই বিবাহের ক্ষেত্রে অপছন্দ করছে৷ বয়স হলে মানুষের হৃদয় থেকে কি মায়া উঠে যায়? বয়স্ক মানুষের ছায়া আরও বেশি শীতল হয় বয়স্ক বটের ছায়ার মতো। বয়স বেড়েছে আর সবাই ভেবে নিচ্ছে সব কমে গিয়েছে; শখ কমে গিয়েছে, তেজ কমে গিয়েছে। কিন্তু পুরুষের দেহে একবার যৌবন এলে আর যে তা যায় না, বোঝে না কি কেউ? বয়স বেড়ে যাওয়া কি অযোগ্যতা? বয়স্ক মানুষের মায়ার সাগর কি শুকিয়ে যায়? যোগ্যতার প্রমাণ রাখতে যাওয়া কি অন্যায়? সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিবাহ অনিবার্য না হলে সাধন বিবাহের কথা ভুলেই যেতো। বিবাহ না করার চেয়ে বিবাহ না করতে পারার পরিস্থিতি সে সামাল দিতে পারছে না; যতটা না যন্ত্রণাদায়ক, তারচেয়ে বেশি অপমানজনক।
গত
মার্চ মাসে মেয়ে দেখতে গিয়ে সাধন ভীষণ বিব্রত হয়েছিলো। এসএসসি পাশের সাল জানার পর
মেয়ে দেখায় দেয়নি। মেয়ের মামা বলেছিলেন, ছেলের
তুলনায় আমাদের মেয়ে অনেক ছোটো, জ্ঞানত এই অন্যায়টা আমরা কেউ
করবো না।
সাধনের
বড়ো মামা বলেছিলেন, বর্তমান সমাজ বাস্তবতায় একজন
প্রতিষ্ঠিত ছেলে পাবেন?
মেয়ের
বড়ো দাদা বলেছিলেন, চাকুরি করলেই মানুষ প্রতিষ্ঠিত
হয়, আর ব্যবসায় করলে মানুষ প্রতিষ্ঠিত হয় না? অন্যান্য পেশাজীবীদের হেয় করে কথা বলা কখনোই ঠিক না।
ছেলেপক্ষ
দুটো কথা বেশি বলে মেয়েপক্ষকে কোণঠাসা করবে এটাই ছেলেপক্ষের সহজাত প্রবৃত্তি।
কিন্তু ছেলেপক্ষের ছেলের কারণে সেই কথা বলার শক্তি নেই। অগত্যা মেয়েপক্ষের
উচ্চবাক্য মেনে নিচ্ছে। সাধনের কাকা বলেছিলেন, আপনাদের
মেয়ে সুখে থাকবে, সাধনের স্থায়ী চাকরি, ভবিষ্যৎ অনেক নিরাপদ।
মেয়ের
মামা বলেছিলেন, টাকা থাকলেই নিরাপত্তা থাকে না।
টাকা দিয়ে ভবিষ্যৎ জয় করা যায় না। বয়সের বিস্তর ফারাক থাকলে মন-মানসিকতা মেলে না।
সাধনের
মামা বলেছিলেন, যোগ্যতা থাকলে যোগ্যতা কী
বুঝতেন। যোগ্য কে জানতেন। সুখে নেই, তাই মেয়ের
সুখ চান না। মূর্খ পাঠ্য বইয়ের মর্ম বোঝে, অন্ধ পা
টিপে গন্তব্যে পৌঁছায়; কিন্তু আপনাদের মতো নির্বোধরা
কাচ-কাঞ্চনের পার্থক্য বোঝেন না।
মামা
সবাইকে নিয়ে মেয়ের বাড়ি থেকে দ্রুত বের হয়ে পড়েছিলেন। বয়স বাড়তির কারণে বিবাহ করতে
পারবে না জানলে সাধন চাকরিই খুঁজতো না; সে জানতো
চাকরি না পেলে বিবাহ হবে না। এই সব অপমান যতদিন মনে থাকে ততদিন মেয়ে দেখার কথা
ভুলে থাকে সে৷ তারপর আবার যখন ভাবে বয়স তো আরও বেড়ে যাচ্ছে, তখন আবার মেয়ে দেখতে বের হয়ে পড়ে। এবার মেয়ে দেখতে গিয়ে অন্য বিড়ম্বনায় পড়লো
সে। মেয়েপক্ষের একজন বললেন, বয়সের ছাপটা মুখমণ্ডলে স্পষ্ট।
বয়স তো মনে হয় অনেক। চেহারাটা ভেঙে গিয়েছে। মুখে বলিরেখা, দেখতে বাহাত্তুরে।
একথা
শুনে সাধনের কাকা বললেন, রিক্সাওয়ালা, অটোওয়ালারা দেখতে অনেক সুন্দর, আপনাদের
মেয়েকে তাদের কারও সাথে বিবাহ দেবেন?
মেয়েপক্ষের
অন্য আর একজন রেগে বললেন, চাকরি করে ছেলে তাই বলে কি উচ্চ
পর্যায়ে চলে গিয়েছে? নিম্নবিত্ত মানুষদের এত হেয় করে
কথা বলেন যারা তাঁরা প্রবল অহংকারপ্রবণ হন।
সাধনের
বন্ধু বললো, বয়স নিয়ে কথা বলছেন, আপনি কি জানেন আপনি কত বছর বাঁচবেন? এক জন্মে
মানুষ টাকার মুখ দেখেন না। এক জন্মের কর্মেও মানুষ সম্মাননীয় হন না। মেয়েকে একটি
উচ্চবংশীয় ঘরে বিবাহ দিতে এত দ্বিধা কেন? সুখ
রাজপ্রাসাদেও নেই, কুঁড়েঘরও নেই; কিন্তু স্বাচ্ছন্দ্য আছে। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হলে পাথর ভেবে সোনা ফেলে দিতেন না।
মানুষ বুদ্ধি-জ্ঞানে ছাই থেকে সোনা খুঁজে নেয়, আবার
বোধবুদ্ধিহীনতায় সোনাকে তামা ভেবে ফেলে দেয়।
মেয়ের
বড়ো দাদা বললো, মদখোর বুঝতে পারলে মদের বোতল
একদিন ফেলে দেয়। বখাটে ছেলেও একদিন আদর্শ পিতা হয়ে উঠে। কিন্তু বার্ধক্যে নত বৃক্ষ
কোনোদিন আর প্রথম জীবনের সজীবতা ফিরে পায় না। যার সব আছে তার কিছুই নেই যদি বয়স না
থাকে! যার বয়স নেই তার কিছুই নেই। চিকিৎসায় রোগ সারে, চিকিৎসায় যৌবন ফেরে না। টাকা দেখলে সবাই হাসতে পারেন, কিন্তু টাকা দেখলে কোনো বাবা-মা তাঁর সন্তানকে অপাত্রে পাত্রস্থ করবেন না।
এবারও
সাধন অপমানিত হয়ে ফিরে এলো। লেখাপড়া করতো যখন একটা কথা সে যার তার মুখে শুনতো, চাকরি পেলে মেয়ে, মেয়ের মা, মেয়ের বাবা তোমার পেছনে লাইন দেবেন। সে আরও শুনতো, প্রতিষ্ঠা পেলে অনেক কিছুই অধরা থেকে ধরাতে আসবে। কিন্তু বাস্তবতায় দেখলো
রোজগার-পয়সা-সম্মান বয়স বাড়লে বিলীন হয়ে যায়। যে বয়সে যে চাহিদা বয়স গেলো সেই
চাহিদায় ভাটা পড়ে। দরকার নেই, প্রয়োজন নেই; কিন্তু সমাজ বাস্তবতায় অত্যাবশ্যকীয় বলে আবার অপমানিত হওয়ার জন্য প্রস্তুতি
নিতে হয়। পড়ন্ত সিংহের রাজ্য দরকার, কিন্তু সবাই
ভাবছে পড়ন্ত সিংহের সামর্থ্য নেই। ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে অন্য মানুষ যখন কথাবার্তা
বলে মনে হয় দেহত্যাগ করবে সে। সে বুঝতে পারে না তার ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে মানুষ কেন
সন্দিহান। মানুষগুলো কী ব্যক্তিগত জীবন দিয়ে বুঝতে পারে না সাপ বুড়ো হয়ে গেলেও
বিষহীন হয় না! বাঘ বুড়ো হলে কি খুঁড়িয়ে হাঁটে? আজীবন পুরুষ
বীর্যবান প্রত্যেক পুরুষই জানে। তবে কেন সেই পুরুষরাই শৌর্যশালী পুরুষকে বয়স্ক
তকমা দেয়!
আবার
মেয়ে দেখতে গেলো। এবার পড়লো অন্য বিড়ম্বনায়। মেয়েপক্ষের একজন বললেন, ছেলের তো বয়স চল্লিশ বছর হবেই। চোখে চশমা, চালশে।
স্ট্রোক বা হার্ট অ্যাটাকের বয়স এসে গিয়েছে। যেকোনো দিন নাই হয়ে যাবে। বাঁচার আয়ু
আছে, বিবাহের আয়ু নেই; বিবাহের শখ
কমে না কেন বয়সে ভারাক্রান্ত কালেও!
একথা
শুনে সাধনের মামা বললেন, মৃত্যুর কথা কেউ বলতে পারেন? কী আহম্মকী কথা বলেন! বয়স বেশি চোখে পড়লো, তার সম্মান
চোখে পড়লো না? তার রোজগার সম্বন্ধে ধারণা আছে? স্রষ্টা একসাথে মানুষকে রোজগার আর সম্মান দেন না।
মেয়েপক্ষের
একজন বললেন, রোজগারের বড়াই যারা করেন তাঁরা
মানুষ সুবিধার না। সবাই রোজগার করেন, আর সবাই
তাঁর নিজ নিজ পেশায় আত্মনিবেদিত। চাকরি করলেই মানুষ ভালো চরিত্রের হন না। একজন
চরিত্রবান ছেলে গরীব হলেও তাঁর কাছে সুখ সহজে ধরা দেয়।
সাধনের
মামা বললেন, চামড়ার মুখে মন খুলে জ্ঞানী কথা
বলা যায়। সবাই নিজেকে চরিত্রবান ভাবেন, কিন্তু
বিবেকের আয়নায় তাকালে তিনি নিজেই বুঝতে পারেন কতটুকু চরিত্রসম্পন্ন। আর সুখ ধরতে
সিঁড়ি লাগে। সিঁড়ি পেলে হারাতে নেই। নিচে দাঁড়িয়ে গাছের পাকা ফল পাড়া যায় না, লগি লাগে। উপর থেকে কেউ টানলে নিচ থেকে উপরে উঠা সহজ। এই সুযোগ মানুষ এক জনমে
বারবার পান না। তলার লোক তলাতেই থাকেন, শুধু সুযোগ
না বুঝে লুফে না নিয়ে।
মেয়ের
পিসি রেগে গেলেন, বললেন, আমাদের মেয়ে ভারবোঝা হয়ে যায়নি যে, পাকা হাড়ের
ঘরে পাঠাবো। ঘাটের মরার বুদ্ধি পাকা, তবে বিবাহের
জন্য পাকা হাড়ের ঘরে যায় না কেন? বন্ধনের মধ্যেও সৌন্দর্য দরকার, সৌন্দর্যপ্রেমীরা সেটা বোঝে। মগজের মধ্যে কি মূত্র? বিবেক কি লয় গিয়েছে?
আবারও
অপমানিত হয়ে সাধন ফিরে এলো। অনেক আগেই বন্ধুদের থেকে নিজেকে সে গুটিয়ে নিয়েছে, কারণ তারা কথার ছলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতো। আজ রিংকুর সাথে দেখা হয়েই গেলো।
সাধনকে সে বললো, তুই আমাদের সাথে না মিশলেও আমরা
তোর সম্বন্ধে জ্ঞাত। পয়সা আছে লোভ দেখিয়ে সুন্দরী শ্রেষ্ঠা ঘরে আনবি ঐ আশা বাদ দে।
গোল্ডেন গার্ল টগবগে তাজা তোর জন্য না। তোর যেমন চটক নেই, চটকহীনই খোঁজ। নারীর সংস্পর্শে তোর রক্ত গরম হবে কিনা সেই সন্দেহ সবার ভেতর।
তাই কামনাময়, কামগন্ধময় থেকে পিছপা হয়ে যা।
ভাই তুই মুচি খদ্দের, ঘেয়ো কাঁঠাল খোঁজ। মৌন আর
অস্তপ্রায় সূর্যকে কেউ পছন্দ করে না। অবিবাহিত মেয়েদের আর দেখতে যাসনে, লাভ হবে না। বোবা, স্বামী পরিত্যক্তা বা দুর্ঘটনায়
স্বামী হারানো নারীর দিকে নজর দে। সঙ্গী জুটে যাবে।
রিংকু
চলে গেলো। সাধন বিমর্ষ হয়ে গেলো বন্ধুর কথা শুনে। নিজের সাফল্যের চূড়াতে এত বেশি
অধপতন লেখা থাকতে পারে সে বুঝতেও চাইছে না। সে আবারও এক মেয়ে দেখতে গেলো। পড়াশোনা
করে। এখানে এসেও সাধন নানা বিড়ম্বনায় পড়লো। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া, চমৎকার রেজাল্ট, চমৎকার চাকরি এসব বলে আর কারও
বাহবা অর্জন করা যাচ্ছে না, বয়সটা সব নষ্ট করে দিয়েছে।
সাধনের
বন্ধু বললো, সাধনের বয়স বেশি আমরা তো
লুকাচ্ছি না। কিন্তু তার অভিজ্ঞতা আপনাদের চোখে পড়ছে না কেন?
মেয়ের
ছোটো মামা বললেন, বয়স বেশি মানেই অভিজ্ঞতা বেশি
এটা ভুল। বয়সের সাথে অভিজ্ঞতার কোনো সম্পর্ক নেই। বয়স বেশি হলে অভিজ্ঞতা যদি বাড়তো
তবে বয়স্ক ছাগল ম্যা ম্যা ছেড়ে দিতো। বয়স্ক বানর গাছে উঠা ছেড়ে দিতো।
সাধনের
কাকা বললেন, আপনাদের ইউনিয়নে খোঁজ নিয়ে
দেখেন তো কয়জন ক্লাস ওয়ান কর্মকর্তা আছেন! সোনা চিনছেন না জহুরি নন বলে। মেয়ের
সুখের কথা, ভবিষ্যতের কথা তো ভাবছেন না!
মেয়ের
ছোটো মামা বললেন, মেয়ের সুখের কথা আর ভবিষ্যতের
কথায় ভাবছি, নতুবা লোভে পড়ে রাজি হয়ে যেতাম।
মানুষ সুখের ঘর বাঁধে দীর্ঘকাল বাঁচার জন্য। যার জীবন থেকে বয়সই চলে গিয়েছে, তাকে বিবেচনার জন্য আর কিছুরই দরকার নেই। টাকায় সুখ হয় না। ক্লাস ওয়ান
চাকরিজীবীর ঘরে সুখ আকাশ থেকে ঝরে পড়ে না। ছেলের বয়স আর মেয়ের বাবার বয়স যদি একই
হয়ে যায়, আমরা মেয়ের নিকট আত্মীয় হয়ে মানি কী করে?
সাধন আবারও ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলো। বারবার অপমানিত হয়ে এই ফিরে আসা সাধনের মনোবলকে ভেঙে দিলো। প্রেমময় হৃদয়ে কেউ আসতে চায় না। প্রেমার্দ্র তৃষ্ণার্ত হৃদয়ের সংস্পর্শে কেউ আসতে চায় না। বিশাল আকাশের ন্যায় বিশাল হৃদয়ে কেউ ঠাঁই চায় না, শুধু একটু বয়স বেড়ে গিয়েছে বলে।
অনেক ভেবে-চিন্তে সে রিংকুর কথায় রাজি হয়ে গেলো। দুর্ঘটনায় স্বামী মারা গিয়েছে এমন একজন মেয়ের সন্ধানও পেয়ে গেলো। কিন্তু সেই মেয়ের শিক্ষা-দীক্ষা নেই। সন্তান আছে। মন না চাইলেও দেখতে গেলো। কিন্তু নারাজি এলো মেয়ের পক্ষ থেকেই, সে বললো, আমার সন্তান আছে, স্বামীর শেষ স্মৃতি। তাকে বুকে আঁকড়েই বাঁচতে চাই।
সাধনের
বড়ো মামা বললেন, তোমার সন্তান
শিক্ষা-দীক্ষা-পয়সা সবই পাবে। উন্নত পরিবেশ পাবে। আমরা তো নিম্নবিত্ত নই, হীন মানসিকতা আমাদের নেই।
মেয়েটি
বললো, নিম্নবিত্তরা হীন মানসিকতার হয় এই কথা যারা বলতে
পারেন, তাঁদের ভেতরই হীন মানসিকতা প্রবল।
সাধনের
বন্ধু বললো, ঘর ভেঙেছে, ঘর পাবেন। এমন সৌভাগ্য কতজনের আছে?
মেয়েটি
বললো, আমার স্বামী নেই, আর আমার সব
আছে। আমি আমার স্বামীর ভিটাতেই থাকি। আমাকে কেউ অসম্মান করেন না।
স্বামীহীন নারীকেও সাধন বিবাহ করতে পারলো না। বারবার ফিরে আসা আর এবার ফিরে আসার মধ্যে অনেক পার্থক্য। নিজের অবস্থান কোথায় গিয়েছে যে, কেউ তাকে গ্রহণ করতে চাইছে না। একবার ভাবলো বিবাহই আর করবে না, কারণ সবাই বলছে যে সে বিবাহের উপযুক্ত আর নেই। আত্মবল ভাঙতে ভাঙতে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। আবার ভাবলো, আমি একজন সুস্থ মানুষ, আমি বিবাহ করবো না কেন? প্রত্যেক কৃষ্ণের জন্য রাধা নির্ধারিত।
সে এবার বুদ্ধি করে গরীব ঘরে মেয়ে দেখতে গেলো। গরীব পিতা-মাতার ঘাড়ে কন্যা সন্তান ভারবোঝা, এমন চাকরিজীবী ছেলে পেলে যারপরনাই খুশীই হবে। ছেলের বয়সটা মেয়ের বাবার চোখে না পড়লেও মেয়ের মায়ের চোখে পড়লো। বললেন, আমার মেয়েকে আমি বিবাহ দেবো না এই ছেলের সাথে।
সাধনের
কাকা বললেন, সাত জনমের পুণ্যের ফল আমরা
এসেছি আপনার মেয়েটাকে নিতে। সুখ পড়ে থাকে না পথে। আভিজাত্য একদিনে কেউ পায় না।
সোনার হরিণ পেয়ে কেউ ছাড়ে না।
মেয়ের
মা বললেন, আমার একটা মাত্র মেয়ে। আমাদের যা আছে সব মেয়ের সুখের
জন্য দিয়ে দেবো। তবুও আমার মেয়েকে আভিজাত্যে ভাসাবো না। কুঁড়েঘরে মেয়ে আমার বড়ো
হয়েছে, বিলাসবহুল ঘরে গেলে মানিয়ে চলতে পারবে না। তাছাড়া
একজন বয়স্ক মানুষের সামাজিক সম্মান রক্ষা করার জন্য আমি সন্তান মানুষ করিনি।
সাধন আর কাউকে কথা বাড়াতে দিলো না। সবাইকে নিয়ে সে বের হয়ে পড়লো। ঊর্ধ্বে নজর দিয়েও সে পেলো না, নিম্নে নজর দিয়েও হারলো সে। এবার সে একটি ডিভোর্সি মেয়ের সন্ধান পেলো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে মেয়ে দেখতে যেতে রাজি হলো। তার এক বন্ধু বললো, উপঢৌকন দিয়ে হলেও এবার মেয়েপক্ষকে রাজি করাবো।
ডিভোর্সি
মেয়ে হলেও দেখতে মন্দ না। সবার নজর কাড়লো। যেমন তেমন সুন্দর না, অনেক সুন্দর। এমন মেয়েকে ডিভোর্স দিয়েছে কোন পাগল!
মেয়েপক্ষ সাধনকে পছন্দ করেছেন। পরে মত পরিবর্তন করতে পারে এই ভয়ে সাধনের মামা আজই বিবাহটা সেরে ফেলতে চাইলেন। মেয়েপক্ষও এই অভিমতকে সমর্থন দিলেন। কিন্তু সাধনের ভেতর জাগলো বিতৃষ্ণা। ডিভোর্সি মেয়েকে বিবাহ করবে সে, এত অযোগ্য সে! দুই চারবার না-বোধক শব্দ উচ্চারণ করলেও মামা-কাকা-বন্ধুদের চাপে সাধন রাজি হয়ে গেলো। যার সাথে যার বন্ধন লেখা হাজার বিপত্তি মাড়িয়েও সেখানে মানুষ যায়।
সাধন বিবাহ করেছে মহল্লায় খবর ছড়িয়ে গেলো। কারও বিবাহ এমন আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারেনি সাধনের বিবাহে যেভাবে এলাকাতে সাড়া পড়ে গেলো। নানা মতের মানুষ আসছেন আর নানা কথা বলছেন। কাকলির মা বললেন, কোন দুর্ভাগা এলো সাধনের ঘরে! সুখ কী পাবে! কই দেখি কেমন! খুব সুন্দর চেহারা সুরত নাকি!
রিগ্নির
ঠাম্মা বললেন, যুবতির বাজখাঁই চাহিদা সাধন কি
বুঝবে? বাঁশের কাজ কুঞ্চি দিয়ে হবে?
রুবির
মা ওসব সমালোচনায় কান না দিয়ে বললেন, নতুন করে
সংসার পেলে, স্বামীকে যত্ন করবে। হিন্দু
নারীর দ্বিতীয় বিবাহ হয়-ই না। স্বামী-সংসার পেয়েছো, সব সময় সন্তুষ্ট থাকবে।
রুবির
মা গেলে দিবার মা এলেন। সাধনের বৌকে দেখে বললেন, ভাগ্যবতী তুমি। কত বড়ো ঘরে বৌ হয়ে এলে, নিয়তিকে আর
কখনো দোষ দেবে না।
ওদিকে সাধনকে ঘিরে আছে বন্ধুর দল। জ্ঞান দিচ্ছে কেবল। কাজল বললো, অনেক সাধনের পরে বৌ পেয়েছিস, অনেক যত্নে রাখবি। বৌ আশীর্বাদ হয়ে জীবনে আসে। দুঃখ দিবি না।
পাশ
থেকে রিংকু বললো, ঘ্রাণশক্তি দিয়ে সমাজকে বুঝিয়ে
দে তুই-ও বীরপুরুষ। তোর যৌবন নিয়ে প্রচ্ছন্ন উপহাস যারা করেছে পৌরুষের প্রবল আঘাত
দিয়ে তাদের বুঝিয়ে দে তুই বরাবরই ছিলি দামামা বাজানো প্রগলভ।
গৌতম
বললো, বৌদির মুখে হাসির বন্যা ফুটিয়ে বুঝিয়ে দে তোকে যারা
সন্দেহ করেছে তারা ভুল ছিলো। পুরুষ মানুষ ফুরায় না কখনো; না আঘাতে, না রোগে, না পৌঢ়ে। নারী এলো নাতো জীবনে, এলো দুলুনি।
বিভাস
বললো, পুরুষ মানেই অমিতসম্ভাবি। জীবনে ভাটা বলতে কিছু নেই, আছে কেবলই জোয়ার।
সবার কথায় সাধন শুনছে, কিন্তু তার মনের মধ্যে দ্বিধার আগমন। মনে মনে কেবলই বলছে, আমি কি এতটাই অযোগ্য ডিভোর্সি মেয়ে বিবাহ করলাম!
প্রাপ্তিতে আত্মতৃপ্তি নেই। প্রাপ্তিতে আনন্দ নেই। মনে দ্বিধা আর অনাগ্রহ। কত কষ্ট করে বড়ো হয়েছে, অথচ কাঙ্ক্ষিত মেয়েকে ঘরনি করতে পারলো না। সারা মহল্লার মানুষ জানেন, সব আত্মীয়-স্বজন জানেন ডিভোর্সি মেয়েকে সে বিবাহ করেছে। একারণে সারাক্ষণ মনের মধ্যে হীনম্মন্যতা কাজ করে। তার বৌ অন্যের ঘরনি ছিলো যখনই ভাবছে তখনই অস্থির হয়ে উঠছে। কাছে যেতেও ঘৃণা লাগে। জল দূষিত জানলে জলে মুখ দেওয়া যায় না। কিন্তু না জেনে দূষিত জলও অমৃত লাগে। তার বৌ অন্যের ঘরে ছিলো ভাবতেই ঘৃণার হাওয়া তাকে ভাসাতে থাকলো।
ওদিকে ঘর হারিয়ে ঘর পাবে কখনোই ভাবেনি রোহিনী। স্বামীর কাছে কাছে থাকার চেষ্টা করে, ঘরের কাজ যত্নে করে। সাজগোজ করে থাকে, কিন্তু সাধনের নজরে পড়ে না। সাধন দিনের শুরুতে অফিসে চলে যায়, দিনের শেষে ফেরে। ঘরের মানুষের প্রতি কোনো আগ্রহ প্রকাশ করে না। কেন ডিভোর্সি মেয়ে বিবাহ করেছে জনে জনে জবাবদিহি করতে হয়, কেন জাতের মেয়ে বিবাহ করেনি তাও আত্মীয়-স্বজনদের বলতে হয়। অথচ জাত-ভাই যারা তাঁরা সুন্দর একটি জাতের মেয়ে খুঁজে দিতে পারেননি।
মদন বৌদিকে দেখলেই মিষ্টি মিষ্টি হাসে আর বৌদির রূপের প্রশংসা করে। রোহিনী কাজে ব্যস্ত থাকলেই কখনো সামনে থেকে কখনো আড়াল থেকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে। ব্যাপারটা প্রথম দিকে স্বাভাবিক ভাবে নিলেও এখন আর স্বাভাবিক ভাবে নেয় না রোহিনী। যার কাছে আসার অধিকার নেই সেই কাছে আসে, যার কাছে আসার অধিকার সে দেখেও দেখে না। স্বামীর কাছে অধিকার পেশ করে না, কারণ তার কারণে সে পুনর্বার জীবন পেয়েছে, ঘর পেয়েছে; আশা দেখার সুযোগ পেয়েছে। আর তাই মদনের অযাচিত ইঙ্গিতে আনন্দ পেলেও সাড়াদান থেকে সে বিরত থাকে। একজন মানুষ ধারে ঘেঁষতে চায় উপলব্ধি করতে পারলে ভীষণ ভালো লাগে। একজন মানুষ কাছেই আসতে চায় না বোঝার পর কত খারাপই না লাগে অনুমেয়। নিজ ঘরে খাদ্য-খাবার, পোশাক-আশাক, অর্থ-বিত্ত আছে; কিন্তু মদন গাছ থেকে একটি পেয়ারা পেড়ে এনে দিলে সে বেশি খুশি হয়।
ক্ষুধার্ত বাঘ খাই খাই চিন্তায় হিংস্র হয়ে কাছে আসে, কিন্তু হিংস্রতা ধরে রাখতে পারে না। শক্তিশালী দমকা হাওয়া তেলশূন্য বাতির মতো ফুস করে নিভে যায়। গতিসম্পন্ন গতিদানব না হয়ে গতিশূন্য হয়ে যায় ক্ষণকালের মধ্যেই। কুৎসিত ভেবে চলে যায় গবেষণায়, তৃপ্তিশূন্য পড়ে থাকে তৃষ্ণাকাতর। আর তখন যদি শীতল বাতাস হয়ে দেখা দেয় মদন রোহিনী ইতস্তততা ভুলে মানসিক শান্তি খোঁজে। মদন শকুন চোখে চেয়ে বলে, বৌদি সুখী নয়, বৌদি অসুখী। বৌদির চলন-বলন-কথন-ধরনে বোঝা যায়। হাসি নেই ঠোঁটে, নির্বাক আর নিশ্চুপই সারাক্ষণ। অস্তপ্রায় রবি থেকে সূর্যকিরণ পাওয়া যায় না। অস্তপ্রায় রবি অস্তই যায়, তাকে থামানো যায় না।
উত্তরে রোহিনী
বলে, সধবাদের রং-বেরঙের শাড়ি পরা দেখলে হৃদয়টা ফেটে যেতো।
রঙিন শাড়ি পরার অধিকার পেয়েছি, আমি পৃথিবীর চিরসুখীদের একজন।
আড়চোখে
চেয়ে মদন বলে, বৌদির চাহিদাও নেই। দাদার এত
অনুপস্থিতি, কিন্তু কোনো খেদোক্তি নেই। একজন
দুর্দশাগ্রস্তের জীবনে থেকে কি জীবনের সুখ পাবেন?
রোহিনী
বলে, যার চাহিদা যত কম, তার সুখ তত
বেশি। আমি অল্পে তৃপ্ত, আধেকে তৃপ্ত, ক্ষণিকেও।
তা শুনে
মদন বলে, বয়স্ক মানুষ কি গোরু ধরে রাখতে পারে? বয়স্ক মানুষ কি খরস্রোতা নদীর বেগ সামলাতে পারে?
একথা
শুনে রোহিনী রেগে গেলো, কিন্তু রাগ প্রকাশ করলো না।
শুধু বললো, মরণপ্রায় জীবন থেকে আমি আবার জীবন পেয়েছি, স্বপ্ন দেখার সুযোগ পেয়েছি। জীবনে আমার আর কোনো পাওয়া নেই। এখন একটু মায়া
পেলেই কেঁদে উঠি, একটু ছোঁয়া পেলেই বিগলিত হয়ে
উঠি। শুধু অধিক ব্যক্তিগত চাহিদা পেশের কারণে আমি আমার পূর্ববর্তী ঘর হারিয়েছি। ঘর
হারিয়ে বুঝেছি চাহিদা পরে, ঘর আগে।
মদন
আবার বলে, বৌদি নিজেকে মূল্যহীন করে ফেলবেন না। জীবনকে সহজ করা
ভালো, সস্তা করা ঠিক না। আপনি হাসলে পুকুরেও জলোচ্ছ্বাস
হবে। আপনার বয়স আপনার হাতে, অসময়ের ঘরে পড়ে থাকবেন কেন? দাদার কবজায় বৈঠাও নেই, জাহাজ চালাবে কী করে?
অনিচ্ছা
সত্ত্বেও রোহিনী উত্তরে বললো, কুয়োর ব্যাঙ সাগরে গেলে দিশা
পায় না, মারা যায়। আমার জগৎ ছোটো, আমার স্বপ্ন ছোটো।
এরপর রোহিনী ঘরে গিয়ে ঘরের দরজা এটে দেয়। সে সময় চায়; দেবরের অঢেল সময়, স্বামীর সময় নেই। সে ভালোবাসা চায়; দেবরের হৃদয় ভালোবাসায় ঠাসা, স্বামীর হৃদয়ে নেই ভালোবাসা। স্বামী চায় টাকা আর টাকা, দেবর চায় দেহ। একটি একটি দুটি ঘর পেলো সে, সুখ পেলো না। পুকুরের জলের মতো তার জীবন, সবাই ব্যবহার করতে চায়, কিন্তু কেউ গ্রহণ করে ধন্য করে না।
সাধনের উদাসীনতা দেখে বন্ধুরা বুঝতে পারে সাংসারিক জীবনে সে সন্তুষ্ট না। গৌতম বলে, যাকে মেনে নিয়েছিস তার ভেতর ত্রুটি খোঁজা অন্যায়। জীবন থেকে অনেক বসন্ত চলে গিয়েছে, আর দূরে থেকে ভুল করিস না। তার সান্নিধ্যে ধন্য হ। তাকে ঘরে রেখে বাইরে কখনোই সুখ পাবি না।
রিংকু
বলে, বৌদিকে খুশি করতে নিজেকে ব্যস্ত রাখ্। তোর ব্যস্ততায়
তোর কার্যক্রমকে পূর্ণতা দেবে। দক্ষ নাবিকের পরিচয় দে স্রোতাবেগের নদীর বুকে।
বিভাস
বললো, পাকনা ফল খাওয়ায় বাওই পাখির কাজ। হয় বাওই হ, নতুবা বাওই পাখি ঘরে আসবে, বুঝবিও না।
দিনান্তে সাধন বাসায় ফিরলো। দূরে বসে থেকে রোহিনীকে দেখে সে। কাছে আসে না রোহিনী। রাগে ফোঁসে। পূর্বপুরুষটি অমানুষ ছিলো যেমন, তেমন শ্বাপদের মতো হিংস্রও হতো। সুখের ছোবল দিতো। তার দাঁত আর নখের আঘাত এখনো দেহ থেকে বিলীন হয়নি। বর্তমান পুরুষটি সমাজে সম্মাননীয়, কিন্তু ন্যূনতমও আবেগীয় নয়। রোহিনী বিড়াল পায়ে হেঁটে সাধনের কাছে এসে বললো, আপনার জীবন সূচিতে কি আমার জন্য একটুও সময় নেই? আমি কি এতই কদর্য যে দেখার মতো না! আমাকে যদি নাইবা দেখবেন তবে কেন আমায় বরণ করেছেন?
সাধন কখনোই ভালো করে লক্ষ্য করে দেখেনি রোহিনীকে। পুরাতন পত্রিকাতে কেউ যেমন নজর দেয়ই না, তেমনি রোহিনীকে ভালো করে সে দেখেইনি। রোহিনী আরও কাছে এসে বলে, আপনি জীবন জুড়ে সংগ্রাম করেছেন, প্রতি পদক্ষেপে জিতেছেন; আপনি ভয় পাবেন না, আমার নৈকট্য নিন; আপনি জিতবেন। আমি চির নত আপনার কাছে, আপনি চির বিজেতা আমার কাছে।
কথাগুলো শুনতেই সাধন ভীষণ ক্রোধাগ্নি চোখে রোহিনীর দিকে তাকালো। রোহিনী অধিকার আদায়ে সোচ্চার। সে সাধনের রক্তচক্ষুকে ভয় না পেয়ে বললো, আপনার হেরে যাওয়ার ভয় নেই। আমি বিন্দুমাত্রও অতৃপ্তি প্রকাশ করবো না। আমি জানি আপনি বেসামাল, আমি জানি আপনি উন্মাদ। আপনি হিম্মতদারও। পারবো, না পারবো না দ্বিধাদ্বন্ধে স্বকীয়তাকে আড়াল করবেন না।
এসব কথা শুনে সাধন আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। তার পুরুষত্ব নিয়ে সারা সমাজ কথা বলে, এখন নিজ স্ত্রীও কথা বলছে। রাগাগ্নিতে ফোঁসফোঁস করে উঠলো সে। দাহ্য বস্তু সাধনের ভেতরে দাহ্যতা আরও বাড়ানোর জন্য আরও একটু বললো, যে ঘরে স্ত্রী অবহেলার স্বীকার হয়, আর সুখ পায় না; সে ঘরে কিন্তু অতিথি পাখি আসার সুযোগ পায়।
একথা শুনতেই সাধন হিংস্র হয়ে দুই হাত দিয়ে রোহিনীর গলা চেপে ধরলো আর বললো, অনর্গল পুরুষত্ব নিয়ে কথা বলছো, পুরুষত্ব নিয়ে কথা বলা খোজা পুরুষও সহ্য করে না।
রোহিনীর
ঠোঁটে তখনও নির্মল হাসি। সেই হাসিতে নজর ফেলে সাধন থমকে গেলো। মনের ভেতর জমা
দ্বিধা, ঘৃণাকে সে বিদায় দিতে বাধ্য হলো। ভেতর থেকে অরুচিকর
দ্বিধা আর ঘৃণা কেটে যেতেই রুচিকর সৌন্দর্যবোধ জাগ্রত হলো। সে বুঝলো, দূরের জনকে কাছের করতে হলে দূরে থাকতে নেই। আরও বুঝলো, প্রজ্জ্বলিত হতে হলে দাহ্য বস্তুর কাছেই যেতে হয়। রক্তিম চোখেই সে রোহিনীকে
আরও ভালো করে অবলোকন করে বুঝলো, কিছু আঘাত প্রাপ্ত পুষ্প অনেক
অনাঘাত পুষ্প অপেক্ষা সুন্দর।
রোহিনীর গলা তখনো সাধনের দুই হাতে বন্দি। নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে সে বললো, যে পুরুষ পারে না অন্তর্শক্তি দিয়ে, সেই পুরুষই পেশিশক্তি দিয়ে দমনে নামে। যে পুরুষ কামোন্মত্ত হতে পারে না সেই পুরুষই পেশিশক্তি প্রয়োগ করে পীড়ন করে। কামাসক্ত পুরুষ কখনো নিরাসক্ত থাকে না।
কলমে - সৌমেন দেবনাথ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন